কলম পাতুরি

ভাবনা আপনার প্রকাশ করবো আমরা

বিজয়িনী

বিজয়িনী প্রেমের গল্প –  অঞ্জন ব্যানার্জ্জি

মাষ্টারমশাই, ভালো আছেন। – মহিলার মুখে স্মিত হাসি বাসব বিস্মিত।তার সামনে দাঁড়িয়ে অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি মোনালিসা চৌধুরী।মোনালিসার সাথে তার পূর্ব পরিচয় হয়নি। এই অনুষ্ঠানে প্রথম দেখা। মোনালিসা পড়েছে বাসবের অবয়বে বিস্ময়ের ভাষা। -আমায় চিনতে পারলেন না! না চেনাই স্বাভাবিক। কত বছর পর দেখা। আপনাকে চেনা আমারও অসম্ভব ছিল। ঠোঁটের উপরে আপনার সিগনেচার কালো মোটা গোঁফ উধাও, ঘন চুলের জায়গায় খাঁ খাঁ করছে খালি মাঠ। – মোনালিসার মুখে দুষ্টুমি হাসি -চিনলেন কি করে? -প্রকাশক আপনার লেখা বইটা আগাম দিয়েছে। প্রথম পাতায় মার ছবি ও আপনার উৎসর্গ। দুয়ে দুয়ে চার। মনে পড়ে কি নামে ডাকতেন? বই প্রকাশের অনুষ্ঠান। প্রখ্যাত সাহিত্যিক মোনালিসা চৌধুরী ও আরো কয়েকজন গুনীজনদের উপস্থিতিতে আনুষ্ঠানিক মোড়ক উন্মোচন হবে খ্যাতনামা চিকিৎসক ডঃ বাসব মুখার্জীর প্রথম উপন্যাস। তিনি প্রকাশকের ভাল বন্ধু ও গৃহ চিকিৎসক। প্রকাশক চায় বন্ধুর প্রথম উপন্যাসের বহুল প্রচার। প্রচারের জন্য চেষ্টার ত্রুটি রাখেনি। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়, সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন দিয়েছেন। মোড়ক উন্মোচনের জন্য মোনালিসা চৌধুরীর মতন খ্যাতনামা সাহিত্যিক ও বাংলার গুনীজনদের আমন্ত্রিত করেছেন। -তুমি টিকলি! – বিস্মিত বাসবের অস্ফূট কণ্ঠস্বরে মহিলাকে চিনবার ইঙ্গিত। কুড়ি বছর আগে টিকলিকে শেষ দেখেছিল শ্মশানে, তার মার সৎকারে। বাসব ছিল টিকলির মা নিবেদিতার গৃহশিক্ষক। সেই উদ্ভিন্নযৌবনা মেয়ে টিকলি এখন পূর্ণ যুবতী, প্রতিষ্ঠিত লেখিকা। মা শিখিয়েছিল মেয়েকে ডাকতে মাষ্টারমশাই। নিবেদিতা বাসবকে ভালবাসত। স্কুল, কলেজে স্থানাধিকারী মেধাবী বাসব নিবেদিতার প্রেমের স্বীকৃত দেয়নি। নিবেদিতা বাসবের মতন মেধাবী না হলেও মেধা সাধারণ গড়ের উপরে। কিন্তু বাসবের প্রত্যাশা ছিল পার্শ্বচারিণীর হবে উচ্চ মেধাবী,বুদ্ধির ধার হবে ধারালো ছুড়ির মতো যার ঘষায় তার নিজের বুদ্ধি হবে সুতীক্ষ্ণ। বাবা মার পছন্দ করা পাত্রের সাথে নিবেদিতার বিয়ে হয়। যে নারীর পছন্দ সমুদ্র তার সহ্য হয়নি পুকুরের শান্ত জল। গর্ভাবস্থায় বিবাহ বিচ্ছেদ। গর্ভের ভ্রুণকে হত্যা করেনি। অদম্য ইচ্ছা ছিল নিজের শক্তিতে ভ্রণ থেকে এভারেস্ট গড়বে যে মহিমায় ছাড়িয়ে যাবে বাসবের মতন কাঞ্চনজঙ্ঘাকে। কিন্তু ভাগ্যের পরিহাস সে এভারেস্টের পূর্ণ রূপ দেখে যেতে পারেনি। গুণীজনদের সাথে মোনালিসা বইটির মোড়ক উন্মোচন করেছে। শ্রোতারা শুনছে বইটি নিয়ে গুণীজনদের ব্যক্তিগত অনুভূতি ও উপলব্ধির কথা। সর্বশেষ বক্তব্য রাখবে মোনালিসা। মোনালিসার কথা শোনার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় উপস্থিত বইপ্রেমীরা। অসংখ্য বইপ্রেমী ও গুণীজনদের উপস্থিতিতে তার প্রথম উপন্যাস প্রকাশিত। তার বই নিয়ে আলোচনা করবে মোনালিসা চৌধুরীর মতো প্রতিষ্ঠিত জনপ্রিয় লেখিকা। একজন নতুন লেখকের পক্ষে গর্বের বিষয়। কিন্তু বাসবের মনে বইছে দুশ্চিন্তার ঝড়।বাসব তার মাকে কষ্ট দেওয়ায় বাসবের প্রতি টিকলির অভিমান ছিল।বলত, আপনাকেও একদিন কষ্ট দেব। ভুলতে পারবেননা সেই কষ্ট। তার উপন্যাস নিয়ে মোনালিসার আলোচনার প্রতিটি কথা মূল্যবান। আজ কি কথার চাতুরীতে প্রশংসার ছলে তার লেখার দুর্বলতা সবার সামনে তুলে ধরবে? তার উপন্যাসিক হওয়ার সাধ অঙ্কুরে শেষ করবে? মোনালিসা তার বই নিয়ে আলোচনা করবে। অভিমানী কিশোরী কি মার অপমানের প্রতিশোধ নেবে? মোনালিসা উপন্যাসটির অনুচ্ছেদের পর অনুচ্ছেদ উদ্ধৃত করে বিস্তৃত আলোচনা করল। সে আলোচনায় ছিল লেখকের বলিষ্ঠ লেখনীর প্রশংসা সাথে কাহিনীর বিন্যাসে আরো মনোযোগ দেবার উপদেশ। বাসবের মনে স্বস্তি। উপস্থিত দর্শকরা তার বিদগ্ধ আলোচনায় মুগ্ধ। অনুষ্ঠান শেষে একান্তে গল্প করার জন্য মোনালিসা ডেকে নিয়েছে বাসবকে। দুজনে মুখোমুখি বসে। মোনালিসা আলাপচারিতা শুরু করল। -মা বেঁচে থাকলে খুশি হতো। -হ্যাঁ। তোমার মা আমার প্রিয় বন্ধু ছিল। সব ব্যাপারে উৎসাহ দিত। তাই আমার প্রথম উপন্যাস ওকে উৎসর্গ করেছি। মোনালিসার মুখে রহস্যময় হাসি। – আপনার মেধা মার তুলনায় বেশী বলে আপনি মাকে অবজ্ঞা করতেন। মার শেষদিন পর্যন্ত দুঃখ ছিল। আজ মার মেধাকে আপনি স্বীকৃতি দিয়েছেন। -বইটা তুমি পড়েছ? এ গল্পের নায়িকা তোমার মা। প্রেক্ষাপট আমাদের যৌবন। যাকে ঘিরে এই উপন্যাস তার প্রতি কৃতজ্ঞতা না জানানো অন্যায়। -কতদিন লেগেছে আপনার এই উপন্যাসটি লিখতে? -ব্যস্ততার ফাঁকে বহুদিন ধরে একটু একটু করে লিখেছি। -মিথ্যা বলছেন। বাসব হতভম্ব। বাসব বাক্যহীন। প্রকাশক বন্ধুর অনুরোধে বাসবের গল্প লেখা শুরু। নিজের চিকিৎসা জগতের অভিজ্ঞতা নিয়ে লিখেছে ছোট বড় গল্প। এ বছরে বইমেলার জন্য প্রকাশক উপন্যাস লেখার অনুরোধ করে। লেখা শুরু করেছিল। দক্ষতার অভাবে সময়ে শেষ করতে পারেনি। লেখা জমা দেবার জন্য প্রকাশকের চাপ ছিল। সম্মানহানির ভয়ে সত্যি কথা প্রকাশককে বলতে পারেনি। যশের হাতছানিতে নিজেও বইমেলায় বই প্রকাশের সুযোগ হাতছাড়া করতে চায়নি। নিবেদিতার আত্মজৈবনিক উপন্যাস নিজের লেখা বলে প্রকাশকের হাতে তুলে দিয়েছে। মৃত্যুর আগে নিবেদিতা্ আত্মজৈবনিক উপন্যাস লেখা শুরু করেছিল। সে পড়তে দিয়েছিল বাসবকে।বাসবের হাতে তুলে দিয়ে বলেছিল, আপনিই এই উপন্যাসের প্রথম পাঠক। উপন্যাসটি পড়তে গিয়ে বুঝেছিল গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র নিবেদিতা আর নায়ক বাসব নিজে। দুজনের সম্পর্কের টানাপোড়েনের কাহিনী। লেখার বুননে, কাহিনীর বিন্যাসে,‌ রচনাশৈলীতে বিস্মিত বাসব নিজের মন্তব্য নিবেদিতাকে জানানোর আগেই কর্কট রোগে নিবেদিতা চলে যায। টিকলি হোস্টেলে থেকে পড়াশোনা করেছে। ছুটিতে বাড়িতে আসত। মার শেষ জীবনের অনেক শখের কথাই তার অজানা থাকার কথা। আজ পরিষ্কার কোন কিছুই মোনালিসার কাছে অজ্ঞাত নয়। -ইচ্ছা হয়েছিল আপনার কুম্ভিলক বৃত্তি সবার কাছে জানিয়ে দি।সে সুযোগ আমার কাছে ছিল। আপনার সম্মানে কালো দাগ পড়ত। মাকে অবজ্ঞা করার প্রতিশোধ নাওয়া হতো। কিন্তু মায়ের প্রেমের পূজ্য দেবতাকে অসম্মান করতে পারলামনা। মা দুঃখ পেত। সবার সামনে দাঁড়িয়ে বলতে পারলামনা এ আমার লেখা প্রথম উপন্যাস। বাসব অবাক হয়ে তাকালো টিকলির দিকে। শেষের কথাটির রহস্য উদ্ধারে ব্যর্থ। টিকলি রহস্য ফাঁস করল। -উপন্যাসটি মার নয় আমার লেখা। -অসম্ভব। আমি তোমার মায়ের হাতের লেখা চিনি। পুরো উপন্যাসটা ওর হাতে লেখা। – বাসবের কথায় ঝরে পড়ল তার অবিশ্বাস। মোনালিসা ম্লান হাসি হেসে বলল, মার জীবনের প্রতিটি কথা আমি জানতাম। মার লেখার প্রতিভা ছিলনা।মার আপনাকে না বলা অনেক কথা ছিল। উপন্যাসের মাধ্যমে আপনাকে বলতে চেয়েছিল।কাহিনীর বুনন, শৈলী সব আমার। মার জীবন কাহিনী। আমি বলতাম মা লিখত। লিখতে লিখতে ভুলে যেত নিজের অসুখের কথা। আপনার সাথে সম্পর্কটা তার কাছে ছিল পদ্ম পাতায় জলের মতন, বড় যত্নে শেষ দিন পর্যন্ত আগলে রেখেছে। আমার অল্প বয়সের কাঁচা লেখা। বাসবের মনে হলো উপর থেকে নিবেদিতা হাসছে। সে পেড়েছে প্রতিশোধ নিতে। এক ধাক্কায় চুরমার করেছে তার মেধার অহংকার। যশের লোভে সাহিত্য জগতে প্রতিষ্ঠার আকাঙ্খায় বাসব চুরি করেছে নিবেদিতার আত্মজার কাঁচা লেখা। তাকে মাথা নোয়াতে হয়েছে মোনালিসার প্রতিভার কাছে। নিবেদিতা এই জয়ের অপেক্ষায় ছিল।

বিজয়িনী প্রেমের গল্প – সমাপ্ত

আপনাদের লেখা আমাদের ওয়েব সাইটে জমা দিতে গেলে, অনুগ্রহ করে আমাদের লেখা-জমা-দিন মেনু-তে ক্লিক করুন ও নিজেকে Author হিসেবে Register করুন এবং আমাদের পরবর্তী আপডেট পেতে আমাদের ফেসবুক পেজ অনুসরণ করুন।

error: Content is protected !!