চা বাগানের জালিয়াত অণুগল্প – চন্দন দাশগুপ্ত
গরমের ছুটিতে মাসির বাড়ি গিয়েছিলাম। মেসো ছিলেন তরাই এর শিমূলবাড়ি চা-বাগানের ম্যানেজার। তাই মেসোর বাংলোয় খেয়ে-ঘুমিয়ে-বেড়িয়ে দিনগুলো ভালই কাটছিল। আমি ছিলাম আমার মাসতুতো দাদার একনিষ্ঠ ভক্ত। দাদা পড়ত কলেজে। ওরও সেই সময় ছুটি থাকায় আমাদের মজা বেড়ে দ্বিগুণ হয়ে গিয়েছিল।
সেদিন দুপুরে দাদা বলল,
—–“চল্ , আজ মাটিগাড়ার মেলা দেখে আসি !”
আমি তো একপায়ে খাড়া ! শুনলাম, মেলাটা বেশ বড়, তবে একটু দূরে বসেছে। কুছপরোয়া নেই, দাদার সাইকেলে বসেই যাওয়া যাবে।
বিকেল সাড়ে তিনটে নাগাদ আমরা বেরিয়ে পড়লাম। মাসি আপত্তি করেনি, কারণ এদিকের রাস্তাঘাট সব দাদার নখদর্পণে।
যথাসময়ে আমরা মেলায় পৌঁছে গেলাম। চা বাগান এলাকায় এত বড় মেলা হতে পারে ,ভাবতেই পারিনি আমি। সব ঘুরে ঘুরে দেখছি, হঠাৎই চোখে পড়ল একটা দোকানের সামনে বিরাট ভিড়। বেশিরভাগই স্থানীয় চা-বাগানের শ্রমিক আর তাদের পরিবারের ছেলে মেয়েরা জড়ো হয়েছে।
একটু এগোতেই দেখলাম দোকানটায় লটারি খেলা হচ্ছে। টিকিট মাত্র পাঁচ টাকা। দারুণ সব প্রাইজ সাজানো রয়েছে……..সাইকেল, দেওয়াল ঘড়ি, প্রেশার কুকার, ইলেকট্রিক ইস্ত্রি, স্টেনলেস স্টিলের বড় বড় বাসন, হাতঘড়ি, টর্চ…….আরো কত কী ! আর দেখলাম, প্রত্যেকটা প্রাইজের নিচে একটা করে নম্বর লেখা আছে।
আমার তো চোখ ছানাবড়া ! পাঁচ টাকার টিকিট কাটলে এইসব প্রাইজ ? দাদাকে বললাম,
——-দেখেছো দাদা, একবার খেলবে নাকি ?
কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার। দেখলাম, দাদা ভুরু কুঁচকে পুরোটা খুব মন দিয়ে লক্ষ্য করছে। খেলার পদ্ধতিটা অবশ্য একদম সহজ। একটা মাঝারি সাইজের কৌটোতে ক্যারামের গুটির মতো দশটা একই সাইজের ছোট ছোট কাঠের গুটি দেওয়া হচ্ছে। প্রত্যেকটা গুটির ওপর ০ থেকে ৯ পর্যন্ত একটা করে সংখ্যা লেখা। যে পাঁচ টাকা দিয়ে লটারি খেলবে, তাকে ঐ কৌটোটা কয়েকবার ঝাঁকিয়ে যেকোনও একটা গুটি তুলতে হবে। সেই গুটির নম্বরটা সামনের বোর্ডে লিখে রাখা হবে।একই কাজ করতে হবে পরপর দশবার। প্রত্যেকবারের তোলা গুটিগুলোর নম্বর বোর্ডে লেখার পর যোগ করে যা যোগফল হবে, সেটা সামনে সাজিয়ে রাখা যে প্রাইজের নিচে লেখা নম্বরের সাথে মিলে যাবে, সেই প্রাইজটাই পাওয়া যাবে।
আমাদের চোখের সামনেই দুজন লটারি খেললো। কিন্তু অবাক কান্ড ! একজন পেলো একটা সেফটিপিন। অন্যজন পেলো একটা কাগজ, তাতে লেখা, “খেলার জন্য ধন্যবাদ। পরের বারের জন্য শুভকামনা রইল।”
কয়েক মিনিট পরেই দাদা আমাকে টেনে নিল,
——“চল্ চল্ ……এগুলো সব বুজরুকি। তোকে পরে বলব……..”
আমি কিছুই বুঝলাম না। কিন্তু দাদার অবাধ্য হবোনা। তাই চুপচাপ বাড়ি ফিরে এলাম।
জলখাবার খেয়ে উঠে দাদা বলল,
——“ওখানে কেউ কখনই ভাল প্রাইজ পাবেনা। কেন জানিস ?”
——“কেন ? আমি তো বুঝতেই পারিনি কিছু !”
——“ওরা ভীষণ চালাক। এটা চট করে ধরা অসম্ভব। তুই দেখেছিলি তো কৌটোর ভেতর ‘শূণ্য’ থেকে ‘নয়’ পর্যন্ত নম্বর লেখা দশটা গুটি আছে ?”
—–“হ্যাঁ হ্যাঁ।”
—–“সেখানে ০ লেখা গুটি আছে একটা, ১ লেখা একটা………এইভাবে ৯ লেখা গুটি আছে একটা। তাহলে মোট কটা হল ?”
——“দশটা।”
——“ঠিক বলেছিস। এবার যখন আলাদা ভাবে এদের থেকে দশবার যেকোনও একটা তুলবি, তখন প্রতিবারই ০ , বা প্রতিবারই ৯ ওঠার সম্ভাবনা কতটা ?”
——“খুব কম।”
——“ন-বার ০ আর একবার ১ ওঠার সম্ভাবনা ?”
—‐–“এটাও খুবই কম।”
——“বেশ। উল্টোদিকে, ন-বার ৯ আর একবার ০ কিংবা ১ ওঠার সম্ভাবনা কতটা ?”
——-“এসব কি বলছো বলত ? এটার সম্ভাবনাও তো কম !”
——“কারেক্ট। তাহলে দ্যাখ্, দশটা গুটির নম্বরের যোগফল ০, ১, ২, ৮১,৮২, অথবা ৯০…….. এইসব হওয়া কাগজে-কলমে অসম্ভব না হলেও ভীষণ কঠিন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এই যোগফল ৩০ থেকে ৬০ বা তার আশেপাশেই থাকবে। এটাই প্রবাবিলিটির নিয়ম। আর ওরা এই সুযোগটাই নিয়েছে। লক্ষ্য করবি, ভাল আর দামী প্রাইজগুলোর নম্বর ছিল হয় খুব কম ,নয়তো খুব বেশি। মাঝামাঝি নম্বরগুলোতে রয়েছে বাতাসা, সেফটিপিন, লজেন্স……..এইসব হাবিজাবি প্রাইজ।”
——“বলছো কী দাদা !”
——“একদম ঠিক বলছি। আসলে চা-বাগানের সহজ- সরল মানুষগুলোকে এরা এইভাবেই দিনের পর দিন ঠকাচ্ছে।”
দাদা মেসোকে সবটা বলেছিল। আর পরদিনই পুলিশ গিয়ে সেই জালিয়াত লটারির দোকানটা তুলে দিয়েছিল।
চা বাগানের জালিয়াত অণুগল্প – সমাপ্ত
আপনাদের লেখা আমাদের ওয়েব সাইটে জমা দিতে গেলে, অনুগ্রহ করে আমাদের লেখা-জমা-দিন মেনু-তে ক্লিক করুন ও নিজেকে Author হিসেবে Register করুন এবং আমাদের পরবর্তী আপডেট পেতে আমাদের ফেসবুক পেজ অনুসরণ করুন।
অন্যান্য
শ্রাবণ সন্ধ্যা
শাস্তি
তিতির কান্না