সত্যেন স্যারের জন্য ছোট গল্প – গোবিন্দ মোদক
– এই জাকাত, খবর শুনেছিস!
– কি খবর রে কাশেম!
– আরে আমাদের সত্যেন স্যারকে পুলিশে ধরে নিয়ে গেছে।
– সত্যেন স্যার? কোন সত্যেন স্যার?
– আরে আমাদের স্কুলের সত্যেন স্যার!
– আমাদের সত্যেন স্যারকে পুলিশে ধরে নিয়ে গেছে! বলিস কিরে! নির্বিবাদী শিক্ষক, আদর্শ মানুষ, সৎ, পরোপকারী, ছাত্রদেরকে ডেকে ডেকে বিনা পয়সায় পড়ান, দরকার হলে তাদের বই কিনে দেন, পুরনো জামা কাপড় থাকলে দিয়ে সাহায্য করেন – আর তাঁকে কিনা পুলিশে ধরে নিয়ে যাবে! ধুস! না না, তোর কোথাও ভুল হচ্ছে!
– আরে ভুল নয় রে জাকাত, ঠিকই বলছি!
– আশ্চর্য! তাহলে কিছু একটা তো করতেই হবে! চল চল, শিগগিরই চল!
মুহূর্তের মধ্যে খবরটা দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে এলাকা জুড়ে। তারপর প্রতিটি ঘর থেকে বেরিয়ে আসে এক এক করে ছাত্র। আসে জয়নাল, মইনুদ্দিন, ফকির আলি, হোসেন, রুহুল আমিন, ফজলু। আসে গৌতম, পান্নালাল, মানিক, ভূপেন, দেবেন, সাতকড়ি, পঞ্চানন, সৌগত, ইন্দ্র, সিদ্ধার্থ, জগন্নাথ, সমীর, কানাইলাল, বারীন, তারক। আসে জনসন, শমসের, পিটার এবং আরও অনেকে। কাতারে কাতারে জড়ো হতে থাকে ছাত্ররা।
*** *** *** *** ***
থানার সেকেন্ড ইন্সপেক্টর সত্যেন স্যারের বিরুদ্ধে চার্জশিট লিখছিলেন – তার অপরাধগুলো এক এক করে লিপিবদ্ধ করছিলেন জাবদা খাতায়। এমন সময় বাইরে একটা হৈ-চৈ শোনা গেল। তিনি একজন কনস্টেবলকে পাঠালেন ঘটনাটা জেনে আসতে। কনস্টেবল ফিরে এসে যা বলল তাতে তো তার চক্ষু চড়কগাছ! গিয়ে দেখলেন একদম সত্যি কথা। প্রায় হাজারখানেক ছাত্রের জমায়েত হয়েছে। তাদের স্লোগান – নিরপরাধ সত্যেন স্যারকে অন্যায়ভাবে গ্রেফতার করা চলবে না, চলছে না। তাদের প্রত্যেকের হাতে কাঁচা হাতে লেখা ফেস্টুন এবং তাদের বডি ল্যাঙ্গুয়েজ দেখলে ভয় করে – যেন এক্ষুনি তারা অনর্থ কিছু একটা করে বসতে পারে।
ঘটনার গুরুত্ব বুঝে তিনি ওসিকে খবর দিলেন। ওসি বাড়িতে ঘুমাচ্ছিলেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনি চলে আসলেন। তাকে তো ছাত্রদল থানায় ঢুকতেই দেয় না! শেষ পর্যন্ত তাদেরকে আশ্বস্ত করে তিনি থানার সামনে একটা চেয়ারে দাঁড়ালেন, তারপর বললেন আমি ঘটনার কিছুই জানিনা। আমি সেকেন্ড ইন্সপেক্টরের কাছে শুনে এসে তোমাদের সব কথা শুনব। ততক্ষণ তোমরা কিন্তু কোনও গণ্ডগোল করবে না। তাহলে আমি আইনত ব্যবস্থা …
ওসি ভেতরে গেলেন এবং সেকেন্ড ইন্সপেক্টরের কাছে সব শুনলেন। তারপর নিজের লোমশ কানটা চুলকে নিয়ে বললেন – ব্যাপারটা খুব গম্ভীর বটে! ঠিক আছে, দেখছি কি করা যায়! তিনি লক-আপের ভেতরে থাকা সত্যেন স্যারের সঙ্গে দু’একটি কথা বললেন, তারপর সেকেন্ড ইন্সপেক্টরকে পাঠালেন পাঁচজন ছাত্রকে ভেতরে নিয়ে আসতে। ছাত্ররা তো পাঁচজন কিছুতেই আসতে চায় না। তাদের সমবেত দাবি তাদের বক্তব্য সকলের সামনে শুনতে হবে। শেষ পর্যন্ত ওসি বাধ্য হয়ে তাদের সামনে এসে চেয়ারের উপর দাঁড়িয়ে বক্তব্য শুনতে লাগলেন। শুনে তো তার আক্কেলগুড়ুম! তার ঝাঁটার মতো গোঁফ কাঁপতে লাগল অজানা আশঙ্কায় – সেরেছে! স্কুলের অ্যাসিস্ট্যান্ট হেডমাস্টার রাঘব জোয়ার্দার, সভাপতি ভবানীপ্রসাদ, অঙ্ক স্যার শুকুর আলি মণ্ডল, বাংলার নিতাই ঘোষ এবং আরো কয়েকজন মিলে ঘটনাটা ঘটিয়েছে। সত্যেনবাবুর উপর তাদের একটিই রাগ এবং ঈর্ষা – কারণ সত্যেনবাবু এলাকায় খুব জনপ্রিয়। তিনি যে ছাত্র-ছাত্রীদেরকে শুধু বিনা পয়সায় পড়ান তাই নয়, তাদেরকে নানাভাবে সাহায্যও করেন। সত্যেনবাবুর এই প্রতিপত্তিতে অন্যান্যদের গাত্রদাহ হয়েছে। তাই তারা একটা বাজে অজুহাত দেখিয়ে তাকে এরেস্ট করিয়েছে তার ভাবমূর্তি খারাপ করবার জন্য।
গোঁফ চুলকাতে চুলকাতে ভেতরে ঢুকলেন ওসি। তারপর বললেন – ওহে হরিপদ! ব্যাপারটা শুনেছ, বুঝেছ কিছু! সব জেলাসি! সব জেলাসি! হিংসা! হিংসা! সত্যেন স্যার ছাত্রদেরকে বিনা পয়সায় পড়ান, তাদেরকে জামা-কাপড় কিনে দেন, তাদেরকে দরকার হলে ওষুধপত্র পর্যন্ত কিনে দেন, প্রয়োজনে তাদের বাড়ি গিয়ে খোঁজ খবর নিয়ে আসেন। এই সাদামাটা মানুষটার এই আচরণে এলাকার শিক্ষক নেতারা ভয় পেয়েছে। তারা ভাবছে আগামী দিনে বোধহয় সত্যেন স্যার ভোটে দাড়িয়ে বাজিমাত করবেন। তাই তারা সত্যেনবাবুর এই ছাত্রদরদী ভাবমূর্তি খারাপ করতে চেয়েছিল এবং সেই কারণে বাজে অজুহাতে ওনাকে অ্যারেস্ট করিয়েছে। খোলো, খোলো, খোলো! শিগগিরই লক-আপ খোলো। সত্যেন স্যারকে না ছাড়লে কিন্তু থানায় আগুন জ্বলবে! বুঝেছ ছাত্রদের কত শক্তি! আধঘণ্টার মধ্যে হাজার ছাত্র জড়ো হয়েছে।
*** *** *** *** ***
কিছুক্ষণ পরে এক আশ্চর্য দৃশ্য দেখা গেল – ছাত্রদের কাঁধে চেপে সত্যেন স্যার সগর্বে বাড়ি ফিরছেন আর লজ্জিত মুখে বলছেন – আরে আমাকে নিচে নামা, আমি পড়ে যাব যে!
কে কার কথা শোনে! ছাত্রদের উল্লাস চলতেই থাকে সত্যেন স্যারকে ঘিরে।
সত্যেন স্যারের জন্য ছোট গল্প – সমাপ্ত
আপনাদের লেখা আমাদের ওয়েব সাইটে জমা দিতে গেলে, অনুগ্রহ করে আমাদের লেখা-জমা-দিন মেনু-তে ক্লিক করুন ও নিজেকে Author হিসেবে Register করুন এবং আমাদের পরবর্তী আপডেট পেতে আমাদের ফেসবুক পেজ অনুসরণ করুন।
অন্যান্য
শ্রাবণ সন্ধ্যা
শাস্তি
তিতির কান্না