আর এগোবেন না কিন্তু ভৌতিক গল্প – প্রদীপ দে
জীবনে সাকসেস পেলাম না। বিফল জীবন। পড়াশোনা করেছিলাম অঙ্কে অনার্স নিয়ে এম.এ। সাধারণ চাকরি করার ইচ্ছা ছিল না, পাইও নি। খুবই ইচ্ছে ছিল শিক্ষকতা করার। সবাই মত দিল বি এড করার জন্য। উপায় নেই পয়সার অভাব। বাবা প্রাইভেট কোম্পানিতে কাজ করতো এখন রিটেয়ার্ড। ফলতঃ পশ্চাদপসরণ!
বাবা লুকিয়ে নিজের কষ্টার্জিত অর্থে বানানো দুকাঠায় একতলা বাড়িটি তার প্রতিবেশী বন্ধু নিখিলদার কাছে বন্ধক রাখে এবং যা অর্থ পায় তা দিয়ে আমার পড়ার খরচ রেখে বাকিটুকু ব্যাঙ্কে রাখে। আমায় বলে কোম্পানি পুরোনো বকেয়া টাকা দেওয়ায় এই অর্থ প্রাপ্তি।
অভাগা যেদিকে যায় সাগর শুকায়ে যায়। বি.এড পাশ করি ঠিকই কিন্তু পরীক্ষায় বসাই হলো না। পরীক্ষা তখন বন্ধ ছিল। অপেক্ষায় ছিলাম। কিন্তু প্রাইভেট পড়ানো শুরু করি। সকাল থেকে রাত দশটা পর্যন্ত কলকাতা শহরে ছাত্র পড়িয়ে হাওড়া থেকে শেষে ট্রেন ধরে হরিপালে এসে নামতাম। তারপর দুইমাইল হেঁটে বাড়ি ফিরতাম এই আমার দৈনন্দিন রুটিন ছিল।
এর মধ্যেই বড় বিপদ এসে হাজির হল। একদিন নিখিলদা পুলিশ এনে বাড়ির দখল নিতে গেল। তখন সব ব্যাপারটা জানলাম। বাবা সব বলে পুলিশকে জানালো, — আমার ধার শোধের মেয়াদতো এখনো অনেকদিন বাকী এখন এসব কেন?
পুলিশের হাতে বাড়ি বিক্রির দলিল কোর্টের অর্ডার সহ, — সেকি? আপনি তো বাড়ি বিক্রি করে দিয়েছেন। অনেক আগেই, বন্ধক তো দেননি? উনি আপনাকে অনেকদিনই থাকতে দিয়েছেন, এই দেখুন আপনার সই। চিনতে পারেন? দেখলাম সত্যি বাবার সই।
আমি বাবাকে ধমক দিলাম, — তুমি এমন করলে? তাও এখনো মিথ্যা বলছো? বাড়ি ছেড়ে দাও।
বাবা আমার মুখের দিকে চেয়ে চুপসে গেল। ভাবলাম লজ্জা পেয়ে গেছে। যাকগে থেমে গেলাম। ভাবলাম আমার জন্যই তো করেছে। কিন্তু বিক্রি করে দিয়ে বন্ধকের কথা কেন বলছে বাবা? ভীষণ রাগ হল বাবার প্রতি। বাবা সেটা বুঝলো। বাবার মাথাটা লজ্জায় নেমে গেল।
হঠাৎই দেখলাম বাবা কেমন যেন সাহসী হয়ে গেল, আর আমাকে বললে, — তুই দুদিন তোর মাসির বাড়ি থাক। আমি দেখি বিকল্প কোন ব্যবস্থা করত পারি কিনা? আমি আমার বন্ধু অখিলেশের বাড়ি তারকেশ্বরে গিয়ে থাকি।
অখিলেশবাবুকে জানতাম, ভালো বন্ধু বাবার। উপায় ছিল না। বাবাকে ছাড়তেই হল। আর আমার মাসি খবর পেয়ে ছুটে এসেছিল, সেও আমাকে নিয়ে গিয়ে রাখলো। ওদের বাড়িটা আমাদের বাড়ি থেকে অনেকটাই ভিতরে।
একদম নিরুপায়। ছাত্র পড়ানো বন্ধ করা যাবে না। মাসির বাড়িতে প্রথম দিন কাটলো। দ্বিতীয় দিনে বাবার কথা ভাবছি। ভাবলাম আজ পড়িয়ে কাল ছুটি নিয়ে বাবার কাছে যাবো। এরকম ভাবে কি করে চলবে?
যথারীতি শেষ ট্রেনে এসে হরিপাল নেমে লাইন পাড় হচ্ছি। ফাঁকা রাস্তা। রিক্সাগুলো আওয়াজ করে বেড়িয়ে গেল। আমিতো হাঁটিই রোজই। আজও নির্জনে নিজের মনে হাঁটছি, পিছন থেকে বাবার ডাক পেলাম, — মণি দাড়া, আমি এসে গেছি।
চমকে গেলাম, দেখি বাবা এগিয়ে আসছে আমার দিকে, আমি তো অবাক। — বাবা এতো রাতে? এখানে?
— আরে আমি জানিতো, তুই এই শেষ ট্রেনেই ফিরবি তাই অখিলেশের গাড়িতে চলে এলাম। এই নে, বাড়ির দলিল। আর সত্যি কথাটা শোন আমি বাড়িটা বিক্রি করিনি, বন্ধকী রেখেছিলাম ওই নিখিল আমার সহি জাল করেছিল। অখিলেশ বড় উকিল লাগিয়ে অনেক টাকা ফেরত দিয়ে আমাদের দলিল হাতিয়েছে। এই নে দলিলটা ধর, সাবধানে নিয়ে যা। থানা সব জানে। তুই বাড়ি গিয়ে চাবি খুলে ঢুকে যাবি। এই নে নিখিল ওর নতুন। তালার চাবিটাও দিয়ে দিয়েছে। ওর আর কিছু বলার ক্ষমতাই নেই।
— তা তুমিও তো যাবে আমার সাথে?
— নারে আজ আর ফিরতে পারবো না। অখিলেশ খারাপ ভাববে। ও লাইনের ওপারে গাড়িতে অপেক্ষা করছে যে। আজ ফিরলে খারাপ লাগবে ও এতোটা করলো আর আমি কিনা আজই ওকে ছেড়ে ………… না, না আজ তুই বাড়ি যা। আমার হাতে আমাদের দলিল আর নতুন চাবি। আমি বড় লজ্জায় মরে গেলাম। বাবার কাছে ক্ষমা চাওয়া হলো না। পতে চাইতেই হবে।
আমি দেখলাম বাবা হনহন করে লাইনের উপর দিয়ে ওপারে চলে গেল।
প্রথমেই মাসির বাড়ি গেলাম। যেতেই মেসো বেড়িয়ে এলো আর আমায় হাত ধরে টান মেরে বললে, — তাড়াতাড়ি চল তোদের বাড়িতে। পুলিশ মাসিকে নিয়ে গেছে। একটা বড় খবর আছে।
আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ভয় পেয়েই, — কেন ? কি হয়েছে?
মেসো পাড়ার এক রিক্সায় আমায় তুলেই নিজে উঠে বসলো। তখন রাত বারোটা বেজে গেছে।
বাড়ির সামনে এসে দেখি ভিড়ে ভিড়। পুলিশে পুলিশ। সামনে দু দুটো ডেড বডি। আমি আর থাকতে পারলাম না। আগে গিয়ে ডেডবডি দুটো দেখলাম। অবাক হয়ে গেলাম। একটা বাবার। অন্যটা নিখিলদার।
লোকাল থানার ওসি আর মাসি আমায় নিয়ে বাড়ির ভিতরে ঢুকলো। আমার হাতে দলিলটা সহ বাড়ির চাবিকাঠি তখনও ধরা। অফিসার দেখে চমকে উঠলেন, — এগুলো কোথায় পেলেন?
— একটু আগেই বাবা আমাকে রেল লাইনেই দিল আর বাড়ি যেতে বললে।
— ভেরি অবাক কান্ড? কিন্তু আপনার বাবাতো সেদিনই আমাদের এরিয়ার বাইরে গিয়ে তারকেশ্বরের রেললাইনে মাথা দিয়েছিলেন। তারকেশ্বর থানা বডি উদ্বার করে খোঁজে আমাদের জানায়। পোর্স্টমোর্টেমের পর আমরা সনাক্ত করি।
আমিও অবাক, বাবা যে এখনি আমার সাথে কথা বললো?
আমার কিছু ভালো লাগছিল না। দু চোখ ভিজে যাচ্ছে যে ….
পুলিশের ওসি আরো জানালেন, — যাক এই বাড়ি আপনাদেরই। মরার আগে সুইসাইডাল নোটে এই কথাই স্বীকার করে লিখে গেছেন আপনার প্রতিবেশী নিখিল কর্মকার।
— উনি হঠাৎ মারা গেলেন কি ভাবে ?
— হ্যাঁ। হার্টফেল। সম্ভবত ভয় পেয়েছিলেন কিছু দেখে। আমরা এসে দেখি ঘর তছনছ করা। আলমারি সব খোলা। একটা দলিল পাই কিন্তু সেটার উপড়ে নিখিলের হাতে কাটাকাটি করে লেখা ‘ এটা জাল দলিল ‘। আমরা কিন্তু অনেক খুঁজেও আসল আপনাদের দলিল উদ্বার করতে পারিনি আর পাইনি এই বাড়ির নতুন চাবিটি। অবাক হচ্ছি ওটা আপনার হাতে ধরা দেখে।
এরপর আর এগিয়ে কি লাভ? এখানেই থাক …………।
আর এগোবেন না কিন্তু ভৌতিক গল্প – সমাপ্ত
আপনাদের লেখা আমাদের ওয়েব সাইটে জমা দিতে গেলে, অনুগ্রহ করে আমাদের লেখা-জমা-দিন মেনু-তে ক্লিক করুন ও নিজেকে Author হিসেবে Register করুন এবং আমাদের পরবর্তী আপডেট পেতে আমাদের ফেসবুক পেজ অনুসরণ করুন।
অন্যান্য
রাজবাড়ী রহস্য
ব্রহ্ম দৈত্য
প্রত্যাবর্তন