আতঙ্কের কথামালা গল্প – ভাস্কর পাল
পিকুর বয়ানে
বৃষ্টির দিনগুলোতে আমরা স্কুল যেতাম না। আমরা বলতে আমি আর আমার ভাই অভি। সেই ছেলেবেলার দিনগুলোতে একটা ঘটনা খুব আমাদের সাথে ঘটতো। যখনই স্কুলের ভাত খেয়ে বেরোবার উপক্রম করতাম তখনই আকাশে অজানা আতঙ্কের মতো কোথা থেকে মেঘ এসে দিব্যি বৃষ্টির আয়োজন করতো! আমার কাছে মেঘ অজানা আতঙ্কের মতো হলেও ভাইয়ের কাছে তা ছিল কুড়িয়ে পাওয়া চোদ্দো আনার মতো! তবে বৃষ্টি নাটকীয় ভাবে শেষও হয়ে যেত স্কুল বসে যাওয়ার পরে। এতে মন খারাপ হয়ে যেত আমার, গোঁজ হয়ে বসে থাকতাম ছাদের সিড়িতে, তাকাতাম ভিজে যাওয়া ছাদের দিকে। তবে ভাই ছিল আমার ঠিক উলটো, সে বৃষ্টি পড়ার সাথে সাথে সেদিন কী খেলা যায় তার প্ল্যান শুরু হয়ে যেতো।
ভাইয়ের ছিল নিত্যনতুন সব খেলা। সে গ্ৰাম চলতি কোনো খেলার কোনো ধারই ধারতো না। সে কখনো চুম্বক দিয়ে লোহার কুচি নাচাতো আবার কখনো দেশলাই বাক্স দিয়ে টিকিট বানিয়ে নিজের মনেই খেলতো। আমারও যে খেলায় ডাক পড়তো না তা নয়, তবে সেসব খেলায় আমি ঠিক তার মন জুগিয়ে চলতে পারতাম না, তাই খেলা ছেড়ে অবিলম্বে বেরিয়ে আসতাম!
এমনই এক বৃষ্টির দিন হবে হয়তো সেদিন। বেশ একটা দামাল ঘূর্ণাবর্ত তৈরী হয়েছে সাগরে, টিভি আর রেডিওতে তারই অনর্গল সতর্কতা ভেসে আসছে। খুব জোর ঝড়-বৃষ্টির তান্ডব লীলা শেষ হওয়ার পর একটু সন্ধ্যায় বারান্দাতে ঠান্ডা জোলো হাওয়া বুক ভরে নিচ্ছিলাম আমরা সকলেই। আমরা বলতে বাবা, মা, ভাই আর আমি। কিছুক্ষণ পর মা নিয়ে এলো ধোঁয়া ওঠা কফি! দেখেই আমরা খুব ঝলমলে হয়ে উঠলাম। মা এই জিনিসটা বরাবরই খুব ভালো বানায়।
কফি খেয়েই ভাই উপরতলায় চলে গেলো। আজ সন্ধ্যায় ওর ভিন পাড়ায় টিউশন আছে। সকালে পড়াশোনা হয়নি তাই হয়তো ভয়ে শেষ লগ্নেই হোমওয়ার্ক করে ফেলছে! ভালো ব্যাপার।
বৃষ্টির পর আর কারেন্ট এলো না গ্ৰামে, গোটা পাড়া ঢেকে রইলো নিশ্ছিদ্র অন্ধকারে। এখনকার দিনের মতো তখন এতো LED লাইটের রমরমা ছিলো না। একটা এমনি আলোর চার্জার তখন ছিলো বড়লোকের ব্যাপার। আর ইনভার্টারের কথা তো বলাই বাহুল্য। বৃষ্টি থেমে গেছে বহুক্ষণ, এতক্ষণে অভির টিউশনের সময় হয়ে গেছে। কিন্তু ওকে ঘর থেকে বেরোতে দেখলাম না।
মা বললো-“ পিকু, ভাইকে ডাক তো। ঘুমিয়ে গেছে হয়তো! ”
আমি নীচ থেকে তারস্বরে ডাকতে ডাকতে উঠলাম হ্যারিকেন নিয়ে। সাড়াশব্দ কিছুই পাওয়া যাচ্ছে না, মায়ের ধারনাই ঠিক – কুম্ভকর্ণ আবার ঘুমিয়েছে! আমাদের বাড়িতে এই বান্দাই সবথেকে দেরি করে ওঠে। ঘরের কাছে পৌঁছে আরও উঁচু গলায় ডাকলাম, কিন্তু না এবারও কোনো শব্দ পাওয়া গেলো না। আশ্চর্য ব্যাপার! দরজায় বেশ কয়েকবার জোরে জোরে ধাক্কা মারলাম। কোনো সাড়াশব্দ নেই। অজান্তেই বুকটা ধক করে উঠলো! ছেলেটা অমন কেন করছে!
হ্যারিকেন তুলে বদ্ধ ঘরের ভিতরে দেখার চেষ্টা করি।অন্ধকার আরও রহস্যময় হয়ে ওঠে, ভিতরে কাউকে দেখতে পাইনা। ভয়ে আমার হাত থেকে হ্যারিকেনটা পড়ে যায়!
★★★★★
বেশ কিছু বছর আগের কথা – কানাভুলোর ঘটনা
মন্ডল পাড়ায় সীতারাম মন্ডলের পরিবার ছিল মোটামুটি স্বচ্ছল। সীতারাম ছাড়াও তার মেয়ে আর স্ত্রীকে নিয়ে তার সূখের সংসার। গ্ৰামের সকলেই সীতারাম কে খুব ভালোবাসে আর শ্রদ্ধা করে। প্রতিদিনের মতো সেদিনও শহরের অফিস থেকে বাড়ি ফিরছিলো স্কুটারে। হঠাৎই বিকেলের দিকে বৃষ্টি এলো অপ্রত্যাশিত ভাবে। বলা নেই, কওয়া নেই গুরুগম্ভীর গর্জন তুলে আকাশ কাঁপিয়ে মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হলো। ভাগ্যিস, কাছে তুফানের দোকান তখনও খোলা ছিল। তুফান সীতারাম কে আসতে দেখে নিজেই দোকানে আসতে বললো। তুফান ওদের গ্ৰামেরই ছেলে। নানা কথাবার্তার পর তুফান বললো- “সীতারাম দা আজ মিটিং এ যাবে নাকি? ”
সীতারাম মিটিঙের ব্যাপারে তেমন কিছু জানতো না। সে জিজ্ঞেস করলো- “ কীসের মিটিঙ বলতো? ”
কয়েকদিন যাবৎ একটা খবর আসছে জানো তো। আমাদের এ দিকটায় ছোটো ছোটো মেয়েরা হারিয়ে যাচ্ছে। পুলিশেরা নিজেদের কাজ করে যাচ্ছে, তবে আমাদের এক চেনা আর নামজানা গুনিন বলছে এটা নাকি মানুষের অপরাধমূলক কোনো কাজ নয়। এর পিছনে কোনো অলৌকিক ব্যাপার আছে। পুলিশ নাকি এর কোনো তলই পাবে না। তাই গুনিন আমাদের কল্যানে, দুর্গা মন্দিরের কাছে একটা সভা ডেকেছে। তোমার তো কুসংস্কারে বিশ্বাস নেই তাই হয়তো ডাকেনি! পারলে যেও, বিপদ যে কখন পা টিপে টিপে এসে পিছনে দাঁড়ায়, কেউ জানে না।
শেষ কথাটা বুকে এসে বিঁধলো সীতারামের। অলৌকিক ব্যাপার না হলেও সাধারনভাবেই ঘটনাটা খুবই ভয়াবহ। তারও তো দশ বছরের ছোটো মেয়ে আছে। না, এবার থেকে আরেকটু সাবধানী হবে সে।
বৃষ্টিটা একটু থেমেছে। তুফান কে আজকের সভায় যাওয়ার আশ্বাস দিয়ে আবার সে বাড়ির পথ ধরলো।
সভার আগে লোকজন সমাগমের আগে বিশ্বপতি সীতারামকে ঘটনা বিস্তারিত ভাবে বললো। এক সপ্তাহের মধ্যে এগারোজন মেয়ে নিখোঁজ হয়েছে। এই গ্ৰাম বাদে আশেপাশে একাধিক গ্ৰামে এমন ঘটনা ঘটেছে। কীভাবে, কে এইসব কান্ডের পিছনে কলকাঠি নাড়ছে তা ধোঁয়াশায় থাকলেও একটা জায়গা স্পষ্টভাবে চিহ্ণিত করা গিয়েছে। আর সেই জায়গাটা হলো গ্ৰামে শহরে যাওয়ার যে বাসস্ট্যান্ড আছে সেটা। অন্তত গুনিন বুঝেছে!
সভাতে গুনিন বললো- যা দেখতে পাচ্ছি, সকলেই স্কুল থেকে বাড়ি ফেরত আসার সময়ই উধাও হয়েছে। এ কানাভুলোর কাজ হতে পারে।পথচলতি একাকী পথিককে পথ ভুলিয়ে নিয়ে যায় নিজের ডেরায়। তারপর নৃশংস ভাবে হত্যা করে তাদের।
গুনিনের কথা শুনে সকলে স্তম্ভিত হয়ে যায়। ভয়ের একটা ঠান্ডা স্রোত সকলের শিরদাঁড়া তে নামতে থাকে। সকলেই জানে কানাভুলো কি অতি ভয়ঙ্কর ভুত। অতীতের অনেক স্মৃতি ভেসে আসে তাদের মনে। ওই তো বিশ্বপতি যে কিনা পঞ্চায়েতের সদ্য মেম্বার সেও কানাভুলোর কবলে পড়েছে। কপাল গুনে সে যাত্রায় কোনোক্রমে বেঁচেছিল। সবাই মুখ ফিরে চায় বিশ্বপতির দিকে।
বিশ্বপতির বয়স এখন প্রায় চল্লিশের গোড়ায়। ছাব্বিশে ঘটেছিল কানাভুলোর সাথে সাক্ষাৎ। সে এক ভয়ঙ্কর দিন ছিল বটে। তখন বর্ষাকাল, বাবা বাঁধালো ভাইরাল জ্বর। গায়ে হাত পায়ে সবসময় নারকীয় যন্ত্রনা, মানুষটা যেন রয়েছে সবসময় ঘোরের মধ্যে। এমতাবস্থায় চাষের কী হবে ভেবে বাবা দিশেহারা! তখন বিশ্বপতি নিজে থেকেই চাষের দায়িত্ব নেবে এমন সিদ্ধান্ত নিলো। প্রথম প্রথম খুব অসুবিধা হতো, তারপর ব্যাপারটা সে রপ্ত করলো। সেদিন ঠিক বিকেলের দিকে ঝিরঝির বৃষ্টিতে ,বীজ ধান পুঁতে সে বাড়ির দিকে ফিরছিলো। ঘন মেঘের অন্ধকারে অঘোষিত সন্ধ্যাই তখন বলা চলে। রাস্তাঘাট জনহীন, শুধু বৃষ্টির অনর্গল কলকলানি। আজ আবার বিশ্বপতি সাইকেল নিয়ে আসেনি। তার মনে হচ্ছিলো এখন যদি একটা কিছু পাওয়া যেতো, তাহলে এতো ভিজতে হতো না।
ভাবতে না ভাবতেই বিশ্বপতি দেখতে পেলো কেউ একজন তার অভিমুখেই সাইকেল নিয়ে আসছে প্রচন্ড গতিতে। তবে লোকটা এসে তার পাশে এসেই থামলো। খুবই উদ্বিগ্ন কন্ঠে সে বললো- ‘আপনার নাম বিশ্বপতি তো? ”
হ্যাঁ, কী হয়েছে? – বিশ্বপতি অবাক হয়ে বললো।
আপনার বাবার অবস্থা বেশ সিরিয়াস। হাসপাতালের তরফ থেকে আমাকে জানাতে বলেছিলো, তাই জানালাম। আপনি আমার সাইকেলে বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত যেতে পারেন। সেখান থেকে… । – আরও অনেক কিছু বলে যাচ্ছিল লোকটা। কিন্তু বিশ্বপতি চোখে অন্ধকার দেখছিলো তখন। এই মোটামুটি সুস্থ ভালো মানুষ দেখে এলো ও, এরই মধ্যে এমন কী হলো যাতে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হলো! বিশ্বপতির মনটা ভারী হয়ে এলো।
সে ওই ভিজে পোশাকেই চেপে বসলো ওই আগন্তুকের সাইকেলের পিছনে। বৃষ্টি আরও বাড়লো আর তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়লো সাইকেলের গতি। তবুও বাসস্ট্যান্ড আর আসে না, বিশ্বপতি অধৈর্য হয়ে পড়ে। সাইকেল যা মোটে দশ মিনিটের রাস্তা, তা দুই ঘন্টাতেও পৌছাতে পারলো না! এই আগন্তুক কি রাস্তা চেনে না নাকি?
কিছুক্ষণ পর একটা জংলা এলাকায় সাইকেল থামায় লোকটা। চারিদিকে বড় বড় গাছ, মাটি খুব পিচ্ছিল আর কর্দমাক্ত। এতক্ষণে সে আরও ভালোভাবে দেখলো লোকটাকে। আগের সাক্ষাতের থেকে লোকটাকে যেন বেশিই দীর্ঘদেহী লাগছে এখন, বাঁ চোখটা অতিরিক্ত সাদা আর ফ্যাকাসে। দেখলেই কেমন ভয় ধরে! তবে লোকটার চোখের মধ্যে কি যে ছিল, বিশ্বপতি পোষমানা পাখির মতো লোকটার গতিবিধি অনুসরণ করলো।
ধীরে ধীরে লোকটা জঙ্গলে ঢুকলো, সঙ্গে বিশ্বপতিও। তারপর হাতটাকে বাঘের থাবার মতো ব্যবহার করে জঙ্গলের কর্দমাক্ত মাটি খুঁড়তে থাকলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই লোকটা প্রায় দশ ফুট গর্ত খুঁড়ে ফেললো। বিশ্বপতি চুপচাপ এক প্রস্তর মুর্তির মতো দাঁড়িয়ে সবটা দেখছে। এখন তার চোখে পড়ছে না, লোকটা আরও লম্বা হয়েছে। হাতগুলো কোনো হিংস্র জন্তুর মতো তীক্ষ্ণ নখর বিশিষ্ট পায়ের মতো দেখাচ্ছে! মুখে তার পাশবিক একটা হাসি, ঠোঁটের দুই প্রান্তে তীক্ষ্ণ দুটো দাঁত বেরিয়েছে, ফুলে উঠেছে বুকের ছাতি! বশীভূত বিশ্বপতি কে সেই লোকটা জামার কলার ধরে তুলে আবর্জনার প্যাকেটের মতো ছুঁড়ে ফেলে দিলো গর্তে। তারপর লোকটা ভোজবাজির মতো উবে গেলো!
আগন্তুক সেই পিশাচ বিশ্বপতি কে গর্তে ফেলে দিলেও বিশ্বপতি কিন্তু গর্তের গভীরে পড়ে যায়নি। কোনোক্রমে বরাত জোড়ে গর্তের দেওয়াল ধরে রাখতে পেরেছিলো। পরে ওর চিৎকার শুনে আশেপাশের লোকজন এসে বাঁচায়।
বিশ্বপতির মনে পড়ছিলো সেইসব কথা। তবে সেবারে ও ছাড়া আর কেউ কানাভুলোর কবলে পড়েনি। এবার যেন সে অন্যভাবে এসেছে।
সীতারাম গুনিন কে উদ্দেশ্য করে বললো-“এভাবে চলতে থাকলে তো খুব বিপদ। স্কুল-টিউশনের ব্যাপার আছে, সন্ধ্যা তো মাঝে মাঝে হয়ে যেতেই পারে। আপনি কি কোনো উপায় জানেন? ”
“উপায় বলতেই তো আসা এখানে। ও কিন্তু প্রিয়জনের রূপ ধরেই আসবে। তাই স্বরূপ চেনা বড়ো দুষ্কর- গুনিন থামে।
সভার মাঝেই উঠে পড়ে সীতারাম। সে তার মেয়েকে আনতে যাবে টিউশন থেকে। আরও অনেকে আছে তার সঙ্গে, তারাও একসঙ্গে আসবে। তবে সভা ভাঙলো না, আরও আলোচনা চলতে লাগলো। সীতারাম আরও তড়িঘড়ি ঘরের দিকে রওনা হয়।
★★★★★
সুমি কি বাঁচলো
সীতারামের সাথে গুনিনও যায় রাজার মোড়ের রাস্তায়। এদিক দিয়েই সুমি আর তার বান্ধবীরা টিউশন পড়ে আসবে। যদিও ছুটির অনেক আগেই চলে এসেছে সীতারাম আর গুনিন। গুনিন আজ কিছু একটা সংকেত পেয়েছে, গুঢ় সেই সংকেত, সকলের বোধগম্য নয়।
ছুটি হতে লাগলো আরও আধঘণ্টা। সন্ধ্যা তখন আরও ঘন হয়ে এসেছে। বেশিরভাগ জনেই হেঁটে যাওয়া আসা করে। সীতারাম শুধু তার স্কুটারে মেয়েকে দিয়ে আসে আর নিয়ে যায়। গুনিন অপেক্ষা করছিল কিছু একটার জন্য, ঠিক তখনই ঘটলো ঘটনাটা।
এক্কেবারে ঠিক সীতারামের স্কুটার নিয়েই একজন দাঁড়ালো সুমিদের জটলার মাঝে। সীতারাম দেখলো যেন তারই প্রতিচ্ছবি কে, কোনো তফাৎ নেই। ও আগ্ৰহ ভরে দেখছে লোকটা করে কী!
আগন্তুককে দেখে সুমির চোখ কুচকালো। সে বললো-“ তুমি আজ খুব তাড়াতাড়ি চলে এলে! চলো, তাহলে। ” সুমি স্কুটারে চাপলো। সীতারাম এসব দেখে হইহই করে উঠেছিল, গুনিন ওকে থামালো। ও বললো দেখাই যাক না ভুলো করে কী!
এরপরে কোথাও না দাঁড়িয়ে সবেগে ছুটলো আগন্তুকের স্কুটার। তার পিছু নিলো বিশ্বপতির স্কুটার। পিছু নিতে নিতে ওরা পৌঁছালো কাছের জঙ্গলে।
একটা গাছের আড়ালে দুজনে দাঁড়ালো। বেশ সন্ধ্যা হয়েছে, তবে আকাশে চাঁদের আলো থাকায় সবকিছুই মোটামুটি দৃশ্যমান। ওই আগন্তুক আর সুমি হাঁটতে হাঁটতে অনেকটা এগিয়ে যাচ্ছে। সীতারামরাও নিরাপদ এগোতে থাকলো।
হঠাৎ সুমির গলা শোনা গেলো। সে বলছে-“তুমি আমাকে এখানে কেন নিয়ে এলে বাবা? ”
উত্তর পাওয়া যায় না। বরং ধীরে ধীরে লম্বা হতে থাকে সেই আগন্তুক, ফুলে ওঠে বুকের ছাতি। তারপর মিহি গলায় বলে- “ সুমি, আমার দিকে তাকা! ”
সুমি হয়তো তাকায়, অথবা তাকিয়েই থাকে। তারপর লোকটা বলে-“ ওই যে গর্তটা দেখতে পাচ্ছিস ওখানে ঝাঁপিয়ে পড়! ” লোকটার ঠোঁটের দুই প্রান্তে রক্ত দন্ত বেরিয়ে আসে।
গুনিন আর দেরী করলো না। সে তার মন্ত্রপূত জল সাবধানে ধীরে ধীরে কাছে এসে ওই ভুলোর শরীরে ছিটিয়ে দেয়। সঙ্গে সঙ্গে সে ধুলোর মতো মিলিয়ে গেলো যেন আগে ওর কোনো অস্তিত্বই ছিল না ।
সুমি ভয়ে জড়িয়ে ধরে তার বাবাকে। এতক্ষণে সে বুঝতে পারে সে আজ জোর বেঁচেছে। গুনিন ভালোভাবে গর্তের দিকে তাকায়। টর্চের আলো ফেললে দেখা যায় সে গর্ত প্রায় তিনতলা বাড়ির সমান। আরো ভালোভাবে কান খাড়া করলে শোনা যায় আগের মৃত মেয়েদের করুণ আর্তনাদ। ওরা দেখতেও পেলো কোনো কোনো মেয়ের প্রেতাত্মা গর্ত বেয়ে উপরে উঠে আসার চেষ্টা করছে। তাদের পৈশাচিক কঙ্কালসার দেহ দেখলে ভয়ে গা শিউরে ওঠে। ওরা সরে আসে, ওদের লম্বা শীর্ণ হাত গর্তে ফেলতে চাইবে তাদেরও!
★★★★
বর্তমান কাল – পিকুর বয়ানে
আমি তখন ভয়ে অজ্ঞান হয়ে গেছি। কিছুক্ষণ পর মা এসে আবার জলের ঝাপটা দিয়ে জ্ঞান ফেরায়। আমি মাকে সবকিছু বললাম, মা হতভম্ব হয়ে গেলো আমার কথা শুনে। ঘরের ভিতর থেকে একটা ছেলে পুরোপুরি ভ্যানিশ হয়ে যায় কীভাবে! রাজার মোড়ের কাছে যে জায়গাতে অনেক জঙ্গল ছিলো অনেক বছর আগে , সেখানেই আমাদের বাড়ি। আমাদের ছাড়াও এ অঞ্চলে আরও বাড়ি আছে। আর জঙ্গল এখনও নেহাত কম নেই, সেদিক দিয়েই পাড়ার লোকে খুঁজতে গেলো ভাইকে। আমিও তাদের অনুসরণ করলাম।
ভাইয়ের খোঁজে ঘুরতে ঘুরতে কিছুক্ষণ পর মনে হলো আমরা যেন এক জায়গাতেই ঘুরপাক খাচ্ছি! বারংবার মনে হচ্ছে আমাদের বাড়ির চারদিকে চক্কর কাটছি। শুধু তাই নয় সারা বাড়ির দেওয়ালে আর আনাচেকানাচে শুরু হয়েছে মিহি কন্ঠের ফিসফিসানি! ভয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো মা, মায়ের মতে ঘরে যেন মনে হচ্ছে ভুমিকম্প হচ্ছে! ঘর থেকে বেরিয়ে আসার পর মিহি মেয়েলি কন্ঠের ফিসফিসানি আরও জোরালো হলো। যেন বহু দিন থেকে ওরা কোনো নির্মম কারাগারে বন্দী হয়ে আছে, আর আজ কোনো ক্ষীণ মুক্তির আশায় ব্যাকুল হয়ে উঠেছে।
এরপর এক অভাবনীয় ভয়ঙ্কর কান্ড ঘটলো যা এখনো ভাবলে বুক কেঁপে ওঠে। আমরা দেখলাম আমাদের ঘরটি চোখের সামনে ভয়ানক ভাবে নড়ে উঠলো। আমরা যে যেখানে ছিলাম নিরাপদ স্থানে সরে এলাম। আশেপাশের আরো ঘরের দিকে তাকালাম, কই সেখানে তো গন্ডগোল নেই! এখানে আবার কী হলো। ভাবতে ভাবতেই দেখি আমাদের আস্ত বাড়িটা সমূলে খড়কুটোর মতো শুন্যে উড়ে মাটিতে আছড়ে পড়লো। সে কি কান ফাটানো, অসহ্যকর শব্দ, ওখানে যারা দাড়িয়ে ছিল সকলেই মাটিতে আছড়ে পড়ার প্রাবল্যে টাল সামলাতে না পেরিয়ে পড়েছিলাম মাটিতে। ততক্ষণে গোটা এলাকায় শোরগোল পড়ে গেছে, মুহুর্তের মধ্যে পিলপিল করে লোক ভিড় করেছে সেখানে।
অনেকে ঘরটার আদি শেকড়ের কাছে এগিয়ে গেলো। সেখানে এখন ভয়ানক এক শুন্যস্থান। কেউ ভাবতেও পারবেনা ওখানে আসলে বাড়িটা ছিল। সেখানে এখন গভীর বৃত্তাকার গর্ত। কিছু লোক আরও কাছে গিয়ে গর্তটি ভালোভাবে দেখার চেষ্টা করলো, তবে তারা আর ফিরলো না। অসংখ্য কালো হাত পৈশাচিক হাসি হাসতে হাসতে তাদেরকে টেনে নিয়ে গেলো সেই গর্তে। সকলেই এবার আতঙ্কে সরে এলো সেখানে থেকে।
মা খুব কাঁদছিল, একে তো ভাইকে হারানোর যন্ত্রনা, তার উপর এমন ভয়ানক এক বিপর্যয়- কার স্নায়ুই বা ঠিক থাকে। বাবারও মন ভারাক্রান্ত, চারিদিকে অল্প অল্প আলোর জন্য জায়গাটা এখন আর অন্ধকার নেই। তবে সেই মেয়েলি কন্ঠের রব তখনও শোনা যাচ্ছিল। আলোতেও যখন তাদের কন্ঠ থামলো না তখন মনে হলো ওরা কি কোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছে? কন্ঠের মধ্যে ভয়াবহতা কি ভয় পাওয়ার পরিণতি না কি আমাদেরকে ভয় দেখানোর কৌশল!
আমি কিছুটা কৌতুহলী হয়ে অন্যদেরকে উপেক্ষা করে গর্তের কাছে এসে পৌছালাম। হঠাৎ দেখি এক কিশোর ধীরে ধীরে উঠে আসছে। আশ্চর্যজনক ব্যাপার, আমাকে দেখে কোনো পৈশাচিক হাত টেনে নামাবার চেষ্টা করলো না! উল্টে সেই হাত গুলোর সাহায্যে উঠে এলো আমার ভাই! একদম নিঁখুত আর নিপাট ভদ্রলোকের মতো।
ধীরে ধীরে অদ্ভুত ভাবে আরো কিছু অলৌকিক ঘটনা ঘটলো যা নিতান্তই কম ভয়াবহ নয়। চোখের পলকে দেখি গর্ত থেকে অক্টোপাসের অসংখ্য শুঁড়ের মতো যেন কী বেরিয়ে এলো ,সেগুলো বেছে বেছে কিছু পুরুষ মানুষকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরলো তারপর তাদেরকেও গর্তে ঢুকিয়ে নিলো। একটা অদ্ভুত শান্তির ধ্বনি উৎসারিত হলো সেই গর্ত থেকে, তারপর সেই শুঁড় গুলো ধীরে ধীরে আবার অদৃশ্য হয়ে গেলো গর্তের মধ্যে। এতক্ষণে সকলেই ভয়ে পালিয়েছে যে যার বাসস্থানে।
আমরা কেউই এখনও ধাতস্থ হতে পারিনি। কিছুক্ষণের মধ্যেই যা তান্ডব চললো তাতে নিজেকে ঠিক রাখা কম কথা নয়! আমরা এখন গৃহহীন, অন্ধকারে দুমড়ে মুচড়ে পড়ে আছে আমাদের বাড়ি। বাবা অসহায়ের মতো তাকিয়ে আছে সেইদিকে। ওই গর্তের ভিতর থেকে এখনও অশরীরীর ফিসফিসানি শোনা যাচ্ছে। কি যে করবো কিছুই বুঝতে পারছি না।
★★★★
বর্তমান কাল
“এ দাদা, আমাকে নিতে এসে এভাবে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছিস কেন?”- অভি বললো।
পিকু ধড়ফড় করে উঠলো। ভাই যেটা বলছে সেটা ঠিক নয়। সে ঠিক অজ্ঞান হয়নি। কেমন ঘোর লাগা নেশা যেন হয়েছে তার, কী সব ভুলভাল বকছিলো সে। এখন তারা আছে একটা ছাতিম গাছের নীচে। অভিকে খুঁজতে এসে পিকু তাকে এখানে পায়। ঘর থেকে হঠাৎই নিরুদ্দেশ হয়ে যায় অভি।
পিকু একটু চেতনা ফিরে পেয়ে বললো-“আমাদের বাড়ি ঠিক আছে তো? ”
বাড়ির আবার কী হবে? তবে আমি অনেকদূর চলে এসেছি । হয়তো লীলাপুরে চলে এসেছি, দোকান- বাজার দেখে তাই তো মনে হচ্ছে। কীভাবে যে এলাম! হয়তো তুই ঠিক সময়ে এসেছিলিস বলেই আমার কিছু হয়নি।
পিকু আর অভি দুজনেই উঠলো। ওরা যে জায়গায় আছে সেটা একটু নির্জন জায়গা। বেশ কিছুক্ষণ আগে একটা মাঠের ধারে পিকু তার ভাইকে আবিষ্কার করে। অন্ধকারে সে দেখতে পায় তার ভাই মাঠের আল ধরে কোথায় যেন হেঁটে যাচ্ছে। কিছুদূর ওকে অনুসরণ করার পর মনে হলো অভি একা নয়, অভির আগে আগে কেউ একজন যাচ্ছে। বাতাসে তার উৎকট গন্ধ টের পাওয়া যায় অথবা খুব হাওয়া দিলে এক বালিকার আবছা অবয়ব ফুটে উঠছে! একটা নয়, ধীরে ধীরে গোটা আল জুড়ে ওই বালিকাদের আবছা অবয়বের সারি দেখা যায়। তখনই পিকুর শরীর কেমন করতে থাকে, তারপর আর মনে নেই।
পিকু বললো- “ হয়তো আটটা বেজে গেছে। শিবমন্দিরে ঘন্টাধ্বনি বাজছে। চল কিছু খেয়ে নি। ”
কাছেই লীলাপুরের মোড়, সেখানে হরিশ কাকুর মিষ্টির দোকান খুব ফেমাস। তবে ওরা মিষ্টি খাবে না, তেলেভাজা কিছু হলে ভালোই হয়। পিকু উঠতে গিয়ে দেখলো কোমরের কাছটাতে ইলেকট্রিক শক খাওয়ার মতো চমক ব্যাথা অনুভূত হলো। কোনোমতে সে উঠে দাঁড়ালো। এখন আর ব্যাথাটা নেই। পিকু পথ চলতে চলতে একবার ভেবে দেখলো সে কীভাবে এলো এখানে। কার মাধ্যমেই বা খবর পেলো যে তার ভাই এখানেই আছে! সবকিছু একটা জটিল ধাঁধার মতো মনে হয় তার। তার তেরো-চোদ্দো বয়সের মাথাতে এসব কিছুই বোধগম্য হয় না।
হাঁটতে হাঁটতে ওরা হরিশ কাকুর দোকানে চলে এলো। তারপর পিকু পকেটে পয়সার ভাবগতিক দেখে দুজনের দুটো শিঙারা আর একটা করে রসগোল্লার অর্ডার দিলো। দুজনেই পরম তৃপ্তিতে খেয়ে দোকান থেকে বের হয়ে এলো।
খাওয়ার পর অভি বললো- “ দাদা, এবার কীভাবে যাবো? ”
“হেঁটেই যেতে হবে। তুই তো একবারে অ্যাথলেটিকের মতো চলে এসেছিলিস এখানে। এবার চল! – পিকুর গলায় উপহাসের সুর।
“তখন যে কীভাবে চলে এসেছিলাম কে জানে। মনে করার জন্য একটু টাইম দিতে হবে। কিন্তু এখন তো পায়ে প্রচন্ড ব্যথা করছে।”- ব্যাথায় চোখ ছলছল করে ওঠে বেচারার।
পিকুর একটু করুনা হয়। দুজনেই দোকানের বাইরে ধারিতে একটু বসে। রাত বাড়ছে, মা-বাবাও হয়তো চিন্তা করছে! কী যে হবে!
হঠাৎই দোকানের সামনে একজন স্কুটার নিয়ে থামে। পিকু লোকটাকে চিনতে পারে। তখন তার মনে পড়ে এই লোকটার সঙ্গেই তো সে লীলাপুর এসেছিলো অভিকে খুঁজতে! লোকটাকে দেখেই ভরসা পেলো পিকু। লোকটার গোটা মুখমণ্ডলেই এমন কোনো পজিটিভ এনার্জি আছে যার সংস্পর্শে এলেই বুকে একটা সাহস জন্মে।
লোকটার বয়স অনেক, ষাটের কাছাকাছি। একটু হেসে বললো- “ বাঃ,ভাইকে পেয়ে গেছো দেখছি। উঠে পড়ো স্কুটারে। তবে একটা কথা আছে। ”
কী কথা- অবাক হয়ে বলে পিকু।
এখন বাড়ি যাওয়া যাবে না। আগে আমাদের বাড়ি, তারপর খাওয়াদাওয়া করে একদম সোজা ঘর, কেমন? – লোকটা বলে।
ঘরে জানিয়ে দিলে আমাদের কোনো অসুবিধা নেই। কী বলিস ভাই? – পিকু ভাইকে জিজ্ঞাসা করে।
পিকু সঙ্গে সঙ্গে রাজী হয়ে যায়। দুইজনে লোকটার স্কুটারে চেপে রওনা হয়।
★★★★
অভির ঘটনা
লোকটার নাম অভয়াচরণ ভট্টাচার্য। বয়স অনেক হলেও শরীরখানা এখনও ফিট প্লেয়ারদের মতো। আমাদেরকে ঘরে নিয়ে এসে বৈঠকখানায় বসালো। ঘরে লোক বলতে উনি একাই আর সঙ্গে একটা বাচ্চা চাকর রয়েছে। তবে ঘরে আসার পর নানা জনে তার কাছে অতিলৌকিক আর অলৌকিক ব্যাপারে সমাধান খুঁজতে তার কাছে আসছে। কিন্তু আজ উনি কাউকেই পরামর্শ দিতে রাজি নন। সকলকে কালকে আসার অনুরোধ করলেন।
তারপর চাকরকে গরম কচুরি আর শিঙারা আনার আদেশ দিয়ে আমাদের কাছে এসে বসলেন। এখানেও কারেন্ট নেই, অভয়াচরণ একটা হ্যারিকেন ধরালেন। তিনি বললেন-“ আজ তোমাদের গল্প শুনবো। আমার শোনাটাও ভীষণ জরুরি! ”
আমাদের আবার কীসের গল্প- ভাই বললো।
তোমার ঘর থেকে হঠাৎ ভ্যানিশ হয়ে যাওয়ার গল্প। আজ না সেই গল্প শুনলে ,অনেক বছর আগে ঘটে যাওয়া সেইসব ভয়ানক গল্পগুলো হয়তো আবার জেগে উঠবে! ওই জন্যই তোমাকে ডেকে এনেছি। – লোকটি চিন্তিত গলায় বললেন।
ততক্ষণে বাচ্চা চাকর কালুয়া খাদ্যবস্তু নিয়ে ঢুকেছে। তার সুঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়েছে ঘরময়। দেখলাম ঠাকুরমশাই কিছুই খেলো না, আমাদের দিকে শালপাতার ঠোঙা বাড়িয়ে দিয়ে বললো- “খাও।”আমাদের তখন পেটে গভীর শুন্যস্থান, একেবারে হামলে পড়ে খেয়ে ফেললুম দুজনে। কিছুক্ষণ পর ভাই বলতে শুরু করলো তার উধাও কাহিনী-“সন্ধ্যাবেলা হবে তখন। আমার টিউশন ছিল রাতে। তাই ব্যাগপত্র, বই গোছাতে আমি কফি খেয়েই উঠে যায় উপরে। সেইসময় খুব সম্ভবত লোডশেডিং ছিলো। তখন আমি মোমবাতি জ্বালিয়েই উপরের ঘরে ঢুকি। মোমবাতি টেবিলের উপর রেখে ব্যাগে বই রাখছিলাম। ঠিক তখনই মনে হলো অলি ডাকলো। অলি অন্য গ্ৰাম থেকে এখানে পড়তে আসে। ও আগে এলেই আমাকে ডাকতে আসে। খুব ভালো মেয়ে, আমার সাথে ওর খুব ভাব। ফাইভ থেকে সিক্সে উঠতে এবার ও ফার্স্ট হয়েছে। সে যাইহোক, ওর ডাকে সাড়া দিয়ে আমিও ব্যাগ নিয়ে নামতে শুরু করি সিড়ি বেয়ে। ” আমি থামালাম ভাইকে। বললাম- “ সিড়ি বেয়ে নামলে তো আমার সাথে তোর দেখা হোতো। তাহলে? ”
সে জানি না। কিন্তু আমার তো মনে হচ্ছিল ঘরের সিড়ি বেয়েই আমি নামছি। এমনকি মাকেও আসি বলে ঘর থেকে বেরিয়ে ছিলাম যদিও মা নির্বিকার বসেই ছিলো। যেন আমি তাকে কথাই বলিনি। অলি আমাদের গেটের সামনেই দাঁড়িয়ে ছিলো। এতক্ষণ যেটা খুবই স্বাভাবিক লাগছিল, এবার তাতে যেন ছন্দপতন ঘটলো। অলির পাশে দাঁড়াতেই সবকিছু যেন অন্যরকম লাগতে শুরু করলো। চোখে কেমন একটা আলস্যের মতো ঘোর লাগলো।
আমি এখন যেন নিজে যাচ্ছি না, কেউ নদীর উপর কোনো নৌকা ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে। সেই নৌকার মাঝি অলি অন্তত তখনও আমার তাই মনে হচ্ছিল। ধীরে ধীরে আমাদের পিছনে আরো অনেক মেয়ে জড়ো হয়ে গেলো যেন আন্দোলনে নামবে। তবে তারা নৌকায় যাচ্ছে না। নদীর জলেই তারা হেঁটে যাচ্ছে। চারপাশ ভয়াবহ অন্ধকার, কেউ কোনো কথা বলছে না। তবে মাঝেমধ্যে দুই একজন করুণ গলায় বলছে-“ এভাবে কোনো কিছুর সমাধান হয়না। তবুও থেমে থাকলে চলবে না। ” অনেক দূর নৌকাতে যাওয়ার পর মাঠের কাছে এসে থামলো। তারপর আমি ঘোরের নৌকা থেকে নামলাম। তারপর… তারপর আর কিছু মনে নেই! – ভাই থামলো।
আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি ভাইয়ের দিকে। এ কোন ভয়ের পৃথিবীতে বিচরণ করছিলো এতক্ষণ! ঠাকুরমশাই বললো- “আমারই ভুল হয়েছে। তোমাদের বাড়ি রাজার মোড়ের কোনদিকে? ”
ওই যে ,যে জায়গায় অনেক আগে অনেক জঙ্গল ছিলো। – আমি বললাম।
আমার কথা শুনে ঠাকুরমশাই এমন চিন্তিত মুখে আমার দিকে তাকালেন আমার বুকটা হঠাৎই ধক করে উঠলো।
আগে ওখানে কি কোনো বিশাল গর্ত ছিলো? – ঠাকুরমশাই জিজ্ঞেস করলেন।
বাবা তো তাই বলে। অনেক মাটি গেছে গর্তের মধ্যে, তারপর তার উপর আমাদের বাড়ি। – আমি বললাম।
কিন্তু আমার কথা শুনে ঠাকুরমশাই উদ্বিগ্ন হয়ে উঠে দাঁড়ালো। বললেন- “এখনই সরে আসতে হবে ওখানে থেকে না হলে ভয়ানক বিপদ আসন্ন! আমাকে তোমাদের বাড়ি নিয়ে চলো এখনই?”
★★★★
আতঙ্কের অবসান
রাস্তায় আসার সময় পিকু তার স্বপ্নের কথা বললো ঠাকুরমশাই কে যেটা সে লীলাপুরে ঘোরের মধ্যে দেখেছিলো। ঠাকূরমশাই আন্দাজ করতে পারছিলেন সবটাই। তিনি স্কুটারের গতি আরও বাড়িয়ে দিয়ে ছুটলেন রাজার মোড়ের দিকে।
বাড়ির কাছাকাছি পৌছাতেই পিকু বাবা মাকে ডেকে বাইরে নিয়ে এলো। ওদের বাবা মা ওদের কাছে পেয়ে খুব খুশি হলো। তবে সেটা স্বল্পক্ষনের জন্য, কিছুক্ষণ পরই ছেড়ে আসা ঘরটা কাটা কলাগাছের মতো ভেঙে পড়লো। ঘরটায় যেন কোনো বিস্ফোরক দ্রব্য রাখা ছিল এমন ভাবে আগুন লেগে গেলো সেই ঘরে! কিছুক্ষণের মধ্যেই ভিড় জমা হোলো ধ্বংসস্তুপের চারপাশে। ধীরে ধীরে গোটা ঘরটা যেন কোনো অত্যাশ্চর্য জাদুবলে কর্পুরের মতো উবে গেলো। মনে হচ্ছে যেন ওখানে আগে কোনো বাড়িই ছিলো না। অন্ধকারের মধ্যেই একটা লাল গাঢ় আলোর বৃত্ত সেইখানে আবির্ভূত হয়েছে।
সেই বৃত্ত ধীরে ধীরে একটি বিশাল গর্তের রূপ নিয়েছে এখন। অভয়াচরণ আর দেরি করলেন না, তিনি একটা নীল রঙের অদ্ভুত বোতল বের করলেন। তারপর উদাত্ত গলায় অজানা কোনো মন্ত্র পড়লেন! পড়ার সাথে সাথেই শোনা গেলো ছোটো ছোটো মেয়েদের অতৃপ্ত আত্মার কলরব, ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে এলো অনেকে। ধীরে ধীরে একটা লাল আলোর বলয় ঠাকুর মশাইয়ের বোতলে এসে জমা পড়লো। আবার সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে এলো।
এক অনুসন্ধিৎসু জিজ্ঞেস করলো -“ওই অশরীরী দের বিনাশ না করে আপনি বোতলে সংরক্ষণ করলেন। আবার যদি ওরা কোনোভাবেই বেরিয়ে আসে? ”
অভয়াচরণ কোনো জবাব দিলেন না। তিনি পিকুর পরিবারকে সঙ্গে নিয়ে দূরে গিয়ে একস্থানে বসলেন। তারপর এই জায়গাটার ভয়ঙ্কর ইতিহাস মনে করালেন। পিকুর বাবা এখানকার নন, তবুও এই এলাকায় কানাভুলোর সেই আতঙ্কের ঘটনা জানতেন। কীভাবে একটার পর একটা সদ্য কৈশোরে পা দেওয়া কিশোরীদের বশীভূত করে এই গর্তের কাছে নিয়ে এসে… । কিন্তু ঘটনাটাকে নেহাত একটা লোককথা ভেবে উড়িয়ে দিয়েছিলেন। এখন বুঝতে পারছেন কত বড়ো ভুল করেছেন! ঠাকুরমশাইয়ের দিকে একবার গভীর শ্রদ্ধার দৃষ্টিতে তিনি তাকালেন। ধন্যবাদ জানানোর ভাষা তার নেই।
সদ্য গৃহহীন হয়েও বাবার মনে এক প্রশান্তির ছাপ! কিছুক্ষণ পর তিনি বললেন-“ আমি শুনেছিলাম সেইসময় কানাভুলো কে আপনি মেরেছিলেন মধ্য বয়সে এসে। কিন্তু এবার তা করলেন না কেন? ”
অভয়াচরণ একটা চওড়া হাসি হাসলেন, তারপর বললেন-“কী জানো সব তথাকথিত অশুভ শক্তিকে বিনাশ করতে নেই! তাদের কে যদি সঠিক সময়ে পরিচালনা করা যায় তাহলে সেটাই হয়ে উঠে শুভ শক্তি। এটাও তাই, এই ক্ষয়িষ্ণু, শিরদাঁড়া ভাঙা সমাজ সোজা করে রাখতে কখনো কখনো এদের প্রয়োজন। আরও যদি কিছু ভালোভাবে বুঝতে চাও, তাহলে পিকুর স্বপ্নটা একবার শুনে নিও।”
কথাগুলো বলে নীল বোতলটা তিনি দিলেন পিকুকে, তারপর ঘাড়ে হাত রেখে বললেন- “ব্যাটা, যা কিছু হয়ে যাক। অন্যায়ের বিরুদ্ধে শিরদাঁড়া সোজা করে দাঁড়াতে শিখবি । এটা খুবই প্রয়োজন। ”
অভয়াচরণ ভট্টাচার্য ধীরে ধীরে স্কুটারে স্টার্ট দিয়ে অন্ধকারে মিলিয়ে গেলেন।
পিকু নীল বোতলটাকে জীবনের মহামুল্যবান সম্পদের মতো আগলে রেখে চলতে লাগলো বাড়ির দিকে। পিকু অনুভব করলো বোতল থেকে একটা সুগন্ধি আসছে! বাড়ি কি আছে, বাড়ি তো নেই! তবে?
কিন্তু অকুস্থলে পৌছে ওরা হতবাক হয়ে দেখলো বাড়ি তো আবার যেন পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে! ভাই অভি বললো- “ চলো সবাই, পরশু আবার আমার জন্মদিন। কাকে নেমন্তন্ন করতে হবে তার একটা, লিস্টি বানাতে হবে। কেউ না থাকুক,অলি তো থাকছেই। শুধু একটাই প্রার্থনা এবার যেন ভুলিয়ে নিয়ে যাস না ডিয়ার!
আতঙ্কের কথামালা গল্প – সমাপ্ত
আপনাদের লেখা আমাদের ওয়েব সাইটে জমা দিতে গেলে, অনুগ্রহ করে আমাদের লেখা-জমা-দিন মেনু-তে ক্লিক করুন ও নিজেকে Author হিসেবে Register করুন এবং আমাদের পরবর্তী আপডেট পেতে আমাদের ফেসবুক পেজ অনুসরণ করুন।
অন্যান্য
শ্রাবণ সন্ধ্যা
শাস্তি
তিতির কান্না