হাসতে নেইকো মানা গল্প – প্রসূন কুমার দত্ত
১. ব্যাকরণ
পটল বাবু স্কুলে বাংলা পড়ান। ব্যাকরণ বিশারদ। সুযোগ পেলেই বাক্য সংশোধন করেন, শব্দের উৎপত্তি বলেন বা বানান ভুল ধরেন। একবার বাসে ওনার চেয়ে অন্তত বছর দশেকের বড় এক নিরীহ সহযাত্রীর প্রতিযোগিতা বানানটা সংশোধন করতে গিয়ে এমন তর্ক বাধালেন যে স্কুলের স্টপ ভুলে দু স্টপ পরে নেমে উল্টো মুখি বাস ধরে দেরিতে স্কুলে পৌঁছে ছিলেন।
পটল বাবুর বন্ধু গজা বাবু ব্যাংকে কাজ করেন। খাদ্য রসিক। মাঝে মাঝে পটল বাবুকে ফোন করে আড্ডা মারেন। সেদিনও ফোনটা এসেছিল। প্রথমে নীল গেরুয়া পরে সবুজ মেরুন আর লাল হলুদ নিয়ে কচকচি করে গজা বললেন, সামনের রবিবার বিকেলের দিকে এসো ভায়া পটল। জমিয়ে কেলাব। কেলাবার মানে পটল বাবু জানেন। কথা না বাড়িয়ে ফোন কেটে দিলেন।
গজা বাবু বেশ বলিষ্ঠ লোক। উনি কেলালে রোগা পাতলা পটল বাবু পেরে উঠবেন না। ওনার বেশ ভয় ধরে গেল। ফোনে যে হুমকি দেওয়া হল সন্দেহ নেই। কিন্তু কেন? পটল বাবু মাথা চুলকে মনে করার চেষ্টা করলেন। মনে পড়ল বটে। মাস তিনেক আগে বাজারে গিয়ে কেনাকাটার পর আবিষ্কার করলেন মানিব্যাগটা নিয়ে আসেন নি। দোকানিকে ছশো সতের টাকা দিয়েছিলেন গজা বাবু। ইস্ টাকাটা ফেরত দেওয়া হয় নি।
রবিবার সকাল নটা নাগাদ পাশের পাড়ায় গজা বাবুর বাড়িতে হাজির হলেন পটল বাবু। আরে এসো এসো পটল। গরম গরম ফুলকো লুচি আর সঙ্গে সাদা আলুর তরকারি। গজা বাবুর সাদর আপ্যায়ন। হে: হে: সে সব পরে হবে একদিন। এখন উঠি ভাই। টাকাটার কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। গজা বাবুর অনুরোধ সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান করে টাকা কটা ওনার হাতে গুঁজে দিয়ে উঠে পড়লেন পটল বাবু। তখনই গজা বাবুর সহাস্য প্রশ্ন। কি ভায়া বিকেলে আবার আসছ তো। জমিয়ে কেলানর কথাটা মনে আছে তো। আমতা আমতা করে পটল বাবু বললেন, টাকা তো দিয়েই দিলাম। আবার কেলানর কথা আসছে কেন ভাই। হো হো করে হেসে উঠলেন গজা বাবু। কেলাব কেন ভাই। পানিহাটি তে জামাই বাবাজির বাগান বাড়ি। পাঠিয়েছে গাছের মর্তমান কলা আর রসাল জামরুল। ওগুলো কি আমি একা খাব?
যেন ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল পটল বাবুর। বিকেলে নির্ভয়ে এলেন। গোটা চারেক কলা আর গোটা আষ্টেক জামরুল উদরপূর্তি করে নিছক কৌতুহল নিবৃত্তির উদ্দেশ্যে জিজ্ঞাসা করলেন। হে: হে: এই জমিয়ে কেলান মানে কি গজা বাবু। উত্তর এল। আরে রসিকতা বোঝ না। জামরুল কলা খেয়ে জমিয়ে আড্ডা এই আর কী।
ব্যাকরণ পন্ডিত পটল বাবুর মুখ গম্ভীর। বললেন, বিশেষ্যকে ক্রিয়ায় পরিণত করে অপভ্রংশের অপপ্রয়োগ করে ভাষা আর ব্যাকরণ নিয়ে অহেতুক রসিকতা বড় অশোভন গজা বাবু।
ভ্যাবাচাকা গজা বাবু কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে মিনমিনে গলায় বললেন। জামরুল গুলো চিনির মত মিষ্টি।
২. দাক্ষিণাত্যে ঔরঙ্গজেব
ঔরঙ্গাবাদে ওনার খাস তাঁবুতে বসে আধবোজা চোখে অম্বুরি তামাকের ধোঁয়ায় মজেছিলেন বাদশা ঔরঙ্গজেব। রসভঙ্গ কোরল মুঘল এলাইট সার্ভিসের ওমরাহ ইমতিয়াজ। বয়সে তরুণ। বেশ চালাক চতুর। বৃদ্ধ সম্রাটের অনুগত সেবক।
ইমতিয়াজকে দেখেই সম্রাটের ভুরু কুঁচকে প্রশ্ন : ওহে কী যেন নাম তোমার? হ্যাঁ ইমতিয়াজ। তা মুঘল প্রোটোকল ভুলে গেছ নাকি? এই খাস তাঁবু তে এলে অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছাড়াই ?
ভুলি নি স্যার। তামাকের ধোঁয়ায় আপনার মগজ বোধ হয় একটু…..যাগ্গে। এই সব প্রোটোকল তো দিল্লির লাল কিলা তে। এখানে এই দক্ষিণ ভারতের তাঁবুতে প্রোটোকল আবার কী স্যার?
এই ডেঁপোমির জন্য তোমার কয়েদ হতে পারে জানো? সম্রাট যেখানে লাল কিলা সেখানে সেই আইনটা কী ভুলে মেরে দিয়েছ?
আপনারই ভুল হচ্ছে স্যার। ওই আইনটা আপনিই বাতিল করেছিলেন। আপনার বাবা বাদশা শাহজাহানকে আপনি আগ্রার দুর্গে বন্দী করেছিলেন। শুনেছি মাসুর উকিল আমির ইকবাল তখন এই পয়েন্টেই মুঘল সুপ্রিম কোর্টে সওয়াল করেছিলেন। তাই আইনটা আপনি তুলে দেন।
হ্যাঁ হ্যাঁ মনে পড়েছে। বয়স বাড়ছে তো। তার ওপর এই মারাঠারা বড্ড জ্বালাচ্ছে। চল্লিশ বছর হতে চললো এই দক্ষিণে শিরমাল কোর্মা ছেড়ে রুটি ডাল খাচ্ছি। কোরান কপি আর টুপি সেলাই করে খরচ চালাচ্ছি।
আপনার আবার খরচ কী স্যার? সব কিছুরই তো রিইম্বার্সমেন্ট নেন। তার ওপর কাফের হিন্দুদের এ্যাকাউন্টেট রেখেছেন স্যার। ওরা আবার খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে। বেগমের জন্য বাংলা থেকে মসলিন আনিয়েছিলাম। বিল নাকচ হল। বলে কিনা আমার গ্রেডে অ্যালাউড নয়।
ওদের কাজ তো ওরা করবেই। আমারও তো বিল পাস হয় নি একবার।
জানি স্যার। আপনার হাঁটুর ব্যথার দাওয়াই। ফিরিঙ্গিদের দেশ থেকে ইমপোর্ট করেছিলেন। দেশে এই ওষুধ পাওয়া যায়। তাই নিয়ম অনুযায়ী এই ওষুধ ইম্পোর্ট করা যায় না। আপনি ডিপার্টমেন্ট হেড কে একটু ধমকে পাস করিয়ে নেন।
কী যা তা বলো। ধমকাব কেন। একটু বিবেচনা করার অনুরোধ করেছিলাম মাত্র।
আর তারপর স্যার একটা ব্যাকডেটেড শাহি ফরমান জারি হয়। বেশ কিছু ইম্পোর্টেড জিনিস অ্যালাউড হয়। তার মধ্যে আপনার ব্যথার ওষুধ টা ছিল।
রেভিনিউ আর অ্যাকাউন্ট ডিপার্টমেন্ট আমি হিন্দু অফিসারদেরই আন্ডারে রেখেছি। বেশ ইমানদার এরা। নইলে আমির ওমরাহরা কবে লুটেপুটে ট্রেজারি খালি করে দিত।
তা এতই যদি ইমানদার তো জিজিয়ার বোঝা ওদের ওপর চাপালেন কেন?
বোঝা? মুঘল এলাইটস সার্ভিস পরীক্ষায় ইকনমিক্সে কত পেয়েছিলে হে? তীর্থযাত্রীদের নিরাপত্তা আর সুযোগ সুবিধার জন্য সরকারের বিপুল খরচ হয়। ভর্তুকি অর্থ ব্যবস্থায় প্রতিকূল প্রভাব ফেলে। তাই এই জিজিয়া।
তাহলে মুসলমানদের ছেড়ে দিলেন কেন স্যার?
ছেড়ে দিতে চাই নি। কিন্তু এই মৌলভিদের আমরা মাথায় তুলেছি। ওরা রাজি হল না। শাহি ইমাম নিজে আমায় সাবধান করেছিলেন। পার্সিয়ার অ্যাম্বাসেডর মতও ছিল না। তাই…। যাক এসব ফালতু কথা না বলে কী জন্য এসেছিলে বল।
মানে স্যার আমি দিল্লি গিয়েছিলাম।
জানি আর একটা বিয়ে করতে। নিকার নিয়ম কানুন মেনে করেছো তো। চারটের বেশি তোমার গ্রেডে কিন্তু অ্যালাউড নয়।
আলবাৎ স্যার। কাশী আর মথুরা ও দেখে এলাম। মন্দির দুটোর পাশে নতুন মসজিদ দুটো ভাল মানিয়েছে। কাফের হিন্দুরা খুশি নয়। বাওয়াল করছে। বলছে ওদের ধর্মস্থান অপবিত্র হয়েছে। কোতোয়ালরা নাকি জবরদস্তি, ভাঙচুর আর মারপিট করেছে। আচ্ছা কোরানে এসবের অনুমোদন আছে স্যার?
পবিত্র কোরান হিংসার অনুমোদন দেয় না। কত আর দেখব? এখানে মারাঠারা হাড় মাস কালি করে দিচ্ছে আর ওখানে হতচ্ছাড়া কোতয়ালগুলো ধরে আনতে বললে বেঁধে আনছে। কাশী আর মথুরায় মৌলভিরা ভ্যান ভ্যান করছিল। নামাজের জন্য নতুন মসজিদ চাইছিল। তাই ভাবলাম মন্দির কমপ্লেক্সেই মসজিদ বানিয়ে দিই। আশেপাশে জমিগুলো হিন্দুদের। সরকার জমি অধিগ্রহণ করলে ওদের ক্ষতি হত। ওরাও মামলা করত। সময় লাগত। তাছাড়া এক জায়গায় পুজো আর নামাজ হলে দুই ধর্মের মানুষদের পারস্পারিক সম্প্রীতি বজায় থাকবে। বাদশা হয়ে মদ খেয়ে বিলাসে ডুবে সরকারি খাজানার বারোটা না বাজিয়ে আমি বরাবরই দূরদর্শী হতে চেয়েছি। উত্তরকাল নিশ্চয়ই এক মহান সম্রাট হিসেবে আমার তারিফ করবে।
উত্তরকাল কী করবে তা ভবিষ্যৎ বলবে। আমি তবে এখন আসি স্যার।
হ্যাঁ। এবার যাও। বকবক করে আর আমার মাথাব্যথা আর বাড়িও না। এক পাতা কোরান আমি বরং কপি করি আর একটা টুপি সেলাই করে নি।
৩. চাল নিয়ে কথা চালাচালি
আমরা বাঙালি ভাত খাই তাই চাল কিনি। আতপ বা সেদ্ধ। আতপ পরিবারের পরিমল আছে, তবে তার আভিজাত্য নেই। একেবারে সাদামাটা। বাসমতি অবশ্যই অভিজাত। তবে বাজারে সবাই পূর্ণ দানার নয়, দামের প্রকারভেদে আধা বা পৌনাও আছে। গোবিন্দভোগও আতপ। বাংলায় খ্যাতিমান হলেও দিল্লিতে বিশেষ কল্কে পায় না। আমরা দিল্লী ওয়ালারা বলি মন্দ না। সেদ্ধ চাল মানে সেলারও দাম অনুপাতে প্রকারভেদ আছে। বাংলায় অবশ্য আতপ চালের কদর কম ওখানে সেদ্ধরা রাজা। দিল্লির বাজারে সবচেয়ে ভাল সেদ্ধ চাল গোল্ডেন সেলা। দিল্লিতে অনেক বাঙালি দৈনন্দিন ব্যবহারের জন্য এই গোল্ডেন সেলাই কেনেন। আমরা কিনি পূর্ণ দানার উচ্চমানের বাসমতি, লালকিলা বা দাওয়াত ব্রান্ড।
চালের রকমফের শুধু কী ভাত, পোলাও, বিরিয়ানি আর পায়েস খেতে? মোটেই নয়। কারোর চাল বেড়েছে মনে হলে সে কত হাতা ভাত উদরপূর্তি করেছে জানবার প্রয়োজন হয় না। অনেকের আবার চাল চুলো নেই। তার মানে এই নয় তার বাড়িতে চাল আর রাঁধার উনুন নেই। অনেকের চাল চলন নিয়েও লোকে প্রশ্ন করে। বেচালদের এড়িয়ে চলে। কারোর আবার ঘরের চালের মেরামত দরকার কিন্তু সে দাবার চালে মাত করতে পারে। মেঝেতে পাথর বসাচ্ছিল আব্বাস মিঞা, বলল তাড়াহুড়ো না করে চাল মিলিয়ে বসাতে হবে। ডিমে তা দেওয়ার মত চালে তা দিলে কিন্তু চালতা হবে না।
ভেতো বাঙালি ভাত খায় বটে, চেলো বাঙালি কি চেলো কাবাব খায়? কলকাতায় পার্ক স্ট্রিটের পিটার ক্যাট রেস্তোরাঁর এই খাদ্য বস্তুটা কিন্তু জনপ্রিয় হলেও স্বাদে খুব একটা যে আহামরি তা মোটেই নয়। মাখন ছড়ান ভাতের চালটা কিন্তু বাসমতি গোবিন্দভোগ নয়। তবে এবিষয়ে আর কথা চালাচালি না করাই ভাল।
ব্র্যান্ডেড না কিনলে চাল কেনায় একটু চালু হওয়াই বাঞ্ছনীয়। নইলে কোনো চালাক চাল ওয়ালার চালিয়াতির খপ্পরে পড়তে হতে পারে।
৪. মিন্টু হল mean x 2
মিন্টু বাবুর মিনিস্টার হবার বাসনা ছিল। হতে পারেন নি। অনেকে বলে তার মিনমিনে স্বভাবের জন্য। ওনার আর একটা বাসনাও পূর্ণ হয় নি। শহীদ মিনারের ছাদে উঠে চার মিনারে সুখটান দেবার সৌভাগ্য ওনার হয়নি।
মিনিবাসে করে অফিস যান। মিনিমাম কাজ করেন। লাঞ্চে খরচটা মিনিমাইজ করে মিনি মিল খান। অফিস ছুটি হয় সাড়ে পাঁচটায়। পাঁচটা থেকেই মিনিটে মিনিটে ঘড়ি দেখেন। কোনো কোনো দিন বিশেষত মাসের গোড়ার দিকে অফিস ফেরত মিনার্ভা তে গিয়ে সিনেমা দেখেন। উনি মীন মানে মাছ ভালবাসেন। সিনেমা দেখে তাই সামনের ছোট খাবার দোকানে ঢুকে পড়েন। দোকানটার নাম মিনি হোটেল। মীন ভাজা মানে ফিস ফ্রাই এরা বেড়ে বানায়। মিনিমাম দামে। এই দোকানের মালিকের মেয়ে যামিনী। ডিভোর্সের পরে মেয়েটা এখন বাবার এই দোকান দেখাশোনা করে। মিনিম্যাল মেকআপে মেয়েটাকে মেরেকেটে মোটামুটি দেখতে। মেয়েটার প্রেমে পড়েছেন মিন্টু বাবু। বাড়িতে বিয়ে করা বৌ আছে। তার নাম মিনি। আর্টিস্ট। মিনিয়েচার পেইন্টিং বানায়। মিন্টু বাবুর সঙ্গে তার সম্পর্ক ছিল একসময় ম্যাক্সিমাম। এখন তলানিতে পৌঁছে মিনিমাম হয়ে গেছে। লোকে বলে কোনো এক ছোট খাট মিনিস্টারের পিএর সঙ্গে তার একটু ইয়ে আছে। তবে গুজব ও হতে পারে।
মিন্টু বাবুর means তো তেমন কিছু নয়। তার ওপর মানুষ হিসেবে meanie. তার কথার meaning বোঝা সকলের কর্ম নয়। তার ওপর আছে meaningless joke. লোকে demeaned ফিল করে। মোদ্দা কথা তার demeanor ভাল নয় মোটেই। Dementia আছে একটু আধটু। যামিনী কে ভুল করে দামিনী ডেকে এমন মিনমিন করেছিলেন যে প্রেম পর্বের
অকাল ইতি। যামিনীর দৌলতে ওর বাবা দোকানে না থাকলে মীন ভাজা অর্থাৎ ফিস ফ্রাই মিন্টু বাবু বিনা পয়সায় খেতেন। সেটাও বন্ধ। ঠিক সেরকম কিছু mean করেন নি বলে অনেক মিনতি করেছিলেন মিন্টু বাবু। ফল হয় নি। উল্টে যামিনী বলেই দিয়েছিল মিন্টু মানে mean × 2 মানে double mean.
৫. হিন্দি বলতে হবে
বাংলা নিবাসী বাঙালিদের হিন্দি বলাটা অবশ্যই কৌতুকপ্রদ মানে হাসা হাসির বিষয়। তবে ওদের দোষ নেই। বাংলায় হিন্দি বলার প্রয়োজন নেই কেননা এখানে অবাঙালিরা দিব্যি বাংলা বলে। তাছাড়া ইংরিজি তো রয়েছেই। তবুও নিম্নমানের হিন্দি মানে জরু, জারা, একঠো, দোঠো এই সব বলেই কাজ চলে যায়।
শুদ্ধ হিন্দির পীঠস্থান হল বারাণসী আর প্রয়াগরাজ। শুদ্ধ হিন্দি আর শুদ্ধ বাংলায় তেমন প্রভেদ নেই। সব সংস্কৃত শব্দ বাংলা আর হিন্দিতে সমপ্রয়োজ্য। সোনার কেল্লায় লালমোহন বাবুর হিন্দি নিয়ে রসিকতা যাই হোক না কেন, সাম্প্রতিকতম উপন্যাস হিন্দি আর বাংলায় একই। উচ্চারণে অবশ্য পার্থক্য আছে। বাংলায় সাম্প্রতিকতমো আর হিন্দিতে সাম্প্রতিকতম্। বাংলায় মমতা হল মমোতা আর হিন্দিতে মম্-তা। ওকার আর হসন্তের খেলা আর কিছুই নয়। তবে খামোকা পানি না বলে জল বললেও চলে। হিন্দি ধারাবিবরণীতে মহত্বপূর্ণ কভার ড্রাইভ বলতে যে অর্থে মহত্বপূর্ণ শব্দের ব্যবহার হয় বাংলায় সে অর্থে নয়। আবার বাংলা হরফে দুটো বএর আলাদা উচ্চারণ নেই, তাই সংস্কৃত শব্দগুলোর উচ্চারণ বদলে যায়। Vidya হয় বিদ্যা। হিন্দিতে তা হয় না। হিন্দিতে স্বাভাবিক শব্দের উচ্চারণ সোয়াভাবিক্ বাংলায় সাভাবিক। আমি লিঙ্গ বৈষম্যের বিরোধী। বাংলা ভাষায় লিঙ্গ বৈষম্য না থাকায় খুশি। বচন নিয়েও তেমন ঝঞ্ঝট নেই। তবে সংস্কৃত বা হিন্দিতে এই লিঙ্গ আর বচনের ঝামেলা আছে। তাছাড়া এই দুটো ভাষায় ভক্ষণ অর্থাৎ খানা আর পান অর্থাৎ পিনা সমার্থক নয়। বাংলায় কাটলেট আর মদ দুটোই খাওয়া হয়। হিন্দিতে প্রথমটা খাওয়া হয় বটে পরেরটা পান করতে হয়।
হিন্দির সঙ্গে বাঙালির বিশেষ পরিচয় বলিউড চলচ্চিত্রের মাধ্যমে। সেখানে অবশ্য উর্দু শব্দের ছড়াছড়ি। উর্দু সুমিষ্ট ভাষা। বাংলা আর হিন্দি ভাষাগত মিষ্টতার বিচারে হয়ত উর্দুর চেয়ে একটু পেছিয়ে। ধৈর্যের পরীক্ষা উর্দুতে কি সুন্দর শোনায়। ইন্তেজার কা ইমতেহান! সাদামাটা বিয়ের নিমন্ত্রণ হল অভিজাত দাওয়াত্ এ নিকা। বলিউডের ভাষায় বেশ জোস বা তেজ আছে। কুত্তা কামিনা তেরা টুকরা টুকরা কর্ দুঙ্গা! এই ভাবটা শুদ্ধ হিন্দিতে দুষ্ট সারমেয় তুমকো একাধিক অংশ্ মে খন্ডিত্ কর দুঙ্গা বললে ঠিক প্রকাশ পাবে কি? নিশ্চয়ই নয়।
মোদ্দা কথা হল বাঙালিকে দরকারে হিন্দিতে বলা আর ভাষণ দেওয়ার কোচিং নিতে হতে পারে। কিছুই নয়। প্রথমে শুদ্ধ বাংলায় সংস্কৃত অর্থাৎ তৎসম শব্দগুলো রপ্ত করতে হবে। হিন্দির লিঙ্গ, বচন আর ব দুটোর প্রয়োগ মোটামুটি জানতে হবে। তারপর এগুলোর আধারে রপ্ত করা তৎসম শব্দের ব্যঞ্জনে কিছু উর্দু শব্দের উদার তরকা দিলেই হিন্দি ভাষায় ঝরঝরে তরতরে ভাষণের মচমচে পরিবেশন হয়ে যাবে। সম্বোধনে বন্ধুগন বাদ। ভাইয়োঁ ঔর বহিনোঁ কিংবা মিত্রোঁ বলাটাই উপযুক্ত।
বাংলার বাইরে আধিপত্য বিস্তার করতে হলে মনে হয় নেতাদের হিন্দি ভাষায় ভাব প্রকাশের এই বিজ্ঞান সম্মত প্রশিক্ষণ নিতে হবে। নতুবা চেঁচিয়ে গলা ফাটালেও লোকে বুঝবেনা। ভোট আসবে না।
শেষ করার আগে আর একটা কথা বলে নি। হিন্দি ভাষা বিনম্রতা শেখায়। এই ভাষায় জিতলে হার পরানো হয়। বাংলায় জিতলে মালা পরানো এমন কী মালও খাওয়ানো হয়। পুষ্পহার আর পুষ্পমালার অর্থ বাংলায় আর হিন্দিতে একই। তবু বাংলায় মালা পরানো হয় হার নয়।
হাসতে নেইকো মানা গল্প – সমাপ্ত
আপনাদের লেখা আমাদের ওয়েব সাইটে জমা দিতে গেলে, অনুগ্রহ করে আমাদের লেখা-জমা-দিন মেনু-তে ক্লিক করুন ও নিজেকে Author হিসেবে Register করুন এবং আমাদের পরবর্তী আপডেট পেতে আমাদের ফেসবুক পেজ অনুসরণ করুন।
অন্যান্য
শ্রাবণ সন্ধ্যা
শাস্তি
তিতির কান্না