কলম পাতুরি

ভাবনা আপনার প্রকাশ করবো আমরা

Home » পুজো সংখ্যা ১৪৩১ » বরফের ছুরি

বরফের ছুরি

বরফের ছুরি রহস্য গল্প – রানা জামান

রাত দশটা।

বাবা ফোনকল না ধরায় চিন্তায় পড়ে গেলো সামিরা। বেশ কয়েক বার কল করলো ও। এমনটা হয় না কখনো। মনে প্রশ্ন ওর: বাবার ফোনে কি চার্জ নেই? বিদেশ গিয়ে এমনটা করা কি ঠিক? কোথায় আছেন এখন বাবা? ডাক্তার দেখানো হয়েছে কি? কী বললেন ডাক্তার? আমার বাবা কি ঠিক আছেন? প্রিয় বাবা আমার! মা কি ফোন করেছিলেন কখনো? যাই, মাকে জিজ্ঞেস করি গিয়ে।
মোবাইল ফোন হাতে নিয়ে সামিরা বেরিয়ে এলো নিজ কক্ষ থেকে। মার কক্ষের দরজা ভেজানো ছিলো। টোকা দিয়ে মার অনুমতি পেয়ে ভেতরে ঢুকে দরজা ভেজিয়ে দিলো সামিরা। সাবিহা নেছার মোবাইল ফোনের পর্দায় স্ক্রল করে যাচ্ছেন। সামিরা বিছানায় মুখোমুখি বসে তাকিয়ে রইলো মার দিকে।
মেয়ের দিকে না তাকিয়ে সাবিহা নেছার বললেন, তুই কি আমার দিকে তাকিয়ে থাকার জন্য এসেছিস, না কিছু বলবি?
সামিরা লজ্জা পেয়ে দৃষ্টি অন্যদিকে সরিয়ে বললো, একটা কথা জিজ্ঞেস করতে এসেছিলাম; কিন্তু এখন তোমার দিকে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করছে।
সাবিহা নেছার মুচকি হেসে বললেন, পাগলী মেয়ে! তাহলে এখন অন্যদিকে তাকালি কেনো?
মনে পড়েছে মা।
কী কথা?
বাবাকে ফোনে পাচ্ছি না। তোমাকে কি কল করেছিলো?
নাহ!
বাবার কী হয়েছে মা? প্রতিমাসে দুই/তিনবার কলকাতায় যাচ্ছেন। জটিল রোগ হয়ে থাকলে সিঙ্গাপুর বা ব্যাংকক যেতে পারেন।
আমাকেও রোগের ব্যাপারে তেমন কিছু বলে না তোর বাবা। আমার সন্দেহ হয় তোর বাবা ব্যবসার কাজেও কলকাতা যায়।
কলকাতায় কিসের ব্যবসা মা?
জানি না! তোর বাবা সব কথা আমাকে বলে না।
স্বামী-স্ত্রীর এ কেমন সম্পর্ক তোমাদের মা?
বিয়ের পরে তুইও বুঝতে পারবি। সকল স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক সমান না।
সামিরা মার আরেকটু ঘনিষ্ট হয়ে বললো, তুমি কি বাবার সাথে সুখী নও মা?
অধিকাংশ বাঙালি মেয়েরা স্বামীর সাথে সুখী হতে পারে না; এডজাস্ট করে নেয়।
তাহলে তুমিও এডজাস্ট করে নিচ্ছো।
অনেকটা তাই।
কেনো মা?
আরেকদিন বলবো। এখন তোর বাবার খোঁজ কর। ফোনে না পেলে থানায় যা। তোর বাবা তিন তিনবারের এমপি। থানার ওসি ব্যস্ত হয়ে যাবে খোঁজ নেবার জন্য।
আজ রাতটা দেখি মা। আমি যদি ফোনে না পাই, বা বাবা কল না করেন, তাহলে সকালে ছুটে যাবো থানায়। ব্যতিব্যস্ত করে ফেলবো ওসিকে ফর সিউর!
সাবিহা নেছার ডান হাতে মোবাইল ফোন ধরে দুই হাত মেয়ের দিকে বাড়িয়ে ধরে বললেন, আয় একটা হাগ দেই।

সামিরা মায়ের কোলের কাছে এসে বসলে সাবিহা নেছার দু’হাত বাড়িয়ে জড়িয়ে ধরলেন মেয়েকে। সামিরাও জড়িয়ে ধরলো মাকে।

মেয়েকে জড়িয়ে ধরে রেখে সাবিহা নেছার বললেন, শাহরুখ খানের একটা সিনেমা দেখতে ইচ্ছে করছে রে মা!

সামিরাও ওভাবে মায়ের বুকে লেপ্টে থেকে বললো, কোনটা মা? ডিডিএলজি?

ডিডিএলজি মানে?

দিলওয়ালে দুলহানিয়া লে যায়েঙ্গে।

ওটা বহুবার দেখেছি। নতুন একটা সিনেমার নাম বল। ইদানিং সিনেমার নাম মনে থাকছে না।

ডানকি?

ডানকিটা ভালো। তবে ওটা না। মারামারির একটা সিনেমার নাম বল।

পাঠান জোয়ান।

দুটোই চমৎমার সিনেমা। তবে এখন জোয়ান দেখতে ইচ্ছে করছে। তোর কাছে আছে রে মেয়ে?

সামিরা মার বুক থেকে উঠে বললো, কোনো সমস্যা নাই। আমি এখনই ডাউনলোড করে নিয়ে আসছি। তুমি সপুরাকে চা করতে বলো।

সাবিহা নেছার বললেন, ও চা করতে পারে না, জানিস তুই। আমি চা করে আনছি। তুমি ছবিটা ডাউনলোড করে নিয়ে আয়।
চায়ের কাপ ও টোস্ট সামনের টি-টেবিলে রেখে মা-মেয়ে শাহরুখ খানের জোয়ান দেখতে বসে গেলো। কিন্তু ছবি শেষ হবার আগেই দু’জন সোফায় হেলান ঘুমিয়ে হয়ে গেলো লাশ! পরদিন সকাল আটটায় ঘুম ভাংলে ধড়ফড়িয়ে উঠে বসলো সামিরা। দেয়াল ঘড়িতে সময় দেখে প্রথমে নিজের মোবাইল ফোনটা দেখলো। কোনো কল আসে নি। সামনের টি-টেবিলের উপর থেকে মার ফোনটা নিয়ে কললগ দেখলো: কোনো কল আসে নি। তাহলে বাবা কোথায়? এখনই যেতে হবে থানায়। মাকে ডেকে তুলে দুটো ফোনের কললগ দেখিয়ে থানায় যাবার কথা বললো।
সাবিহা নেছার হাই তুলতে তুলতে যা বললেন তা বুঝতে না পেরে সামিরা বললো, কী বলছো মা? হাই শেষ করে বলো!
সাবিহা নেছার হাই মুখের সামনে একবার তুড়ি বাজিয়ে বললেন, বেশি টেনশান করিস না। তোর বাপ মাঝে মাঝেই এভাবে কলকাতা গিয়ে গায়েব হয়ে যায়! আমি জিজ্ঞেস করলে বলে বিজনেসের জন্য মাঝে মধ্যে গায়েব হয়ে যেতে হয়।

তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে বাবা রহস্যময় কোনো ব্যবসা করেন!
আমি ঠিক জানি না রে।
এটা কেমন কথা মা? বাবার আসল ব্যবসা কী, সেটা কি তুমি জানো মা?
সাবিহা নেছার থতমত খেয়ে বললেন, না মানে আমিও পুরাটা জানি না!
তেইশ বছরের বিয়ের জীবনে বাবা কী ব্যবসা করে সেটা তুমি জানো না? আশ্চর্য মা! এখন থানায় চল।
রাত জেগে আমার ক্ষিধে পেয়েছো! নাস্তাটা খেয়ে যাই?
সামিরা বিস্মিত হয়ে বললো, বাবার নিরুদ্দেশ হওয়া নিয়ে তুমি এতো নির্লিপ্ত থাকতে পারছো কিভাবে মা?
কারণ তোর বাবাকে আমি হাড়ে হাড়ে চিনি! কাজের মেয়েগুলা নিশ্চয়ই নাস্তা তৈরি করে ফেলেছে। নাস্তাটা খেয়েই থানায় যাবো।

এক ঘণ্টা পর। উলটচণ্ডাল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ইন্সপেক্টর আক্কাসের সামনে বসে আছে মা ও মেয়ে। ইন্সপেক্টর আক্কাসকে বেশ তটস্থ দেখাচ্ছে। কিভাবে আপ্যায়ন করবে ওদের বুঝতে পারছেন না। মাননীয় সংসদ সদস্য নেছারউদ্দিনের কাছে নালিশ করলে খবর আছে! এক মিনিটের মধ্যে পুলিশ লাইনে ক্লোজড! কত দিন বা কত বছর পঁচতে হবে আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না! সহজ হবার চেষ্টা করে ইন্সপেক্টর আক্কাস জিজ্ঞেস করলেন, কফির সাথে কী দেবো ম্যাডাম? কী কফি খাবেন? ক্যাপাচিনো, নাকি এসপ্রেসো?
উদ্বিগ্ন সামিরা একটু রুক্ষ কণ্ঠে বললো, যেটা পাওয়া যায়, সেটাই আনান! কোনো নাস্তা আনার প্রয়োজন নাই!
বিগলিত হেসে ওসি আক্কাস বললেন, তা কী হয় মা! তোমরা তো দৈনিক থানায় আসো না। তোমাদের আপ্যায়নে কমতি হলে স্যার ভীষণ রাগ করবেন।
কলবেল টিপে দিলে রাইফেল কাঁধে এক সিপাই ঢুকলে ওসি আক্কাস বললেন, তিনটা এসপ্রেসো কফি, স্পেশাল! সাথে তিনটা প্লেটে তিনটা সমুচা, গরম সমুচা। তাড়াতাড়ি আনবা! যাও!
সিপাই চলে গেলে সামিরা আক্কাসকে জিজ্ঞেস করলো, কলকাতা যাবার পরে বাবা কী কখনো কন্টাক্ট করেছে আপনার সাথে ওসি আঙ্কল?
এখনো করেন নাই। আপনাদের সাথে যোগাযোগ করেন নাই স্যার?
না। আমি কয়েকবার রিং করেছিলাম। ঢুকে না।
টেনশান নিয়েন না ম্যাডাম। আপনাদের কল না দিলেও আমাকে কল দিবেন। অন্তত আসার আগে কল দিবেনই। স্যার তো ল্যান্ডপোর্ট দিয়ে গেছেন ম্যাডাম?
হাঁ। বাংলাবন্দ দিয়ে।
তখন দু’জন সিপাই ঢুকলো ভেতরে: একজনের হাতে সমুচা ও তিন বোতল পানি এবং আরেকজনের হাতে কফির ট্রে। ওরা ট্রে দুটো ওসির সামনে নামিয়ে দিয়ে চলে গেলো। ওসি আক্কাস ট্রে দুটো সামান্য ওঁদের দিকে ঠেলে দিয়ে বললেন, আপনারা কফি পান করতে থাকুন ম্যাডাম, আমি বাংলাবন্দের কাস্টমস অফিসারের সাথে কথা বলছি।
মা ও মেয়ে আক্কাসকে একবার দেখে কফির কাপ টেনে নিলো। আর ওসি আক্কাস মোবাইল ফোনে বাংলাবন্দের কাস্টমস অফিসার মতিন মোকাদ্দেসকে রিং করে মোবাইল ফোন কানে ঠেকালেন। ওদিকের সাড়া পেয়ে বললেন, চিৎপটাং জেলার উলটচণ্ডাল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আক্কাস আবেদিন বলছি!
ওদিক থেকে কাস্টমস অফিসার মতিন বললেন, আখ গাছ! আখ গাছ কারো নাম হয় নাকি?
আখ গাছ না আক্কাস; সরে-আ ক য় কয় সংযুক্ত আকার দন্ত স! আক্কাস!
ওসি আক্কাসের কথা শুনে বিষম খাওয়ার উদ্রেক হলে দুই হাতে মুখ চেপে ধরে তা থামাতে চেষ্টা করছে মা ও মেয়ে দু’জন।
ওদিক থেকে মতিন মোকাদ্দেস বললেন, সরি আক্কাস সাহেব! কী সেবা করতে পারি আপনার?
উলটচণ্ডাল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ইন্সপেক্টর আক্কাস বললেন, আমাদের এলাকার মাননীয় সংসদ সদস্য নেছারউদ্দীন আহমেদ বাংলাবন্দ ল্যান্ডপোর্ট দিয়ে কলকাতা গিয়েছেন। কখন বর্ডার ক্রস করেছেন বলতে পারবেন অফিসার?
একদিন আগে; মানে শনিবার বিকেল পাঁচটায়। কেনো? বলুন তো ওসি সাহেব?
কলকাতায় যাবার পরে স্যারের কোনো ট্রেস পাওয়া যাচ্ছে না।
কলকাতায় বাংলাদেশের ডেপুটি হাইকমিশনের অফিস আছে। ওদের একটিভ করেন; তাহলে কলকাতা পুলিশ তৎপর হয়ে খুঁজে বের করে ফেলবে মাননীয় সাংসদকে।
ওসি আক্কাস মোবাইল ফোনটা টেবিলে রাখলে সাবিহা নেছার জিজ্ঞেস করলেন, কী বললো কাস্টমস অফিসার?
আমাদের স্যার একদিন আগে শনিবার বিকেল পাঁচটায় বর্ডার ক্রস করেছেন। কাস্টমস অফিসার বললেন কলকাতার ডেপুটি হাইকমিশনারের সাথে যোগাযোগ করতে।
নেছার উদ্দীন বাংলাদেশের জাতীয় সংসদের সদস্য হওয়ায় ওসি আক্কাসের কল পেয়ে কলকাতার ডেপুটি হাইকমিশনার নেংটি পরে নেমে পড়লেন কাজে। কলকাতার পুলিশ কমিশনারকে ঘটনা জানালে পুলিশের একটা দল চলে এলো কলকাতা সীমান্তের কাস্টমস অফিসে। খাতাপত্র দেখে কাস্টমস অফিস জানালো: সাংসদ নেছার উদ্দীন আহমেদ একা সীমান্ত অতিক্রম করেন নি, ওঁর সাথে আরো চারজন ছিলো; তন্মধ্যে একজন যুবতী।


সিসিটিভি থেকে গাড়ি ও নম্বর টুকে নিলো কলকাতা পুলিশ। মেট্রোপলিটান পুলিশের কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ কক্ষে এসে দায়িত্বপ্রাপ্ত ইন্সপেক্টর হারাধন সিসিটিভিতে ঐ গাড়িকে অনুসরণ করতে লাগলেন।গাড়িটা কলকাতার শহরতলির ঝুমকোলতা আবাসিক এলাকায় ঢুকলো। চারজন নামলে গাড়িটা বের হয়ে এলো ঝুমকোলতা থেকে।
ইন্সপেক্টর হারাধন সঙ্গীদের বললেন, আমাদের এখনই ঝুমকোলতা আবাসিক এলাকায় যেতে হবে। ইন্সপেক্টর হারাধন চারজন সিপাই নিয়ে চড়লেন পিকাপে। পিকাপ চললো ঝুমকোলতা আবাসিক এলাকার দিকে। পুলিশের পিকাপ ঝুমকোলতা আবাসিক এলাকায় ঢোকার সাথে সাথে বাসিন্দারা পর্দার ফাঁক গলে, জানালার সার্সি সরিয়ে, যারা একটু বেশি সাহসী ওরা ব্যালকনিতে এসে অনুসরণ করতে থাকলো পিকাপের গতিবিধি। দারোয়ানগুলো তটস্থ হয়ে ইন্সপেক্টর হারাধনের সামনে এসে অনভ্যস্ত হাত-পায়ে স্যালুট ঠুকে দাঁড়ালো। দারোয়ান রেকর্ডপত্র দেখালো: বাংলাদেশের জাতীয় সংসদের সাংসদ নেছারউদ্দীন আহমেদ তিন তলার থৃ-বি এপার্টমেণ্টে উঠেছিলেন চারজন সঙ্গীসহ। এই এপার্টমেণ্টের মালিক একজন ইন্ডিয়ান; নাম প্রতাপ পাল চৌধুরী।
এই তিন দিন সাংসদ নেছার উদ্দীন আহমেদ ও ওঁর সঙ্গীরা ক’বার বাইরে গেছে জানতে চাইলে দারোয়ান বললো, দুই দিন কেউ বাইরে যায় নাই ছার। গতকাইল সকালে একজন আইছিলো।
কে?
দারোয়ান রেকর্ড দেখে বললো, জিতেন্দ্র।
হু। তারপর?
বিকালে চার জন বাইর হয়া গেছে লাগেজ নিয়া। আর আসে নাই ছার।
ঠিক আছে। সিসিটিভি দেখতে হবে। কোথায় কণ্ট্রোল রুম?
আমার রুমটার পাশের রুমটা ছার।
ইশারায় ওদিকে যেতে বলে ইন্সপেক্টর হারাধন ওর পিছু নিলো। কণ্ট্রোল রুমে ঢুকে মনিটরের সামনে বসলেন। জিতেন্দ্রকে দেখে চমকে উঠে বললেন, এ কখন ঢুকলো?
ওর নামই জিতেন্দ্র ছার!
ইন্সপেক্টর হারাধন পাশে দাঁড়ানো সিপাহির দিকে তাকিয়ে বললেন, এতো কসাই গাবড়ু!
সিসিটিভির ফুটেজ দেখতে লাগলেন ইন্সপেক্টর হারাধন। বিকেল পাঁচটায় কসাই গাবড়ুসহ চার জনকে বেরিয়ে যেতে দেখা গেলো। কসাই গাবড়ু খালি হাতে ঢুকলেও একটা বেশ বড় স্যুটকেসকে টেনে নিয়ে যেতে দেখা গেলো; কিন্তু ওদের মাঝে সাংসদ নেছার উদ্দীন আহমেদ নেই।
প্রশ্নটা মনে আসতেই শরীরের সকল লোম দাঁড়িয়ে গেলো ইন্সপেক্টর হারাধনের। নিশ্চয়ই কাউকে খুন করে ঐ লাগেজে করে নিয়ে গেছে কসাই গাবড়ু। কাকে? নেছার স্যারকে? কী সর্বনাশ! সটান দাঁড়িয়ে বললেন, এখন ঐ রুমে যাবো। চাবি নিয়ে আসো দারোয়ান!
দারোয়ান বললো, চাবি সোসাইটির সেক্রেটারির কাছে থাকে ছার।
আমার কথা বলে ওর কাছ থেকে চাবি নিয়া আসো। আমি উপরে যাচ্ছি। কুইক!
ঐ কক্ষে ঢোকে হতভম্ব হয়ে গেলেন ইন্সপেক্টর হারাধন। কক্ষ একেবারে পরিপাটি; মনে হচ্ছে কেউ ছিলো না এই কক্ষে। ইন্সপেক্টর হারাধন সরাসরি ওয়াশরুমে ঢুকে পাশে হাত বাড়ালে সঙ্গীয় সিপাই পকেট থেকে একটা আতশ কাঁচ বের করে হাতে দিলো। ইন্সপেক্টর হারাধন আতশ কাঁচ দিয়ে কমোডের কিনার, মেঝের ভাঁজ ও কিনারা পরীক্ষা করে রক্তের চিহ্ন দেখতে পেলেন। সোজা হয়ে সিপাইকে বললেন, এখানে কাউকে খুন করা হয়েছে। ফরেনসিক টিমকে আসতে বলো। তোমরা এখানে থাকো। আমি কমিশনার স্যারের কাছে গেলাম।

ইন্সপেক্টর হারাধন পিকাপে চড়ে চলে এলেন পুলিশ কমিশনারের অফিসে। চেম্বারে ঢুকে কড়া শব্দে স্যালুট ঠূকে পুলিশ কমিশনার রাজেশ সিপ্পির সামনে সটান দাঁড়ালেন। পুলিশ কমিশনার রাজেশ সিপ্পি ওর দিকে তাকালে ঘটনা বলতে থাকলেন ইন্সপেক্টর হারাধন।
ঘটনা শুনে পুলিশ কমিশনার রাজেশ সিপ্পি বললেন, আমাদের এখনই বাংলাদেশের ডেপুটি হাইকমিশনারের অফিসে যেতে হবে।

পুলিশ কমিশনার রাজেশ সিপ্পি দ্রুত চেয়ার ছেড়ে দ্রুত হাঁটতে থাকলেন; পিছু নিলেন ইন্সপেক্টর হারাধন। জিপে চড়ে পুলিশ কমিশনার ইন্সপেক্টর হারাধনকে নিয়ে চলে এলেন বাংলাদেশের ডেপুটি হাইকমিশনার শেখ সালাউদ্দীনের গোপন অফিসে।
ঘটনা শুনে ডেপুটি হাইকমিশনার শেখ সালাউদ্দীন জিজ্ঞেস করলেন, কসাই গাবড়ু কে?
পুলিশ কমিশনার রাজেশ সিপ্পি বললেন, গাবড়ু বাংলাদেশ থেকে এসে কলকাতায় কোনো কাজ না পেয়ে কসাই-এর কাজ শুরু করে এবং মাঝে মধ্যে অপজিশন পার্টির মিছিল মিটিং-এও যেতো। মাইগ্রেটেড জেনে অপজিশন পার্টি ওকে হীন স্বার্থে ব্যবহার শুরু করে। এখন সে আর পশু জবাই করে না- মানুষ জবাই করে কুখ্যাত গাবড়ু কসাই-এ পরিণত হয়েছে। ওর বিরুদ্ধে কুড়িটি হত্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে। ঐ সময়ের অপজিশন পার্টি এখন পাওয়ারে থাকায় কসাই গাবড়ুকে এরেস্ট করা যায় নাই।
কসাই গাবড়ু এখন কোথায়?
ও দিল্লিতে বসে গরুর মাংস রপ্তানির ব্যবসা করছে।
ওকে জিজ্ঞাসাবাদ করে জানা যাবে না কাকে খুন করেছে?
পুলিশ কমিশনার রাজেশ সিপ্পি বললেন, সিসিটিভির ফুটেজ থেকে স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে ঐ রুমে মাননীয় সাংসদ ঢুকেছেন; কিন্তু বের হন নি। এর সহজ সমীকরণ হলো দূর্ঘটনটা মাননীয় সাংসদের উপর দিয়ে গেছে। এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের মোটিভ কী বুঝতে পারছি না।
ইন্সপেক্টর হারাধন বললেন, মাননীয় সাংসদের সাথে যারা ছিলেন, তাদের ইন্টারোগেট করলে মোটিভ জানা সম্ভব হবে স্যার। কিন্তু তিন জন চলে গেছে বাংলাদেশে, একজন যায় নি।
কে?
কায়সার আহমেদ। আর. ।
আর কী ইন্সপেক্টর হারাধন?
যাকে খুন করা হয়েছে, উনি সত্যই মাননীয় সাংসদ নেছার উদ্দীন আহমেদ কিনা তা কনফার্ম করার জন্য ডিএনএ টেস্ট করতে হবে। ওয়াশরুমে পাওয়া ব্লাড স্যাম্পল থেকে ডিএনএ পাওয়া যাবে। এই ডিএনএ-র সাথে ম্যাচ করানোর জন্য ওঁর কোনো সন্তানের ডিএনএ লাগবে।
ডেপুটি হাইকমিশনার শেখ সালাউদ্দীন বললেন, আপনারা কায়সার আহমেদকে খুঁজে বের করুন। আমাকে এক্ষুণি ফরেন মিনিস্ট্রির মাধ্যমে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে ঘটনা জানাতে হবে। এবং ডিএনএ টেস্টের বিষয়টাও বলবো।

পুলিশের বিশেষ শাখার ঢাকা জেলার এসপি রশিদ হেলিকপ্টারে নামলেন উলটচণ্ডাল উচ্চ বিদ্যালয়ের খেলার মাঠে যা নেছার উদ্দীন আহমেদের বাড়ির পাশে অবস্থিত। হেলিকপ্টার দেখার জন্য এলাকার শিশু-কিশোররা দৌড়ে আসতে থাকলো এদিকে। এসপি রশিদ সিভিল ড্রেসে হেলিকপ্টার থেকে নামলেন; পেছনে নামলো একই পোশাকে নামলো একজন সিপাই, ওর হাতে এসপি রশিদের ব্যাগ। একজনকে জিজ্ঞেস করে সরাসরি চলে এলেন সাংসদ নেছার উদ্দীন আহমেদের বাড়িতে।
দশ মিনিট পর। এসপি রশিদ বসে আছেন সাংসদ নেছার উদ্দীন আহমেদের ড্রয়িংরুমে। একটু পরে সাবিহা নেছার ও সামিরা ড্রয়িংরুমে ঢুকলে এসপি রশিদ দাঁড়িয়ে সালাম জানালেন। সাবিহা নেছার সামান্য মাথা নেড়ে সালামের জবাব দিয়ে হাতের ইশারায় বসতে বললেন।
সাবিহা নেছার ও সামিরা বসার পরে এসপি রশিদ বসে নিজ পরিচয় দিয়ে বললেন, সাংসদ স্যারের ব্যাপারে কথা বলতে এসেছি ম্যাডাম।
সামিরা জিজ্ঞেস করলো, বাবার কোনো খোঁজ পাওয়া গেলো এসপি আঙ্কল?
প্রাথমিক তথ্য-প্রমাণ থেকে ধারণা করা হচ্ছে স্যারকে খুন করে লাশ টুকরো টুকরো করে কেটে স্যুটকেসে ভরে বাইরে নিয়ে কোথাও ফেলে দেয়া হয়েছে। কলকাতা পুলিশ বলছে স্যারের সাথে যারা গিয়েছিলো, ওরাই কোনো কারণে স্যারকে খুন করেছে। ওদের তিনজন দেশে ফিরে এসেছে; একজন রয়ে গেছে কলকতায়। কলকাতার পুলিশ ওকে খুঁজছে। আমরা শায়লা শারমিন নামের মেয়েটাকে এরেস্ট করেছি।
কী বলেছে ও?
কেনো খুন করা হলো আমার বাবাকে?
কারা খুন করলো?
এসপি রশিদ বললেন, সাংসদ স্যার যখনই কলকাতা গেছেন, শায়লা শারমিনকে সাথে করে নিয়ে গেছেন। এ বিষয়ে আমি আর কিছু বলতে চাই না!
ঠিকাছে! খুনের ব্যাপারে কী বললো ঐ মেয়েটা?
ও খুনের ব্যাপারে কিচ্ছু জানে না। পাশের রুমে ঘুমিয়ে ছিলো। পরদিন বিকালে চলে এসেছে বাংলাদেশে।
কী আশ্চর্য! পাশের রুমে একটা খুন হয়ে গেলো, আর ঐ বেবুশ্যেটা কিছুই জানে না?
কারো সাথে স্যারের কোনো শত্রুতা ছিলো? বৈষয়িক বা পলিটিক্যাল?
সাবিহা নেছার বললেন, কী বলছেন এসপি সাহেব! আপনাদের স্যার এলাকায় দাতা হাতেম তাই নামে পরিচিত। চার হাতে তিনি দানখয়রাত করেন। তিন তিনবার তিনি বিপুল ভোটের ব্যবধানে এমপি হয়েছেন।
তখন রিং বাজলে এসপি রশিদ মোবাইল ফোনে অপরপ্রান্তকে শুনে লাইন কেটে দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, স্যারের কী ব্যবসা ছিলো ম্যাডাম? কোনো মাছের খামার? মিল-ফ্যাক্টরি?
এখানে কোনো মিল-ফ্যাক্টরি নাই। এক্সপোর্ট-ইমপোর্ট বিজনেস আছে, ঢাকায়।
ঠিক বলেছেন ম্যাডাম! নাগরদোলা জেলার ডিবির এসপি জানালো মাননীয় সাংসদ নেছার উদ্দীন আহমেদের এক্সপোর্ট-ইমপোর্ট বিজনেস আছে; তবে সেটা ঢাকায় না, এখানে!
এখানে? আমি জানি না! মা, তুমি জানো?
কায়সার আহমেদকে এরেস্ট করা হয়েছে। ও সব স্বীকার করেছে!
কী বলেছে ও?
মাননীয় সাংসদ গোল্ড স্মাগলিং করেন! এছাড়াও মাদকদ্রব্যের ব্যবসা আছে। আফতাব হোসেনের সাথে লেনদেন নিয়ে কনফ্লিক্ট হয়ে আসছিলো কয়েকমাস ধরে। হাজার কোটি টাকা! সাংসদ হওয়ার গড়িমায় তিনি পেমেণ্ট নিয়ে পার্টনারদের সাথে ঝামেলা করে আসছিলেন। এইসব ঝামেলা মিটাবার জন্যই সবাইকে নিয়ে কলকাতায় গিয়েছিলেন মাননীয় সাংসদ। কিন্তু আফতাব হোসেনের ষড়যন্ত্র ধরতে পারেন নাই।
আফতাব হোসেন ষড়যন্ত্র করে মাননীয় সাংসদকে নৃশংসভাবে হত্যা করেছে। কায়সার আহমেদ মুসাদ্দেক মবিন সাথ দিয়েছে।
সাবিহা নেছার ও সামিরা ফুপিয়ে উঠলো।
একটু বিরতি নিয়ে এসপি রশিদ বললেন, স্যারের লাশ বা লাশের খণ্ডাংশ পাওয়ার সম্ভাবনা কম। ডিএনএ টেস্টে কনফার্ম হলে গায়েবানা জানাজা পড়াতে পারবেন। ডিএনএ টেস্টের জন্য সামিরাকে কলকাতা যেতে হবে।
কবে?
কলকাতা পুলিশ যেদিন যেতে বলবে।

এক সপ্তাহ পরে মা ও মেয়ে দু’জনেই কলকাতা গেলো। কলকাতার ডেপুটি হাইকমিশনার শেখ সালাউদ্দীন ওদের সাদরে অভ্যর্থনা জানিয়ে সমবেদনাও জানালেন। কলকাতা পুলিশ কমিশনার রাজেশ সিপ্পি জানালেন: কসাই গাবড়ুকে গ্রেফতার করতে না পারলেও উচ্চ পর্যায়ে যোগাযোগ করে তথ্য পাওয়া গেছে। সাংসদ নেছার উদ্দীন আহমেদের শরীরের টুকরো গঙ্গার বিভিন্ন জায়গায় ফেলে দেয়া হয়েছে। ওয়াশরুমের ড্রেনে পাওয়া ব্লাড স্যাম্পল থেকে সাংসদ নেছার উদ্দীন আহমেদের ডিএনএ সংগ্রহ করা হয়েছে। সামিরার ব্লাড স্যাম্পল পেলে এনালাইসিস করে ডিএনএ নিয়ে নেছার বাবুর ডিএনএ ম্যাচ করা হবে।


তিন দিন পরের ঘটনা। কলকাতা পুলিশ কমিশনার রাজেশ সিপ্পির ফোনকলটা সামিরা ধরলো। রাজেশ সিপ্পি জানালেন: ডিএনএ ম্যাচ হয়েছে! তখন আরেকটা ফোনকল এলে ওটা কেটে দিয়ে এটা গ্রহণ করে মোবাইল ফোনটা কানে ঠেকালো সামিরা। কণ্ঠ শুনে অত্যন্ত খুশি হয়ে হাসতে লাগলো।

বরফের ছুরি রহস্য গল্প – সমাপ্ত

আপনাদের লেখা আমাদের ওয়েব সাইটে জমা দিতে গেলে, অনুগ্রহ করে আমাদের লেখা-জমা-দিন মেনু-তে ক্লিক করুন ও নিজেকে Author হিসেবে Register করুন এবং আমাদের পরবর্তী আপডেট পেতে আমাদের ফেসবুক পেজ অনুসরণ করুন।

error: Content is protected !!