ভয় ভেঙে জয় ছোট গল্প – কবিতা ধর
বাইরের ঘরে বসে পার্টির কর্মী ছেলেদের নিয়ে মিটিং করছিলেন সমীরণবাবু। ঘন্টা দেড়েক পরে লোকজন চলে গেলে ড্রয়িংরুম পেরিয়ে দোতলায় ওঠার সিঁড়ির দিকে যেতে যেতে গলা তুলে হাঁক পাড়লেন,”এদিকে শুনে যাও তো।”
স্বামীর গলার আওয়াজ পেয়ে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে আসেন শোভনাদেবী। সিঁড়ির দুটো ধাপ উঠে আড়চোখে তাকিয়ে পেছনে দাঁড়ানো স্ত্রী’কে বললেন, “অর্করা ফিরলে আমার ঘরে আসতে বলবে, সঙ্গে তুমিও আসবে, কিছু দরকারি কথা আছে।”
সিঁড়ির বাঁক ঘুরে দোতলায় উঠে যাওয়া স্বামীর দিকে তাকিয়ে শোভনাদেবী ভাবলেন, কী এমন দরকারি কথা বলবেন উনি?
রাত পৌনে ৯টা বাজে। বাইরে বাইকের আওয়াজ শুনে দরজা খুলে বাইরে এলেন শোভনাদেবী। লোহার গেট থেকে সদর দরজা অবধি চলার প্যাসেজ ধরে এগিয়ে আসতে আসতে অস্মিতা দেখল হাত নেড়ে তাড়াতাড়ি আসার ইঙ্গিত করছেন শাশুড়ি। দ্রুত পায়ে দরজার কাছে এলে উনি বললেন, “এত দেরি হল যে… কখন থেকে হানটান করছি তোমাদের জন্য..!”
“ওর স্কুলের এক বন্ধুর বাড়ি গেছিলাম, গল্প করতে করতে ঘড়ির দিকে খেয়াল ছিল না। কেন মা কিছু হয়েছে?”
গ্যারাজে বাইকটা রেখে অস্মিতার পাশে অর্ক এসে দাঁড়ায়। শুনল মা বলছে, “কীসব কথা বলার জন্য উনি তোমাদের ডেকেছেন।” মাকে অনুসরণ করে ওরা ভেতরে ঢুকে দোতলায় উঠে সোজা বাবা-মায়ের ঘরের সামনে এসে দাঁড়িয়ে অর্ক জিজ্ঞেস করল,”ভেতরে আসব বাবা?”
সিঙ্গেল সোফায় বসে আছেন সমীরণবাবু। হাতে ধরা ফাইল থেকে চোখ না সরিয়ে উপর-নিচে ঘাড় নেড়ে ভেতরে আসার অনুমতি দেন। স্ত্রী’কে নিয়ে অর্ক ঘরে ঢুকতে সমীররণবাবু গম্ভীর স্বরে বলেন,
“এতক্ষণে ফেরার সময় হল! তোমাদের মা কোথায়? তাকেও তো ডেকেছি নাকি… “
“এই তো আমি এসে গেছি।” ছেলে বৌমার পাশটিতে দাঁড়িয়ে নিজের উপস্থিতি জানায় শোভনাদেবী।
ওদিকের সোফায় ওদেরকে বসতে বলে ফাইলটা বন্ধ করে সমীরণবাবু বললেন,”এই বছর সত্তরতম স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষ্যে পার্টির কার্যালয়ে বড়ো করে অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হবে। এই অঞ্চলের এম.এল.এ বিকাশবাবু ওয়ার্ডের কাউন্সিলর এবং কর্মীদের সপরিবারে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন, সেদিনটা আমার সঙ্গে তোমরা যাবে।”
অস্মিতা বলল, “দুঃখিত বাবা। ঐ দিনটা আমি রাজনৈতিক পরিমন্ডলে কাটাতে পারব না।”
“কেন, কোন রাজকার্য আছে শুনি?”
“আমাদের আশ্রমে প্রতি বছর বিশেষ অনুষ্ঠান হয়। সেখানে আমায় যেতেই হবে।”
“এম.এল.এ সাহেবের আমন্ত্রণ উপেক্ষা করছ ! তুমি কি ভুলে গেছ এখন তোমার একটা পরিচয় হয়েছে।”
“ভুলিনি তো। বিয়ের পরে সব মেয়েরই আলাদা পরিচয় হয়। যেমন আমি অর্কর স্ত্রী।”
“তার চেয়েও বড়ো পরিচয় শাসক গোষ্ঠীর একজন কর্তাব্যক্তির পুত্রবধূ হয়েছ।”
“হ্যাঁ, জানি। এবং আপনি জেনে রাখুন গণতান্ত্রিক দেশের একজন নাগরিককে স্বাধীন ভাবে চলাফেরায় বাধা দিতে পারেন না।”
“ছ’টা মাসও হয়নি, এর মধ্যেই আমার কথা অমান্য করছ! মেলামেশার সময় অর্ক তোমায় বলে দেয়নি এবাড়ির কিছু নিয়ম কানুন আছে।”
অর্ক এবার মুখ খুলল, “বিয়ে করে নিজের বাড়িতে নিয়ে এসেছি, জেলখানায় নয়। ওর সঙ্গে আমিও যাব।”
“তোর দেখছি খুব স্পর্ধা হয়েছে, আমার কথার ওপর না বলছিস!”
“হ্যাঁ হয়েছে। এতদিন আমায় আর মাকে তোমার আদেশ মেনে চলতে বাধ্য করেছ। কিন্তু অস্মিতা বুঝিয়েছে প্রত্যেকটা মানুষের ব্যক্তি স্বাধীনতা আছে। আর তা শুধু পনেরই অগাস্টের জন্য নয়, বরং আজীবন। দেশের এই বিশেষ দিনটি আমরা নিজেদের ইচ্ছেয় উদযাপন করব।”
অস্মিতার হাতটা ধরে অর্ক ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
রোষায়িত চোখে অসন্তুষ্ট ভঙ্গিতে স্ত্রী’কে বললেন, “তুমি দাঁড়িয়ে রইলে যে, যাও গিয়ে ছেলে-বৌমাকে বোঝাও এবাড়িতে আমি কারও স্বেচ্ছাচারিতা বরদাস্ত করব না।”
নবালয় আশ্রমে অস্মিতা বড়ো হয়েছে। অর্ক পেশায় সিভিল ইঞ্জিনিয়ার। একদিন সাইট ভিজিটে গিয়ে অ্যাক্সিডেন্ট ঘটলে স্থানীয় হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল। সেখানকার নার্স অস্মিতার সঙ্গে আলাপ থেকে প্রণয়।
একটি অনাথ মেয়ের সঙ্গে ছেলের বিয়ে দিতে সমীরণবাবু রাজি হয়েছিলেন মহানতা জাহির করার উদ্দেশ্যে।
সাদা খোলের দু’দিকের পাড়ে চওড়া অংশে গেরুয়া-সবুজের ছোট ছোট বক্স প্যাটার্নের নকশা করা শাড়িটা বৌমার হাতে দিয়ে শোভনাদেবী বললেন, “কাল এটা পরে অনুষ্ঠানে যেও।”
শাড়িটা একদম নতুন দেখে অস্মিতা জিজ্ঞেস করল, “তুমি কোনওদিন পরোনি মা?”
“জমানো টাকা থেকে লুকিয়ে এটা কিনেছিলাম। পরার সাহস হয়নি।”
“নিজের পছন্দের শাড়ি পরা নিয়েও বাবা নিষেধ জারি করেছেন বুঝি?”
“তোমার শ্বশুর সঙ্গে করে দোকানে নিয়ে যায়। কিন্তু ওর পছন্দে কেনা শাড়ি আমায় পরতে হয়।”
“সন্ধেবেলা তোমাকে নিয়ে দোকানে গিয়ে ম্যাচিং ব্লাউজ কিনে দেব। কাল তুমি আমাদের সঙ্গে আশ্রমের অনুষ্ঠানে এই শাড়িটা প’রেই যাবে।”
“উনি যদি রাগারাগি করেন…”
“তুমি চিন্তা করো না। বাবার অভব্য আচরণের উচিত জবাব দিতে আমি ঢাল হয়ে দাঁড়াব।” শাশুড়িকে আশ্বাস দিয়ে স্মিত হেসে আবদার করল, “অর্ক বলেছে তুমি খুব সুন্দর গান করো, কাল কিন্তু গাইতে হবে।”
অনুচ্চ বেদিতে দাঁড়িয়ে পতাকা উত্তোলন করলেন আশ্রমের কর্ণধার অবিনাশ চক্রবর্তী। এরপর আশ্রমের দায়িত্ব প্রাপ্ত কর্মী-সহ শিশু, বালক-বালিকা’রা সমবেত কণ্ঠে জাতীয় সঙ্গীত গাইল। এবার অস্মিতা শাশুড়িকে চোখের ইশারা করতে বেদির ওপর উঠে উনি গাইতে লাগলেন,
“ভারত আমার ভারতবর্ষ
স্বদেশ আমার স্বপ্ন গো
তোমাতে আমরা লভিয়া জন্ম
ধন্য হয়েছি ধন্য গো।।
ভয় ভেঙে জয় ছোট গল্প – সমাপ্ত
আপনাদের লেখা আমাদের ওয়েব সাইটে জমা দিতে গেলে, অনুগ্রহ করে আমাদের লেখা-জমা-দিন মেনু-তে ক্লিক করুন ও নিজেকে Author হিসেবে Register করুন এবং আমাদের পরবর্তী আপডেট পেতে আমাদের ফেসবুক পেজ অনুসরণ করুন।
অন্যান্য
শ্রাবণ সন্ধ্যা
শাস্তি
তিতির কান্না