কলম পাতুরি

ভাবনা আপনার প্রকাশ করবো আমরা

শাস্তি

শাস্তি গল্প – সুজিত পাছাল

ষোলো নাম্বার ন্যাশনাল হাইওয়ে দিয়ে মসৃণ গতিতে ড্রাইভ করে কোলাঘাটের দিকে এগিয়ে চলেছে সায়ন্তন। পাশের সিটে দীপ্তি কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছে। খোলা জানালা দিয়ে দামাল বাতাস ঢুকে এলোমেলো করে দিচ্ছে তার চুল। সস্নেহে স্ত্রীর মুখের থেকে চুল সরিয়ে দেয় সায়ন্তন। তারপর লুকিং গ্লাস দিয়ে একবার পিছন সিটেও নজর বুলিয়ে নেয় সে। সেখানে পরম নিশ্চিতে ঘুমিয়ে আছে তাঁদের বছর তিনেকের ছেলে টুবলু। দেখে মনে মনে হাসে সায়ন্তন, “উফফ বাপ রে বাপ, মা ছেলেতে ঘুমোতেও পারে, গাড়ি চলতে না চলতেই ঘুমিয়ে একেবারে কাদা।”

সায়ন্তন মুখার্জি একজন সরকারী উচ্চপদস্থ কর্মচারী। সারা বছরই প্রায় তাঁকে চরম ব্যস্ততার মধ্যে দিয়েই চলতে হয়। তাই অনেক দিন থেকেই দীপ্তির বেড়াতে যাওয়ার আবদারে নীরব থাকতে হয়েছে তাঁকে। দীপ্তি অবশ্য তার জন্য কখনও জোর করেনি সায়ন্তন কে। সে সায়ন্তনকে বোঝে। তাই আজ অফিস থেকে সামান্য ছুটি নিয়ে বেরিয়ে পড়েছে সায়ন্তন। গন্তব্য ঝাড়গ্রামের বেলপাহাড়ি অঞ্চল, উদ্দেশ্য সেখানকার স্নিগ্ধ প্রাকৃতিক  পরিবেশে কিছুটা ভালো সময় কাটিয়ে আসা।

— কি গো কখন পৌঁছাব আমার? 

ঘুম জড়ানো গলায় হাই তুলতে তুলতে প্রশ্ন করে দীপ্তি। 

— আশা করি আর ঘন্টা দেড়েকের মধ্যে পৌঁছে যাব। তবে তার আগে চলো কোথাও দাঁড়িয়ে কিছু খেয়ে নেওয়া যাক। টুবলুরও বোধ হয় খুব খিদে পেয়েছে। 

পিছনের সিটে ঘুমিয়ে থাকা টুবলুর মাথায় আদর করে হাত বুলিয়ে দেয় দীপ্তি। তারপর বলে, “চলো তাই করা যাক।”

                        ২. 

রাস্তার পাশে একটি ধাবাতে পেটাই পরোটা, ঘুগনী ও সিদ্ধি ডিম সহযোগে ব্রেকফাস্ট সেরে আবার গাড়িতে স্টার্ট দিল সায়ন্তন। কিছু দূর যেতে না যেতেই রাস্তার দুপাশের পরিবেশ বদলে যেতে শুরু করল। দীপ্তি মুগ্ধ নয়নে উপভোগ করতে থাকে সেই দৃশ্য। মাঝে মাঝে নিজের আধো আধো কথায় নানান প্রশ্ন করতে থাকে টুবলু, 

— মাম্মাম ওগুলো কি গাছ? 

— ওগুলো শাল গাছ সোনা। 

বলে দীপ্তি। 

এক সময় তাঁরা পৌঁছে যায় পালক গেস্ট হাউসে। তাদের অগ্রিম বুকিং করাই ছিল, গাড়ি গেস্ট হাউসের গেটে লাগতে না লাগতেই দারোয়ান তড়িঘড়ি এসে গেট খুলে দিল। 

গাড়ি থেকে নেমে চারপাশের মনোরম প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখে ওদের মন ভরে গেল। ‘পালক গেস্ট হাউস’- সত্যিই সার্থক হয়েছে নামটি। গেস্ট হাউসটি তিন দিক অনুচ্চ পাহাড়ে ঘেরা। সত্যি যেন পাহাড়ের কোলে পালকের মতো ভাসছে সেটি। 

গেস্ট হাউসের এলাকাটি বিশাল। সমগ্র এলাকাটির ইতিউতি মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে শাল, পলাশ, কেন্দু ও মহুয়া গাছের দল। 

এই মাত্র যে লোকটি ওদের দরজা খুলে দিয়েছিল সে-ই ওদের মালপত্র একে একে নামাতে লাগল। তাঁকে উদ্দেশ্য করে সায়ন্তন প্রশ্ন করল, 

 — এই যে শুনছ, তোমার নাম কি? 

 — আমার নাম  সাবুরাম মুর্মু বাবু। 

— আর সবাই গেল কোথায়? কাউ কে দেখেছি না যে? 

সাবুরাম কিছুক্ষণ হাত কচলে উত্তর দেয়, 

— আজ্ঞে বাবু , আর কেউ তো নেই। আমি একাই সব দেখাশোনা করি। 

শুনে একটু অবাক হয়ে যায় সায়ন্তন। এত বড় জায়গার দেখা শোনা করার মাত্র একটি লোক। তাই যেন জায়গাটা আরও নিরিবিলি লাগে। তবে দীপ্তি বা টুবলুর ওসব দিকে খেয়াল নেই। তাঁরা ইতিমধ্যেই গেস্ট হাউসের দক্ষিণ পূর্ব কোণের ট্রি হাউসটাতে গিয়ে উঠেছে। 

টুবলু এর আগে কোনো দিন ট্রি হাউস দেখেনি। গাছের এত উপরে ঘর, আবার সেই ঘরে চড়াও যায় দেখে সে খুব মজা পেয়েছে। সায়ন্তনও আর কথা না বাড়িয়ে গাছের সাথে বাঁধানো মই বেয়ে তরতর করে উঠে যায় সেখানে। ছোট্ট ঘরটি থেকে দূরের পাহাড়ের কোলে ছোটো ছোটো গ্রাম গুলি দেখে সত্যি জায়গাটার প্রেমে না পড়ে থাকা যায় না। বছরের এই সময়ে শালের পাতা ঝরে যায় এবং নতুন করে পাতা গজায়, ফলে শালের জঙ্গলের সৌন্দর্য কয়েকগুন বেড়ে যায়। ওরা মুগ্ধ হয়ে পাহাড়ী বন্য জঙ্গলের রূপ মাধূর্য্য উপভোগ করতে লাগল। 

এই ভাবে বেশ খানিকটা সময় পার হয়ে যায়।  শেষে সাবুরামের হাঁক ডাকে ওদের খেয়াল হয়, এই রে অনেকটা বেলা হয়ে গেছে তো। ওরা তড়িঘড়ি উপর থেকে নেমে আসে।

— বাবু, দুপুর হইয়ে আইসছে, এই বেলা ছেনান ছেরে নেন। দুপুরের রান্না আমার হয়ে গেছে। আপনাদের ছেনান করা হলেই বেড়ে দেব। 

— ঠিক আছে ।

সাবুরামের কথায় ছোট্ট করে উত্তর দিয়ে ওরা এই প্রথম গেস্ট হাউসটির ভিতরে প্রবেশ করল। ঢুকেই গেস্ট হাউসের বাহার দেখে ওদের তাক লেগে গেল। পুরোনো আমলের সেকেলে বাংলো প্যাটার্নের বাড়িটি এখনও দেখলে মনে মনে সমিহ জাগে। চারিদিক ঝকঝক করছে, কোথাও এত টুকু মলিনতার ছাপ নেই। দেখে সাবুরামের কাজের প্রতি বেশ শ্রদ্ধা জাগে। সত্যি লোকটা একা হাতে সব কিছুর খুব ভালো ভাবে খেয়াল রাখে। 

                       ৩.

দুপুরে স্নান সেরে এক সাথে খেতে বসল দীপ্তি ও সায়ন্তন। টুবলুকে আগেই খাইয়ে ঘুম পড়িয়ে দিয়েছে দীপ্তি। সাবুরাম খাবার রেখে দিয়ে নিজের বাড়ি চলে গেছে। গেস্ট হাউসের পশ্চিম দিকে কাঁটা তারের বেড়া সামনেই তার ছোট্ট এক চালা ঘর। দীপ্তি একবার তাঁকে জিজ্ঞাসা করায় সে বলেছিল তাঁর সংসার বলতে সে আর তার স্ত্রী। এছাড়া তাঁর পরিবারে আর কেউ নেই। সাবুরামের কথায়, “দুই মানুষে থাকি বাবু। সারা দিন হাউসের কাজকম্ম দেখাশোনা করি, রাতে দুজনে মিলে ধম্মকম্মে মেতে থাকি, এতেই বেশ দিন চলে যায়।” দিন যে চলে যায় তা তো আজ সারা দিন দেখেই বুঝে গেছে দীপ্তি আর সায়ন্তন। অসম্ভব রকম পরিশ্রম করতে পারে লোকটি। যখন থেকে ওরা এসেছে ওদের নানা কাজ সে একাই করে চলেছে। তবে এখনও সাবুরামের বউয়ের সাথে ওদের দেখা হয়নি। সে হয়তো ঘরকন্নার নানা কাজে ব্যাস্ত আছে। 

সাবুরামের অন্যান্য কাজের মতো তাঁর রান্নার হাতটিও চমৎকার। সারা দিনের পথশ্রমে খিদেটা একটু বেশিই লেগেছিল, তার উপর সাবুরাম যখন ভাত, বেগুনি, ঘন ঘন মুগের ডাল আর দেশী মুরগীর মাংস কষা দিয়ে গেল তখন খাওয়াটা যে কখন গুরু পাক হয়ে গেছে বুঝতে পারেনি সায়ন্তন ও দীপ্তি । তারপর খাওয়া সেরে একটা লম্বা ঘুম দেয় ওরা। 

ঘুম যখন ভাঙল তখন সূর্য পশ্চিম আকাশে পাড়ি জমিয়েছে। পূব দিকের পাহাড় গুলিতে অস্তমিত সূর্যের রক্তিম আভা লেগেছে। বাগানে পেতে রাখা চেয়ার গুলিতে বসে সেই দৃশ্যই উপভোগ করছে ওরা। টুবলু একটা ঘাস ফড়িংয়ের পিছনে ছুটে চলেছে। এমন সময় চা দিয়ে যায় সাবুরাম। চায়ে একটা ছোট্ট চুমুক দিয়ে সায়ন্তন তাঁকে জিজ্ঞাসা করে, 

— আচ্ছা সাবুরাম এখানে বেড়নোর জায়গা কি আছে? 

— আজ্ঞে বাবু, আসে পাশে কিছু আদিবাসী গেরাম আছে। পশ্চিমে ওই দিকে তিনকোনিয়া গেরাম। সেখানে বনদেবী বেদী আছে। সেখানে যেতে পারেন বাবু দেবী খুব জাগ্রত। 

— হুম বুঝলাম। আর কিছু নেই। 

— কেন থাকবে না বাবু। এই যে, এই পূব দিকে গেলে পরবে কাঁকড়াঝোর গেরাম। সেখানে আবার শনিবার বিকেলে হাট বসে। সেখান থেকেই খানিক দূরে গেলে ময়ূরঝর্না যাওয়া যায়। একসময় সেখানে নাকি একটা ঝর্ণা ছিল আর পাশের মহুয়া আর শালের বনে ময়ূরে দল ঘুরে বেড়াত। তবে আজ সে ঝর্নাও আর নেই, আর নেই ময়ূরের দলও। শুধু নামটাই রয়ে গেছে। 

— আচ্ছা, সাবুরাম দা তোমার বউয়ের সাথে তো দেখা হল না? 

এতক্ষণে  প্রশ্ন করে দীপ্তি। এই হচ্ছে দীপ্তির একটা বড় গুণ। সে সবাইকেই খুব সহজে আপন করে নেয়। 

—  তার শরীলটা কদিন থেকে ভালো যাচ্ছে না মেডাম। তাই বাইরে তেমন বেরোয়নি। আচ্ছা দাঁড়ান তাকে ডেকে আনি। 

বলে আর কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে হনহন করে হেঁটে নিজের চালা ঘরটার দিকে চলে যায় সে এবং কিছুক্ষণ পরে একটি স্ত্রীলোক তার পিছু পিছু ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। স্ত্রীলোকটির আলুথালু কাপড় আর শুকনো মুখ দেখে সে যে অসুস্থ তা বলে দেওয়ার অপেক্ষা রাখে না। 

— আজ্ঞে ও আমার বউ, ওর নাম বিন্দি।

বিন্দি চুপচাপ মুখ নীচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। তাঁকে দেখে সায়ন্তন বলে, “আচ্ছা তুমি যাও।” তার কথা শুনে বিন্দি তেমনি নিঃশব্দে চলে যায়। 

পরিস্থিতির অস্বস্তি কাটাতে সাবুরামই প্রথম কথা বলে ওঠে। 

— ও এমনিতেই একটু চুপচাপ তার উপর শরীলটাও কদিন ধরে ভালো যেচ্ছে না। ঠিক আছে বাবু আপনারা বসেন। আমি দেখি রাতে আপনাদের জন্য কি ব্যবস্থা করতি পারি। 

বলে সাবুরাম চলে গেল। 

— অদ্ভূত তো! সাবুরামের বউকে 

দেখে শরীরের থেকেও মনের অসুখ বেশি আছে বলে আমার মনে হয়। 

বলে সায়ন্তন।

— তোমার না এই এক দোষ। তুমি সব কিছুকেই সন্দেহের চোখে দেখ। চল সন্ধ্যা হয়ে আসছে আর এখানে বসে থেকে কাজ নেই। চলো ভিতরে যাওয়া যাক। টুবলু চলো বাবা আর খেলা নয় এবার ভিতরে যাই। 

মাটিতে বসে একমনে মরা ঘাস ফড়িংটাকে নিয়ে কি করছিল টুবলু। তাদের কথার ফাঁকে কখন সেটাকে ধরে তার ভব লীলা সাঙ্গ করে দিয়েছে সে। মার কথায় খেলা ছেড়ে উঠে পড়ে সে। সায়ন্তনও আর বসে না থেকে উঠে পড়ে ভিতরে যাওয়ার জন্য। ওদের পিছু পিছু সন্ধ্যাটাও আরও গাঢ় হয়ে নেমে আসে চারিদিকে। 

                      ৪. 

 এক সময় সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত নামল। আকাশে এক ফালি চাঁদ উঠেছে। তারই মরা জ্যোৎস্নায় চারিদিক মায়াময় দেখাচ্ছে। শাল গাছের নবীন পাতা গুলো সেই জ্যোৎস্না মেখে যেন এক একটি রুপোর ফলকে বদলে গেছে। 

গেস্ট হাউসে কোন রান্না ঘর নেই। সাবুরাম রান্নাবান্না তার ঘরেতেই করে। তার চালার উপর দিয়ে ধোঁয়া উড়তে দেখে দীপ্তি বলল, 

— সাবুরাম বোধহয় এখনও রান্না করছে। 

— সেই রকমই তো মনে হচ্ছে। 

অন্য মনষ্ক ভাবে উত্তর দেয় সায়ন্তন। 

— এই তোমার কি হয়েছে বলত, এত সুন্দর জায়গায় বেড়াতে এসেও বিকাল থেকে দেখছি কেমন অন্য 

মনষ্ক হয়ে রয়েছ। 

— কিছু না, এমনি। 

এমন সময় খাবার হাতে সাবুরামকে আসতে দেখা গেল। 

— বাবু, এই বেলা খাবার গরম আছে, বেড়ে দেই? 

সায়ন্তন দেখল ঘড়িতে প্রায় সাড়ে আটটা। এই অজ পাড়াগাঁয়ে খামোখা রাত জেগে কি হবে। তারচেয়ে তাড়াতাড়ি খেয়ে ঘুমিয়ে নেওয়া যাবে। 

— হ্যাঁ, দিয়ে দাও। 

রাতের আয়োজন সামান্যই রুটি, ডিমের কারী আর গরম গরম বাড়িতে বানানো বোঁদে। ওরা তাড়াতাড়ি খাওয়া দাওয়া সেরে ঘুমতে চলে যায়। 

কিছুক্ষণ এপাশ ওপাশ করেও ঘুম আসছে না সায়ন্তনের চোখে। বিছানার অপর পাশে দেখে মা ছেলের কোনো দিকে ভ্রুক্ষেপ নেই, নিশ্চিন্ত মনে নিদ্রা দেবীর পুজা করে চলেছে তাঁরা।

অনেক চেষ্টাতেও যখন একেবারেই ঘুম আসল না, তখন আর থাকতে না পেরে বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ে সে। বেডরুম লাগোয়া ছোট্ট বারান্দাটিতে তখনও কয়েকটা বেতের মোড়া পাতা ছিল। তার একটাতেই বসে পড়ে সায়ন্তন। সন্ধ্যার ভাঙ্গা চাঁদের ফিঁকে জ্যোৎস্না যেন রাত বাড়ার সাথে সাথে আরও ফিঁকে হয়ে এসেছে। দূরে শাল বনের গাছ গুলি যেন এক একটি আস্ত দৈত্যৈর ন্যায় চুপটি করে শিকারের আশায় দাঁড়িয়ে থাকে। কোথাও কোনো শব্দ নেই। নাকি আছে। খুব হালকা অস্পষ্ট কিছু কথা যেন বহু দূর থেকে ভেসে আসছে। কি কথা ভালো বোঝা যায় না। কিন্তু গুন গুন শব্দ একটা ঠিকই হচ্ছে। তাহলে কি ভুল শুনছে সে। কান পেতে আরও ভালো করে শোনার চেষ্টা করে সায়ন্তন। এবার তার মনে হল কথা গুলো ভেসে আছে সাবুরামের চালা ঘরের দিক থেকেই। খুব চাপা অস্পষ্ট একটা গুন গুন শব্দ সাথে মাঝে মাঝে একটা চাপা স্ত্রী লোকের কান্নার আওয়াজও আসছে। নানা প্রশ্ন ভীড় করে এসে সায়ন্তনের মাথায় ঘোর পাক খেতে লাগল। সাবুরাম কি এখনও ধর্মকর্ম করছে? নাকি তাঁর বউয়ের শরীর খারাপ আরও বেড়েছে, তাই কি সে কাঁদছে? কোনো প্রশ্নেরই সঠিক উত্তর পায় না সায়ন্তন। অবশেষে কাল সকালেই সাবুরাম কে জিজ্ঞাসা করা যাবে মন স্থির করে ঘরে ফিরে যায় সে। 

                        ৫.

 পরদিন সকাল সকাল চা জল খাবার খেয়ে বেরিয়ে পড়ে ওরা তিনজন। আজ জাগ্রত বনদেবীর বেদী দেখার কথা মনে মনে ঠিক করে তিনকোনিয়ার দিকে হাঁটা লাগায় ওরা। পাহাড় জঙ্গলের মাঝ দিয়ে পায়ে হাঁটা এক চিলতে মাটির পথ ধরে প্রায় মিনিট পনেরো চলার পর এক জায়গায় জঙ্গল কিছুটা ফাঁকা দেখাল। কাছে গিয়ে দেখা গেল কিছুটা জঙ্গল পরিষ্কার করে কারা যেন মাটি থেকে সামান্য উঁচু একটা বেদীর মতো করেছে। 

বেদীতে অপরিচিত একটি গাছ আরাধ্য দেবীর চিহ্ন বহন করছে। এই যে সাবুরামের সেই বনদেবীর বেদী তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। ইতিউতি পড়ে থাকা টমেটো, আলু কিংবা কেন্দু ফল স্থানীয় মানুষের পূজা পাঠের প্রমাণ দেয়। 

— জায়গাটা বেশ নিরিবিলি তাই না? 

প্রশ্ন করে সায়ন্তন। 

—হুম নিরিবিলি কিন্তু বেশ গা ছমছমে। বেশিক্ষণ একা থাকলে ভয় ভয় করে। 

দীপ্তির কথায় মাথা নেড়ে সায় দেয় সায়ন্তন।

এমন সময় জঙ্গল থেকে হুরমুরিয়ে বেড়িয়ে আসে একটি আধবুড়ো লোক। মাথার চুল উসকো খুসকো, মুখে বহু দিনের না কামানো দাঁড়ি গোঁফের জঙ্গল। পরনের একমাত্র ধুতিটা শতছিন্ন এবং সেটা এত ময়লা হয়েছে যে সেটা কখনও সাদা ছিল ভাবতেও কষ্ট হয়। তাঁকে দেখেই ভয়ে অস্ফুট চিৎকার বেরিয়ে আসে দীপ্তির গলা থেকে। তাই দেখে পাগলাটে লোকটা খিক্ খিক্ করে হেসে উঠে হাততালি দিয়ে বলতে শুরু করে, 

— পালক, পালক, পালক, কত পালক। কাকের পালক, বকের পালক, কত পালক। আরও একটা পালক আছে, ওই ওই পাহাড়ের উপরে। কিসের পালক মুই জানিনে। 

কিন্তু খুব খারাপ হবে, খুব খারাপ হবে। অভিশাপ নেমে আসবে, ঘোর অভিশাপ। সব পালক উড়ে যাবে। হি হি। সব উড়ে যাবে, সব উড়ে যাবে…. 

বলতে বলতে আবার জঙ্গলে ছুটে ঢুকে গেল লোকটা। ঘটনার আকস্মিকতায় সবাই কাঠের পুতুলের মতো দাঁড়িয়ে রইল। সম্বিত ফিরতেই স্ত্রী ও ছেলের হাত ধরে তাড়াতাড়ি সেখান থেকে বেরিয়ে ফেরার পথ ধরে সায়ন্তন। দুশ্চিন্তার একটা কালো ছায়া ধীরে ধীরে গ্রাস করতে থাকে তার মনকে। কি বলতে চাইছিল পাগলটা। গতরাতের কথা ফিরে আসে তার মনে। তাহলে কি সত্যিই ওখানে কিছু সমস্যা আছে? সাবুরাম কি কিছু লুকোচ্ছে তাঁদের থেকে? 

                       ৬.

সকালের ওই খারাপ অভিজ্ঞতার পর সারাদিন আর কোথাও বেড়াতে যেতে মন চায়নি ওদের। বাকি সময়টা গেস্ট হাউসেই কাটিয়েছে। এর মধ্যে টুবলু সাবুরামের সাথে বেশ বন্ধুত্ব পাতিয়ে ফেলেছে। তার পিছনে পিছনে ঘুরছে, তাঁকে নানা প্রশ্ন করে জ্বালিয়ে মারছে। সাবুরামের অবশ্য এতে কোনো রকম বিরক্তি নেই। সে হেসে হেসেই টুবলুর প্রতিটি কথার উত্তর দিচ্ছে। সাবুরামের সাথে টুবলুর মেলামেশায় দীপ্তি কিছু মনে না করলেও সায়ন্তনের কেমন একটা অস্বস্তি বোধ হতে লাগলো। যেন কোথাও খুব খারাপ কিছু হচ্ছে।কিন্তু কি হচ্ছে তা বোঝা যাচ্ছে না। নিজের মনেই নিজেকে খানিকটা বকা দেয় সায়ন্তন। না দীপ্তি ঠিকই বলে সে সব কিছুতেই খামোখা একটু বেশি বেশি চিন্তা করে। 

 গতরাতে ভালো ঘুম হয়নি তাই সেদিনও তাড়াতাড়ি রাতের খাওয়া সেরে বিছানায় শরীরটা এলিয়ে দেয় সে। তারপর কিছুক্ষণ টুবলুর সাথে খুনসুটি করে ও দীপ্তির সাথে দু একটা কথা বলে ঘুমানোর চেষ্টা করে সায়ন্তন। কিছুক্ষণের মধ্যেই দীপ্তির জোরে জোরে শ্বাসপ্রশ্বাসের আওয়াজে সে বুঝতে পারে যে দীপ্তি গভীর ঘুমে তলিয়ে গেছে। কিন্তু আজও কোনো কারণে কিছুতেই দু চোখের পাতা এক করতে পারছে না সে। বেডসাইড টেবিলে রাখা মোবাইলটা জ্বালিয়ে সময় দেখে নেয় সে। রাত বারোটা কুড়ি। অনিদ্রার রোগ সায়ন্তনের কোনো দিনই ছিল না। তবে কি নতুন জায়গা বলে ঘুম আসতে চাইছে না। এই রকমই সাত-পাঁচ চিন্তা করতে করতে বেতের মোড়ায় এসে বসে সে। আজ বাইরে একটা মৃদু বাতাস বইছে, বেশিক্ষণ থাকলে গা শীর শীর করে। 

একটুক্ষণ বসে উঠতে যাবে এমন সময় আবার গতকাল রাতের মতো একটা আওয়াজ পায় সে। ভালো করে কান পেতে শুনে বুঝতে পারে হুবহু গত রাতের মতই একটানা গুন গুন করে কিছু বলে চলেছে কেউ আর কেউ খুব চাপা কন্ঠে কেঁদেই যাচ্ছে। আওয়াজ গুলো এতই চাপা যে তা মহিলার না পুরুষের বোঝার উপায় নেই। সারাদিনের অস্বস্তির ভাবটা কয়েক গুন বেড়ে যায় সায়ন্তনের। সে দেখে সাবুরামের চালার ছোট্ট জানালা দিয়ে এক টুকরো আলো বাইরে এসে পড়েছে। 

সাবুরাম এত রাত পর্যন্ত কি ধর্ম কর্ম করে তা কিছুতেই ভেবে পায়না সায়ন্তন। 

                        ৭.

পরদিন ছিল শনিবার। সাবুরামের থেকে তাঁরা জানতে পেরেছে আজ বিকেলে গেস্ট হাউস থেকে কিছু দূরে কাঁকড়াঝোরে হাট বসবে। গ্রাম্য হাট সায়ন্তন বা দীপ্তি কেউই আগে দেখেনি। তাই পরন্ত বিকেলে আস্তমিত সূর্যের আভা গায়ে মেখে তাঁরা হাটের পথ ধরলো। ছেলের হাত ধরে দীপ্তির সাথে নানা কথা আলোচনা করতে করতে চলেছে সায়ন্তন। হঠাৎ টুবলুর মাথার দিকে নজর পরে সায়ন্তনের। তার মাথার টিকির কাছে বেশ অনেকটা জায়গা জুড়ে চুল নেই। প্রথমে ভাবল বুঝি খেলতে গিয়ে কোথাও হয়েছে। তারপর ভালো করে খেয়াল করে দেখে কেউ কাঁচি বা ব্লেড দিয়ে মাথার ওই অংশের চুল গুলো কেটে নিয়েছে। 

এই ঘটনায় খুব অবাক হয়ে যায় সায়ন্তন।টুবলু সারাক্ষণ ওদের সাথেই ছিল তবে এটা কি করে সম্ভব। সে দীপ্তি ডেকে চুলের কাটা অংশটা দেখায়। দীপ্তিও কিছুই বুঝতে পারে না। তবে কি ওটা আগে থেকেই ছিল তাঁরা খেয়াল করেনি। ভাবতে ভাবতেই কিছু সমবেত মানুষের গলার আওয়াজে তারা বুঝতে পারল যে তাঁরা গন্তব্যে পৌঁছে গেছে। 

গ্রাম্য হাট, গ্রামের মানুষই বিক্রি করে আবার গ্রামের মানুষই কেনে। দৈনন্দিন সাংসারিক কাজে লাগার মতো জিনিসপত্র, কাঁচা সবজি, দেশী মুরগী ইত্যাদি জিনিস নিয়ে বেশ জমজমাট হাট তা মানতেই হবে। সায়ন্তন এক জায়গায় দেখল ব্যাসনে ছোট ছোট করে পেঁয়াজ আর লঙ্কা মেখে তা ছোট ছোট বারির মতো করে ভাজা হচ্ছে এক জায়গায়। এরা বলে পকড়ি। সেই পকড়ি কিছু কিনে তিন জনে খেয়ে দেখল। ভালো লাগায় সাবুরাম আর তার বউয়ের জন্যও কিছু কিছু কিনে নিল। দোকানদার শাল পাতায় মুড়ে পকড়ি প্যাক করে দিল। 

হঠাৎ করে হাটের মধ্যে খুব শোরগোল চেঁচামেচি শুরু হয়ে গেল। কিছু লোক এক হাত লম্বা বাঁশের লাঠির মাথায় মশালের মতো আগুন নিয়ে ছুটে গেল হাটের অন্য দিকে। আশপাশের কথা বার্তা থেকে তাঁরা বুঝতে পারল কাছেই কোথাও হাতির পাল এসে পড়েছে তাই সবাই সন্ত্রাস্ত হয়ে পড়েছে। তাঁরাও আর দেরি না করে গেস্ট হাউসের পথ ধরল। 

গেস্ট হাউসে পৌঁছে সাবুরাম আর তার বউকে চালার সামনে বসে থাকতে দেখে দীপ্তি টুবলুর হাত দিয়ে তাদের জন্য আনা খাবারটা পাঠিয়ে দেয়। কিন্তু টুবলু কে খবর হাতে আসতে দেখে হঠাৎ বিন্দি রেগে গিয়ে চেঁচিয়ে বলে, 

—  তুই আবার এয়েছিস। তোকে না মানা করেছি একানে আসবিনি।

বিন্দির এহেন ব্যবহারে সবাই বাক্ রুদ্ধ হয়ে যায়। সাবুরাম তাঁকে ধমক দিয়ে ওঠে, 

— বিন্দি, কি আজেবাজে বলছিস তুই? ও আসবেনে কেনে? তুই ঘরে যা, এখনি ঘরে যা। 

সাবুরামের বকুনি খেয়ে টুবলুর দিকে একবার কটমট করে তাকিয়ে ঘরে চলে যায় বিন্দি । এসবের মধ্যে টুবলু ভয় পেয়ে শাল পাতায় মোড়া খাবার ফেলে দিয়ে দৌড়ে দীপ্তির দিকে আসতে গিয়ে একটি পাথরে ধাক্কা খেয়ে পড়ে যায়। সবাই তাড়াতাড়ি তার কাছে দৌড়ে আসে। সায়ন্তন ছেলেকে কোলে তুলে যায়। টুবলুর পায়ের নখ উঠে গেছে পাথরে ধাক্কা লেগে সেখান দিয়ে দরদর করে রক্ত বেরোচ্ছে। সাবুরাম কোথা থেকে একটু সাদা কাপড় এনে টুবলু পায়ে বেঁধে দেয়। টুবলু আরও জোরে কেঁদে ওঠে। সায়ন্তন এক ধমক দিয়ে তাকে সরিয়ে দেয়। ধমক খেয়ে সাবুরাম বলে,

— এসব জায়গায় রাতে বাচ্চার রক্ত বাইরে পরা ভালো লয় বাবু। 

— সে চিন্তা তোকে করতে হবে না ব্যাটা গেঁও ভূত। এখন চটপট ফার্স্ট এডের বাক্সটা এনে দে। 

 সাবুরাম ছুটে গিয়ে ফার্স্ট এডের বাক্স এনে দেয়। পায়ের নখটা এমন ভাবে উঠেছে যে সেটা আর রাখা যাবে না দেখে আসতে আসতে কাঁচি দিয়ে কেটে তুলে দেয় সায়ন্তন। ব্যাথাটা বোধহয় একটু সয়ে এসেছে টুবলুর। সে এখন আর কাঁদছে না, মায়ের কোলে চুপটি করে বসে মিটি দেখছে বাবা কি করছে। 

সে রাতে টুবলুর খুব জ্বর এলো। জ্বরের ঘোরে সে নেতিয়ে রইল বিছানায়। নাহ ছুটিটা ভালো কাটল না তাদের। সেই আসার দিন থেকেই নানা কারণে মনটা বিষিয়ে আছে সায়ন্তনের। তারপর আজকের ঘটনাটা। নাহ আর এখানে থাকা চলে না। কাল সকালেই সে চলে যাবে ঠিক করে। টুবলু জ্বর যেভাবে বাড়ছে তাতে ওর ভালো ডাক্তার দেখান দরকার। 

দীপ্তি ছেলের পাশে এক ভাবে পরে রয়েছে। সায়ন্তন বিষন্ন মনে বাইরে মোড়ায় গিয়ে বসে। অল্প কিছুক্ষণ বসার পরই অন্য দিনের মতো সেই গুন গুন আওয়াজটা আবার শুরু হয়ে যায়। কিন্তু আজ আর কান্নার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে না। তার পরিবর্তে কেউ যেন খুব চাপা স্বরে কারোর সাথে ঝগড়া করে চলেছে। 

সায়ন্তন আর কৌতুহল দমন করতে না পেরে দীপ্তিকে কিছু না বলেই খুব ধীরে ধীরে সাবুরামের চালা ঘরের দিকে এগিয়ে চলে। সেখানে গিয়ে দেখে চালায় প্রবেশের ছোট্ট দরজা টা ভিতর থেকে বন্ধ, এমন কি জানালা গুলোও আজ খোলা নেই। তবু দরজায় কান রেখে শোনার চেষ্টা করে ভিতরে কি হচ্ছে। সে শোনে বিন্দি বলছে, 

— এ কাজ তুই করিস নে সাবু, এ কাজ তুই করিস নে। এ পাপ। এ কাজ করে কেউ কোনো দিন বড় হয় নে রে। 

তাঁর কথায় সাবুরাম গর্জে ওঠে,

— আহ, তুই থামবি। আজকের দিনটার জন্য আমি সারা জীবন অপেক্ষা করেছি। কোনো দিন ভাবিনি তা এত সহজে এ সুযোগ পেয়ে যাব। আজ আমি যা চাই তা পাবই। তুই আমায় বাঁধা দিসনি বিন্দি। তাহলে আমি তোকেও ছেড়ে দিব না। 

বলে কোনো অঞ্জাত ভাষায় গুন গুন করে এক টানা একই সুরে একটা মন্ত্র পড়ে চলে সে। এসব শুনে সায়ন্তনের গা ছমছম করে ওঠে। সে ঠিক করে নেয় কাল যেমন করেই হোক এখানে থেকে পালাতে হবে। এখন কোন ভাবে রাতটা ভালোয় ভালোয় কেটলে বাঁচা যায়। 

                        ৮.

পরদিন খুব ভোরে বিন্দির কান্নার আওয়াজ শুনে ঘুম ভেঙ্গে যায় সায়ন্তন আর দীপ্তির। ছেলের গায়ে হাত দিয়ে দীপ্তি দেখে জ্বর এখন আর নেই। টুবলু পরম সুখে ঘুমিয়ে রয়েছে । কিন্তু বিন্দি এমন করে কাঁদছে কেন? দুজনে তড়িঘড়ি ছুটে যায় সাবুরামের ঘরের দিকে। সেখানে গিয়ে তাঁরা দেখে ঘরের দাওয়ায় বিন্দি পা ছড়িয়ে হাউ হাউ করে কাঁদছে। পরনের কাপড় মাটিতে লুঠছে। গতকাল সন্ধ্যার সেই রুদ্র চাহনি আর নেই। 

দীপ্তি তার শাড়ি ঠিক করে দিয়ে কি হয়েছে জিজ্ঞাসা করায় সে শুধু আঙুল তুলে ঘরের ভিতরে নির্দেশ করতে পারে তারপর জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পরে। সায়ন্তন দৌড়ে ঘরের মধ্যে ঢুকে যায়, তার পিছু পিছু দীপ্তিও আসে। কিন্তু ঘরের দৃশ্য দেখে দুজনেই ভয়ে হিম হয়ে যায়। তাঁরা দেখে সাবুরামের মৃত দেহটা ঘরের মেঝেতে  মুখ থুবরে পরে আছে। তাঁর মাথাটা কে যেন ধরে পিছন দিকে ঘুরিয়ে দিয়েছে। হাত – পা গুলো দুমড়ে মুচড়ে ভাঙা। ঘরের এক কোণে মানুষের বাচ্চার অবয়োবের একটি অদ্ভূত দর্শন ভয়ংকর মূর্তি রয়েছে।সেটি আকারে একটি ছোট পুতুলের মতো। সে মূর্তির চোখের পুরো অংশটুকুই গাঢ় কালো আর মুখে বড় বড় হিংস্র দাঁতে কূঢ় কুটিল হাসি লেগে আছে । সেই নারকীয় দৃশ্য বেশিক্ষণ দেখা যায় না। তাঁরা ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। 

অনেকক্ষণ মুখে হাতে জলের ছিটে দিয়ে বিন্দির জ্ঞান ফেরায় তাঁরা। তারপর কি ঘটে ছিল জানতে চাইলে, একটু সামলে নিয়ে সে বলতে শুরু করে। 

— সাবু মোটেও ভালো লোক ছিল না বাবু। সে ছিল লোভী। টাকার জন্য করতে পারত না এমন কাজ পৃথিবীতে নেই। কিন্তু সে ছিল চরম অলস।  সে সব সময়ই কি ভাবে সহজে বড় লোক হওয়া যায় সেই রাস্তা খুঁজে বেড়াত। 

একদিন কোথার থেকে এক অপদেবতার সন্ধান পেল সে। সে ভয়ংকর অপদেবতার নাম গুদ্রবঙ্গা, তার মূর্তি ওই ঘরে রাখা আছে। সে প্রতিদিন সেই মূর্তির পূজা করতে লাগল।

কথায় আছে যে গুদ্রবঙ্গার পূজা করে তাকে খুশি করতে পারে, গুদ্রবঙ্গা তাকে তাঁর অপার ঐশ্বর্যৈর ভাগ দেয়। তবে সেই পূজা খুবই কঠিন। একমাত্র চরম পাষন্ডরাই বুঝি সেই পূজা করতে পারে। কারণ সেই পূজার প্রধান উপকরণ পূজারীর নিজের সন্তান। হ্যাঁ, সাবু ছিল সেই দলেরই। আমাদের দুই সন্তানকে সে একে একে সেই পুজোয় আহুতি দিয়েছে। কিন্তু কোন কারণে সফল হয়নি। ধাপে ধাপে সন্তানের শরীরের চুল, নখ ও রক্ত নৈবিদ্য দিতে হয় এই অপদেবতাকে। কিন্তু নিজের সন্তান না হলে এই পূজা হয় না। সাবুরাম সে কথা জানত। কিন্তু ও লোভে অন্ধ হয়ে গিয়েছিল। তাই আপনার ছেলেকেই নিজের সন্তান বলে পূজায় লাগাতে শুরু করে। আপনারা দেখেননি বোধ হয়, আপনার ছেলের মাথায় একটু চুল কাটা। ওটা ওই শয়তানটারই কাজ। তারপর আজ সন্ধ্যায় আচমকাই ওর হোঁচট লেগে নখ উঠে যায়। তাতে শয়তানটা অকস্মাৎ সুযোগ পেয়ে যায় নিজের কুকর্ম সমাপ্ত করার। আমি শুরুর থেকেই জানতাম এরকম কিছু একটা হবে তাই আমি আপনাদের ছেলের ভালোর জন্য ওকে বকাবকি করতাম, যাতে ও এই ঘরে না আসে। কিন্তু ছোটো তো, শুনতো না। তাই বাধ্য হয়েই আপনাদের সামনে কাল খারাপ ব্যবহার করি। 

টুবলুর কথা ভেবে আতঙ্কে শিউরে ওঠে দীপ্তি। আবার বিন্দির কথা ভেবে মায়া হয় তাঁর। মেয়েটা সব হারিয়েছে। একটুক্ষণ চুপ করে বিন্দি আবার বলতে শুরু করে, 

— কিন্তু দেবতাকে ফাঁকি চলে না বাবু। সে মিছা বলার শাস্তি দিয়েছে শয়তানটা কে। 

বলে অঝোর ধারায় কাঁদতে থাকে বিন্দি। 

সায়ন্তন ভেবে অবাক হয় যে সীমাহীন লোভ মানুষকে কত নীচে নামাতে পারে যেখানে পাপের কালো পাঁক গায়ে লাগলেও তার ভাবান্তর হয় না। সেই দিনই সাবুরামের মৃতদেহের সৎকারের ব্যবস্থা করে দীপ্তি ও টুবলু কে নিয়ে ফেরার পথ ধরে সায়ন্তন। টুবলু এখন অনেকটাই সুস্থ। 

শাস্তি গল্প – সমাপ্ত

আপনাদের লেখা আমাদের ওয়েব সাইটে জমা দিতে গেলে, অনুগ্রহ করে আমাদের লেখা-জমা-দিন মেনু-তে ক্লিক করুন ও নিজেকে Author হিসেবে Register করুন এবং আমাদের পরবর্তী আপডেট পেতে আমাদের ফেসবুক পেজ অনুসরণ করুন।

error: Content is protected !!