চন্দ্রযান থেকে সৌরযান ইসরোর সাফল্য
নাসার মহাকাশ যান পার্কার সূর্যের কাছে গিয়েছিল ২০২১ এর ডিসেম্বরে। সূর্যের কাছে গিয়ে সে যা অদ্ভুত কান্ডকারখানার খবর দিয়েছিল, তা দেখে চক্ষু চড়কগাছ হয়েছিল গোটা বিশ্বের। এবার সেই মামাবাড়ির দিকে এগোচ্ছে আমাদের ভারতবর্ষ। আপনি ঠিকই শুনেছেন। আমি আমাদের প্রিয় সূয্যি মামার কথাই বলছি। সেখানকার তাপমাত্রা প্রায় ১৫ লক্ষ ডিগ্রি সেলসিয়াস।সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে একটা ছবি আমরা সকলেই দেখেছি, যেখানে বিদেশি মিডিয়া আমাদের মহাকাশ গবেষণাকে ব্যঙ্গ বিদ্রুপ করছে। ছবিতে দেখা যায় , ভারত একটা গরু নিয়ে চীন আমেরিকা , রাশিয়াদের মতন স্পেস এলিটদের ক্লাবে ঢোকার চেষ্টা করছে। এ চিত্র ভারতের কাছে ভীষন অপমানজনক। তবে কথায় আছে, যে অপমান সহ্য করে,সে নিঃশব্দে জবাব দেয় সাফল্যের থাপ্পর মেরে। একটা সময়ে এই ইসরো সাইকেলে করে গবেষনার যন্ত্রাংশ নিয়ে যেত। তাছাড়া, বিজ্ঞান খাতে বেশি টাকা বরাদ্দ থাকতো না। তখন এই দেশকে লোকে করুণার চোখেই দেখতো।অবশ্য সেসব অনেক পুরনো দিনের কথা। যমুনা দিয়ে অনেক জল গড়িয়েছে। আসলে সময় চলে সময়ের মেজাজে।সেই মেজাজে হাওয়া দিয়েছে দেশ বিদেশ থেকে পড়াশুনো করে আসা বহু যুবক যুবতী। এই সব নব্য চেতনার হাত ধরে ভারত সাবলম্বী হয়েছে। ওই যে কোথায় আছে, ‘শিক্ষা আনে চেতনা, চেতনা আনে বিপ্লব , বিপ্লব মানে পরিবর্তন’ । এই বিপ্লবের যুগে সাইকেলে করে স্পেস রকেটের যন্ত্রাংশ নিয়ে যাওয়া থেকে শুরু করে, আজ ভারত সাফল্যের চরম শিখরে পৌঁছেছে। প্রথমে মহাকাশ, মঙ্গলযান তারপর চাঁদের মাটি জয় করার ব্যাপারটা ভারত তথা ভারতবাসীর কাছে অন্য দেশের চেয়ে অনেক বেশি আলাদা ও গুরুত্বপূর্ন। এই সমস্ত অভিযানে অন্যান্য দেশ যা অর্থ ব্যায় করে, ভারত তার অর্ধেক খরচে চাঁদে অভিযান করেছে। একটা যদি তুলনা করা যায় তাহলে ব্যাপারটা বুঝতে অনেক সুবিধা হবে। ভারত যেখানে ৬০০ থেকে ১ হাজার কোটি টাকার মধ্যে চাঁদে যাওয়া সম্ভবপর করে তুলেছে, সেখানে আমেরিকার খরচ হয়েছে প্রায় ২০০০ হাজার কোটি টাকা । তাই এখন বিশ্বের সব দেশ ভারতবর্ষের দিকে তাকিয়ে। আসলে আমরা ভারতীয়রা কম খরচে অনেক বড় বড় কাজ করে দেখাতে চিরকালই সক্ষম। এটা ভারতীয়দের চিরাচরিত প্রতিভার মতো। এবার সেই প্রতিভা কাজে লাগানো হলো মহাকাশ অভিযানের মতন এমন এক ব্যয়বহুল চেষ্টায় । মহাকাশ থেকে শুরু করে চাঁদে যাওয়া, সবই সম্ভব করেছে এই ভারত বর্ষ। যাদের কাছে ভারতবর্ষ মানেই গরিব লোকের ছড়াছড়ি তাদের কাছে এই সাফল্য কিছুটা হলেও আগুনের ছ্যাকার মতন ব্যথা দেয়। ভারত খুব কম সময়ে কম খরচে চাঁদ অব্দি পৌঁছে গেছে। এর পরবর্তী ধাপ হল , সূর্য জয়। সূর্যে যাওয়া অসম্ভব মনে হলেও, চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে সফল অবতরনের পর আমাদের মহান দেশ ভারতবর্ষ সূর্যে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে।তবে হ্যাঁ , সূর্যের মাটিতে বা বলা ভালো লাভাতে অবতরন সম্ভব না।কিন্তু তার কাছাকাছি কোনো এক কক্ষপথে থেকে এই পরীক্ষা নিরীক্ষা করা সম্ভব। অনেকেই মজা করে বলতে থাকেন যে, সূর্যে পৌঁছতে গেলে রাতে যাওয়া উচিত। কারণ রাতে নাকি অন্ধকার থাকে। একথা আপাদমস্তক ভুল হলেও, সূর্য দেবের কাছে যাওয়ার অভিযান কোনোমতেই অসম্ভব না তা আবারও প্রমাণ করে দেখাতে চলেছে ইসরো। ইসরোর সৌরযান আদিত্য এল – ১ সূর্যে পাড়ি দিয়েছে গত দোসরা সেপ্টেম্বর। সৌরযান আদিত্য এল – ১এর সঙ্গী হয়েছে সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য PSLV – XL C57 বা পোলার স্যাটেলাইট লঞ্চ ভেহিকল’ নামের শক্তিশালী রকেট। ইসরোকে এই রকেট তৈরি করতে সাহায্য করেছে ভারতবর্ষের একটি কোম্পানি ATL বা অনন্ত টেকনোলজি। শোনা যাচ্ছে যে আদিত্য এল ১ উচ্চতায় হবে প্রায় ২ মিটার এবং ওজন ১৭০০ কেজি। তবে আগেই বললাম ,ভারতের এই সৌরযান একেবারে সূর্যে অবতরন করবে না চন্দ্রযান ১ এর মতন।
এই বিষয়ে ইসরো প্রধান কি বলেছেন একটু বিস্তারিত জেনে নেওয়া যাক,
‘ আদিত্য এল-১ মিশনটি সূর্য পর্যবেক্ষণের জন্য ISRO-এর প্রথম উৎসর্গ করা মহাকাশ মিশন হতে চলেছে। উৎক্ষেপণের প্রস্তুতি চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে। লঞ্চের মহড়াও শেষ হয়েছে। ISRO-এর সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য রকেট PSLV-C57, আদিত্য এল-১কে পৃথিবীর নিম্ন কক্ষপথে ছেড়ে যাবে। এর পরে, তিন বা চারটি কক্ষপথের পরে, এটি সরাসরি পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ বলয়ের (SOI) বাইরে চলে যাবে। তারপর শুরু হবে ক্রুজ পর্ব।
আদিত্য এল-১ হ্যালো অরবিটে ঢোকানো হবে। যেখানে L1 পয়েন্ট এই বিন্দুটি সূর্য ও পৃথিবীর মাঝখানে অবস্থিত। কিন্তু সূর্য থেকে পৃথিবীর দূরত্বের তুলনায় তা মাত্র ১ শতাংশ। এই যাত্রায় ১২৭ দিন সময় লাগবে। এটি কঠিন বলে মনে করা হয় কারণ এটি দুটি বড় কক্ষপথে যেতে হয়।
সূর্যের নিজস্ব মাধ্যাকর্ষণ আছে। যাকে মহাকর্ষ বল। পৃথিবীর নিজস্ব মাধ্যাকর্ষণ আছে। মহাকাশে যেখানে এই দুটির মহাকর্ষের সংঘর্ষ হয়। পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ যেখানে শেষ হয়, সেখান থেকেই শুরু হয় সূর্যের অভিকর্ষের প্রভাব। এই বিন্দুটিকে ল্যাগ্রেঞ্জ পয়েন্ট বলা হয়। ভারতের আদিত্য লারেঞ্জকে পয়েন্ট ওয়ান অর্থাৎ এল১-এ মোতায়েন করা হবে।’ সুতরাং আমাদের প্রিয় সুজ্জিমামা কে নিয়ে ভারতের সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা রয়েছে।
এতো গেল সূর্য অভিযানের কথা। কিন্তু, সম্প্রতি সফল হওয়া চন্দ্রযানের নেপথ্যে রয়েছে সুদীর্ঘ ইতিহাস।সময়ের সাথে সাথে ভারতবর্ষের বুক থেকে বিভিন্ন আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক কারণে প্রাচীন বিজ্ঞান চর্চার ধারণা লোপ পেয়েছিল ঠিকই, কিন্তু ভারতবর্ষের জ্ঞানী মানুষদের মন থেকে মহাকাশ গবেষণা সংক্রান্ত চিন্তা কোনদিন সম্পূর্ণরূপে মুছে যায়নি। হয়তো সে কারণেই ঔপনিবেশিক ভারতবর্ষের স্বাধীনতা লাভের কিছু পরেই সদ্যোজাত একটি দেশে মহাকাশ গবেষণার গুরুত্ব বুঝে দেশে আধুনিক মহাকাশ গবেষণার প্রচলনের উদ্যোগ নেন বিলেত ফেরত এক ভারত সন্তান: ডঃ বিক্রম আম্বালাল সারাভাই। তিনি ভারতীয় আধুনিক মহাকাশ গবেষণার প্রাণপুরুষ। ভারতের এই প্রবাদপ্রতিম সন্তান কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা করেছেন । তিনি দেশে ফিরে ১৯৬৬ সালে আমেদাবাদে প্রতিষ্ঠা করেন কমিউনিটি সায়েন্স সেন্টার। এই সায়েন্স সেন্টার বর্তমানে বিক্রম সারাভাই স্পেস সেন্টার নামে পরিচিত। তাছাড়া বিক্রম সারাভাই-এর হাত ধরেই প্রতিষ্ঠিত হয় ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ইসরো। এই কারণেই তাকে ভারতের মহাকাশ গবেষণার জনক বলে অভিহিত করা হয়ে থাকে।ভারতীয় মহাকাশ গবেষণার প্রাণপুরুষ ডঃ বিক্রম সারাভাই-এর একান্ত উদ্যোগে এবং ভারত সরকারের সহায়তায় ১৯৬৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ইসরো। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই ইসরো নিজের উদ্যোগে কিংবা বিভিন্ন পাশ্চাত্য দেশের সহযোগিতায় মহাকাশ গবেষণার ক্ষেত্রে অগ্রসর হবার প্রয়াস চালিয়ে এসেছে। পাশ্চাত্য দেশের সাহায্য নেওয়ার দরুন সেই সমস্ত দেশের সংবাদ মাধ্যমে অনেক সময় ভারতকে কথা শোনাতে ছাড়েনি। আসলে কথায় আছে ব্যর্থ মানুষকে খোঁটা দেওয়া খুব সহজ। কিন্তু তাদের পাশে দাঁড়িয়ে তাদের সাফল্য ও ব্যর্থতার ভাগীদার হওয়া মোটেও সহজ ব্যাপার নয়। যদিও ভারত সেই সমস্ত দেশের সাহায্য কোনদিনই ভুলে যাবে না বলেই আশা রাখা যায়। ইসরো প্রতিষ্ঠিত হওয়ার প্রায় নয় বছরের মধ্যেই প্রথম সফলতা আসে ভারতের। ইসরোর একান্ত প্রচেষ্টায় ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দে মহাকাশের উদ্দেশ্যে পাড়ি দেয় ভারতের প্রথম কৃত্রিম উপগ্রহ ‘আর্যভট্ট’। এর পরবর্তী সময় থেকে ইসরোকে খুব একটা ঘুরে তাকাতে হয়নি। ব্যর্থতা এসেছে অসংখ্য, একথা সত্য; তবে ব্যর্থতা যে সাফল্যের পথ সুগম করে, এই চিরসত্যকে বুকে নিয়ে ইসরো মহাকাশ গবেষণায় কোনদিন থেমে থাকেনি। তাদের কখনো থামতে হয়নি নানা সমস্যার মধ্যেও। যার ফল হিসেবে পরবর্তীতে অনিবার্য সাফল্যও এসেছে ইসরোর ঝুলিতে। এই প্রসঙ্গে উঠে আসে আর একজন উল্লেখযোগ্য ব্যক্তির নাম। তিনি আর কেউ না, স্বয়ং সতীশ ধাওয়ান। ইসরোর উন্নতির পিছনে এই মানুষটির অবদানের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করতেই হয়। এমন সব প্রবাদপ্রতিম ভারতীয় বিজ্ঞানীদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় এখনো পর্যন্ত ইসরোর সর্বমোট মহাকাশ অভিযানের সংখ্যা ১১১। বলা বাহুল্য এর মধ্যে অধিকাংশই সফল কিংবা আংশিক সফল। সফল হওয়া এই অভিযান গুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ‘মঙ্গলযান’, ‘চন্দ্রযান ১’ ইত্যাদি।
সত্যি বলতে মানুষ মহাকাশে গেলেও চাঁদের মাটিতে পা রাখার ইচ্ছে ছিলো প্রবল। এর ইতিহাস শুধু ভারত নয়, সারা বিশ্বেই যেন এক বর্নময় অধ্যায়।
এর জন্য ফিরে যেতে হয় গত কয়েক দশকের পটভূমিতে। সোভিয়েত, জাপান, চীন ও ইউরোপের মহাকাশ গবেষণা সংস্থাগুলোও আন-ম্যানড (মানুষ ছাড়া) অভিযান চালিয়েছে চাঁদে। তার মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখ্যযোগ্য ছিল নীল আর্মসট্রং এর পদার্পন। কিন্তু,তারপরেও কেন আবার চাঁদে অভিযান চালাতে গেল ভারত? এটি কি কেবলই নিজেদের প্রযুক্তিগত ক্ষমতা দেখানোর জন্যে? না, বিষয়টি পুরোপুরি তা নয়। চাঁদে অনেক অভিযান হলেও, চাঁদ সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ অনেক তথ্যাদি এখনো জানতে পারেনি মানুষ। সেসব অনুসন্ধানের জন্যই চাঁদের প্রতি মানুষের আগ্রহ বেড়েছে নতুন করে। ভারত ছাড়াও জাপান, চীন, ইউরোপ চাঁদে নতুন করে মহাকাশযান পাঠানো শুরু করেছিল। ভারতের চন্দ্রযান-১ ছিল সেই প্রচেষ্টারই অংশ।
চন্দ্রযান-১ এর বৈজ্ঞানিক লক্ষ্য ছিল চাঁদের রাসায়নিক, খনিজ ও ভূতত্ত্বিক মানচিত্র তৈরি করা। তাছাড়া এটি ছিল ডিপ স্পেসে অর্থাৎ পৃথিবী থেকে এতোটা দূরত্বে ইসরোর প্রথম অভিযান। তাই প্রযুক্তিগত সক্ষমতা প্রদর্শনের বিষয়টি তো ছিলই। সে লক্ষ্যেই ২০০৮ সালের ৮ই নভেম্বর পৃথিবী ছেড়ে যাত্রা শুরু করে চন্দ্রযান-১।
ভারতের শ্রী-হরিকোটায় অবস্থিত সতীশ ধাওয়ান স্পেস সেন্টার থেকে উৎক্ষেপণ করা হয় মহাকাশযানটিকে। উৎক্ষেপণের জন্যে ব্যবহৃত হয় ইসরোর বিখ্যাত পোলার স্যাটেলাইট লঞ্চ ভেহিকল (পিএসএলভি)-এর কিছুটা পরিবর্তিত সংস্করণের একটি রকেট। নভেম্বরের আট তারিখে মহাকাশযানটি চাঁদের কক্ষপথে পৌঁছায়। ১৪ই নভেম্বর চন্দ্রযান থেকে ‘ মুন ইমপ্যাক্ট প্রোব ‘ (এমআইপি) নামের অংশটি বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। পরিকল্পনামতো সেটি আছড়ে পড়ে চাঁদের বুকে।এতে তিনটি প্রযুক্তি ছিল, ভিডিও ইমেজিং সিস্টেম, রাডার অ্যাল্টিমিটার ও মাস স্পেক্ট্রোমিটার। মাস স্পেকট্রোমিটারটি ব্যবহৃত হয়েছিল চাঁদের বায়ুমণ্ডল পর্যালোচনার জন্যে।চন্দ্রযান-১ এর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য সাফল্য ছিল চাঁদে জলের (ওয়াটার আইস) অস্তিত্ব নির্ণয় করতে সাহায্য করা। চন্দ্রযানে করে পাঠানো নাসার এম-থ্রি এর পাঠানো তথ্য থেকে চাঁদের ভূমিতে হাইড্রোজেন-অক্সিজেন বন্ধনের প্রমাণ পাওয়া যায় (যা হাইড্রোক্সিল বা জলের সংকেত নির্দেশ করে)। আরো দুটি অভিযান থেকে পাওয়া তথ্যের সাথে মিলিয়ে নাসা সিদ্ধান্তে আসে যে, চাঁদে আসলেই জলজ বরফের অস্তিত্ব আছে।
এই অভিযান সফল হওয়ার পর বিজ্ঞানীরা বসেছিলেন না। সফল উৎক্ষেপণের পরই কাজ শুরু হয় দ্বিতীয় চন্দ্রজানের। এবারের আশা ছিল অনেক বড়।
২০১৯ সালের ২২ জুলাই। এই দিনেই চাঁদ অন্বেষণে আকাশছোঁয়া স্বপ্ন দেখতে শুরুর করেছিলেন ইসরোর বিজ্ঞানীরা। ইসরোর সতীশ ধাওয়ান স্পেস সেন্টারের গ্য়ালারিতে সেদিন ছিল ঠাসা ভিড়। ২০১৯ সালের ২২ জুলাই চাঁদে দিকে উড়ে গিয়েছিল চন্দ্রযান-২। সূচনা হয়েছিল ইতিহাসের এক নতুন অধ্যায়ের।শ্রীহরিকোটার সতীশ ধাওয়ান মহাকাশ কেন্দ্র থেকে জিওসিঙ্ক্রোনাস লঞ্চ ভেহিকেল মার্ক-III (GSLV Mk-III) রকেটের পিঠে চেপে চাঁদের উদ্দেশে পাড়ি জমিয়েছিল চন্দ্রযান-২। ২০১৯ সালের ২০ অগাস্ট প্রবেশ করে চাঁদের কক্ষপথে। তখনই চন্দ্রযান-৩-এর ল্যান্ডার ‘বিক্রম’-কে চাঁদের অবতরণ করানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গিয়েছিল।
ইসরোর প্রতিষ্ঠাতা বিক্রম সারাভাইকে সম্মান জানিয়ে তাঁর নামেই রাখা হয়েছিল ল্যান্ডারের নাম। চাঁদের দক্ষিণ মেরু অঞ্চলে ল্যান্ডার ‘বিক্রম’ সফল অবতরণের পর রোভার ‘প্রজ্ঞান’-কে প্রতিষ্ঠা করার কথা ছিল।
এই মিশনের উদ্দেশ্য ছিল চাঁদ নিয়ে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার । বিশেষত চাঁদের খনিজ শনাক্তকরণ, চাঁদের পৃষ্ঠের রাসায়নিক গঠন এবং উপরের অংশের থার্মো-ফিজিক্যাল বৈশিষ্ট্যের তথ্য অন্বেষণের মাধ্যমে চাঁদ সম্পর্কিত আমাদের জ্ঞানকে আরও প্রসারিত করাই ছিল লক্ষ্য। বহুদিন ধরেই বিজ্ঞানীরা এই মিশনের জন্য প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। অধ্যয়ন করা হয়েছিল খুঁটিনাটি বিষয়গুলিও। কিন্তু শেষ মুহূর্তে ঘটে অঘটন। হাজার পরিশ্রমের পরেও ব্যর্থ হয় চন্দ্রযান-২ মিশন।৭ সেপ্টেম্বর ২০১৯-এ ঘটে অঘটন। ওই দিন চাঁদের দক্ষিণ মেরু অঞ্চলে সফট ল্য়ান্ডিংয়ের কথা ছিল ল্যান্ডারটির। কিন্তু চাঁদের পৃষ্ঠ থেকে মাত্র ৩৩৫ মিটার দূরে থাকাকালীন ‘বিক্রম’-এর সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় ইসরোর। প্রাথমিক তথ্যনুসারে, সমস্যা হয়েছিল ফাইন ব্রেকিং-এর সময়। চাঁদের থেকে মাত্র ৫ কিলোমিটার দূরত্বে থাকার সময় গতির উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে ‘বিক্রম’। শেষ ২.১ কিলোমিটারে কোনও যোগাযোগই করা যায়নি সেটির সঙ্গে।পরে এই নিয়ে আরও পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালায় ব্যর্থতা বিশ্লেষণ কমিটি। জানা গিয়েছে সফটওয়্যারের ত্রুটির কারণেই চাঁদের পৃষ্ঠে ভেঙে পড়েছিল ‘বিক্রম’। তবে মিশনকে পুরোপুরি ব্যর্থ বলা যায় না। বরং আংশিক সাফল্যের মুখ দেখেছিল চন্দ্রযান-২। মহাকাশযানটির অরবিটারটি ঠিকভাবেই কাজ করেছে। অবতরণের আগের মুহূর্ত পর্যন্ত প্রতিটি ধাপই একেবারে কোনও সমস্যা ছাড়াই নির্বিঘ্নে পার করে গিয়েছিল চন্দ্রযান-২।
চন্দ্রযান-২-এর সঙ্গে পাঠানো অরবিটারটি বহু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাঠিয়েছে ইসরোকে। চাঁদের পৃষ্টে জলের অস্তিত্বের খোঁজ দিয়েছে চন্দ্রযান-২-এর অরবিটার। চাঁদের পৃষ্ঠে খুঁজে পেয়েছে হাইড্রক্সিল ও জলের অণু। এছাড়াও চাঁদের পৃষ্ঠে থাকা প্রচুর পরিমাণে খনিজের সন্ধান দিয়েছে এই অরবিটারটি।
চন্দ্রযান-২ এর ব্যর্থতা এবং সাফল ্য চন্দ্রযান-৩ এর পথ সুগম করেছে। ইসরোর লক্ষ্য ছিল চাঁদের দুঃখের মেরু অভিযান। দক্ষিণ মেরু জয় করতে ব্যর্থ হয়েছে রাশিয়া। তাই সাফল্যের উন্মাদনার মাঝে ছিল ব্যর্থতার চোরাবালি। কিন্তু, শেষমেষ সকলকে ভুল প্রমাণ করে ভারত ইতিহাস লিখলো। সে অক্ষর স্বর্ণের চেয়ে কম কি!
তবে প্রশ্ন আসতেই পারে চাঁদের দক্ষিণ মেরু নিয়ে কীসের এত উৎসাহ?
প্রথমত চাঁদের দক্ষিণ মেরুতেই জলের অনু দিয়ে তৈরি বরফের সন্ধান মিলেছেন। এই অংশে রয়েছে প্রচুর খনিজের সম্ভার।২০০৮ সালে চন্দ্রযান-১ তো বটেই আগেও একাধিক চন্দ্রাভিযানে চাঁদের এই অংশে জলের উপস্থিতি নজরে এসেছিল। বিজ্ঞানীদের মতে প্রাচীন এই জল-বরফ থেকে চাঁদ সৃষ্টির বিষয়ে অনেক অজানা তথ্য জানা যেতে পারে। যদি পর্যাপ্ত পরিমাণে সেখানে জলের উৎস থাকে, তবে পানীয় জল পাওয়ারও সম্ভাবনা রয়েছে।এই জল ভেঙে হাইড্রোজেন ও অক্সিজেন উৎপন্ন সম্ভব হলে জ্বালানি হিসেবে ও শ্বাসপ্রশ্বাস চালানোর জন্য ব্যবহার করা যাবে।চাঁদের গহ্বর বা ক্রেটারে খনিজের ছড়াছড়ি। ‘মুন মিনারালোজি ম্যাপার ইনস্ট্রুমেন্ট (এম-থ্রি)’ দিয়ে চাঁদের পৃষ্ঠে হদিশ মিলেছে বিভিন্ন খনিজের। এই হদিশ দিয়েছিল চন্দ্রযান-১।চাঁদের পৃষ্ঠে কী কী খনিজ রয়েছে তার সন্ধান করতেই ২০১৯ সালে চন্দ্রযান-২ এর ল্যান্ডার ‘বিক্রম’-কে ও রোভারকে পাঠিয়েছিল ইসরো। কিন্তু ‘বিক্রম’ চাঁদের মাটিতে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। ব্যর্থ হয়েছিল মিশন। তবে এবারের মিশন সফল হয়েছে। চন্দ্রযান-৩-এর রোভার সেই একই কাজ করবে। কাজ হবে চাঁদের রুক্ষ, পাথুরে পৃষ্ঠে ম্যাগনেসিয়াম, সিলিকন, অ্যালুমিনিয়াম, টাইটেনিয়ামের মতো খনিজ রয়েছে কিনা তার সন্ধান করা।বিজ্ঞানীরা খোঁজ পেয়েছেন, চাঁদের পৃষ্ঠে রয়েছে লোহা ও টাইটেনিয়াম অক্সাইড। চাঁদের পিঠে এক একটি বড় গহ্বরে যারপরিধি প্রায় ৫ কিলোমিটারের কাছাকাছি, সেখানেই জমে থাকতে পারে লোহা, টাইটেনিয়াম অক্সাইডের মতো মূল্যবান ধাতু। চাঁদের পিঠে ধাতুর খোঁজের সঙ্গেই তড়িদাহত কণাদের লাফালাফিও প্রত্যক্ষ করেছে এলআরও। চাঁদের ক্রেটার বা গহ্বর জুড়ে থাকে ধুলো বা রেগোলিথ (Regolith)। এই ধুলোতেই মিশে থাকে সোডিয়াম,ক্যালসিয়াম, অ্যালুমিনিয়াম, সিলিকন, টাইটেনিয়াম ও আয়রনের মতো খনিজ পদার্থ।১৯৬৭ সালে ইউনাইটেড নেশনের বহির্বিশ্ব চুক্তি বা আউটার স্পেস ট্রেইটি (Outer Space Treaty ) অনুযায়ী কোনও দেশ চাঁদকে নিজেরে সম্পত্তি বলে ঘোষণা করতে পারবে না। তবে চাঁদের বুকে বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ড চালানোর উপর কোনও নিষেধাজ্ঞা নেই। ১৯৬৯ সালে নীল আর্মস্ট্রংরা নেমেছিলেন চাঁদের উত্তর মেরুর একটি অংশে। তার পর থেকে এখনও পর্যন্ত চাঁদে যে ক’টি সফল অভিযান হয়েছে সবই চাঁদের নিরক্ষীয় অঞ্চলকে কেন্দ্র করে। এই প্রথমবার চাঁদের দক্ষিণ দুয়ারে পা পড়ল ভারতের। ভারতের এই সাফল্যের গোটা দেশ শুধু নয়, গোটা বিশ্ব খুশি। আসলে বিজ্ঞান মানুষকে এক জায়গায় নিয়ে আসে। বিকেল বাড়ি সফলতার ঝুলি খুলে মানুষের মনের সংকির্ণতার বাঁধনকে আলগা করে তোলে। তাই আমাদের দেশে নানা বৈচিত্র্য থাকা সত্ত্বেও, বাঙালি থেকে হিন্দিবাসি তথা দক্ষিণ ভারতীয় নাগরিকরা একযোগে ভারতবর্ষকে চুড়ায় দেখতে চায়। যে দেশ শিল্প সংস্কৃতির দিক থেকে গোটা বিশ্বকে চমকে দিচ্ছে, সে দেশ বিজ্ঞানের হাত ধরে চরম শিখরে পৌঁছবে না তা কি কখনো হয়!
চন্দ্রযান থেকে সৌরযান – সমাপ্ত
আপনাদের লেখা আমাদের ওয়েব সাইটে জমা দিতে গেলে, অনুগ্রহ করে আমাদের লেখা-জমা-দিন মেনু-তে ক্লিক করুন ও নিজেকে Author হিসেবে Register করুন এবং আমাদের পরবর্তী আপডেট পেতে আমাদের ফেসবুক পেজ অনুসরণ করুন।
অন্যান্য
ভোগবাদ কি প্রয়োজনীয় ?