কলম পাতুরি

ভাবনা আপনার প্রকাশ করবো আমরা

Home » পুজো সংখ্যা ১৪৩১ » সমরের বাড়ি

সমরের বাড়ি

সমরের বাড়ি গল্প – তন্ময় কবিরাজ

১,”আসতে অসুবিধা হয়নি তো?”মোহিনী মোহনকে প্রশ্ন করলেন সমর সেন।

“একদম নয় সমরদা। আমি তো আপনার জন্য অপেক্ষা করছিলাম।”হালকা স্বরে বললেন মোহিনী মোহন গঙ্গোপাধ্যায়।

“আসতে একটু দেরি হয়ে গেল বুঝলেন।”সমর সেনের কথায় অনুতাপ।

“কোন সমস্যা সমরদা?”জানতে চাইলেন মোহিনী মোহন।

“আমার আর কবিতা লিখতে ভালো লাগছে না। বিষ্ণু দে’কে বলে এলাম সে কথা।”

শুনে অবাক হলেন মোহিনী মোহন।”সেকি সমরবাবু, স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত আপনারা লেখা পড়ে বলেছেন আপনারা লেখা টেকসই হবে।আর আপনি কিনা লেখা ছেড়ে দেবেন?

“ভালো লাগছে না মোহিনীবাবু। তাছাড়া আপনি আছেন, মলয় আছে, বীরেন্দ্র, সারদা তো রয়েছে।”বললেন সমরবাবু।

“আপনি চলে গেলে কে লিখবে”মাঝে মাঝে তোমার চোখে দেখেছি/বাসনার বিষন্ন দুঃস্বপ্ন?”মোহিনী মোহন বোঝাতে লাগলেন সমর সেনকে।

“আমার থেকে আপনি যথেষ্ট ভালো লেখেন। আপনারা সেই কথাটা আমাকে আজও শান্তি দেয়,”ক্ষুধার গল্প আছে বলেই অন্নের কথা সবাই বলে।”আপনারা লেখায় চেতনার দম্ভ রয়েছে। মাঝে মাঝে ভাবি, কবিতাই তো আপনারা অস্ত্র।”” শান্ত সমর সেন।

“সমরবাবু, আমার মনে হয়, কবিতাই পারে অশুভ শক্তিকে প্রতিহত করতে। তবে ভালো কবিতা লিখতে গেলে ভালো ভাষা ও জীবনের অভিজ্ঞতা থাকা দরকার। আমি তো সবাইকে বলি আমি আমার ভাষার জন্য প্রান দিতেও রাজি।রবীন্দ্রনাথের বঙ্গাব্দ তেরেশ সংখ্যাটা পড়লে জানবেন মাতৃভাষা কি?”বললেন মোহিনী মোহন।

খানিক ভাবলেন সমর সেন। বিরতির পর উদাস স্বরে বললেন,”পড়েছি মোহিনীবাবু। আসলে রবীন্দ্রনাথ আমার কাছে মহা সমস্যার বিষয় । তাঁর সব লেখা হয়তো আমি বুঝতে পারিনি। তবে তাঁর শেষের কবিতাগুলো অন্য রকম। আমার ভালো লাগে।”

“আপনি তো বললেন না সমরবাবু, অসময়ে কবিতা কেন ছাড়লেন? যে মানুষটা লিখতে পারে “তুমি যেখানেই যাও /… হটাৎ শুনতে পাবে/মৃত্যুর গম্ভীর অবিরাম পদক্ষেপ/আর আমাকে ছেড়ে তুমি কথায় যাবে?”সেই মানুষ কবিতা ছাড়লে কবিতার অসুখ হয়ে যাবে মশাই।”বন্ধুর মতো বললেন মোহিনী মোহন।

“কবিতাকে ছাড়তে চাইনি মোহিনীবাবু। চারদিকের পরিস্থিতি আমাকে বড়ো কষ্ট দেয়। কবিতা বড্ড ব্যক্তি কেন্দ্রিক হয়ে গেছে। সমাজ মানুষ কবিতায় আর নেই। সেদিন মলয়বাবুর সঙ্গেই এ নিয়ে কথা হলো। তিনিও একই কথা বললেন। আপনি তো জানেন,আমি কোনদিন আপস করতে শিখিনি। স্টেটসম্যান, হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ডস এর চাকরি ছেড়েছি। নিজের কথা বলব বলে ফ্রন্টিয়ার বানিয়েছি।”কথার মধ্যে একটা দম্ভ রয়েছে।”আপনারা সব খবর রাখি মোহিনীবাবু। দেশে বিদেশে আপনারা নাম ডাক বাড়ছে। মলয়বাবুর কাছে শুনলাম, কেতকীর পাশাপাশি নাকি মর্মবীনা,নীহার,মুগবেরিয়ার সম্পাদনার কাজও করছেন?”

লজ্জায় পড়ে গেলেন মোহিনী মোহন।”আপনারা প্রশংসা করলে সাহস পাই। তাছাড়া ওগুলো সব পাক্ষিক।”

“সাহস যদি পেতেই হয় তাহলে মলয়বাবুর কাছ থেকে পান।”অভিভাবকের মত বললেন সমর সেন।

“কেন?”

“খবর পাননি? মলয়বাবু তো সাহিত্য অ্যাকাডেমি নিলেন না।”

“লোকটার জেদ আছে সমরবাবু।”স্বীকার করলেন মোহিনী মোহন।

“আক্ষেপ কি জানেন, মানুষটাকে কেউ বুঝলো না। সুনীল সেদিন পাশে থাকলেও সুনীলের নাকি মলয়ের আন্দোলনের ধরনটা পছন্দ নয়। চেনা জানা মানুষের মধ্যে উৎপলকে দেখেছি মলয়ের পাশে দাঁড়াতে। সবার সামনেই উৎপল বলেছিল, আক্রান্ত হবার পরেও মানুষটা মাথা মত করেনি। লোকে বলে মলয়ের কবিতা সবার সামনে পড়া যায় না। আপনি বলুন তো,”নিজের মাথা কেটে পাঠালুম আজকের ভ্যালেন্টাইন দিনে”এই রকম কথা কে বলতে পারে?”

সমরবাবুর সঙ্গে একমত মোহিনী মোহনবাবু।”১৯৬৪সালে যখন গ্রেফতার হলেন তখন আমার খুব খারাপ লেগেছিল। পরে জেনেছিলাম, ভদ্রলোক নাবারডে চাকরি করেন। হাংরি আন্দোলনের প্রাথমিক খসরা তিনিই তৈরি করেছিলেন। যদিও পরে সাহায্য করেছিল সমীর,শক্তি,দেবী।”

“তার পরে আসে বিনয়,উৎপল,ফাল্গুনী।”মোহিনী মোহনবাবুর কথার সঙ্গে বাড়তি তথ্য সংযোগ করলেন সমরবাবু।”কে আর এসব মনে রাখেন বলুন? মাটির গন্ধ না জেনে, মাটির ইতিহাস না জেনেই সবাই এখন কবি। দলের রঙ দেখে রাজনীতি বন্ধ হোক। রাজনীতি করতে হলে দলের আদর্শকে জানতে হবে। মলয়বাবুর নামগন্ধ উপন্যাস কলকাতার প্রকাশকরা ফিরিয়ে দেন। পথের পাঁচালীর মত অবস্থা অনেকটা। আমার একটা মজার কথা মনে হয়, মলয়ের শেষটাই বোধহয় নবারুণ শুরু।”

“ঠিক কথা সমরবাবু।আমি তো আমার কবিতায় এতো আগুণ আনতে পারবো না।”

“আপনারা লেখায় মাটির গন্ধ আছে মোহিনীবাবু। আপনার জাতক কবিতার সেই কথাগুলো – প্রসব যন্ত্রণার কে তুমি আকাশ ফাটাও”। আপনি পুরুলিয়ার মানুষ হতে পারেন, তবে আপনারা লেখায় সাবেক বাংলার গল্প লুকিয়ে আছে।”কথার ফাঁকে থেমে গেলেন। খানিক পরে উত্তেজিত হয়ে সমর সেন বলে উঠলেন,”আপনি জানতে চাইছিলেন না আমি কেন লেখা ছাড়লাম? উত্তরটা আপনারা কবিতা থেকে ধার করেই বলি। গোপাল বাগানের ঝড় কবিতায় আপনি লিখেছিলেন,”বয়স অনেক হলো সত্তর পেরিয়ে গেছি কবে/ভালোবাসাহীন একা পড়ে আছি।”

“এত খুঁটিয়ে পড়েছেন সামান্য অজ শিয়ালডাঙ্গা গ্রামের কবির কবিতা? অবাক মোহিনীবাবু।”এসেছিলাম নতুন কবিতা শোনাব বলে।এতো কিছু পাবো ভাবিনি।রবীন্দ্রনাথের শেষের কবিতার কথা মনে পড়ছে।”

“রবীন্দ্রনাথ, নজরুল আমাকে প্রথম দিকে খুব জ্বালাতো। ওদের মত লেখা হয়ে যেত। পরে অবশ্য নিজেকে আলাদা করেছি।”

এক মাঝবয়সী ভদ্রলোক এসে চা দিয়ে গেলো। সমরবাবু বললেন,”আপনারা চা মোহিনীবাবু।”, ধন্যবাদ জানিয়ে চায়ের কাপটা নিজের দিকে টেনে নিলেন মোহিনী মোহন গঙ্গোপাধ্যায়। সমর সেন প্রশ্ন করলেন, “আপনি এলেন, সারদা কোথায়?”

“আসছে। গীতাঞ্জলির অনুবাদের সমস্যা হয়েছে ওর একটা।”উত্তর দিলেন মোহিনী মোহন।

সমরবাবু গর্বের সঙ্গে বললেন,”মলয়বাবুর মত ঐ একজন আছেন যিনি নিজের জাতির জন্য গীতাঞ্জলি পর্যন্ত অনুবাদ করে ফেললেন। শেখার আছে।”

মোহিনী মোহনবাবু হেসে বললেন,”আমি তো ওনাকে বলি ভানুভক্ত আচার্য্য। ভানু ভক্ত রামায়ন অনুবাদ করেছিলেন আর আমাদের সারদা গীতাঞ্জলি অনুবাদ করলেন।”

“আপনারা পড়াশোনা তো মশাই বেশ গভীর।”

“ওই যে সমরবাবু আপনি একটু আগে বললেন না মাটির গন্ধ। মাটির গন্ধ যেখানেই পাই সেখানেই চলে যাই।”

কথাটা শুনতে ভালো লাগলো।তাই জানতে চাইলেন সমরবাবু,”কি রকম?”

মোহিনীবাবু জমিয়ে বলতে শুরু করলেন,”নেপালের ভানু ভক্ত ছাড়াও যেসব মহা রথীরা আছেন সবার সঙ্গেই ভারতের সম্পর্ক রয়েছে। লেখনথ পাউদিয়াল তো বেনারসে এসেছিলেন। কালিদাস পড়েছেন। গান্ধীজির জন্য কবিতা লিখেছেন। নেপালের শেক্সপিয়ার বাল কৃষ্ণ শামা দেরাদুনে আর্মি ট্রেনিং করেছেন। লক্ষ্মী প্রসাদের জীবন খুব কষ্টের।তিনি চিকিৎসার জন্য রাঁচি এসেছিল। আবার ভুটানের কুনজং চোডেনের কথাই যদি ধরেন তবে তাঁর আসল কাজের বেশির ভাগই উত্তর ভারতে। জানেন সমরবাবু, সাহিত্য তো আর কাঁটাতার মানে না।”

চুপ করে শুনছিলেন সমরবাবু।”সুনীলবাবু প্রায় বলতেন, পড়াশোনা না করলে ভালো লেখক হওয়া যায় না। নিয়মিত পড়াশোনার রেওয়াজ দরকার। এখন যাদের লেখা পড়ি তাদের পড়াশোনা নেই।”

“আপনি রাম দয়াল মুন্ডার নাম শুনেছেন?”

“রাম দয়াল মুন্ডা?”নামটা শুনে অবাক হলেন সমর সেন।

মোহিনীবাবু বুঝতে পারলেন,”একটু অপেক্ষা করুন। সারদাবাবুই বলবেন।”কথার মাঝ পথেই সারদা প্রসাদ কিসকু হাজির। সমরবাবু হাঁক দিলেন, আরোও এক কাপ চা লাগবে।”

ঘরের মাঝখানের টেবিলে তিনটে চায়ের কাপ আর প্লেটে রাখা নোনতা বিস্কুট। খোলা জানালার হালকা হাওয়াতে উড়ছে পাণ্ডুলিপি। গরম চায়ে চুমুক দিয়ে সারদা প্রসাদ বললেন,”এতো আড্ডার মেজাজ”।

২,

“আপনারা জন্যই অপেক্ষা করে আছি আর আপনারই আসতে দেরি।”সিগারেটের ছাইটা ফেলে রসিকতা জুড়ে দিলেন বীরেন্দ্র।”মলয়বাবু আবার সত্যজিতের মত আড্ডাতে ধিতকার এলো না তো?”

“চা’ টা নিই তারপর আপনার প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছি “। কথাটা শেষ করে চায়ের ভাঁড়টা হাতে নিলেন। প্রথম চুমুকে হালকা শক্তি সংগ্রহ করে মলয়বাবু বললেন,”আসতে দেরি হয়ে গেল কারন আমার ওই বৈদ্যুতিক ছুঁতোর প্রকাশের পর থেকেই বিভিন্ন ঝামেলায় জড়িয়ে পড়ছি।আর ওই যে বললেন রায়বাবু নাকি আড্ডা দেখলে সমালোচনা করতেন তাহলে ওনাদের মনডা ক্লাবটা কিসের? আসলে উনি আড্ডার মধ্যে পজিটিভ চিন্তা চেয়েছিলেন। কিন্তু সেটা তো সব সময় সম্ভব নয়। আমাদের দেশের লোক রাজনীতিটা ভালো বোঝে।”

“তাহলে আমাদের মলয়বাবু বলছেন, বাঙালি আড্ডা পছন্দ করে?”বীরেন্দ্রর প্রশ্ন।

“আপনি তো আমাদের পাবলো নেরুদা মশাই, আপনারা তো এগুলো ভালো জানা উচিত। বাকিদের থেকে আমাদের আড্ডার বৈচিত্র্য অনেক বেশি। দিলীপদা, নাড়ুদার চায়ের দোকান আপনি বাইরে পাবেন না। আবার তিনটে চা চার জায়গায় সেটাও পাবেন না।”

“এটা কিন্তু খাস কথা। চায়ের দোকানে না বসলে আদর্শের ভীত মজবুত হয়না।”

“কিরকম?”

“কতো রকমের মানুষ আসে। নিজেদের মত করে যুক্তি দেয়। এক কথায় মিনি দ্বন্দ্ব মূলক বস্তুবাদ। অনেকটা আবার প্লেটোর আড্ডার অ্যাকাডেমিক, সিনকোনিজিমের মত।”

“বাবা, বীরেনবাবু আপনি তো সোজা ক্লাসিকে চলে গেলেন।  আমেরিকার রোটারি ক্লাবের কথা ভুলে গেলেন? আমাদের দেশেও কিন্তু অনেক ইতিহাস রয়েছে।”

“যেমন?একটু শুনি”

“ব্যাসদেবের মহাভারত পড়তে হবে আপনাকে। ঠাকুরবাড়ির বারান্দায় রবীন্দ্রনাথ আর রথেনস্টাইনের গল্প করার ঠেক ছিল। মোগলযুগে জাহাঙ্গীরের ঠেকে আড্ডা দিতে আসতেন এডওয়ার্ড টেরি। আমি তো শুনেছি, চৌরঙ্গীর আড্ডা থেকেই রায়বাবু পথের পাঁচালীর কথা ভেবে ছিল। বীরেনবাবু, যাঁরা বাংলা ভাষাতে খিস্তি মেরে শেষ করে দিল আজ তারা ভাষার ধ্রুপদীতা দাবি করে।”

বীরেন্দ্র সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলেন,”বাংলা তো পুরনো ভাষা।

মলয়বাবু বললেন,”হলেই বা। তথ্যের মধ্যে বিতর্ক রয়েছে।”

কাপের চা’টা শেষ করলেন। বীরেন্দ্রবাবু প্রস্তাব দিলেন,”আর এক কাপ হোক।”

“হলে মন্দ হয় না।”হাসলেন মলয় রায়চৌধুরী।

নতুন কাপটা হাতে ধরে মলয়বাবু খবর নিলেন,”লেখালিখি কেমন চলছে বিরেনবাবু?”

“চলছে। তবে সেটা কবিতা কিনা জানি না।”

“কেন?”

“আমার কবিতায় সে ভাবে রূপক আসে না। যা দেখি তাই লিখি।” উত্তর দিলেন বীরেন্দ্র।

“তবে আপনার কবিতায় কিছু কালজয়ী কথা আছে,”রক্ত রক্ত শুধু রক্ত দেখতে দুই চোখ অন্ধ হয়ে যায়।”

“এটা উত্তর পাড়া কলেজ কবিতার লাইন।”

“আবার একটা লাইন ছিল,”রুটি দাও রুটি দাও/ রুটি বড়ো দরকার”।কি ভাবে লেখেন এসব লাইন?”

“আপনিও তো দারুন লিখছেন।”

“আমার কথা ছাড়ুন। আপনারাটা বলুন।”

“আসলে কি জানেন, জীবনে তো অনেক কিছুই দেখলাম, সেটা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ হোক, ঢাকার আন্দোলন,তেভাগা। মুজিবর, হচি মীনকেও চিনেছি। আমার মাঝে মাঝে ভলতেয়ায়ের সেই কথাটা মনে পড়ে যায়, যেখানে কর্তা ভুল সেখানে সমাজের রোগ কে সরবে? বিপ্লবের দরকার।”

“সেতো আপনারা কথার মধ্যেই রয়েছে,”বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক।”

“আমি তো পলাতক হতে চাইনি।”

“হওয়ায়টা উচিতও নয়। কবিরা সব সময় পদাতিক।”

“আমি ভালোবাসাকেই ধর্ম বলে মনে করি। আমার কবিতাতেও সে কথা বলেছি,”আমার ঈশ্বর নেই বলে/সবাই আমাকে উপহাস জুড়ে দেয়।”

কথার শেষে আবার একটা সিগারেট ধরালেন মলয়বাবু।”বীরেনবাবু একটা পিকনিকের আয়োজন করুন।সব কবিরা আসবে সেখানে।”

“হোক না। আমার কোনো আপত্তি নেই মলয়বাবু। কিন্তু আপনার লেখা নিয়ে কি সব অভিযোগ উঠছে।”জানতে চাইলেন বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।

“আমার লেখাতে অভিযোগ সে আবার নতুন কি? তা আপনি নতুন কি শুনলেন?”

নিচু স্বরে বীরেন্দ্রবাবু জানালেন,”আপনারা লেখা নাকি শালীনতার মাত্রা অতিক্রম করেছে। আপনারা একটা লাইন আছে না,”আমি কখনও কোনো প্রেমিকের স্তনে দাঁত বসাইনি।”

“যারা এগুলো বলে তাদের যৌনতা সম্পর্কে জ্ঞান নেই। প্রতি বছর রাশিয়াতে ১ লা সেপ্টেম্বর গর্ভ দিবস পালন করা হয়। ফুকো তাঁর বইতে লিখছেন, আঠারো উনিশ শতকে যৌন চাহিদা এতো বেশি ছিল যে তাকে বিয়েতে আটকে রাখা যায়নি।আরে মশাই যৌনতা আদিম খিদে। তাকে আপনি শিক্ষিত করবেন কি করে? মহারাজ রণজিৎ সিং প্রকাশ্যে যৌন ক্রিয়া করতেন। জোহান বাচোফোনের একটা বিখ্যাত বই ছিল। নামটা সম্ভত মাদার রাইট। বইটা পড়লে মানুষ ফালতু কথা বলতো না। ক্যাথি আকার, সুসি বাইটরা মেয়েদের যৌনতার অধিকারে পজিটিভ জেন্ডার আন্দোলন করেছিলেন।”

“এতো রাজকীয় ব্যাপার। শুনুন মলয়বাবু, আমার কোনো আপত্তি নেই। আপনি আপনারা মত করে চালিয়ে যান।”

“ধন্যবাদ। তবে আমার পিকনিকের প্রস্তাবটা যেন আপনারা মাথায় থাকে।”

“থাকবে।”ঘাড় নাড়ালেন বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।বললেন,”কাল সমরবাবুর বাড়ি যাবো। সারদা আসবে। ওখানেই কথা হবে।”

“বেশ যান।আমি এদিকের ঝামেলাগুলো মিটিয়ে নেই।”

উঠে পড়লেন মলয় রায়চৌধুরীর। বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় চলে গেলেন রাস্তার পাশ দিয়ে মলয়বাবুর সমান্তরালে।

৩,

আদ্রা স্টেশনে ট্রেনের অপেক্ষা করছেন সারদা প্রসাদ। গন্তব্য কলকাতা। নিজের কিছু কাজ আছে, সঙ্গে সমরবাবু ডেকেছেন। হটাৎ দেখা হয়ে গেল রাম দয়াল মুন্ডার সঙ্গে। সারদা প্রসাদ দেখতে পাননি। নিজের গীতাঞ্জলি অনুবাদের প্রুফ দেখছিলেন। রাম দয়াল পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন।”এতো মনযোগ দিয়ে কি পড়ছেন? আমাদের কিছু শোনান। কবির মুখ থেকে কবিতার শোনার অনুভূতিটা আলাদা।”

লজ্জিত সারদা প্রসাদ। নিজেকে সামলে বললেন,”আসলে শহরে যাবার আগে ভালো করে দেখে নিচ্ছি।”

“তা একটা কবিতা শুনি।ট্রেন তো আসতে দেরি আছে।”রাম দয়ালের আবদার।

“আমার থেকে জবার অনুবাদ আরোও ভালো। দাঁড়ান আমি ওঁর একটা কবিতা শোনাচ্ছি।”কথা শেষ করে ব্যাগ থেকে বইটা বার করে জবার একটা কবিতা শুনালেন। খুশি হলেন রাম দয়াল।বললেন,”আপনি কিন্তু ভাষার জন্য ভালো কাজ করছেন।”

“আমি আর কি করলাম? যা করার সে তো মাঝি রামদাস টুডু, রঘুনাথ মুর্মুরাই করে গেছেন। তাঁরাই তো আসল। আমরা তো শুধু বহন করছি মাত্র। এই আপনাদের রুহি দাস সিং নাগের কথাই ধরুন।”

“ঠিক কথা। ওনার অবদানেই জেনিভা যাওয়া। একটা ব্যাকরণ বই লিখলাম জানেন। কেমন হয়েছে জানি না। তবে ভালো করার চেষ্টা করেছি বলতে পারেন।”বললেন রাম দয়াল।

“আপনাদের সক্রিয়তার অভাব। জয়পাল অনেক চেস্টা করেছে। শুনেছি রাজেন্দ্র প্রসাদকে চিঠিও লিখেছে। তার কোনো উত্তর আসেনি বোধহয়?”

রাম দয়াল অবাক, সারদা প্রসাদ বেশ খবর রাখেন। তাই তিনিও বললেন”উনি তো রামগড় অধিবেশনেও যোগ দিয়েছিলেন।”কথার মাঝে খানিক বিরতির পরে রাম দয়াল বললেন,”এসব বাদ দিন। আপনি তো একাই একশো। আর কতো কাজ করবেন? এবার থামুন।”

একটু আবেগতাড়িত হয়ে পড়লেন সারদা প্রসাদ।”আসলে কি জানেন, ভাষাই শিক্ষার বাহন। আমি তো ভাষার জন্যই বলি ,”লাহা হর রে”। শুধু বড়োদের কথা ভাবলে হবে না। বাচ্চাদের কোথাও ভাবতে হবে।”

“আপনি তো বাচ্চাদের জন্যও কাজ করেছেন। আপনা গীদরা বাউলি আমি পড়েছি।”বললেন রাম দয়াল।

শুনে খুশী হলেন সারদা।”আরোও কিছু বই বার করেছি।পড়বেন।”

“নামগুলো একটু বলুন।”

“সালোম লটম, ভূর্কা ইপিল,গান গদর।”

“পড়বো।”ভাবুক হয়ে পড়লেন রাম দয়াল।”সারদাবাবু আমরা কি বেশি অনুবাদ করে নিজেদের ক্ষতি করছি?”

উত্তরটা সারদার কাছেই ছিল।তাই বললেন,”এনিয়ে রূপ চাঁদ হাঁসদাকে প্রশ্ন করেছিলাম।তিনি বলেছিলেন, অনুবাদের দরকার আছে। যেহেতু আমাদের সৃষ্টি কম, তাই খিদে মেটাতে ধার করতেই হবে।”

“আমার তো ভয় হয় অনুবাদে যেনো আবার নিজেদেরটাই না হারিয়ে যায়।”সাবধানী রাম দয়াল।

ট্রেনের খবর হলো। উঠে পড়লেন দুজনই। রাম দয়াল বললেন,”কাল অশোক সিংহের একটা কবিতা পড়লাম। শুনবেন?”

“বলুন।”

রাম দয়াল শোনালেন,”এখন আমরা কোথায় দেখা করবো ফুলমনি/কোন জঙ্গলে কোন পাহাড়ে/দুজনের দেখা হবে।”

ট্রেন চলে গেল। ফাঁকা হতে থাকল ব্যস্ত স্টেশন।

৪,

সমরবাবু পাণ্ডুলিপি সরিয়ে চায়ের কাপটা রাখলেন।”সারদাবাবু আপনাকে নিয়েই একটু আগে কথা হচ্ছিল। আপনি নিজেও জানেন না আপনি কি অসম্ভব ভালো কাজ করছেন। আপনারা গ্রামের লোকেরাই সাহিত্যকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। কলকাতার লোকেরা তো বাঙালি সাহিত্যকে বেচে দিতে পারলে বাঁচে।”

“আমি তাগিদ থেকে করেছি সমরবাবু।আমি চাই আমার ভাষাটা বাঁচুক। ভাষা না থাকলে জাতির বিকাশে হবে না।”

মোহিনী মোহনবাবুর দিকে তাকিয়ে সমর সেন বললেন,”সবাই যদি ওনার মত করে ভাবতে পারতো তাহলে জাতির মর্যাদা আজ এতটা নষ্ট হতো না। আমাদের নতুন করে শুরু করতে হবে।”

কথার মাঝেই বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় হাজির।”নতুন প্রস্তাব তো আমার কাছে।”

কথাটা শুনে সবাই অবাক। বীরেন্দ্রবাবু বললেন,”মলয়বাবু পিকনিকের প্রস্তাব দিয়েছেন।”

মোহিনী মোহন বললেন,”দারুন প্রস্তাব। তবে মলয়বাবু ফরাসি শব্দের পিকনিক না বলে বনভোজন বলতে পারতেন।”

পাশ থেকে সারদা প্রসাদ বললেন,”তখন তো আপনারাই বলতেন রবীন্দ্রনাথের অচলায়তন থেকে টুকেছে।”

সবাই হাসলো শুনে। সমর সেন বললেন,”আমাদের আবার ফিরতে হবে। আমাদের এক জোট নাহলে বাংলা ভাষার মত বাংলা কবিতাও মরে যাবে।”

সারদা প্রসাদ বললেন,”তাহলে দিন ঠিক করে জানিয়ে দেবেন।”

সমরবাবু হালকা হাসিতে জবাব দিলেন,”সামনের শীতে। আর আপনারা ওখানেই হবে। লাল পাহাড়ির দেশে।”

সারদা প্রাসাদ চিন্তিত।”আমি পারবো এতো দায়িত্ব নিতে? আপনারা শহুরে মানুষ।”

সারদা প্রাসাদ বাদে সবাই একসঙ্গে বলে উঠলো,”পারলে তুমিই পারবে। এতটা পথ যখন আসতে পেরেছো তখন বাকিটা পথও তুমি চলে যেতে পারবে। আমরা তোমার পাশে আছি।”

সমরের বাড়ি গল্প – সমাপ্ত

আপনাদের লেখা আমাদের ওয়েব সাইটে জমা দিতে গেলে, অনুগ্রহ করে আমাদের লেখা-জমা-দিন মেনু-তে ক্লিক করুন ও নিজেকে Author হিসেবে Register করুন এবং আমাদের পরবর্তী আপডেট পেতে আমাদের ফেসবুক পেজ অনুসরণ করুন।

error: Content is protected !!