বীরভূমের পট ও পটুয়া নিয়ে দু’চার কথা প্রবন্ধ – গৌর গোপাল পাল
বীরভূমের পট ও পটুয়াদের কথা লিখতে গিয়ে আজ আমার একটা কথা বার বার মনে পড়ছে। আমি যখন ছোট ছিলাম, দেখেছি কাঁধে এক ফালি ছেঁড়া কাপড়ের টুকরোর দু’মাথায় গিঁট দিয়ে ঝোলা বানিয়ে, বগলে একটা গোটানো পট নিয়ে দু’ একজন পটুয়া গৃহস্থের বাড়ি বাড়ি গিয়ে গান গেয়ে তা দেখিয়ে বেড়াতো। কিশোর বয়সের কৌতুহলী মন খোঁজ নিয়ে জেনেছিলো তাদের বাড়ি দাঁড়কা গ্রাম। রামায়ণ- মহাভারতের চরিত্র চিত্রণ করে, নিজেদের বাঁধা গানে সুর দিয়ে ওই সব গোটানো পটগুলি দেখানোর সাথে-সাথে সুললিত ছন্দে নিজেদের বাঁধা গানগুলিও গেয়ে শোনাতো তারা। বিনিময়ে গৃহস্থের বাড়ি থেকে চাল-মুড়ি, আলু-পিঁয়াজ ইত্যাদি নিয়ে যেত। নানা নীতি শিক্ষার পাশাপাশি, মানুষের মনে যাতে পাপ বোধ জেগে না ওঠে, তার জন্য সেইসব চরিত্র চিত্রণের শেষে যমালয়ের নরক যন্ত্রণার চিত্র অঙ্কন করে, তাদের পাপের সেই ভয়াবহ পরিণতির কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে মানুষের মানবিক সত্ত্বাকে জাগিয়ে তুলতে তাদের কোন তুলনাই ছিল না।
‘পট’ শব্দটি এসেছে সংস্কৃত ‘পট্ট’ শব্দ থেকে। প্রাচীনকাল থেকেই কাগজের উপর ছবি আঁকার রীতির প্রচলন ছিল। তার স্থায়িত্ব আনার জন্য কাগজে আঁকা সেই চিত্রকে কাপড়ের সঙ্গে সেঁটে দেওয়া হতো। এখনকার পটুয়ারা কাগজের পিছনে কাপড় লাগিয়ে তার উপর পটচিত্র আঁকেন। সাধারণ ড্রয়িং সীটে কাগজের উপর আঁকা ছবিকেই পট বলে। কেউ কেউ মনে করেন পাটা (Cover) আঁকার জন্যই এদের পটুয়া বলা হয়। আর চিত্র আঁকার জন্য এরা চিত্রকর। আসলে এই দুটি নাম একে অন্যের পরিপূরক। এদের আদি নিবাস উড়িষ্যা বলে মনে করেন গীতিকণ্ঠ মজুমদার। তিনি বলেন দ্রাবিড় ‘পড়ম’ শব্দ থেকে ‘পট’ শব্দটি এসেছে।
বর্তমানে এই রাজ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা পটুয়াদের সংখ্যা প্রায় হাজার দশেক। এ জেলায় এদের সংখ্যা আড়াই হাজারের মত। ১৯০১ সালের জনগণনায় হিন্দু সমাজের জাতি ও বর্ণ তালিকায় এদের নথিভূক্ত করা হয়। ১৯১০ সালে প্রকাশিত L.S.S.O Malley সাহেবের বিবরণে এক ‘নতুন শ্রেণী’ রূপে এ জেলার যাদু পটুয়াদের উল্লেখ পাই। এদের ‘নবগায়ক’ গোষ্ঠীর চিত্রকর সম্প্রদায়রূপে চিহ্নিত করা হয় ১৯৫১ সালে। বিক্ষিপ্তভাবে এই রাজ্যের বিভিন্নস্থানে এদের বসতি লোকশিল্পের বিস্তৃতিই প্রমাণ করে। মোটামুটি ভাবে এই জেলার যে সব স্থানে পটুয়াদের বসতি দেখতে পাওয়া যায় সেগুলি হল, লাভপুর থানার লাভপুর ও দাঁড়কাগ্রামে। কথাসাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাহিনীতেও লাভপুরের পোটো পাড়ার উল্লেখ পাই। এছাড়া ময়ূরেশ্বর থানার- ষাটপলশা, শিবগ্রাম, সুপুর,মালঞ্চ,তালোয়া, সমাচার, নদীয়ান,বল্লভপুরেও এদের বসতি রয়েছে। সাঁইথিয়া থানার-জিউই, আমোদপুর, মেজেরা,বাগডোলা,মইরাপুর,দিঘা,ভ্রমোরকোল, কুসুমযাত্রাতেও যেমন দেখতে পাই তেমনি মুরারই থানার- রুদ্রনগর, কামালপুর, জানকি- নগরেও এদের বসতি গড়ে উঠেছে। রামপুরহাট থানার- বসোয়া, আয়াম,চাঁদপাড়া, সাহাপুর, বোনতা; দুবরাজপুর থানার- পছিয়াড়া বা পছেড়া ও কুলতোড়েও এদের যেমন দেখা মেলে তেমনি সিউড়ি থানার-পানুরিয়া ইটাগড়িয়া, পুরন্দরপুর ও জুনিদপুরেও এদের বসতি দেখা যায়। তবে দুবরাজ পুর থানার পছিয়াড়া এবং ময়ূরেশ্বর থানার দাদপুর ও কুণ্ডলায় এখন এরা আর থাকে না। জয়দেব-কেন্দুলির কাছে কোটা গ্রামের পটুয়ারাও এখন দিঘা ও পুরন্দরপুরে উঠে এসেছে।
আগে পটুয়াদের পদবি ছিল চিত্রকর।বেদে,মাল,পটুয়া পদবিওয়ালা চিত্রকরদের উপজাতি সম্প্রদায়ভুক্ত আদিম গোষ্ঠী বলে মনে করেন অনেকেই । বিনয় কুমার ঘোষের লেখায় আদিতে চিত্রকররা কোন নিষাদ জাতির শাখা ছিলেন। সুহৃদ কুমার ভৌমিক, সঙ্গীত সহযোগে পট প্রদর্শককে আর্য-পূর্ব জাতি বলে মনে করেন। পণ্ডিত-সাহেবরা পটকে ‘ম্যাজিক ইমেজ’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। আসলে পটুয়ারা বেদিয়া উপজাতি সম্প্রদায়ভুক্ত। সরকারি নথিতে বেদিয়া বলেই এদের উল্লেখ পাই। তবে বেদেদের থেকে পটের ঐতিহ্য কোথায় যেন আলাদা। এ জেলায় মনসা মাহাত্ম্য প্রাধান্য পাওয়ায় অনুমান অসংগত হবে না যে পটুয়া এবং সাপুড়েদের মধ্যে অতীতে কোন যোগাযোগ ছিল। আবার এও হতে পারে উভয়ে একই পরিবারের দু’টি শাখা। আশ্চর্য্যের সঙ্গে এও লক্ষ্য করা যায়- বেদে,বাজিকর প্রভৃতি অতীতের যাযাবর গোষ্ঠীর শাখায় তাদের জীবন যাত্রা তথা পরিব্রাজন প্রক্রিয়াতেও এক অদ্ভুত মিল।
স্বর্গের অপ্সরা ঘৃতাচীর ( অনার্য কন্যা ) গর্ভে দেবশিল্পী বিশ্বকর্মার ঔরসে ন’টি পুত্রের জন্ম হওয়ার গল্প পৌরাণিক কাহিনীতে আমরা দেখতে পাই। এরা হলেন- চিত্রকর, ভাস্কর, মালাকার, কাংসকার, তন্তুবায়, সুত্রধর, শঙ্খকার, কুম্ভকার ও স্বর্ণকার। এই নয় পুত্রের মধ্যে পতিত হন চিত্রকরেরা।
নিজেদের বিশ্বকর্মার বংশধর বলে চিহ্নিত করলেও এ জেলার চিত্রকর সম্প্রদায় কর্মকার, স্বর্ণকার,সুত্রধরদের মতো বিশ্বকর্মার পূজো করে না। সম্ভবতঃ এটা বৌদ্ধ প্রভাবেরই ফলশ্রুতি। সাধারণতঃ এই জেলার পটুয়ারা পটুয়া নামে পরিচিত হলেও- পাকুড়হাঁসের পটুয়ারা পটুয়া, মাল, চিত্রকর এই তিনটি পদবি ব্যবহার করে না। আবার হাটসেরান্দীর সূত্রধর উপাধিধারীরা এই কাজটি করে থাকেন।
ত্রয়োদশ শতকে লেখা ‘ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ’-এ বলা হয়েছে ব্রাহ্মণ নির্দ্দিষ্ট চিত্র পদ্ধতির ব্যতিক্রম ঘটিয়েছিলেন চিত্রকরেরা। পৌরাণিক রীতির পরিবর্তে চিত্রকলায় লৌকিক রীতির অনুসরণ, আসলে চিত্রকর সম্প্রদায়রাই প্রবল প্রতাপান্বিত পৌরাণিক দেবদেবীদের, ঘরোয়া অন্তরঙ্গতার স্তরে নামিয়ে আনেন। কেউ কেউ মনে করেন অর্থ,যশ,প্রতিপত্তির লোভে চিত্রকরেরা ভিন্নধর্মী ছবি আঁকার অপরাধে সমাজচ্যুত হয়ে যান।
জনগোষ্ঠীর বিচারে এরা নগণ্য হলেও- এদের আলাদা ভাষা রয়েছে। গীতিকণ্ঠ মজুমদার তাঁর গ্রন্থে এমনই দাবী করেন। তিনি বলেন উড়িয়া ভাষার সঙ্গেও নাকি হুবহু মিল দেখা যায় এদের মৌখিক ভাষায়। তবে এখন বাংলা ভাষাতেই এদের সমস্ত রকম যোগাযোগ হয়ে থাকে।
এদের ধর্ম মূলত ইসলাম। সেন শাসনের অবসানের পর এরা ইসলাম ধর্মের সংস্পর্শে আসেন এবং আত্মরক্ষার তাগিদেই হোক বা সামাজিক কিছু সুযোগ সুবিধা ভোগ করার উদ্দেশ্য নিয়েই এরা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। ইসলাম সম্প্রদায়ের লোকেদের মতই রমজান মাসে রোজা রাখেন,নমাজ পড়েন। বিয়ে-শাদীর সময়ে কাজী আসে। মরলে গোরস্থানে প্রবেশাধিকারও পায়। তবে মুসলিমরা পটুয়া সমাজে বিয়ে করলেও পটুয়াসমাজে তাদের মেয়েদের বিয়ে দেন না। সচারচর এরা দাড়ি রাখেন না। মুসলমান হয়েও, পূর্ব আচারিত হিন্দু অভ্যাসগুলি আজও ত্যাগ করতে পারেনি এরা। ফলে মুসলিম সমাজেও সম্পূর্ণতা পাইনি তারা। তাই,একুল ওকুল দু’কুল হারিয়ে আজ সমাজের উপেক্ষিত প্রান্তে ভাসমান অবস্থায় দাঁড়িয়ে রয়েছেন। এটাই পটুয়া সমাজের এক মর্মান্তিক ট্রাজেডি। একটি বিচিত্র আত্ম সাম্প্রদায়িকতার নজির হিসাবে সম্পৃক্ত দু’টি পরস্পর বিপরীত ধর্ম।
১৯৫৪ সালে প্রমথনাথ মাইতি,শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী, ইন্দুভূষণ দাশ প্রমুখের উদ্যোগে এরা হিন্দু ধর্মে আশ্রয় নিয়ে ‘পাল’ পদবি গ্রহণ করলেও এ জেলায় তাদের সে প্রচেষ্টা সার্থক হয়নি। ‘বৃহৎবঙ্গ’ পুস্তকে দীনেশচন্দ্র সেন মহাশয়ের লেখায় দেখতে পাই- “ইহারা নিশ্চয় বৌদ্ধ ছিল। এজন্য অনেকস্থলেই ইহারা মুসলমান হইয়া অত্যাচার হইতে ত্রাণ পাইয়াছে।” এই ভেবে আশ্চর্য হতে হয়, ইসলামী সমাজে এদের প্রত্যক্ষ প্রভাব থাকা সত্ত্বেও পরম্পরাগত চিত্রকলায় ইসলাম ধর্ম বা শিল্পের কোন প্রভাব দেখা যায় না। মুসলিম গৃহস্থের বাড়িতেও এরা পট দেখায় না। এদের পুরুষরা মানেন মুসলিম রীতি-নীতি আর মেয়েরা হিন্দুর। পটুয়া মেয়েরা শাঁখা-সিন্দুঁর পড়েন। দেবদেবীর ছবি আঁকেন। ছাঁচের সাহায্যে বাড়িতে বসে ছোট ছোট মূর্তি ও খেলনা তৈরী করেন। পূজো করেন আবার নামাজও পড়েন। পুরুষরা মানেন মুসলমান রীতি-নীতি। নিজেদের কাজের সুবিধার জন্য দু’টি করে নাম ব্যবহার করেন অনেকে। সংসার বা জীবনযাত্রার রীতি-নীতি পালনের জন্য মুসলিম নাম আর ব্যবসায়িক প্রয়োজনে হিন্দু নাম। মুসলিম সমাজে সুকুর চিত্রকর বলে যিনি পরিচিত তিনিই হিন্দু সমাজে সুকুমার। আবার মুসলমান সমাজে যিনি কালাম, তিনিই হিন্দু সমাজে কমল হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। অথবা যিনি সুকুরুদ্দিন তিনিই সুদর্শন হয়ে গেছেন। গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলে, এই দ্বৈত সত্তা পটুয়া সমাজে অন্তর্বেদনারই লোকায়ত প্রকাশ! ইসলাম ধর্মে দেবদেবীর মূর্তি আঁকা নিষেধ। অথচ হিন্দুদের দেবদেবীর পট এঁকে,গান গেয়ে এরা হিন্দুদের উপরেই বেশী নির্ভরশীল।
সুপ্রাচীন কাল থেকেই পটুয়ারা সাধারণ মানুষের পুরাণ পিপাসা নিবারণের সাথে সাথে পট ও পটের গান গেয়ে জনগণের চিত্ত বিনোদনের পাশাপাশি মানুষের মনে ধর্মের ভাব উদ্দীপ্ত করে রাখতো। নিরক্ষর লোকসমাজকে প্রথাগত নিয়ম ব্যতিরেকে স্বতঃস্ফুর্ত ধারায় ন্যায় বোধের উপর, ধর্মের ভিত্তিকে প্রতিষ্ঠা করে সমাজকে অধর্মের হাত থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে গ্রাম্য সমাজে এদের ভূমিকা ছিল অপরিসীম।
খ্রীষ্টপূর্ব চতুর্থ শতকে পানিনি’র ‘অষ্টাধ্যয়ী’তে,পাতঞ্জলির ‘মহাভাষ্যে’ সপ্তম শতাব্দীর বাণভট্টের ‘হর্ষচরিত’ কিংবা বিশাখা দত্তের ‘মুদ্রারাক্ষস’ এ পটুয়াদের পট ও পটসঙ্গীতের কথা দেখতে পাই। এ ছাড়াও- জাতক,হরিবংশ,চর্যাপদ, উত্তর রামচরিত, সংযুক্ত নিকায়,মালবিকাগ্নি মিত্র, বিদগ্ধ মাধব, অভিজ্ঞান শকুন্তলম ইত্যাদিতে পটও পটুয়াদের অস্তিত্বের প্রমাণ রয়েছে। পটের বিষয় বৈচিত্রও ছিল উল্লেখযোগ্য। ধর্মীয় বা কিহিনি নির্ভর পটই বেশী প্রচলিত ছিল প্রাচীনকালে। রামলীলা,চণ্ডী, মনসা,কৃষ্ণলীলা প্রভৃতি দেবদেবীর মাহাত্ম্য ছিল পটের বিষয়। প্রত্যেক পটের শেষে ভীষণাকৃতি যমরাজ,ভূতপ্রেতসহ যমালয়ের জীবন্ত ছবি জুড়ে দেওয়া হত। সেই জন্য হয়তো এগুলিকে যমপট বলে অভিহিত করা হত। পটুয়ারা জনগণকে বোঝাতে চাইতো যমরাজ কখনো পাপী ও অসাধু ব্যক্তিদের ক্ষমা করে না। আর পটুয়াদের এই নীতিশিক্ষা থেকে তৎকালীন গ্রাম্য সমাজ পরকালের কথা ভেবে নিজেদের বিরত রাখতো পাপ ও অসৎ কাজ থেকে।
একাধারে চিত্রশিল্পী,সঙ্গীতজ্ঞ ও কবি পটুয়ারা সহজ সরল মন মাতানো সুরে রামায়ণ, মহাভারত, ধর্মমঙ্গল,চণ্ডীমঙ্গল,মনসামঙ্গল প্রভৃতি মহাকাব্যের কাহিনি বিবৃত উপসথাপন করতো। সাঁওতালদের লোক কাহিনিকে আশ্রয় করে মানুষের জীবন বৃত্তান্তের যে কাহিনি বর্ণিত হতো সেই পটগুলি আদিপট বলে পরিচিত ছিল।
পটুয়ারা গাছের ছাল,ফল,পাতা,শেকড় প্রভৃতি থেকে রঙের উপাদান করে, নিজেরাই রঙ তৈরী করে সেই রঙেই ছবি আঁকতো। খোলার কালি, গাছের ছাল গুঁড়ো, হীরাকস, হরিতকি,এঁটেল মাটির রস ইত্যাদি মিশিয়ে তৈরী করতো সেই সব রঙ। সমাজকে সৎ ও সুপথে চালিত করতে শিক্ষামূলক পট কাহিনি রচনাই বেশী প্রাধান্য পেত।
এখন এই জেলায় লোকশিল্পী, লোকগায়ক পটুয়াদের এক চরম দুর্বিসহ দিন যাপন। সরধার জার্মানি পটুয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতার পাশাপাশি তাঁতে শান, বাঁশের বুনুনীর কাজ করেছেন পটুয়া জীবন ছেড়ে দিয়ে। তার ছেলে বিশ্বনাথ পটুয়া ডি.আই অফিসে কাজ করার ফাঁকে ফাঁকে সময় পেলেই মূর্তি গড়ায় মন দিতেন। পট আঁকা বা দেখানোয় তাদের কোন আগ্রহ ছিল না। দেশ বিদেশে ঘুরে আসা ষাটপলসা’র বাঁকু পটুয়া মাঝে মাঝে আমার বাড়িতে এসে পট নিয়ে বাবুসাহেবদের কালোবাজারীর দুঃখের কথা শুনিয়ে যেতেন।বাঁকু পটুয়া গত হয়েছেন। তার ছেলে অরুণ পটুয়া পট আঁকার পাশাপাশি বাউল গানের দল গড়েছেন। এই জেলার জার্মানী পটুয়াকে নিয়ে দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়, ৪ জুন,১৯৭৭-র ‘দেশ’ পত্রিকায় যে নিবন্ধ লিখেছিলেন “পটের ভাষা” শিরোনামে তা অনেকেরই মনে থাকতে পারে। বীরভূমের অধিকাংশ স্থানে এদের দেখা মিললেও এদের একটা বড় অংশই এখন আর পটের কাজ করে না। এখন বড় অবহেলায় মূল জনস্রোতের অনেকটা বাইরে এই উপজাতীয় মানুষজনের অবস্থান। অথচ লোক শিক্ষার অঙ্গনে এই পটের কাজ একদিন সুন্দর ভাবে ব্যবহৃত হতো। পৌরাণিক পট,যমপট, সামাজিক পট এবং শিস পট প্রচলিত থাকলেও দু’একখানা যারা কেনেন, তারা শিস বা খণ্ড পটই কেনেন। কেন না পটের দাম বেশী আর তার বিক্রিও কম হয়। অথচ এককালে পটুয়াদের শিল্পসৃষ্টি ধনীর বাড়ির সংগ্রহ শালায় ঠাঁই পেত। সুরম্য অট্টালিকায় গৃহসজ্জার অঙ্গ হিসাবে অথবা শিল্প রসিকদের দেওয়ালে যে পট শোভা পেত, এখন অত্যাধুনিক ছাপাখানার দৌলতে কম অর্থের বিনিময়ে ওই সব পট চিত্রের চাহিদা অনেকটা কেন একেবারেই কমিয়ে দিয়েছে বললে ভুল বলা হয় না। এ জেলায় কোন না কোন সময় যারা পট দেখিয়ে কিছুটা পরিচিতি লাভ করেছিলেন তাদের কয়েক জনের নাম উল্লেখ না করলে এ লেখার সার্থকতা বজায় থাকে না। যে কয়জন জীবিত বা মৃত পটশিল্পীর নাম এখানে উল্লেখ করছি তারা হলেন- ইটাগড়িয়ার-খোকন,কমল,কবীর,লালটু,সুদর্শন,
ফকির ও জলিল। ভুরকুণ্ডার কালু। চাঁদপাড়ার তরুণ পটুয়া। পানুরিয়ার- ছবিলাল,জলিল ও ভক্তি। মদিয়ানের – সদানন্দ, জানকি। বোনতা’র রাখু। শিলগাঁয়ের- কুমারেশ,অবনীশ, ফটিক, জানকি। নগরের- বসন্ত। সাহাপুরের-অদৃষ্ট শ্রীপতি। সরধার- বাঁকু,খোকন, তরুণ, প্রমথ । আয়াশের- ভুতু, মটরা,সতীশ। কানাচির কানা পাঁচকড়ি’র কথা স্মরণ করতেই হয়। ষাট পলশার বাঁকু পটুয়া ১৯৫৮ সালে লণ্ডন এবং ওয়াশিংটনেও যান।
ক্যামেরা প্রচলনের আগে চিত্রকরের তুলিতে ধরা থাকতো ছবি।পটুয়াদের আঁকা পট নিয়ে ঘটকরা এককালে পাত্র পাত্রীর খোঁজে বেরুতেন। কথায় আছে না “পটের বিবি”। এমন মনোজ্ঞ বিবরণ আমরা বঙ্কিমচন্দ্রের রাজসিংহতেও দেখতে পাই। তৎকালীন গ্রাম বাংলায় আমরা প্রতিটি হিন্দু ঘরেই “লক্ষ্মীর ঝাঁপি” দেখতে পেতাম যা লাল শালুতে মোড়া কড়ির কত্রাদ্মজ করা থাকতো। এক শ্রেণীর পটুয়ারা এই শিল্পের সঙ্গে তখন যুক্ত ছিল। আমরা অনেকেই জানি- হাট-সেরান্দীর “বিত্তির মা” বা পটে আঁকা দুর্গা প্রতিমা পূজোর কথা। যা এখনও চলে আসছে। ১২৫০ সালে প্রতিষ্ঠিত হেতমপুরের মুখী দুর্গাপূজো হতো পটে। পটের মধ্যেই অর্ন্তলীন থাকে দেবীরূপ। আর পট পূজো তারই জন্য। এখন বেশীরভাগ পটুয়ারাই রাজমিস্ত্রীর কিজে ব্যস্ত সঙ্গে রঙের কাজও বাদ যায় না।কখনো সখনো পট দেখানর কাজও করেন। একদিন যারা পট দেখিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেছেন আজ জীবিকার জন্য পট থেকে তারা অনেকটাই সরে এসেছেন। তাই আজ অনেকেই খুঁজছেন জীবিকার অন্য উপায়। আজ বীরভূমের এই লোকশিল্প দু’চার জনকে লক্ষ্মী এনে দিলেও অধিকাংশ পটুয়াই আজ লক্ষ্মী কৃপালাভে বঞ্চিত। লক্ষ্মীছাড়া। বিনোদনের হরেক কিস্ সা-টিভি’র দৌলতেআজ তারা দিশেহারা! প্রখ্যাত শিল্পী রামকিঙ্কর বেইজ, যামিনী রায় একদিন এই পটের দ্বারাই প্রভাবিত হয়েছিলেন। কোন কোন শিল্প সমালোচককেও সেদিন বলতে শোনা গিয়েছিল পোটো রবীন্দ্রনাথ। সরকার যদি এই পটুয়াদের জন্য দু’মুঠো ভাতের ব্যবস্থা করে দিতে পারেন তাহলে পটুয়া পাড়াতেও আবার আনন্দের মাতন লাগবে।
বীরভূমের পট ও পটুয়া নিয়ে দু’চার কথা প্রবন্ধ – সমাপ্তি
আপনাদের লেখা আমাদের ওয়েব সাইটে জমা দিতে গেলে, অনুগ্রহ করে আমাদের লেখা-জমা-দিন মেনু-তে ক্লিক করুন ও নিজেকে Author হিসেবে Register করুন এবং আমাদের পরবর্তী আপডেট পেতে আমাদের ফেসবুক পেজ অনুসরণ করুন।
অন্যান্য
মহামায়া মা দুর্গার আগমনী সুরে
মেয়েরা আজ নির্দয়তা/নির্যাতিতা
ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায় – জাদু-বাস্তবতার এক আদি জনক?