সব খেলার সেরা ভৌতিক গল্প – মানসী গাঙ্গুলী
সুমন খুব ভালো স্টুডেন্ট, যাকে বলে ব্রিলিয়ান্ট। স্কুলে-কলেজে সর্বত্র তার নাম। ডাক্তারির ছাত্র, আবার খেলাধুলায়ও চ্যাম্পিয়ন। ছোট থেকেই খেলার মাঠের প্রতি তার অদম্য আকর্ষণ। ক্রিকেট, ফুটবল, ব্যাডমিন্টন, টেবিল টেনিস, সবেতেই সে চৌকস। অফুরন্ত ওর প্রাণশক্তি। আর এসব করত ও পড়াশোনা সামলেই। কাজেই এ নিয়ে বাড়ি থেকে কোনো বাধা ওকে পেতে হয়নি কোনোদিন। যখন যেটা করেছে সেটাকেই পাখির চোখ করে রেখেছে ও। পড়ার সময় পড়া, খেলার সময় খেলা। এই ছিল ওর বীজমন্ত্র। তাই স্কুলে, পাড়ায়, সবার প্রিয় ছিল ও। খেলতে যেমন ভালোবাসে, দেশ-বিদেশের সমস্ত খেলার খবর ও পরিসংখ্যানও ওর ঠোঁটস্থ সেই ছোট থেকেই। ওর প্রিয় খেলা ফুটবল, আর ওর ঘর জুড়ে পেলে, মারাদনা, মেসি এইসব ফুটবলারদের পোস্টার। ছোট থেকেই ক্লাবের প্রশিক্ষকের কাছে খেলা শিখত ও, আরও অনেকেই শিখত। শুধু শেখা নয়, একটু সুযোগ পেলেই পায়ে বল দেখা যেত ওর। বাবার কাছে বায়না করে বল কিনে রেখেছিল বাড়িতে। বাবা মর্ণিংওয়াকে বেরলে ও সঙ্গ নিত বল নিয়ে। বাবা হাঁটতেন আর ও বল নিয়ে ছুটে বেড়াত মাঠময়।একটু বড় হতেই ক্লাবের হয়ে খেলার সুযোগ পেল ও। যে কোনও ফুটবল ম্যাচ খেলার সময় সবাই লক্ষ্য করল, একবার কায়দা করে বলটা নিজের আয়ত্তে পেয়ে গেলে সে বল সর্বদা ওর পায়ে পায়ে থাকত। ওর পা থেকে বল কেড়ে নেওয়া বেশ সহজসাধ্য ছিল না, আর এই কারণে বিপক্ষের পরাজয় অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ত।
ওর খেলায় মুগ্ধ হয়ে ক্লাবের কর্মকর্তারা মিটিংএ সর্বসম্মতিক্রমে জুনিয়ার টিম ক্যাপটেন করলেন সুমনকে। ওর ক্যাপটেনশিপে খেলবে দল আসন্ন টুর্ণামেন্টে। প্র্যাকটিস চলছে জোরদার। কোচ সমানে প্রশিক্ষণ দিয়ে যাচ্ছেন। তিনি লক্ষ্য করেন কিছু শেখানোর সময় ও নিবিষ্ট চিত্তে তা শেখার চেষ্টা করে এবং সহজেই তা শিখে নেয়। খেলা নিয়ে এতটাই ওর আবেগ যে খেলার আগের রাতে স্বপ্নের মধ্যে চিৎকার করে ওঠে ‘গোওওওওল’। নির্দিষ্ট দিনে খেলা শুরু হয়। অল্পক্ষণ পরেই দেখা গেল তীব্র গতিতে ছুটে এসে বিপক্ষের খেলোয়াড়ের পা থেকে বল কেড়ে নিল সুমন। ওর গতির সামনে কেউ এঁটে উঠতে পারছে না। অদ্ভুত ওর পায়ের কাজ, ভেলকি দেখাতে শুরু করেছে ও তখন। বল ওর পা থেকে কেড়ে নেওয়া যাচ্ছে না কিছুতে। সজোর লাথিতে বলটা দূরে ঠেলে দেয় কখনও। আবার কিছু পরে সেন্টার ফরোয়ার্ডের বাড়ানো পাস থেকে বলটা নিয়ে এসে সে দুর্ধর্ষ গতিতে গোল করে দেয়। শটের এত স্পিড ছিল যে দক্ষ গোলকিপার গোলটা বাঁচাতে পারল না। একের পর এক খেলা জিতে সুমনের টিম ফাইনালে, আর তা সম্ভব হয়েছে সুৃমনেরই জন্য।
ফাইনালে ওরা খেলবে পাশের পাড়ার সঙ্গে, যাদের সঙ্গে ওদের আজন্ম প্রতিযোগিতা। ওরাও শক্তিশালী টিম, কাজেই খেলতে হবে নিজের সর্বস্ব দিয়ে। ফাইনালের দিন যেন একটা উৎসব লেগে যায়। মাঠটিকে সাজানো হয় সুন্দর করে। সাদা গুঁড়ো দিয়ে আউটলাইন কাটা হয়। মাঠের একধারে মঞ্চ, যেখান থেকে খেলাটির পরিচালনা ও ধারাভাষ্য দেওয়া হয়। খেলা শুরুর আগে গান বাজতে থাকে, “সব খেলার সেরা বাঙালির তুমি ফুটবল”। বিভিন্ন পাড়ার লোকজন এসে হাজির হয়েছে মাঠের চারপাশে। নামীদামী খেলোয়াড় কয়েকজন এসে মঞ্চে বসবেন। ছেলেরা সব উত্তেজনায় টগবগ করে ফুটছে। দলের জন্য নির্ধারিত নীল জার্সি পরে ওরা মাঠে নামল। সুমনের জার্সির নম্বর ১। রেফারির বাঁশি বাজিল, মাঠজুড়ে শুরু হলো দাপাদাপি। সুমনের পায়ের কাজ শুরু হয়ে গেল। সবাই দেখল বল ১ নম্বর জার্সির দখলে, কেউ পারছে না কেড়ে নিতে। শরীর যেন ওর পাখির পালক, হালকা হাওয়ায় ভেসে যায়। খেলা শুরুর অল্পক্ষণের মধ্যেই গোলকিপারের হতভম্ব দৃষ্টির সামনে আলতো ঠোকায় বল ঠেলে দেয় গোলে, নেটে জড়িয়ে যায় বল। দিনের শেষে জয়ের হাসিটা হাসল তাদের টিম শক্তিশালী বিপক্ষকে হারিয়ে। সুমনকে কোলে তুলে নাচানাচি করতে লাগল টিমের ছেলেরা। প্রথম পুরস্কার হিসেবে ট্রফি ক্লাবের ঘরে তুলল ওরা। ওর খেলা দেখে বিভিন্ন ফুটবল ক্লাব ওকে নিজেদের দলে খেলানোর জন্য চুক্তিবদ্ধ করতে চায় প্রচুর অর্থের বিনিময়ে। কিন্তু সুমন নিজের ক্লাবকে ভালবাসে, ক্লাব ছেড়ে ও কোথাও যাবে না। আর তাছাড়া খেলাকে ও পেশায় পরিণত করতে চায় না। ফুটবল খেলা ওর প্রাণের আনন্দ, মনের আরাম। ভবিষ্যতে ও ডাক্তার হবে কিন্তু ফুটবল ছাড়বে না।
পরেরবার টুর্নামেন্টে দুটো খেলা জিতল ওরা। বলাই বাহুল্য সুমনেরই কৃতিত্বে। ফুটবল একটি দলগত খেলা হলেও অধিকাংশ সময়ে বল থাকত সুমনের কর্তৃত্বে, সুমনের পায়ে। ওর কাছে ফুটবল কোনো সাধারণ খেলা নয়, বরং ফুটবল হল আবেগ আর এই আবেগের সঙ্গে কোনোভাবেই কোনো সমঝোতা করতে রাজি নয় ও। তৃতীয় খেলায় বিপক্ষে স্ট্রাইকারের পায়ে বল চলে যায়। সুমন পায়ে বল পাবার জন্য অস্থির হয়ে ওঠে। ছুটতে থাকে। বিপক্ষের খেলোয়াড়ও চায় বল যাতে সুমনের পায়ে না পৌঁছায়। সুমন পৌঁছাবার আগেই সে সজোরে লাথি চালায় বলে। কিন্তু মর্মান্তিকভাবে বলটা তার তলপেটে ও নিম্নাঙ্গে আঘাত করে। মাঠের মাঝেই পড়ে যায় সে ব্যথায় কুঁকড়ে, তলপেট চেপে ধরে। দু’দলের সব খেলোয়াড় ছুটে আসে, ঝুঁকে পড়ে ওর ওপর। সুমনের জ্ঞান নেই। ধরাধরি করে মাঠের বাইরে নিয়ে যাওয়া হল। চোখেমুখে জল ছিটিয়ে জ্ঞান এল না দেখে ডাক্তার ডাকা হলে তিনি পরীক্ষা করে হসপিটালে নিয়ে যেতে বলেন। অ্যাম্বুলেন্স এল। হসপিটালে নিয়ে যাওয়া হলে তাকে পরীক্ষা করে মৃত বলে ঘোষণা করা হয়। সুমনকে হারিয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে দলের ছেলেরা। বিপক্ষের ছেলেদেরও চোখে জল। এমন অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটতে পারে স্বপ্নেও কেউ ভাবেনি। ক্লাবের বড়রাও মর্মাহত। এমন সম্ভাবনাময় ভাল একটা ছেলের এমন মর্মান্তিক অপমৃত্যুতে সে’বছর টুর্নামেন্ট স্থগিত হয়ে যায়।
এরপর কয়েকবছর তাদের ক্লাব আর কোনো টুর্নামেন্টে যোগ দেয়নি। পাড়ার মাঠে আর বল পড়ে না, ছোট ছোট ছেলে মেয়েদের মুখে হাসি নেই। সারা পাড়া থমথমে সুমনের অকালমৃত্যুতে। খেলার মাঠ ফাঁকা, খাঁ খাঁ করছে সর্বদা। ক্লাবের বার্ষিক স্পোর্টসও বন্ধ হয়ে গেছে। এ পাড়ায় যেন কোনো প্রাণ নেই। তিনবছর কেটে গেল এভাবেই। ক্লাবের ফুটবল কোচ বললেন, “এভাবে সব বন্ধ করে কী হবে? যে গেছে সে তো আর ফিরবে না! বরং তাঁর মতো একজন খেলোয়াড় তৈরি করতে পারলে তার আত্মা শান্তি পাবে”। সবাই সমর্থন করল তাকে। আস্তে আস্তে ছেলেরা মাঠে ফিরতে লাগল। আবার খেলা শুরু হল। কোচ বিশেষভাবে তাদের প্রশিক্ষণ দিতে লাগলেন। একবছর প্রশিক্ষণ দেওয়ার পর আবার তারা টুর্নামেন্টে যোগ দিল।
ওদিকে বাড়িতে সুমনের মা তাঁর একমাত্র সন্তানকে হারিয়ে তার রেখে যাওয়া জিনিসপত্র আঁকড়ে ধরে দিন কাটাতে থাকেন। তার ঘরের দেওয়াল জুড়ে যেসব পোস্টার রয়েছে তাতে হাত বোলান, পরিষ্কার করে রাখেন। ওর জার্সি, ফুটবল খেলার বুট, নিজেরও বেশ কয়েকটা ফুটবল ছিল ওর, সকালে সুযোগ পেলেই মাঠে গিয়ে একা একা প্র্যাকটিস করত ও, সব রয়েছে, কেবল ফুটবল পাগল ছেলেটাই নেই। মা সুরমা অবসরে ছেলের ঘরে বসে থাকেন। মনে হয় ছেলে রয়েছে আশেপাশে। সবাই ভাবে স্মৃতি নিয়ে ভাল থাকে থাকুক। ক্লাবের খেলার আগের রাতে উনি নিজের ঘরে বিছানায় শুয়ে শুনতে পান সুমনের ঘরে ফুটবলের আওয়াজ, কেউ যেন ড্রিবলিং করছে, শোনা যায় ফুটবল ছুটে বেড়াচ্ছে ঘরময়। ধড়মড় করে বিছানায় উঠে বসেন, ছুটে বেরিয়ে ছেলের ঘরে যেতে গেলে সুমনের বাবা মিলনবাবুর ঘুম ভেঙ্গে যায়, ধরে ফেলেন সুরমাকে। কেঁদে ফেলেন সুরমা, “আমাকে যেতে দাও আমার বাবুর কাছে। ও এসেছে, ও এসেছে”। মিলনবাবু সুরমাকে জাপ্টে জড়িয়ে নেন বুকের মধ্যে, মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকেন। সুরমা মিলনের বুকের মাঝে ফুৃঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়েন। মিলনের আর ঘুম আসে না। ভোরের আলো ফুটতই সন্তর্পণে বিছানা ছেড়ে উঠে পায়ে পায়ে সুমনের ঘরে যান। গা শিরশির করে ওঠে ওনার সব দেখে। দেখেন সুমনের খাটের ওপর ফুটবল খেলার জার্সি পড়ে রয়েছে, যেটা ওর আলমারিতে থাকে। জুতোগুলো যেগুলো বাক্সের ভেতর থাকে সেগুলো ঘরে এদিক ওদিক ছিটিয়ে রয়েছে, বলটাও ক্যাবিনেটের মাথা থেকে মাটিতে গড়াচ্ছে। “তবে কী কাল রাতে সত্যিই ও এসেছিল অশরীরী আত্মার বেশে?” মনের মধ্যে হাজার প্রশ্ন জড়ো হয়। আস্তে আস্তে সব জিনিস জায়গামত রেখে দেন যাতে সুরমা উঠে এসব না দেখে।
ওদিকে এবারে ওদের ফুটবল টিমের ক্যাপ্টেন মৈনাক খেলার আগের দিন খুব টেনশনে। কতদিন পর খেলার শুরু হচ্ছে, তাকে ক্যাপ্টেন করা হয়েছে, তার দায়িত্ব অনেক। ক্লাবে বড়দের তার ওপর অনেক প্রত্যাশা। নিজের সেরাটা দিতে হবে, মাঠে রাজত্ব করতে হবে, বল রাখতে হবে নিজেদের দলের আয়ত্তে। সারাদিন মাথায় এইসব ঘুরতে থাকে তার। রাতে ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দ ওঠে ওর ঘরের জানলায়, তারপর সারাঘর জুড়ে যেন এক ঠান্ডা হাওয়ার স্রোত বয়ে যাচ্ছে। স্বপ্ন দেখে ও। স্বপ্নের মধ্যে খুব ভয় পায়। মনে হয় কেউ যেন ওর মুখের ওপর ঝুঁকে আছে। বরফ ঠান্ডা দুটো হাত ওর পা ঝাঁকিয়ে ওকে কিছু বলতে চায় যেন। ঘুমের মধ্যেই ও শোনে কেউ যেন খেলার জন্য টিপস দিচ্ছে ওকে ফিসফিস করে। ওর কানে যেন কেউ বলে যায়, “তুই খেলে যা, আমি তো আছি। চিন্তা করিস না, তোর পায়ে ভর করব আমি, জিতব আমরাই”। ঘুমের মধ্যেই মৈনাকের গায়ের সমস্ত রোমগুলো জেগে উঠল। আবার শুনল ফিসফিসানি, ” ভয় পাস না, আমি তোর কোনো ক্ষতি করব না, ভালই করব। ফুটবল আমার প্রাণ, এই ক্লাবে ছোট থেকে খেলে এসেছি, ক্লাব হেরে যাক আমি তা কিছুতে মানতে পারব না”। ঘুম ভাঙলে মৈনাক দেখল ভোর হয়ে গেছে। স্বপ্নটা মনে পড়ে গেল। অনেকক্ষণ চুপ করে বসে রইল বিছানায়। তারপর ভাবল ক্ষতি তো কিছু হয়নি, দেখা যাক যদি ভাল কিছু হয়। মন বলে উঠল, “নিশ্চয়ই ভাল হবে, নাহলে সুমন মারা যাবার পর এতদিন কিছু হয়নি, আমিও এরমধ্যে ওর কথা চিন্তা করিনি, তবে হঠাৎ আজ কেন?” বেশ খুসি খুসি লাগল ওকে। ভোরের স্বপ্ন নাকি সত্যি হয়! সব টেনশন নিমেষে উধাও। ভাবে, “খেলায় হারজিত তো আছেই কিন্তু আগেই হেরে বসে থাকলে চলবে না, লড়াইটা চালাতে হবে। থাকতে হবে জয় করার তীব্র বাসনা। আজ মনে যেন এক অদ্ভুত জোর পাচ্ছি, একটা শক্তি আমাকে সাহস যুগিয়ে চলেছে, মনে হচ্ছে আমরাই জিতব”।
বিকেল ৪টেয় খেলা শুরু। আগেভাগেই মাঠে হাজির হয়ে গেছে সবাই। মৈনাককে টেনশন ফ্রি দেখে ক্লাবের বড়রা একটু অবাক, ক’দিন যে ও খুব টেনশনে ছিল। বলল, “সেরা খেলাটা দেওয়া চাই, বিপক্ষকে শক্তিশালী মনে করে খেলবি। খেলার ১.৩০ ঘন্টা বলটাকে পাখির চোখ করে রাখবি। হার্ড ওয়ার্ক কর তুই পারবি”। মৈনাকের যেন গা’ছাড়া ভাব। বড়রা চিন্তিত, “ডোবাবে না তো?” বাঁশি বাজিয়ে রেফারি খেলা শুরু করে দিলেন। বল বিপক্ষের কব্জায়। হঠাৎ মৈনাককে কে যেন ধাক্কা দিল, ঝড়ের গতিতে সে বলের কাছে পৌঁছাল। কিছুক্ষণ কাড়াকাড়ির পর বল মৈনাকের কব্জায়। এরপর সবাই দেখল মৈনাকের খেল। বল আর কেউ তার পা থেকে ছিনিয়ে নিতে পারল না। সোজা গোলে বল পাঠিয়ে দিল সে। হাততালিতে ভেসে যাচ্ছে প্রাঙ্গণ, বড়রা বলাবলি করছে সুমনের কথা, “মৈনাকের ওপর যেন আজ সুমন ভর করেছে, তাই না?” সত্যিই যে সুমন ভর করেছে তা তো আর তারা জানে না, সে কেবল মৈনাক জানে। এরপর আরো দুটো গোল দিয়ে দিল মৈনাক, বিপক্ষ হতভম্ব হয়ে দেখল। কোনো কিছুই করতে পারল না, হেরে গিয়ে মাথা নিচু করে মাঠ ছাড়ল তারা। আর মৈনাককে দলের সবাই কাঁধে তুলে নাচল। বড়রাও মাঠে ঢুকে পড়েছে, অনেক আদর করল ওকে। “তোরা আমাদের মান রাখলি আজ। তবে মনে রাখবি, success is a journey not a destination.”
এভাবে একের পর এক খেলা জিতে ফাইনালে পৌঁছে গেল ওদের টিম আর সবাই দেখল মৈনাকের খেলা। ছেলেটা নিজেকে বেশ তৈরি করেছে, অনেক উন্নতি করেছে খেলায়। আশপাশের ক্লাবগুলো যারা ওদের টিমের কাছে হেরে গেছে, প্রত্যেকেই সুমনের কথা বলছে। ওকে ভোলেনি কেউ। মৈনাক যে একেবারে ওর মতোই খেলছে, তাই আবার সুমনের কথা সবার মনে পড়ে যাচ্ছে বড্ড বেশি করে। ওদিকে বাড়িতে সুমনের ঘরে ওর ছবিতে মা চন্দন দিয়ে সাজান, মালা পরান, ঘরে ফুলদানিতে ফুল রাখেন, কিন্তু এই টুর্নামেন্টে চলাকালীন রোজ ঘরের সব লন্ডভন্ড হয়ে যায়। সকালে ঘরে ঢুকে দেখে সুরমা বলেন মিলনকে, “দেখো আমার বাবু এসেছিল রাতে ঘরে। আজ রাতে আমি এঘরেই থাকব”। মিলন ভয় পেয়ে যান। অনেক করে বোঝান সুরমাকে, “তাহলে ও আর আসবে না, তোমাকে ওর ঘরে ওর আসার আশায় বসে থাকা দেখলে ওর খুব কষ্ট হবে। তার চেয়ে এই ভাল, তুমি জানতে পারছ বাবু আসছে, তার অস্তিত্বহীন অস্তিত্ব রেখে যাচ্ছে রোজ এই ঘরে। তুমি ওর উপস্থিতিটুকু জানতে পারছ”। সুরমা অগত্যা মেনে নেন। মিলন তো থাকেন অফিসের কাজে ব্যস্ত সারাদিন, বাড়িতে ওই কাজের মেয়ে মিনুর সঙ্গে দিন যেন আর কাটে না। বাবু থাকতে ওর জন্য নানারকম রান্না করতে ইচ্ছে করত, ওকে ঘিরেই যে সুরমার দিন কাটত। ওকে ঘিরেই ছিল যত ব্যস্ততা। বাবুকে হারিয়ে যে চারিদিকে শুধু শূন্যতা ঘিরে ধরেছে তাঁকে।
পরের ম্যাচেও সবাই দেখল মাঠে মৈনাকের আধিপত্য। সবাই জেনে গেছে মৈনাক এক্সপার্ট প্লেয়ার হয়ে গেছে। খেলতে খেলতে কেবল গোল লক্ষ্য করে বলটা ছুঁড়তে যাবে, বিপক্ষের এক শক্তিশালী খেলোয়াড় এসে পড়ে ওর সামনে, বল প্রায় মৈনাকের পা থেকে বেরিয়ে যায়, এমন সময় সবাই দেখে বিপক্ষের খেলোয়াড়টি মাঠে ছিটকে পড়ল আর মৈনাক বলটা পাঠিয়ে দিল সোজা গোলে। খেলোয়াড়টি উঠে অভিযোগ করে তাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেওয়া হয়েছে অথচ কেউ যে তাকে ধাক্কা দিয়েছে এমন কোনো প্রমান নেই। ওর ধারে কাছে মৈনাক ছাড়া আর কেউ ছিল না, আর মৈনাক ছিল বল পায়ে ব্যস্ত। রেফারি ওর ঐ অভিযোগের কোনো গুরুত্ব দিলেন না। কেবল মৈনাক বুঝল ব্যাপারটা কী হল। পরপর ম্যাচে সবাই দেখে মৈনাকের কৌশল। কিভাবে বলকে বাগে আনে সে, সুকৌশলে অন্যের পা থেকে বল টেনে তরতর করে দৌড়বার কায়দা রপ্ত করেছে। চিতার দৌড় আর সবুজ ঘাসের ক্যানভাসে যেন তুলি দিয়ে রূপকথা লিখে চলেছে মৈনাক। তাকে আটকানোর সাধ্য কারও নেই তখন। এইভাবে টুর্নামেন্টে জয়ী হয়ে শিল্ড ঘরে তোলে তারা। আনন্দে ক্লাবে একদিন পিকনিক হয়ে গেল। কেবল মৈনাক ভাবে, “আমাকে সবাই বিরাট খেলোয়াড় ভাবছে কিন্তু আমি তো জানি আমার দৌড় কতটা”।
এরপর ক্লাবের রেগুলার ম্যাচে দুটো টিমের খেলা হয়। একদলে মৈনাক ক্যাপ্টেন, আরেক দলের তাপস। সবাই জানে মৈনাকের দল জিতবে কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে জিতল তাপসের দল। মৈনাকের সেই খেলা যেটা টুর্নামেন্টে খেলেছিল, তা আর কেউ দেখল না। সবাই অবাক হয়ে গেল ওর অতি সাধারণ মানের খেলা দেখে। খেলা শেষে বড়রা চেপে ধরল ওকে। এভাবে খেললে পরেরবার টুর্নামেন্টে জিতবে কেমন করে? নানারকম প্রশ্নে জর্জরিত হয়ে মৈনাকের কাঁদো কাঁদো অবস্থা। বলে ফেলে সে, “আমি তো খেলাগুলো খেলিনি, খেলেছিল সুমন”। “তার মানে?” সবার সমবেত প্রশ্ন। মৈনাক ওর স্বপ্নে দেখা, সুমনের ওকে বলা কথা গড়গড় করে সব বলে দেয় চাপের মুখে পড়ে। সবাই তাজ্জব হয়ে যায়। এত ভালোবাসে সুমন ক্লাবকে? এরপর ক্লাবের মাঠের একপাশে সুমনের একটা মূর্তি স্থাপন করা হয়। ওর জন্মদিনে উন্মোচন করা হয় সেই মূর্তি বিশিষ্ট ফুটবলারকে দিয়ে। নিশুতি রাতে, সারা পাড়া যখন গভীর ঘুমে মগ্ন, মাঠের আশপাশের বাড়ি থেকে ঘুমের মাঝে সবাই শুনতে পায় রাতে মাঠে ফুটবল পায়ে কারও দৌড়ের আওয়াজ।
সব খেলার সেরা ভৌতিক গল্প – সমাপ্ত
আপনাদের লেখা আমাদের ওয়েব সাইটে জমা দিতে গেলে, অনুগ্রহ করে আমাদের লেখা-জমা-দিন মেনু-তে ক্লিক করুন ও নিজেকে Author হিসেবে Register করুন এবং আমাদের পরবর্তী আপডেট পেতে আমাদের ফেসবুক পেজ অনুসরণ করুন।
অন্যান্য
রাজবাড়ী রহস্য
ব্রহ্ম দৈত্য
প্রত্যাবর্তন