কলম পাতুরি

ভাবনা আপনার প্রকাশ করবো আমরা

Home » পুজো সংখ্যা ১৪৩১ » সুন্দর বনের আতঙ্ক

সুন্দর বনের আতঙ্ক

সুন্দর বনের আতঙ্ক গল্প – রমেন্দ্র নাথ মিশ্র

আষাঢ় মাসের মাঝামাঝি হতে চললো, তবু এবার খুব একটা বৃষ্টি হচ্ছে না। আমি আমাদের ছাদের ঘরে বসে বাইরে আকাশ দেখছিলাম । এমন সময় সিঁড়িতে দুপদাপ শব্দ শুনে পিছন ফিরে তাকালাম, দেখি রাহুল ঘরে ঢুকছে। সে হাজির হয়েই বলল “ঝটপট চল। অরন্যদাদু এসেছেন। তোকে ডাকতে বললো আমায়।” অরন্যদাদু আসলে পল্টন এর দাদু । পেশায় ছিলেন একজন ফরেস্ট রেঞ্জার। দীর্ঘ চাকরিজীবনে ঘুরেছেন অনেক জায়গায়। মাস চারেক পর পর আসেন পল্টনদের বাড়ি আর তখন আমাদের দারুন দারুন গল্প বলে শোনান। এর আগে যখন এসেছিলেন তখন সমুদ্রগড়ের এক জমিদারবাড়ির দারুন এক ভৌতিক অভিজ্ঞতা আমাদের শুনিয়েছিলেন। 

পল্টন দের বাড়ি পৌছতে না পৌছতেই বড়ো বড়ো ফোঁটায় বৃষ্টি নেমে গেল । বাড়ির সামনের বারান্দাটায় ইতিমধ্যেই বাকিরা এসে উপস্থিত হয়েছে। সজনে খুব খেতে ভালোবাসে,  এবং যথারীতি একটা চিপসের প্যাকেট থেকে চিপস বার করে খেতে লাগলো। একটা চেয়ার আছে যেটায় দাদু এসে বসবেন । আমি আর রাহুল দুজনে বসার সাথে সাথেই কফির কাপ হাতে নিয়ে অরন্যদাদু এসে বসলেন । বসার পর, আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘তারপর। খবর কি সবার? পড়াশোনা কেমন চলছে?’ 

‘ভালো চলছে দাদু’ 

 ‘বাঃ! বাঃ! বেশ, তারপর সজনে তুই কি নতুন কোনো খাবার খেলি? নাকি পুরনো গুলোই জাবর কাটছিস ।’

সজনে চিপস চিবোতে চিবোতেই বললো, ‘আমি কি গরু যে জাবর কাটবো’। পল্টন এইসময় পিছন থেকে কিছু একটা বলে সজনে কে রাগিয়ে দেওয়ার তাল করছিলো, কিন্তু আমরা ওকে মানা করলাম। 

অরন্যদাদু কফির কাপে চুমুক দিয়ে বললেন, ‘চল, তাহলে তদের আজ একটা অন্য গল্প শোনাই, সুন্দরবন, বাংলার মানুষদের গর্ব করার মতো এক ঐতিহ্য। প্রকৃতি এমন একটি বনস্বর্গ আমাদের উপহার দিয়েছে যেটা নিয়ে সারা বিশ্বের কাছে গল্প করা যায়। বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশীদার এই সুন্দরবন। গঙ্গা এবং ব্রহ্মপুত্রের মোহনায় অবস্থিত পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বন আমাদের এই সুন্দরবন। কী নেই এখানে? বিশ্ববিখ্যাত রয়েল বেঙ্গল টাইগারের আবাসস্থল এই বনভূমি। আরও আছে চিত্রা হরিণ, কুমির, বিষাক্ত সাপ, কচ্ছপ আরও কত কী! এছাড়া আছে সুন্দরী, গরান, কেওড়া গাছের মতো বিচিত্র রকমের গাছ। এই ঐতিহ্যবাহী জঙ্গলে আছে পরিবার নিয়ে মানুষের বসবাস। তারা মধু সংগ্রহ করে, কাঠ কেটে, মাছ ধরে তাদের জীবিকা নির্বাহ করে চলে। এসব জীবিকা নির্বাহ করে থাকার সময় এসব মানুষদের কত যে বিপদের সম্মুখীন হতে হয় তার ইয়ত্তা নেই। মধু সংগ্রহ বা কাঠ কাটতে যাওয়ার সময় বাঘে নিয়ে যাওয়ার ভয়, সাপ কামড়ানোর ভয়, নদীতে মাছ ধরতে যাওয়ার পর কুমিরের ভয় ইত্যাদি সর্বদা তাদের চিন্তার কারণ। তবুও মানুষ থাকে সেখানে। তাদেরকে থাকতে হয়। আর তাদের সাথে থাকে তাদের দেবতারা l মানুষজন এখানে বসবাস শুরু করার পর আরও জায়গা প্রসারণ করতে গাছ কাটা শুরু করে টিলমেন হেনকেল এর সময়, যিনি যশোর জেলার ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন সুন্দরবন জায়গাটি মানুষের জন্য বিপদসঙ্কুল। সেখানে থাকতে থাকতে মানুষজন বিভিন্ন ধরনের বিপদের সম্মুখীন হয়। আবার বিপদের সাথে থাকতে থাকতে তারা বিপদ থেকে মুক্তির বিভিন্ন উপায়ও আবিষ্কার করে ফেলে। উপায়গুলোর মধ্যে কিছু আধ্যাত্মিক, আবার কিছু ব্যবহারিক, যেমন কুমিরদের নিয়ে এখানকার গ্রামবাসীরা আতঙ্কের মধ্যে থাকে। সেজন্য পরিবারের মেয়েরা কুমির ব্রত পালন করে, যাতে করে তারা কুমির দেবতাকে সন্তুষ্ট করতে পারে। আবার মধু সংগ্রহের জন্য মৌয়ালরা যখন বনের ভিতরে যায় তারা সাথে করে বাউলিদের (Tiger Charmer) নিয়ে যায়। বাউলিদের সম্পর্কে মনে করা হয় যে তারা বাঘ সামলাতে ওস্তাদ। বিভিন্ন মন্ত্রবলে তারা বাঘকে কাছে আসতে দেয় না বা আসলেও তাদেরকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। বাউলি যারা হয় তাদের আবার বিভিন্ন নিয়মের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। যেমন, শুক্রবার যেহেতু জুম্মাবার, তাই এই দিন তারা জঙ্গলে যেতে পারবে না, কাঁকরা কিংবা শূকরের মাংস খেতে পারবে না, সুদের কারবার করতে পারবে না ইত্যাদি। এগুলো মূলত মুসলমান যারা তাদের জন্য প্রযোজ্য। তবে এই অঞ্চলে বাউলিদের জীবনই সবচেয়ে কঠিন এবং অতিরিক্ত ঝুঁকিপূর্ণl  সুন্দরবনের মানুষদের আচার আচরণ, রীতিনীতি, জীবনযাত্রার ধরণ, তাদের বিশ্বাস-অবিশ্বাস, আর্থ-সামাজিক অবস্থা ইত্যাদি জানার একটি উপায় হচ্ছে সশরীরে গিয়ে তাদের সাথে কথা বলা বা সাক্ষাতকার নেয়া। আবার আরেকটি উপায় আছে। সেটা হচ্ছে তাদের পুঁথি পড়া। পুঁথিগুলোতে মূলত সেই অঞ্চলের দেব-দেবীর বর্ণনাই বেশী দেয়া আছে। মূলত হিন্দু এবং মুসলমান এই দুই ধর্মের মানুষদের বসবাস এই সুন্দরবনে। মুসলমানদের মধ্যে সেখানে আছে শেখ, সাইয়িদ, পাঠান ইত্যাদি। অপর দিকে হিন্দুদের মধ্যে সেখানে দেখা যায় নাপিত, কৈবর্ত, চণ্ডাল, জালিয়া, ধোবা, যোগী ইত্যাদি শ্রেণীর মানুষদের। এদের বেশীরভাগই হিন্দুদের শূদ্র গোত্রের। জীবিকার জন্য তাদেরকে বনের উপর নির্ভর করতে হয় এবং প্রকৃতির সাথে লড়াই করে বেঁচে থাকতে হয়। সেই জন্য তারা তাদের বিপদ ও সমস্যা সমাধানের জন্য নিজেদের ধর্মীয় বিশ্বাস এবং দেবতাদের উপর নির্ভর করে থাকে। দেবতাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশী আলোচিত দক্ষিণ রয় এবং বনবিবি। বনবিবির উৎপত্তি নিয়ে খুব সুন্দর একটি প্রবন্ধমূলক লেখা পড়া যাবে এখানে।দক্ষিণ রায়কে মনে করা হয় বাঘের দেবতা হিসেবে। সুন্দরবনের বসবাসরত মানুষ তার পূজা করে থাকে। বিভিন্ন রকমের কাল্পনিক ঘটনা আছে তাকে ঘিরে। এই ঘটনাগুলো মানুষের মুখে মুখে রচিত। দক্ষিণ রয়কে অনেকে শিবের পুত্র বলে মনে করে থাকে। আবার অনেকে মনে করে যে, গণেশ দেবতার মাথা শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন করার পর সেটা দক্ষিণ দিকে ছুটে গিয়ে পড়ে যায় এবং সেখান থেকেই এই দেবতার সৃষ্টি। মরহুম মুন্সী মোহাম্মদ খাতের এর রচিত “বনবিবির জহুরনামা”-তে আছে যে, দক্ষিণ রায়কে জঙ্গলের অপদেবতা বা শয়তান বলেও অনেকে বিশ্বাস করেন।অপরদিকে বনবিবি হচ্ছে জঙ্গলের আরেক দেবতা যে সবাইকে রক্ষা করে থাকে। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, বনবিবির উপস্থিতিকে হিন্দু এবং মুসলমান উভয় ধর্মীয় সম্প্রদায়ের লোকজনই বিশ্বাস করে এবং এর শক্তিকে ঐশ্বরিক শক্তি হিসেবে মনে করে থাকে। কিন্তু দুই ধর্মের মানুষদের বনবিবির জন্য ধর্মীয় আচারপূর্ণ অনুষ্ঠান ভিন্নভাবে হয়ে থাকে।
মুসলিমরা এই দেবতাকে বনবিবি বলে থাকে এবং হিন্দুরা তাকে বনদেবী বলে। হিন্দুরা বনদেবীকে মাতৃদেবতার কাতারে স্থান দিয়ে থাকে। সেবার এক আশ্চর্য অভিজ্ঞতা হয়েছিলো বলি শোনো ,’তখন আমার পোস্টিং ছিলো সুন্দরবনে। চামটায় আমার অফিস। জানিস তো, আমাদের ভারতবর্ষে সুন্দরবনের মতো সুন্দর জিনিস আর একটাও নেই। আমি যে সময়ের কথা বলছি তখন সুন্দরবনে বাঘের উপদ্রব এখনের থেকে অনেক বেশি। আমার এলাকায় শুধু বাঘ নয়, তার সাথে চোরাশিকারিরাও ভীষণ জ্বালাচ্ছে। কিছুদিন আগেই এখানের একটা বেশ পরিচিত পুরনো বাঘের মৃতদেহ আমরা পেয়েছিলাম। 
চোরাশিকারিদের গুলিতে বাঘ টা মারা যায়। কিন্তু গার্ডরা এসে যাওয়াতে ওরা দেহটা ফেলেই পালিয়ে গেছিলো। তা, একদিন অফিসে বসে বিকেলে কাজ করছি; এমন সময় একজন গার্ড এসে বললো, ‘স্যার। আপনার ফোন এসেছে। বড়োসাহেব ফোন করেছেন’। ‘ চামটা অঞ্চলের বড়োকর্তা অসীম গাঙ্গুলি বেশ রাশভারি মানুষ। কাজে একটু গাফিলতি দেখলে ভীষণ খুঁতখুঁত করেন। আমি তড়িঘড়ি গিয়ে ফোন ধরলাম। ফোনে বড়োসাহেব আমাকে জানালেন যে দলটা সেদিন ওই বাঘ টাকে মেরেছিল চর মারফত খবর এসেছে যে তারা আজ তেঁতুলবাঁকির চরে থাকবে সবাই। আমি যেন একদম দেরি না করে সেখানে পৌঁছে যাই। আর ওদের গ্রেফতার করি। আমি জানিয়ে দিলাম যে একটু পরেই বেরচ্ছি।’দাদু এই পর্যন্ত বললেন এবং সঙ্গে সঙ্গেই একটা কানফাটানো আওয়াজ করে বাজ পড়লো কাছেই কোথাও। আর পটাইদের সি এফ এল লাইটটা দপ করে নিভে গেল।লোডশেডিং। মেঘের জন্যে অনেক তাড়াতাড়ি অন্ধকার নেমে এসেছে আজকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই পল্টন এর দিদি এসে একটা বড়ো বাটিতে করে মুড়িমাখা আর একটা দেওয়ালগিরি রেখে গেলেন। দাদুও চেয়ার থেকে নেমে এসে একমুঠো মুড়ি মুখে দিয়ে আবার শুরু করলেন। 
 ‘তারপর ফোন পাওয়া মাত্রই তো আমি দু জন ফরেস্ট গার্ড সাথে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। একটা খাল ধরে মিনিট খানেক চলার পরেই আমাদের লঞ্চ এসে কালিন্দী নদীতে পড়লো।এইসময় নদীতে বেশ জল থাকে, তাই আমাদের লঞ্চ জলের ঢেউয়ে বেশ দুলতে লাগলো। ততক্ষণে সন্ধে হয়ে গেছে, চাঁদের হালকা আলো এসে পড়েছে নদীর জল আর দু পাশের ঝোপ ঝাড়ের ওপর। এরকমভাবে, প্রায় মিনিট কুড়ি চলার পর একটা অপেক্ষাকৃত সরু খালে আমরা ঢুকলাম। এটাই কুমিরমারির খাল। তেঁতুলবাঁকির চর এর শেষেই। এই তেঁতুলবাঁকির চরের খুব একটা সুখ্যাতি নেই। এখানে বাঘের উপদ্রব বেশ ভালোই। দিনের বেলা এদিক দিয়ে যাওয়ার সময় প্রায়ই দেখা যায় কোন না কোন দ্বিপে পতপত করে উড়ছে এই বাদা অঞ্চলের সবথেকে ভয়ানক নিশান, একটা লাঠির ডগায় আটকানো একটা ছেঁড়া শার্ট বা গেঞ্জির টুকরো।’ 

 আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘দাদু, এই চিহ্ন টা কেন সবথেকে ভয়ানক।’ দাদু বললেন , ‘আসলে কি জানিসতো ওখানের মানুষদের জীবন খুব একটা সহজ নয়। এই নিশানটা একদিকে যেমন ভীষণ কষ্টের সেরকম আবার সাবধানের ও। আসলে কি বলত; যদি কোন মানুষকে কোন দ্বিপে বাঘে নিয়ে যায় বা মেরে ফেলে তাহলে তার দলের সাথীরা তার একটা কাপড়ের টুকরো লাঠির ডগায় আটকে সেটাকে পুঁতে দেয়। তার মানে এখানে বাঘে মানুষ মেরেছিল,’  
 ‘তা শোন তারপর, সুন্দরবনের অনেক দ্বীপেই অনেক ভাঙ্গাচোরা কুঠিবাড়ি আছে জানিস । বেশিরভাগই হ্যামিলটন সাহেবের আমলে তৈরি। এই তেঁতুলবাঁকির চরেও একটা আছে। চোরাশিকারিদের সেইখানেই পাওয়া যেতে পারে এই আশায় আমরা সেটার দিকেই এগোলাম। চারিপাশে বুনো হেতাল,গরান এর ঝোপ তার ভেতরেই , সন্ধের অন্ধকারে একটা প্রাচীন জন্তুর মতো দাঁড়িয়ে আছে বাড়িটা। দরজা-টরজার কোন বালাই নেই। আমরা খুব সাবধানে, যথাসম্ভব শব্দ না করে ভেতরে ঢুকলাম। কিন্তু, বাড়িটা পুরো ফাঁকা। চোরাশিকারি কেন কয়েকটা ইঁদুর ,চামচিকে ছাড়া আর কিছু নেই। আমরা এটা দেখে বেশ একটু দমে গেলাম। তাহলে কি আমরা যে আসবো এটা ওরা আগের থেকে জেনে গেল। যাকগে, এতটা এসেছি যখন অপেক্ষা করেই যাই।

 তিনজন মিলে একটা ঘরে বসলাম ঘাপটি মেরে। আমার সঙ্গে যে দুজন গার্ড ছিল তাদের একজনের নাম বিকাশ প্রামানিক আর একজনের নাম ইসমাইল। বিকাশ আগে ছিল বাউলে, তার একমাত্র ছেলে কে বাঘে নিয়ে যায়। তারপর সে ফরেস্টের চাকরিতে যোগ দেয়। ইসমাইল আমাদের লঞ্চ এর ড্রাইভার। সন্ধে গভীর হতেই জঙ্গলের চেহারা পাল্টে গেলো। বাইরের গাছপালার ভিতর থেকে নানা পোকামাকড় আর ঝিঁঝিঁর শব্দ আমাদের কানে আসছে। দূরে কোথাও হরিণ ডেকে উঠলো শুনতে পেলাম। টর্চ জ্বেলে ঘড়িটা দেখলাম একবার, আটটা বাজে। 

এই পর্যন্ত বলে দাদু একটু থেমে জল খেলেন কিছুটা। আমরা তখন সবাই ঘন হয়ে বসেছি। ভেজা ঠাণ্ডা হাওয়া দেওয়ালগিরির আলোটাতে একটু কাঁপন ধরিয়ে দিল সাথে আমাদের ছায়াগুলো কেঁপে গেলো। দাদু একটা মৌরি লজেন্স মুখে দিয়ে আবার বলা শুরু করলেন, 

‘আমরা তো বসে আছি আর বিকাশ মাঝে মাঝে জানলা দিয়ে উঁকি মেরে বাইরেটা দেখছে। আমি তাকে মানা করতে যাচ্ছিলাম তখন আমার মনে হোল বাইরেটা বড্ড বেশি চুপচাপ হয়ে গেছে। সব পোকামাকড় এর আওয়াজ যেন চলতে চলতে দুম করে বন্ধ হয়ে গেছে। ঠিক সেই সময় আওয়াজটা শুনতে পেলাম আমিও। বাইরের খালের জলের ছলাত ছলাত শব্দ ছাপিয়ে আমাদের কানে এলো একটা অস্পষ্ট ফ্যাসফ্যাসে কণ্ঠস্বর ,কে যেন হাহাকার করে ডেকে যাচ্ছে , ‘ বাবা ! এই তো আমি। তোমার গদাই । আমার কাছে এসো বাবা। শব্দ টা যেনো সেই ঘরের মেঝে থেকে আসতে লাগলো,  মনে হচ্ছে এই ঘরের ভেতরে কেউ আছে, তারপর বাইরে থেকে আওয়াজ এলো সেই কাতর কন্ঠে l
যেন আমাদের আশেপাশের হেঁতাল, গরানের ঝোপের ভিতর থেকে হাওয়া সেই আওয়াজ কে আমাদের কাছে ঠেলে পৌঁছে দিচ্ছে, যেন তাকে দিতেই হবে না দিয়ে তার একদমই উপায় নেই,ইতিমধ্যে বিকাশের দেখি মুখচোখের ভাব বদলে গেছে। সে একবার বাইরের দিকে তাকিয়ে কাকে যেন খোঁজার চেষ্টা করলো তারপরেই , ‘দাঁড়া গদাই আসছি’ বলে ছুটে বেড়িয়ে গেলো ঘর থেকে। সঙ্গে সঙ্গে দেখি ইসমাইল ও ‘সর্বনাশ, স্যার শিগগির আসুন’ বলে বেড়িয়ে গেলো। আমি বাইরে এসে দেখি অন্ধকার অনেক বেড়ে গেছে। সমস্ত দ্বীপের সব কিছুর মধ্যে থেকে যেন ওই অশরীরী কণ্ঠস্বর তার সেই ডাক আমাদের কাছে পৌঁছে দিচ্ছে, বাবা ! এই তো আমি। আমার কাছে এসো বাবা , এসো । 

বিকাশের পিছনে যেতে যেতে আমি ইসমাইল কে জিজ্ঞেস করলাম, ‘গদাই কে? আর বিকাশ ওরকম ভাবে বেড়িয়ে গেলো কেন? ‘ ইসমাইল বললো, ‘স্যার, গদাই বিকাশদার ছেলে, ওকে বড়ো মামু নিয়েছিল গতবছর। এ বেগো ভূত স্যার। তাড়াতাড়ি চলেন, নইলে বিকাশদারে বাঁচানো যাইব না। এই ঘরের মধ্যেই ওর ছেলের আধ খাওয়া মৃত দেহ পাওয়া গিয়েছিল ” কথাটা শুনে আমার সমস্ত শরীর বেয়ে যেন একটা আতঙ্কের স্রোত নেমে গেলো। যাকে বাঘে মেরে ফেলেছে সেই ছেলে আবার ডাকে কি করে? 

 বিকাশ দৌড়েছিল কুঠিবাড়ির পিছন দিকটায়। এ দিকে জঙ্গল বেশ গভীর। সে জঙ্গলে ঢুকে যাওয়ার কিছুটা আগেই ইসমাইল জোরে দৌড়ে তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। আমি তাদের কাছে যাওয়ার মধ্যেই ইসমাইল বিকাশ কে মাটিতে ফেলে তার ওপর চড়ে বসেছে আর বিকাশ ছটফট করছে। আমি বিকাশ কে জিজ্ঞেস করতে যাব এই সময় আমার চোখ পড়লো সোজাসুজি। আমরা যে জায়গাটায় দাঁড়িয়েছিলাম সেখান থেকে একটু দুরেই গভীর জঙ্গলের শুরু।

 জায়গাটায় অনেক ঝোপঝাড় আর পুরো হাকুচ অন্ধকার। সেদিকে চোখ পড়তেই আমার সমস্ত শরীর যেন আতঙ্কে হিম হয়ে গেলো। ওই অন্ধকারের মধ্যেও স্পষ্ট দেখলাম একটা সুন্দরি গাছের নীচে যেন অন্ধকার জমাট বেঁধে আছে। ঘন মিশকালো অন্ধকার দিয়ে তৈরি একটা আদিম, ক্রুর অপার্থিব ছায়ামূর্তি আমাদেরকে দেখছে। আমাদের আশেপাশের সেই ডাক কিন্তু তখন ও অবিরাম ভেসে বেড়াচ্ছে বাতাসে। ইসমাইল ও মনে হয় সেই মূর্তিকে দেখে একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল সে সুযোগে বিকাশ তাকে এক ঘুষিতে ছিটকে ফেলে দিয়ে উঠে দাঁড়ালো। আমি তখন নড়তেই পারছি না। পা দুটোকে অসম্ভব ভারী মনে হচ্ছে। যেন এ আমার নিজের পা নয়। আমার ইচ্ছেতে এ কিছুতেই নড়বে না। বিকাশের আর হাতখানেক মতো বাকি মূর্তিটার কাছে পোঁছতে এইসময় বাঘের গর্জনে পুরো দ্বীপটা কেঁপে উঠলো, আর মুহূর্তের মধ্যে ওই মূর্তিটার পাশ থেকে একটা প্রকাণ্ড বাঘ এসে বিকাশের ঘাড়ে পড়লো আবার পলক ফেলার আগেই তাকে নিয়ে উধাও হয়ে গেল। আর আমার ও চোখের সামনে সব ঝাপসা হয়ে এল।’

আমরা সবাই তখন এ ওর গায়ে ঘেঁষে বসেছি পুরো। দাদু থেমে যেতেই সবাই বলে উঠলাম, ‘তারপর! তারপর!’ 

‘তারপর জ্ঞান ফিরলে দেখি ইসমাইল খাল থেকে জল এনে আমার মুখে চোখে জল দিচ্ছে। ওর হাত ধরে উঠে বসলাম। মাথাটা ঝিমঝিম করছিলো । মূর্তিটা যেখানে ছিল সেদিকে তাকিয়ে দেখি কিছু নেই ফাঁকা, আর ঝিঁঝিঁ ও পোকামাকড়ের ডাক আবার শোনা যাচ্ছে।আমরা বিকাশের দেহ টা অনেক খুঁজলাম কিন্তু পেলাম না কিছু আর। তারপর ফিরে এলাম।’ 

এই পর্যন্ত বলে দাদু চুপ করলেন। বৃষ্টি পড়লেও তার তোড় সেরকম বেশি নয় এখন। হালকা বিদ্যুতের আলোয় এক ঝলক পল্টন দের রঙ্গন ফুলের গাছটা দেখতে পেলাম।  পল্টন জিজ্ঞেস করলো , ‘দাদু বাঘ টা ওখানে ছিল যে তোমরা টের পাও নি?’ দাদু একটু হাসলেন, বললেন, ‘ তোদের বলেছিলাম তো কিছুদিন আগে আমার এলাকায় একটা বাঘের মৃতদেহ পাওয়া গেছিল।’ আমরা বললাম, ‘হ্যাঁ , হ্যাঁ বললে তো।’ 

‘সেই বাঘটার মৃতদেহ আমি দেখেছিলাম। বাঘটার লেজ ছিল না। হয়তো কোন লড়াই তে বা চোরাশিকারি রাই হয়তো কেটে নিয়েছিল।’ তারপর একটু চুপ করে থেকে বললেন, যে বাঘটা বিকাশ কে সেদিন তুলে নিয়ে গেলো সেই বাঘটারও লেজ ছিল না।’  এরপর কিছুক্ষণ চুপ থেকে দাদু আবার বলতে লাগলেন, ‘এই ঘটনার পর আমি একদিন খবরের কাগজ পড়ছি এমন সময় এক নতুন যুবক ফরেস্ট অফিসার এসে আমার সাথে আলাপ করে বলেছিলেন তিনি এই অঞ্চলে নতুন এসেছেন  আমি যেনো তাকে কাজগুলো বুঝিয়ে দেই l এরপর বেস কয়েক মাস কাটার পর একদিন সেই যুবক অফিসার কে আর খুঁজে পাওয়া গেলো না গত রাত্রে সে কিসের ডাক্ শুনে বাড়ির বাইরে গিয়েছিলো তার পর আর সে ফেরেনি সেদিন আমি শহরে গিয়েছিলাম, পরের দিন এসে শুনে বুঝেছিলাম সেও একই ডাক্ শুনেছিল যে ডাক আমরা শুনেছিলাম l আমি একজনকে সাথে করে তাকে খুঁজতে  বেরোব এমন সময় কয়েক জন যুবক সেই অফিসার কে ধরা
ধইরা করে আমার ঘরে এনেছে তার পর আমি তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করতেই তাদের মধ্যে থেকে একজন বলে চললো “হুজুর গত কাল ভোর রাত্রে আমরা মাছ ধরতে খালে যাচ্ছিলাম এমন সময় দেখি এই বাবু হতে আলো নিয়ে কি যেন খুঁজছেন, এমন সময় দূরে এক বাঘ হুঙ্কার করতে করতে ইনার দিকে আসছে, অমনি আমরা মশাল জেলে বাঘের দিকে এগোতে বাঘ টা এক লাফে উনার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে যাবে উনি তখন ছোট্ট পিস্তল দিয়ে তিনবার গুলি চালা লেন বাঘ টার দিকে তাক করে l কিছু সময়ের জন্য বাঘ টি মাটিতে পড়ে গেলো l এই সময় আমরা এঁকে নিয়ে এসে আমাদের নৌকা য় তুলে মেশিন স্টার্ট করলাম l যেতে যেতে আমরা দেখলাম সেই আহত বাঘ আবার উঠে দাঁড়িয়ে বিকট হুঙ্কার করে হেলে দুলে বনের মধ্যে হারিয়ে গেলো l তবে হ্যাঁ বাঘটার লেজ কাটা ছিলো l লোকে বলে ওই লেজ কাটা বাঘ টা আসলে  ভূত  বাঘ l” এই ঘটনার কয়েক দিন পর নতুন অফিসার আমাকে বলেছিলেন, ওই দিন রাতে ওকে ওপর থেকে আদেশ দেওয়া হয়েছিলো ওই বনে চোরা শিকারী আসবে তাদের ধারার জন্য ওকে রাত জেগে পাহারা দিতে হবে l তাই রাতে খাওয়া দাওয়া শেষ করে উনি বনের মধ্যে সেই পুরোনো কুঠি বাড়িতে তিনজন বন্দুক ধারি সিপাহী নিয়ে আশ্রয় নেন l পাহারা দিতে দিতে গভীর রাতে কখন জানি তারা ওই ঘরের মেঝেতে ঘুমিয়ে পড়ে l শেষ রাতে মেঝেতে ঘুমন্ত অবস্থায় কার ডাক শুনে উঠে বসে l
সেই  ডাক শুনে বনের মধ্যে যায় কিছুদূর গিয়ে  একটি বড় গাছের কাছে গিয়ে দেখে সেখানে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে করতে তার নাকে এক অপার্থিব সুগন্ধ আসতে থাকে, সেই সুগন্ধ নেশা লাগিয়ে দেয় l এরপর সে বাইরে বনের মধ্যে দিক বিদিক শূন্য হয়ে ঘুরতে থাকে l তারপর যা হয়েছে তাতো তোমাদের বললাম l

দাদুর কথা শেষ হতে না হতেই আবার জোরে বিদ্যুৎ চমকে উঠলো আর কোথা থেকে জানি দমকা একটা হাওয়া এসে নিভিয়ে দিয়ে গেল দেওয়ালগিরিটা। 

সুন্দর বনের আতঙ্ক গল্প – সমাপ্ত

আপনাদের লেখা আমাদের ওয়েব সাইটে জমা দিতে গেলে, অনুগ্রহ করে আমাদের লেখা-জমা-দিন মেনু-তে ক্লিক করুন ও নিজেকে Author হিসেবে Register করুন এবং আমাদের পরবর্তী আপডেট পেতে আমাদের ফেসবুক পেজ অনুসরণ করুন।

error: Content is protected !!