দুই বোকার চালাকি ছোট গল্প – রুচিরা মুখোপাধ্যায় দাস
– ” বুঝলি ভোম্বল, উপায় কিন্তু কিছু একটা বার করতেই হবে। নইলে সত্যিই আর চলেনা! ”
– ” উপায় শুধু নয় , ওই ভজহরি মজুমদারকে যতক্ষণ পর্যন্ত না জব্দ করতে পারছি..,. নাক বেড় দিয়ে কান ঘোরানো তোমার বার করছি ভজহরি।”
– ” তোর তো শুধু মুখে বড়ো বড়ো কথা, কাজের বেলা তো অস্টরম্ভা।”
– ” তবে শোন ফটকে ওই ভজহরি মজুমদারকে জব্দ করতে না পারলে আমার নাম ভোম্বল সরদার নয়। “
শুধু ভোম্বল বা ফটকে নয়, ওই ভজহরি মজুমদারের ওপর পাড়ার সকলেরই এখন ভীষণ রাগ।
পূব পাড়ার ভজহরি মজুমদারের বেশ নাম ডাক। শুধু বিরাট পয়সা বা সম্পত্তির মালিক হিসাবেই নয় – কিপটে হিসাবেও বেশ নাম আছে। স্কুল কলেজ অফিস – যেকোনো কাজই হোকনা কেন ভজহরি বাবুর জমির ওপর দিয়েই যাতায়াত ছিল পাড়ার লোকেদের। তাই পিছনে পিছনে গালাগালি দিলেও সামনা সামনি গলাগলি করতে কিন্তু কেউই ভুল করত না।
ভজহরি বাবুর সম্পত্তি অগাধ। বাঁশ বাগান, আম বাগান, জাম বাগান , বাড়ির দুদিকে দুটো পুকুর – কোনো কিছুরই ঘাটতি নেই তার। কিন্তু এত বড়ো সম্পত্তি হলো কিভাবে! এই সম্পত্তি তার বাবার না ঠাকুরদার সে কথা কিন্তু কারও জানা ছিল না। ভজহরি বাবু নিজেও যে কি কাজ করতো, তাও যেনো কেমন রহস্য জনক। কারও মুখে শোনা যায় তার পুকুরের মাছ বিক্রি করেই তার রোজগার, কেউবা বলে বাঁশ বাগানের বাঁশ বিক্রি করে, আবার কারও মতে আম, জাম তার এত ভীষণ পরিমাণে হয় যে একমাসে বিক্রি করে নাকি তার বারো মাস চলে যায়। অবশ্য ভোম্বল আর ফটকের দাবি একমাসে ভজহরি বাবুর আম জাম নাকি তারাই শেষ করে!
আপাতত ভজহরি বাবুকে সবাই সামনাসামনিই গালাগালি দিতে শুরু করেছে।কারণ ভজহরি বাবুর জমির ওপর দিয়ে এখন আর পাড়ার একটি লোকও চলাফেরা করতে পারেনা। অজুহাতে শোনা যায়, শুধু পাড়ার লোক নয় , তার জমির ওপর দিয়ে নাকি চোর ডাকাতদের ও যাওয়া আসা হয়।তার বাড়িতেও নাকি একবার চুরি হয়ে গেছে।
পাড়ার সকলের রাগের থেকে ভোম্বল আর ফটকের রাগটা ছিল বোধয় একটু বেশি। তাই তারা আজ শলাপরামর্শে মশগুল। তাদের দিনের খাওয়া, রাতের ঘুমও প্রায় বন্ধ।তবুও ঠিক মত বুদ্ধি বার করতে কেউই যেন আর পারে না। আর পারবেই বা কি করে! ভোম্বল ঘষে ঘষে ক্লাস ফাইফ পর্যন্ত উঠে কতবার যে কতগুলো স্কুল পাল্টেছে তা সকলেরই অজানা। সে নিজেও বোধয় ঠিক মত বলতে পারবে না। আর ফটকে? সে এখন বাবার মুদির দোকানে অতি কষ্টে হাতের কর গুনে হিসাব করে। দুজনে অন্তরঙ্গ বন্ধু ঠিকই, কিন্তু তাদের চেহারা ছিল সম্পূর্ণ বিপরীত। ভোম্বল এর “ভ” অক্ষর ঠিক যতটা বিস্তৃত করে ভাবা যায় ভোম্বল ঠিক ততটাই। আর ফটকে ? ভোম্বল এর পাশে সে হাঁটলে সহজে তাকে চোখে পড়ে না।
হঠাৎ একদিন মোরগের ডাক শোনার আগেই ভোম্বল শুনতে পেল ফটকের ডাক। এক লাফে বিছানা থেকে উঠে পড়ল ভোম্বল। ভম্বলকে দেখা মাত্রই ফটকের শুরু হলো তাণ্ডব নৃত্য। ঘুম চোখে ভোম্বল বড়ো বিরক্ত হয়ে বলে উঠল –
– ” ওই চেহারায় আর লাফাসনা ফটকে।”
– ” লাফাবনা! বলিস কী! সারা রাত ধরে ভেবে ভেবে… উঃ, দারুণ বুদ্ধি। তবে হ্যা, বুদ্ধি যখন আমি বার করেছি পরিশ্রম কিন্তু তোমার।”
– ” পরিশ্রম না হয় করলাম। কিন্তু বুদ্ধিটা কি? “
– ” কিচ্ছু না, তোকে শুধু কটা ইট বইতে হবে। আর বেড়া গুলো খুলে রাখার দয়িত্ব আমার।”
– ” আমি কিন্তু এখনও কিছুই বুঝতে পারলাম না ! “
ফটকে লাফিয়ে উঠে বলল –
– ” ওরে দারুণ বুদ্ধি। তোকে আর নাক বেড় দিয়ে কান ধরে স্কুল যেতে হবে না। আর আমিও আবার কত তাড়াতাড়ি আবার আগের মতো দোকানে পৌঁছে যাব।”
ভোম্বল একটু বিরক্ত হয়েই বলল –
– “কিন্তু বুদ্ধিটা কি সেটা তো বলবি?”
– ” বেড়া গুলো একটু আলগা করে দেব। ওপর থেকে দেখে মনে হবে কিছু বোঝা যাবে না।কিন্তু আমরা এই বেড়াগুলো খুব সহজে খুলে ফেলতে পারব।”
ভোম্বল এর মুখ কিন্তু তখনও কাঁচুমাচু। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে সে বলল –
-” ভজহরি বাবুর বাগানে যা কাদা! আমি একবার পড়লে আর উঠতে পারবো বলে তো মনে হয় না। “
ফটকে হাসতে হাসতে বলল –
“- সেই জন্যে ই তো বলছি তোকে শুধু কটা ইট পাতাতে হবে। ”
ফটকের বুদ্ধি ভম্বলকে বোঝাতে বোঝাতেই দিনের আলো ফুটে উঠল। দিনের আলোয় ভজহরি বাবুকে ফাঁকি দিয়ে বেড়া আলগা করতে তাদের সাহসে কুলালো না। তারা ঠিক করলো রাত দুটোর সময় তারা তাদের কাজ সারবে।
সমস্ত পাড়া যখন ঘুমে অচৈতন্য – তখন বাড়ির লোককে ফাঁকি দিয়ে চুপি চুপি ভোম্বল আর ফটকে গিয়ে পৌঁছল ভজহরি বাবুর বাগানে।সীমিত টর্চের আলোতে ফটকে আঁতকে উঠে বলল – ” ওরে ভোম্বল এ যে কাদায় কাদা। তুই ইট না পাতালে আমি বেড়া আলগা করি কি করে!”
– ” একটু সময় দে আমি ইট নিয়ে আসছি।”
ফটকে রাম নাম করতে লাগলো। ততক্ষণ ভোম্বল নিয়ে এলো ইট। রাম নাম করতে করতে বেড়া আলগা করলো ফটকে। এদিকে ভূতের ভয়ে ভোম্বল এর হাত পা ঠান্ডা।
” ওরে ফটকে তাড়াতাড়ি কর । আমি আর অন্ধকারে কতক্ষণ দাড়িয়ে থাকব!”
– ” তাড়াতাড়ি বললেই কি হলো অত সোজা নাকি! সবে দুখানা আলগা করেছি। আমি যেতে পারব। কিন্তু তোর যা চেহারা আরো দুটো আলগা না করলে তুই তো কাত হয়েও ঢুকতে পারবি না।”
বেশ কষ্ট করেই তারা তাদের বুদ্ধিটা কাজে লাগালো।
পরদিন সকালে আরও খানিকটা সময় বিছানায় গড়িয়ে ধীরে সুস্থে ফটকে দোকানে যাবার জন্য বের হলো। ভজহরি বাবুর বাগানে ঢোকার আগে ফটকের একটু একটু ভয় করতে লাগল। ভজহরি যদি টের পায় তবে তাকে আর অস্ত রাখবে না।কিন্তু এ কী! সেই ইট গুলো কোথায় গেলো! কাল যেগুলো ভোম্বল পাতিয়েছিল। ফটকে আশ পাশে অনেক খুঁজে দেখলো, কিন্তু কোথাও খুঁজে পেলো না। সে চলে গেল ভোম্বল এর বাড়িতে। ভোম্বল এর তখনও নাক ডাকছে। ভোম্বলকে ঘুম থেকে টেনে তুলে ফটকে চুপি চুপি সব বলল।সত্যিই তো অবাক কাণ্ড ! কী করে হয়! ভোম্বল আশ্বাস দিয়ে বলল – ” আজ আর কী হবে! দিন দুপুরে তো আর ইঁট পাতান যাবে না। আজকের দিনটা ঘুরে ঘুরেই স্কুলে যেতে হবে। “
সেদিনকার মতো তাদের প্ল্যান প্রোগ্রাম সবই ভেস্তে গেলো। ভোম্বল আবার রাতে ইঁট পতাল।সঙ্গে থাকল ফটকে। শুধু সেদিন রাতেই না, এমন ভাবে বেশ কয়েক মাস ধরে তারা রাতে এসে ইঁট পাতায় আর সকালে উঠে নাক বেড় দিয়ে কান ধরে। ভোম্বল এর ধারনা
-” ভজহরি বাবু ঠিকই বলেছেন। রাতে চোর ডাকাতদের উপদ্রপ। চোরেরা আমাদের সমস্ত ইট চুরি করে প্রতিদিন।”
আর ফটকে বলে – ” আমার মনে হয় চোর না, ভূতে এসে আমাদের ইট নিয়ে যায়। চোর ইট নিয়ে কী করবে!”
ভোম্বল এর প্রশ্ন – ” ভূতেই বা ইট নিয়ে কী করবে?”
এমন ভাবে কেটে গেলো বেশ কিছুদিন। তারা ঠিক করলো একদিন সমস্ত রাত জেগে তারা ইট পাহাড়া দেবে। দেখবে কে এসে তাদের ইট চুরি করে। চোর? না ভূত?
সমস্ত রাত জেগে ইঁট পাহাড়া দিল তারা। কিন্তু কী অদ্ভুত! চোর ভূত কেউই এলো না! ভোম্বল বলল – ” আজ বোধয় আর ইঁট চুরি হবে না, কাল মহানন্দে স্কুলে যাওয়া যাবে।
কিন্তু পর দিনও একই কান্ড। ইঁট উধাও। তবে নিচ্ছে কে ইঁট! তবে ফটকের কথাই কী ঠিক!সবার আড়ালে ভূত তাদের ইঁট চুরি করে! ফটকে ভয়ে ভয়ে বলল – ” ছেড়ে দে ভোম্বল আমরা ঘুরে ঘুরেই আসা যাওয়া করব।”
ভোম্বল ও ফটকের কথায় সম্মতি জানাল।
এখন তাদের রোজ রাতেই ঘুম হয়। কারণ তারা ভজহরি বাবুর বাগান দিয়ে যাবার কথা কল্পনাও করে না। কিন্তু কী সর্বনাশ! দুদিন বাদে ভজহরি বাবু নিজেই এলেন ভোম্বল এর বাড়িতে। ভোম্বল এর বাবা তখন বাজারের ফর্দের হিসাব মেলাচ্ছেন। ভোম্বল কে হাক ডাক করতেই তিনি বেরিয়ে এলেন – ” কী ব্যাপার। ভজহরি বাবু , আপনি? “
– ” ভোম্বল কোথায়? ভোম্বল? আমার ওর সঙ্গে দরকার।”
বাড়ির ভেতর থেকে ভোম্বল বেড়িয়ে এল। ভোম্বল কে দেখা মাত্রই ভজহরি বাবুর প্রশ্ন –
– ” তা বাবা ভোম্বল, তোমার কি শরীর খারাপ? দুদিন হলো ইঁট পাতাচ্চ না! আমি সবে দোতলার ওপর তিন তলা তুলতে যাচ্ছি।”
ভোম্বল এর বাবা বেশ অবাক হয়ে বলে উঠলেন – ” আপনার বাড়িতে তিনতলা উঠছে আর আমার বাড়ি থেকে ইঁট উধাও হচ্ছে! ”
সামনে দাড়িয়ে ছিলো ফটকে। আর বিলম্ব না করে সে এমন ভীষণ দৌড় লাগল যে সবার নাগালের বাইরে। আর ভোম্বল? সে তার চেহারার ভারে বাড়ির উঠোন পার হতে না হতেই ধপাস করে আছাড় খেল কাদায়। আর তার সাথে শুরু হল তার বাবার বেদম মার।।
দুই বোকার চালাকি ছোট গল্প – সমাপ্তি
আপনাদের লেখা আমাদের ওয়েব সাইটে জমা দিতে গেলে, অনুগ্রহ করে আমাদের লেখা-জমা-দিন মেনু-তে ক্লিক করুন ও নিজেকে Author হিসেবে Register করুন এবং আমাদের পরবর্তী আপডেট পেতে আমাদের ফেসবুক পেজ অনুসরণ করুন।
অন্যান্য
ভরুয়া
উদ্বর্তিনী
নীলবাস্প