যক্ষী ভৌতিক গল্প – সৌমাল্য শীল
১
অফিসের টিমটিমে আলোতে সৌগতর চোখ ঝিমঝিম করছিল। সামনে রাখা পাতাগুলির উপর অক্ষরগুলি মিশে যাচ্ছিল একে ওপরের সাথে, নেচে বেড়াচ্ছিল পাতার উপর দিয়ে কালো কালো পুতুলের মতন। যেন সে ডিসলেক্সিয়ার রুগী। আসলে অন্য কিছুই না, ক্লান্তি। সেই সকাল থেকে প্রুফরিড করে যাচ্ছে সে। এখন আর তার চোখ কিছুতেই সায় দিচ্ছে না, আর কিছুতেই সে তাকিয়ে থাকতে পারছে না।
সৌগত হাল ছেড়ে দিয়ে মাথা তুলে হেলান দিয়ে বসল। পকেট হাতড়ে বের করে আনলো বিড়ির প্যাকেট। মাত্র 5টা পরে আছে। এখন মাসের শেষ, অন্তত আরো দুটো দিন এতেই চালাতে হবে। তবু সেই মুহূর্তে তার একটা ধরানো দরকার। চোখ বুজে আসছে, মাথা ঝিমঝিম করছে। কিন্তু থামলে চলবে না, কালকের মধ্যেই বইটি প্রুফরিড করে পাঠাতে হবে প্রেসে। মালিকের কড়া নির্দেশ।
চারিদিকের নিস্তব্ধতা যেন গ্রাস করেছে। মাত্র সন্ধে আটটা কি সাড়ে আটটা হবে এখন। কিন্তু কলেজ স্ট্রিট পাড়ায় একবার দোকানপাট বন্ধ হতে শুরু করলে হঠাৎ করেই নিঝুম হয়ে যায়। কয়েক পা দূরেই বড় রাস্তা, সেখানে গাড়ির আনাগোনার শেষ নেই, তবু যেন সেই কোলাহল এই গলির ভিতর এসে পৌঁছায় না। আর এই বই কাগজ বোঝাই জানলা বিহীন ঘরটির ভিতরে আরোই যেন একটা থমথমে নিস্তব্দ ভাব।
সৌগত একটি ছোট প্রেসের কোম্পানিতে কাজ করে। কলেজ স্ট্রিটের একটি সরু গলির ভিতর একটি চারতলা বাড়ির তিন তলায় দুটি ঘর নিয়ে একটি ছোট অফিস। বাড়িটি বহুকালের পুরনো, প্রায় ভগ্নপ্রায়। উত্তর কলকাতার অনেক বাড়ির মতনই। দিনের বেলা গোটা পাঁচেক কর্মচারী কাজ করে তাদের অফিসে, কিন্তু এই মুহূর্তে সে একা। উপরের তলায়, নিচের তলায় আরো গুটিকয়েক বিভিন্ন ধরনের অফিস বা গুদাম আছে, এক তলায় সারি দিয়ে বইয়ের দোকান। কিন্তু এই মুহূর্তে সেই গোটা বাড়িতে সে একা। সবাই সন্ধে নামার আগেই চলে গিয়েছে।
এই বাড়িটা শতাব্দী প্রাচীন। কোন এক কালে কোন এক বনেদি পরিবারের গৃহ ছিল। কালে কালে সেই পরিবারও আর নেই, আর এই বাড়িটিও পারিবারিক গৃহ থেকে পরিণত হয়েছে অফিস বাড়িতে। বহুকাল সরিকি ঝামেলায় জড়িয়ে থাকার পর। বাড়িটির কচ্চিৎ দুর্নাম আছে। যে জমিদার পরিবার এই বাড়িটি বানিয়েছিল তাদের অনেক কেচ্ছা। কোন একটা ঘরে নাকি কোন এক গৃহবধূ গলায় দড়ি দিয়ে মরেছিল। কথিত আছে কাউকে নাকি বাড়ির নিচে হত্যা করে পুতে দেওয়া হয়েছিল। আবার দেয়ালের ভিতর জ্যান্ত গুমখুন করার অপবাদও আছে। সেই ঘটনাগুলি কতটা সত্য, কতটা কেবলই গল্প কারুর জানা নেই। তবে সেই সব অতৃপ্ত আত্মা যে ঘুরে বেড়ায় এ বাড়ির অলিন্দে অলিন্দে অন্ধকার নামার পর, সে কথা এই বাড়িতে কাজ করতে আসা প্রত্যেকটি কর্মী জানে। তাই সন্ধ্যা নামতে না নামতেই ফাঁকা হয়ে যায় বাড়িটি, তালা পরে যায় প্রতি দোরে।
পেটের টান না থাকলে সৌগতও বাড়ি চলে যেত। বিশেষ করে এই আষাঢ় মাসের মাঝামাঝি একটা দিনে, যখন বাইরে তুমুল ঝড় বৃষ্টি। সকাল থেকেই মেঘ করেছিল, থেকে থেকেই ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছিল। আর সন্ধের মুখেই নেমেছিল অঝোর ধারায় বর্ষণ। সঙ্গে কান ফাটানো বজ্রপাত। কিন্তু সৌগত যেতে পারেনি। মালিক বেরোনোর আগে বলে গেছে, বইটির সম্পূর্ণ প্রুফরিড করে তবেই মিলবে তার ছুটি।
সৌগত কিছু বলতে পারেনি। চাকরিটা তার বড় প্রয়োজন। গরীব ঘরের ছেলে সৌগত, স্ত্রী, কন্যা, অসুস্থ মা, অবিবাহিত বোন, মাথার উপর অনেকগুলো দায়িত্ব, অনেকগুলো মুখ তাকিয়ে আছে তার দিকে। নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলেদের বোধহয় এরকম মুখ বুজেই সব সহ্য করে দিনগত পাপক্ষয়ের মধ্যে দিয়ে জীবন কাটিয়ে দিতে হয়। তবু সংসারে অভাব কাটে না, একটু সুখ, স্বাচ্ছন্দ্য আসেনা জীবনে।
মাথার উপর হলুদ আলোর বাল্বটা জ্বলছে টিমটিম করে। মালিক এতটাই কিপটে, পুরো ঘরে মাত্র এই একটাই আলো রয়েছে। বেশির ভাগ দিন সৌগতকেই কাজ করতে হয় রাত অব্দি, বাকি সবাই সন্ধে নামার সাথে সাথেই বাড়ির পথ ধরে। ডানদিকে মালিকের ঘর অন্ধকার, নিশ্চুপ এবং তালাবন্ধ। অফিস ঘরের ঘষা কাঁচের দরজার ওপারেও নিবিড় অন্ধকার। সৌগত জানে গোটা বাড়িতে এই ঘর বাদে আর একটা ঘরেও কোনো আলো জ্বলছে না। পুরো তিনতলা বাড়িটি অন্ধকার, এমনকি সিঁড়িতেও কোন আলো নেই। কাজ শেষ হলে তাকে মোবাইলের টর্চের আলো জ্বালিয়েই অন্ধকার প্যাসেজ দিয়ে হেঁটে গিয়ে অন্ধকার সিঁড়ি বেয়ে নামতে হবে নিচে। একমাত্র শতাব্দী প্রাচীন বাড়িটির থেকে বেরোনোর পরেই রাস্তার কর্পোরেশনের হ্যালোজেন আলোকিত করবে তার বাড়ি ফিরবার পথ। এত অন্ধকারে বাড়িটি যেন এক অদ্ভুতুড়ে রূপ নিয়েছে, থমথমে পরিবেশ।
বিড়িটা শেষ করে সৌগত আবার কাজে ফিরবার মনস্থির করল। এখনও প্রায় শ’খানেক পাতা বাকি। তার কাঁধ পিঠ সব যেন শক্ত হয়ে গেছে, ঘাড়ের ব্যাথাতে সে আর ঘাড় ঘোরাতেই পারছে না। তার মধ্যে এই বইটি অতীব অদ্ভুত। প্রাচীন তিব্বতী তান্ত্রিক ক্রিয়াকলাপের উপর পুঁথির বাংলা অনুবাদ। লেখক প্রায় সময়ই উপযুক্ত বাংলা শব্দ না পেয়ে সংস্কৃত ভাষার উপযোগ করেছে, ফলে ভাষায় দাঁড়িয়েছে অত্যন্ত খটমট। সৌগতের মতন পটু প্রুফরিডারকেও মাঝে মধ্যেই অভিধান দেখতে হচ্ছে বানান জানার জন্যে। বাংলার ছাত্র হিসেবে সৌগত খুব খারাপ ছিল না, প্রথম বর্ষে ইউনিভার্সিটিতে স্ট্যান্ডও করেছিল। কিন্তু পিতার মৃত্যুর পর আর ফাইনাল পরীক্ষাটাও তার বসা হল না। আর আজকের দিনে একজন শুধুমাত্র উচ্চমাধ্যমিক পাস লোকের কি বা চাকরী জোটে।
বইটির একদিকে যেমন ভয়ংকর ভাষা এবং বিষয়বস্তু, তেমনি মাঝে মাঝে ভয়ানক দর্শন সব ছবি। সেগুলি নাকি বিভিন্ন ধরনের তিব্বতী দেবদেবী, কিম্ভুত দর্শন পৌরাণিক জীবজন্তু অথবা যক্ষীর ছবি! দেখলেই যেন হাড়হিম হয়ে যায়। যখন পাতা উল্টে শব্দশ্রেণীর জায়গা চোখের সামনে লাফিয়ে ওঠে ওরকম একটা ছবি, বুকটা কেঁপে ওঠে যেন। তবু সৌগত নির্ভীক ভাবে তার কাজে অগ্রসর হবার জন্যে প্রস্তুত হল। কিন্তু হতে পারল না। কাগজের উপর ওটি কিসের ছায়া?
টেবিলের ঠিক উপরেই ফলস্ সিলিং থেকে ঝুলছে বাল্বটি। তার টিমটিমে আলোর পুরোটাই সরাসরি এসে পড়া উচিৎ টেবিলের উপর খুলে রাখা বইয়ের পাতার উপর। অথচ সে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে একটি ছায়া। একটি হাতের ছায়া। তার নিজের নয়। মানুষের হাতের ছায়া অমন হয় না। প্রথমত আঙ্গুল ছয়টি, পাঁচটি নয়। শীর্ণ আঙুলগুলির প্রত্যেকটির অগ্রে বাঁকানো নোখ। এবং হাতটি কেবল আঙ্গুল এবং অত্যন্ত ছোট একটি চেটোতেই সীমাবদ্ধ, কোনো বাহুর সাথে যুক্ত নয়।
“ধুর এই পাগলের বই পড়তে পড়তে আমার মাথাটাই পাগল হয়ে গেছে। কি দেখতে কি দেখছি। কিছুই তো নেই, কেউই নেই। ছায়া আসবে কোথা থেকে।” সৌগত ভাবল। নিশ্চই ক্লান্তিতে চোখের ভুল ভেবে সে চোখটা কচলে আবার তাকালো। একবার পিছন ঘুরেও তাকালো। দেওয়াল থেকে ছাদ অব্দি বই স্তুপকৃত করে রাখা। কেউ নেই সেখানে।
“হুঁ, মনেরই ভুল। এইতো কিছু নেই,” ভেবে সৌগত আবার কাজে মনোযোগ দিল।
সৌগত মনোযোগ দিয়ে বানান দেখতে থাকলেও একটা অস্বস্তি যেন তাকে ঘিরে আছে। কেবলই মনে হচ্ছে কে যেন তার ঘাড়ের উপর ঝুঁকে পরে বইটি পড়ছে। সে যেন ঘাড়ের কাছে কার একটা নিশ্বাস টের পাচ্ছে, কাঁধে কার যেন ভর অনুভব করছে। এতটাই সেই অনুভব যে সে কয়েকবার মাথা ঘুড়িয়ে দেখেছে। কিন্তু কেউ নেই, কিছু নেই, সেটাই স্বাভাবিক।
থমথমে নিশ্চুপ পরিবেশ, নির্জন অন্ধকার বাড়ি, ক্লান্তি, অদ্ভুতুড়ে বই এবং তার কিম্ভূতুরে ছবি মিলিয়ে যে অলৌকিক পরিবেশ অবির্ভূত হয়েছে, সৌগত তার অস্বস্থির জন্যে সেটাকেই কারণ হিসেবে দর্ষাত। কিন্তু পারল না। কারণ সে একটি বানানের ভুল ধরতে পারেনি। অথচ স্পষ্ট তার চোখের সামনে লাল কালিতে দাগ ফুটে উঠল। কাঁপা কাঁপা অক্ষরে ফুটে উঠল সংস্কৃত শব্দটির সঠিক বানান। লাল দোয়াতের কালিতে, সৌগতের নীল ডট পেনের লেখার সাথে তাকে ভুল করার কোনো অবকাশই নেই।
সৌগত এতটাই অবাক হয়েছিল যে ভয় পেতে সে ভুলে গেছিল। সে পাথরের মতন বসে রইল। দেখতে থাকল বইটির পাতা যেন নিজে থেকে উল্টে গেল। একটি একটি করে ভুল বানান সংশোধিত হতে থাকলে লাল কালিতে। সৌগত যখন সম্বিত ফিরে পেল, সে টের পেল ভয়তে সে স্তম্ভিত হয়ে গেছে। অফিস থেকে বেরিয়ে যে পালাবে সেই ক্ষমতা তার নেই। হাত পা যেন অবশ হয়ে গেছে। কখন একটা ভয়ের আধিক্যে তার পা বেয়ে নেমেছে গরম মুত্রধারা। প্যান্ট জুতো মোজা ভিজিয়ে পায়ের নিচে জমেছে। ঠকঠক করে কাঁপছে সে, দাঁতে দাঁত কপাটি লেগে গেছে।
ঠক ঠক ঠক!
ঘষা কাঁচের দরজার ওপারে কেউ যেন ধাক্কা দিচ্ছে। ভেতরে আসার জন্যে আহ্বান পাওয়ার অপেক্ষা করছে। কিন্তু সৌগত জানে ওখানে কেউ নেই। থাকতে পারে না। পুরনো দিনের বাড়ির কাঠের সিঁড়ি, কাঠের প্যাসেজ। সেখান দিয়ে কেউ উঠলে বা হেঁটে চলে আসলে ক্যাঁচ ক্যাঁচ করে শব্দ হয়। কেউ হেঁটে এসে থাকলে সে টের পেত, শব্দ পেত। কিন্তু দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা আগন্তুক সেই সিঁড়ি বেয়ে ওঠেনি, যেন হওয়ায় ভেসে উপস্থিত হয়েছে।
ঠক ঠক ঠক!
এবার ধাক্কা বাইরে থেকে নয়। মালিকের ঘরের ভিতর থেকে। অন্ধকার তালা বন্ধ যে ঘর। যে অশরীরি বইটি পড়ছিল, সেও যেন টের পেয়েছে এই দ্বিতীয় আগন্তুকের উপস্থিতি। থেমে গেছে পাতা উল্টানো। সৌগত বুঝতে পারছে তার ঘরে বিপদ, বাইরেও বিপদ। ঘনিয়ে আসছে তার মৃত্যু।
সে মরে গেলে ঠিক তারই মতন তার কন্যার শিক্ষা বন্ধ হয়ে যাবে, তাকেও হয়ত এরকম কোনো পদদলিত উপার্জনের পথ বেছে নিতে হবে। সৌগত জানে না ঠিক কেন এই কথাটাই তার সর্বাগ্রে মনে পড়ল। সে ঝপ করে বইটি বন্ধ করে মোবাইলের তীব্র টর্চটা অন করল। তারপর দৌড়ে সামনে পিছনে না তাকিয়ে দৌড়াতে লাগল। অন্ধকার প্যাসেজে হোঁচট খেতে খেতে সিঁড়ি দিয়ে প্রায় গড়াতে গড়াতে সে এসে পৌঁছল নিচের তলায়। রাস্তায়। খোলা আকাশের নিচে। রাস্তার আলোর মধ্যে। এই প্রথম যেন তার ধড়ে প্রাণ এলো, বুক ভরে নিশ্বাস নিতে পারল।
সৌগতের সাহস হল না ওই বাড়িতে ফিরে গিয়ে সাইকেলটা নিয়ে আসার। বড় রাস্তায় গিয়ে বাস ধরেই চলল বাড়ির দিকে।
২
অপমান সহ্য করা সৌগতের মজ্জাগত হয়ে গেছিল। তবু আজ যেন বড্ড বেশি বিদ্ধ করছিল মালিকের কথাগুলো। সে নাকি ফাঁকিবাজ, উদ্ভট অজুহাত দিয়ে কাজ না করার ফন্দি নাকি সব। অকথ্য ভাষায় তাকে গালাগাল দিয়েছে মালিক। অফিসভর্তি লোকের সামনে। লজ্জায় অপমানে কান লাল হয়ে গেছিল সৌগতের। এমনকি পিতা হিসেবে তার অক্ষমতার জন্যে তার কন্যাকে রাস্তায় দাড়িয়ে নিজেকে বিক্রি করতে হবে, এমন চরম ভাষণও তাকে শুনতে হয়েছে।
বইটি বেপাত্তা হয়েছে। সৌগত যে অফিসের দরজা, বাড়ির দরজা সব খুলে রেখে কাল চলে গেছিল, সেই যে এই চুরির জন্যে দোষী একথা বারবার তাকে মনে করিয়ে দিয়েছে মালিক। পায়ে পরে ক্ষমা চাইতে হয়েছে তাকে ঘরভর্তি লোকের সামনে, তারপরে তার চাকরি রক্ষা হয়েছে।
রাগে দুঃখে অপমানে সৌগত স্থবির হয়ে বসেছিল তার টেবিলে। কাল যা সে প্রত্যক্ষ করেছিল, যা অনুভব করেছিল, তার সবই কি তার মনের ভুল? দিনের আলোয় সেই রকমই তার মনে হচ্ছে। অথচ সে বিশ্বাস করতে পারছে না যে সত্যিই সবকিছুই তার কল্পনাপ্রসূত। অন্য কর্মচারীদের বাঁকা চোখের দৃষ্টি বারবার তাকে বিদ্ধ করছিল, মুখ না তুলেই সে বুঝতে পারছিল তাদের ঠোঁটে তাচ্ছিল্যের হাসি।
ধপ!
সৌগত বুঝতে পারল তার সামনের টেবিলে ভারি কিছু একটা ফেলা হয়েছে।
“লেখককে অনেক অনুনয় বিনয় করে এই হাতে লেখা পান্ডুলিপিটা পাওয়া গেছে। আজ কোনো ভুল, কোনো ফাঁকি চলবে না। আজ দরকার হলে সারারাত কাজ করেও শেষ করতে হবে। পুরোটা টাইপ করে প্রুফরিড করে তবেই বাড়ি যাবি, বুঝলি?” মালিকের তাচ্ছিল্য ভরা কথা কানে এল সৌগতের।
সৌগত জানে কোনোভাবেই প্রায় পাঁচশত পাতার বইটি একবেলার মধ্যে টাইপ করে, তারপর আবার পুরোটা প্রুফরিড করা সম্ভব নয়। অথচ তার নিস্তার নেই। সন্ধের পর ঘুটঘুটে অন্ধকারে এই বাড়িতে বসে টিমটিমে আলোর নিচে তাকে কাজ করতে হবে। আবার কোন বিভীষিকার সম্মুখীন হতে হবে তাকে?
“করব স্যার।” সৌগত দ্বিরুক্তি না করে কাজ শুরু করল।
লেখকের হাতের লেখা প্রায় পড়া যায় না, এতটাই জড়িয়ে জড়িয়ে লেখা। তবু সে সাধ্যমতন স্পিডে টাইপ করতে থাকল। দুপুর গড়িয়ে এলো, কিন্তু কাজ ছেড়ে উঠে গিয়ে মধ্যাহ্নভোজন করার অবকাশ তার হল না। পেটে ছুঁচো ডন বৈঠক করছে, তবু সে বিরতি নেবার সাহস পেল না। আর অপমান, আর গালাগাল তার সহ্য করার ক্ষমতা নেই। অপমানিত হবার থেকে ক্ষুধাকে উপেক্ষা করা অধিকতর সহজ। চাকরিটা গেলে ক্ষুধা তো তার নিত্যসঙ্গী হয়ে উঠবে!
তবু যেন সময় ঝড়ের বেগে কেটে যাচ্ছে। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে এলো, বিকেল পেরিয়ে সন্ধে। সৌগত ভীত ভাবে বুঝতে পারল অর্ধেকও সে শেষ করতে পারেনি। একটু পরে এক এক করে বাকি কর্মচারীরা বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে শুরু করল। এক সময় প্রকাশনার মালিকও তার নিজের ঘর তালা বন্ধ করে চলে গেল। এখন গোটা অফিসে কেবল সে একা, এবং সেই টিমটিমে আলো।
সিঁড়িতে পদধ্বনি বুঝিয়ে দিল উপর তলার এবং নিচের তলার সব কর্মচারীও বাড়ি ফিরছে। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই গোটা বাড়ি খা খা করবে, গোটা পাড়া জনমানবশূন্য হয়ে যাবে। শুধু সে থেকে যাবে এই ভৌতিক পরিবেশে, এই ভয়ানক বইটির সাথে। ভাবতেই সৌগতের শিরদাঁড়া বেয়ে একটি হিমশীতল স্রোত বয়ে গেল।
অবোধ ছাগশিশুও বলি হবার ত্রাস অনুভব করতে পারে, কসাইখানার রাস্তায় প্রথমবার এগোলেও টের পায় আসন্ন মৃত্যুর করাল দন্তবিকচিত হাসি। ঠিক সেভাবেই সৌগত যেন বুঝতে পারছিল যে আজ অন্ধকারে তার ললাটেও লিখন হয়ে আছে ভয়ানক কিছু। আর কখনও সে জড়িয়ে ধরতে পারবে না তার স্ত্রীকে, আদর করতে পারবে না তার ফুলের মতন ফুটফুটে কন্যাকে। তার স্নেহময়ী মা কাল সকালে তার মৃতদেহ দর্শন করবে, তার বোন আর ডাকতে পারবে না “দাদা” বলে। এই মৃত্যুগহ্বর থেকে তার কোনো নিস্তার নেই। মালিক আজ অফিসের দরজায় বাইরে থেকে তালা লাগিয়ে দিয়ে গেছে। বলে গেছে কাজ শেষ হলে তবেই ফোন করতে। তার বাড়ি কাছেই, সে নিজে এসে খুলে দেবে একমাত্র কাজ শেষ হলে তবেই।
কাল যে পাতাটা শেষ পড়েছিল বলে মনে করতে পারছিল, সেই পাতাটি পেরিয়ে গেল সৌগত। আজ সুবিধের মধ্যে তার নিজের হাতে টাইপ করা বইটির ভিতর সেই ভয়ঙ্কর ছবিগুলি নেই। বইটির বিষয়বস্তু অবশ্য আরো ভয়ানক এক বিষয়ে অবতীর্ণ হয়েছে। যক্ষ!
‘যক্ষের ধন’ শব্দবন্ধটির সৌগত পরিচিত ছিল, কিন্তু সেটির সাথে যে এমন একটি বিভীষিকাময় এবং করুণ কাহিনী জড়িয়ে থাকতে পারে, সেটা তার জানা ছিল না। পুঁথি অনুসারে, ধনরাশি মাটির নিচে পুঁতে রাখার সময় তার সাথে একটি বাচ্চা ছেলেকে জ্যান্ত গোড় দেওয়া হতো। সঙ্গে থাকত বেশ কিছুদিনের খাবার বা জল। সেই বাচ্চাটি একসময় ক্ষুধায় তৃষ্ণায় অথবা বাতাসের অভাবে মরে গিয়ে যক্ষে পরিণত হয়, তারপর সেই গুপ্তধন পাহারা দেয় অনন্তকাল ধরে। ঠিক যেন, প্রাচীন মিশরে ফারাওয়ের মমির সাথে যেভাবে পিরামিডের ভিতর ক্রীতদাসদের আটক করা হত, পরজন্মে ফারাওয়ের খিদমদগার খাটার জন্যে।
আরো কত ভাবনা আসছে সৌগতের মনে। ও নিজেও যেন একটি যক্ষ, মালিকের পুঁজি রক্ষা করতে ব্যস্ত প্রাণ তুচ্ছ করে। ও যেন মরে বেঁচে আছে কেবলই মালিককে ধনবান থেকে ধনবানতর করার প্রয়াসে। পুঁজিবাদী নগর সভ্যতায় কি প্রতিটা কর্মীই যক্ষ নয়?
এখন বইটিতে বর্ণিত হয়েছে সেই ক্রিয়ার পদ্ধতি। ঠিক কি কি লক্ষণ দেখা গেলে, একটি বাচ্চা যক্ষ বানানোর জন্যে উপযুক্ত চিহ্নিত হবে, সেই সব লিখিত আছে। পড়তে পড়তে সৌগতের মনে হচ্ছিল এমন আজাইরা বই কেই বা লিখল, আর কেনই বা লিখেছে। এইসব পদ্ধতি আজকের দিনে কেউ পড়ে আর কি করবে?!
তারপরেই একটি বাক্য তাকে স্তম্ভিত করে ফেলল। যে পুঁথি থেকে এই জ্ঞান আহরণ করেছে লেখক, সেটিকেও পাহারা দিচ্ছিল এমনই একটি যক্ষ! এবং লেখক সেই পুঁথি পেয়েছেন নিজের সব থেকে কাছের বস্তুটির বিনিময়। কি সেই বস্তু সেটা অবশ্য বিবৃত নেই।
লেখক আবার ফিরে গেছে যক্ষের ধন আহরণের বিষয়। যক্ষ নাকি তার ধন উদ্ধার করতে দেয়ে একমাত্র এক ভীষণ বলির বিনিময়। যে আহরণ করছে তার সবথেকে প্রিয় ফলের বিনিময়। এখানে ফল অর্থাৎ সন্তান। নিজের জীবন বলি দিয়েও সেই ধন উদ্ধার হয়ে না, নিজের জীবনের থেকেও অধিকতর প্রিয় কিছুর বিনিময়েই নাকি সেই ধন আহরণ সম্ভব হয়। যক্ষের আত্মা সেই বলি দেওয়া ‘ফলে’র বিনিময় মুক্তি পায়, শান্তি পায়। এবং নব্যমৃত ব্যক্তিটির আত্মা পরিণত হয়ে যক্ষে!
সাবধানবাণীটি বড় দেরিতে পড়েছিল সৌগত। যক্ষকে আহবান জানানোর মন্ত্র লেখা ছিল। সাবধান করা হয়েছে সেই মন্ত্র উচ্চারণ করে পড়লে যদি ধারে কাছে কোন যক্ষ উপস্থিত থাকে তবে সে জেগে উঠবে। তখন কেবল মাত্র দুটি উপায় থাকে। প্রথমত, যক্ষের হাতে প্রিয় ফল তুলে দিয়ে, অর্থাৎ সন্তানকে বলি দিয়ে গুপ্তধন উদ্ধার। কিন্তু একবার অহবান করে ফেললে, যক্ষকে প্রত্যাখ্যান করা যায় না; তখন ভুল করে ফেলেছি বললে শাস্তি হচ্ছে মৃত্যু!
সৌগত এই অব্দি পড়ে থমকে গেল। এর মধ্যে একটাও তার মনোবাঞ্ছা নয়। তবে মধ্য কলকাতায় বসে এই মন্ত্র পড়লেও নিশ্চই কোন যক্ষ উদয় হবে না! এখানে কাছাকাছির মধ্যে কোন যক্ষ থাকা নিশ্চই সম্ভব না। এই বলেই নিজেকে স্বান্তনা দিল সৌগত।
তবে সব দিক থেকেই যেন তার ভাগ্য সহায় নয়। কারণ এরপরেই লেখা আছে যে ভুলবশত কেউ যদি যক্ষকে আহ্বান করে ফেলে, সেই ক্ষেত্রে নিচে দেওয়া দেবীর ছবিটি তাকে রক্ষা করবে। কালকের ছাপানো বইটি থাকলে তাতে নিশ্চই ছবিটি থাকত। কিন্তু এই হাতে লেখা পাণ্ডুলিপিতে কিছুই নেই, কেবল কিছুটা খালি জায়গা।
তবে আতঙ্কের তখনও আরও অনেক কিছু বাকি ছিল। সৌগত যতই বইটি নিয়ে এগোতে থাকল, ততই যেন বিষয়বস্তু ভয়ঙ্কর থেকে আরো ভয়ংকরতর হয়ে উঠেছে। যেমন শবের সাথে মিলনের মাধ্যমে প্রেত আহবানের পদ্ধতি। অথবা বিভিন্ন তান্ত্রিক দেবদেবীর পূজা বিধি; সেই সব পদ্ধতি যেমন ঘৃণা উদ্রেককারী, ঠিক ততটাই ভয়ানক সেই সাধনার পথ। লেখক বারংবার সাবধান করেছেন পাঠককে, যে আশপাশে কোনরকম অলৌকিক ঘটনা ঘটলে বা তার আঁচ পাওয়ামাত্র তৎক্ষণাৎ পাঠ বন্ধ করতে। অজ্ঞাতে কোনো প্রেত বা দেবীর আহ্বান ঘটলে, ক্ষুব্ধ দেবীর অভিশাপে ঘটে যেতে পারে চরম ক্ষতি, এমনকি মৃত্যু।
সেই বাণী বারবার অগ্রাহ্য করে টাইপ করে চলেছে সৌগত। কারণ সে ইতিমধ্যে টের পাচ্ছে ঘরের ভিতর বিভিন্ন অশরীরীর উপস্থিতি। সেই তার পিঠের পিছন থেকে কেউ উঁকি মেরে দেখছে, তার তপ্ত নিশ্বাস বাইরে অন্ধকার হবার পর থেকেই টের পাচ্ছে সৌগত। তবে আজ সে একা নয়। মাথা না তুলেই চোখের কোণ থেকে সৌগত বুঝতে পারছে ঘরের মধ্যে উপস্থিত হয়েছে একটি হিংস্র জানোয়ার। থেকে থেকেই শুনতে পারছে তার নিচু অথচ রাগত গর্জন। ওদিকে অন্ধকারের মধ্যে থেকে কে যেন তাকিয়ে আছে তার দিকে ভাঁটার মতন চোখের দৃষ্টি দিয়ে। সৌগতের সাহস হচ্ছে না মাথা তুলে দেখার, যেন সে তাদের না দেখতে পেলে তারাও তাকে দেখবে না। বা সে অগ্রাহ্য করলে তারাও তাকে অগ্রাহ্য করবে। ঠিক যেভাবে উটপাখি বালির ভিতর মাথা গুঁজে বিশ্বাস করে সিংহ তাকে দেখতে পাচ্ছে না, সেইরকম কল্পনাপ্রসূত বিশ্বাস নিয়ে।
কিন্তু এক সময় আর সে অগ্রাহ্য করতে পারল না। কি যেন একটা তার পায়ের সাথে জড়িয়ে তাকে আস্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলছে চেয়ারের সাথে। কার যেন শাদন্ত বসে যাচ্ছে তার কাঁধে। তবু সৌগত নিশ্চল নিশ্চুপ নিরবতা পালন করে টাইপ করে যেতে লাগল। আর মাত্র একশ পাতা বাকি, তার পরেই সে ফোন করতে পারবে মালিককে। নিস্তার পাবে এই অন্ধকার হত্যাপুরি থেকে।
“ক্রিং ক্রিং! ক্রিং ক্রিং!” হটাৎ করেই ফোনটা বেজে উঠল।
নিস্তব্ধতা ভঙ্গ হবার সঙ্গে সঙ্গেই যেন একটা ঝড় বয়ে গেল ঘরের মধ্যে। একটা দক্ষযজ্ঞ বেঁধে গেল! ফোনটি বেজে উঠেছিল মালিকের নিজস্ব চেম্বারে টেবিলের উপর। সেই বন্ধ দরজাটি সজোরে খুলে পড়ল আর ভিতর থেকে কি যেন একটা ঝাঁপিয়ে পড়ল সৌগতের টেবিলের উপর। কুণ্ডলিত ধোয়ার মধ্যে সৌগত তার চেহারা বুঝতে পারছিল। একটি ভয়ঙ্কর দর্শন জানোয়ার – তার তিনটি মাথা। একটি তিনমুখো ভয়ানক কুকুর, তার তিনটি মুখ থেকে ঝরছে লালা, শাপদ দাঁতগুলি ঝকঝক করছে। কুকুর হলেও আয়তনে সেটি একটি বাঘের থেকেও বেশি বড়!
সৌগত আর নিজেকে সামলাতে পারল না। চেয়ার টেবিল উল্টে, কোনরকমে গড়িয়ে, হামাগুড়ি দিয়ে সে আশ্রয় নিল মালিকের অফিসের ভিতর। বাইরের ঘরে ঘটে চলছে এক বিষম যুদ্ধ। সেই ভয়ানক দর্শন তিন মাথা কুকুরটি যুদ্ধ করছে একটি কিম্ভুত দেখতে মানুষের সাথে। সেই মানুষটির উচ্চতা প্রায় 10 ফুট, পুরোনো দিনের বাড়িটার প্রায় ছাদ ছুঁয়ে যাচ্ছে! তার হাত পাগুলি অবশ্য পাখির নখরের মতন। সৌগত বুঝল এরই হাতের পাঞ্জার ছায়া কাল সে দেখেছিল, এরই নিশ্বাস সে টের পাচ্ছিল তার ঘাড়ের উপর।
সেই দানবাকৃতি মানুষটি তার তীক্ষ্ম নখর দিয়ে আঘাত হানছে কুকুরটির গায়ে, সেই কাটা দিয়ে রক্ত ফিনকি দিয়ে ছিটকে পড়ছে ঘরের প্রতিটি দেয়ালে, মেঝেতে, এমনকি ছাদেও। আবার কুকুরটি তার স্বদন্ত বসিয়ে দিচ্ছে সেই মানবাকৃতির পায়ে, সেখান দিয়েও ঝরছে রক্ত। সেই প্রবল বিক্রমশীল দুই জীবের রক্ত ক্ষয়িষ্ণু যুদ্ধ দেখতে দেখতে সৌগত ভয়ে থর থর করে কাঁপছিল। সেই দুটি দানবের সামনে সে খুবই দূর্বল।
কে যে তার সহায়? আর কে তার বিপক্ষে? সৌগত বুঝতে পারছিল না তুই যুযুধানের লড়াইয়ের শেষে তার কি পরিনতি হবে। জয়ী কি তাকে রক্ষা করবে, নাকি তার ক্ষতি সাধন করবে? এতক্ষণ টাইপ করা পাতাগুলি সারা ঘরে ছড়িয়ে পড়েছে, উড়ে বেড়াচ্ছে ঘরময়। সেই ভয়ঙ্কর দর্শন মানুষটি এবং সেই ভয়ানক কুকুরটি অবিরাম যুদ্ধ করে চলেছে, তাদের হুঙ্কারে কানে তালা লেগে যাবার জোগাড় তার। মাঝে মাঝে তারা ঘরময় দাপিয়ে বেড়াচ্ছে ধোঁয়ার কু্ডলী হয়ে, কখনও বা তারা তাদের রূপ ধারণ করছে।
ক্রিং! ক্রিং! ক্রিং!
আবার বেজে উঠেছে ফোনটা। সৌগত ভয়ে ভয়ে তুলে নিল রিসিভারটা। “কে?” তার গলা বসে গেছে। কোনো ক্রমে একটা ঘড়ঘড় করে শব্দ বেরিয়ে এল তার গলা থেকে।
“ঘুমিয়ে পড়েছিস নাকি রে! ফোন ধরিস না কেন? সেই কখন ফোন করলাম!” ওপাশে মালিকের কন্ঠস্বর।
সৌগতের খুব রাগ হল। এটা মানুষ? নাকি এই সত্যি করে কোন পিশাচ, কোন প্রেত? ওর প্রাণ সংশয় বিপদ আর ইনি বলছেন ও নাকি ঘুমিয়ে পড়েছে। পর মুহূর্তেই তার মাথায় খেলে গেল একটি ভয়ানক বুদ্ধি। ওর নিজের প্রাণ বাঁচানোর বুদ্ধি।
“না স্যার! কাজ শেষ প্রায়। আসুন!” চুপিচুপি করে বলল সৌগত।
বাইরে ততক্ষণে যুদ্ধ প্রায় অন্তিম পথে। সেই ভয়ানক দর্শন মানুষটি কিভাবে যেন বেঁধে ফেলেছে সেই ভয়ানক কুকুরটিকে। সে রাগে গজরাচ্ছে কিন্তু কিছু করতে পারছে না। মিথ্যা আস্ফালন করছে কোনায় বসে। ভাটার মতন চোখ নিয়ে সেই পুরুষটি কি যেন খুঁজছে। সৌগত বুঝতে পারল, তাকেই খুঁজছে। সৌগতের প্রাণ ধুকপুক করতে লাগলো। সে সেধিয়ে যেতে চাইল অন্ধকারের ভিতর, লুকিয়ে পড়তে চাইল সেই ক্রুর দৃষ্টির থেকে।
কিন্তু পারল না। সৌগত অনুভব করল বিদ্যুতবেগে সেই নখর বসে গেছে তার কাঁধে। তাকে তুলে নিয়েছে ক্ষয়চারি শিকারী পাখির নখে বিদ্ধ খরগোশের মতন।
“আমাকে আহবান করেছিস কেন পাপিষ্ঠ! খুব লোভ গুপ্তধনের? বল! আমি এই বাড়ির নিচে পুঁতে রাখা যক্ষ!” ঘড়ঘড় করে শব্দগুলি উচ্চারিত হল।
সৌগত কি বলবে বুঝে উঠতে পারল না। তার গুপ্তধন চাই না, কেবল প্রাণ রক্ষা হলেই সে নিস্তার পায়। কিন্তু সে নিরুপায়। তার নিস্তার নেই। নয়ে সে নিজের প্রাণ হারাবে, নচেৎ তাকে যক্ষের কাছে তুলে দিতে হবে তার মুক্তিপণ।
“চাই! আমি যখের ধন চাই!” সে বলে উঠল।
হাড়হিম করা অট্টহাসিতে গমগম করে উঠল ছোট্ট বদ্ধ ঘরটি।
“চাইলেই কি পাওয়া যায়? তার জন্যে তোকে একটি চরম বলি দিতে হবে। তোর সব থেকে কাছের মানুষকে!” আবার সেই ঘড়ঘড় কন্ঠস্বর।
“আমি প্রস্তুত। কিছুক্ষণের মধ্যে এই ঘরে যে প্রবেশ করবে, আমার জীবন রক্ষা করতে ছুটে আসছে, সেই আমার সব থেকে প্রিয় মানুষ।” সৌগত দ্রুত নিজের জীবন রক্ষার উপায় ভেবে নিয়ে বলল।
“তবে তুই পাবি অগাধ ঐশ্বর্য! যে জমিদার এই বাড়ি বানিয়েছিল, সেই পাষণ্ড আমাকে এই বাড়ির নিচে মাটির ভিতর পুঁতে রেখেছিল। এই তার অগাধ স্বর্ণ ভান্ডার।”
“যে আসছে সে তারই বংশধর।” সৌগতের কি মনে হল, সে এই কথাটি বলে দিল।
“আহা! আহা! তার রক্তে আমার পিপাসা মিটবে! আমি তোর তুলে দেওয়া ফল পেলেই মুক্তি পেতাম এই যক্ষ হবার অনির্দিষ্ট যন্ত্রণা থেকে, কিন্তু সেই প্রতিহিংসার রক্তপিপাসা আমাকে মুক্তি দিত না! আঃ শান্তি!” সেই ঘড়ঘড় কণ্ঠস্বরে যেন কিছুটা তৃপ্তির ছোঁয়া। সৌগত পতিত হল মেঝের উপর। ঘাড়ের ক্ষত থেকে বইতে থাকল উষ্ণ রক্তের ধারা।
ঘ্রং! ঘ্রং!
সৌগত আড় চোখে দেখতে পেল তার মাথার পাশে দুটি ঘড়া। আওয়াজ থেকেই সে বুঝতে পারছে, সেগুলি খুব ভারী। ভিতরে কি আছে সে জানে না। কিন্তু ঝনঝনানি শুনে বোধ জাগে স্বর্ণ মুদ্রার।
এখন কেবল অপেক্ষার পালা। যক্ষ তার দিকে তাকিয়ে আছে এক মনে। একটা সময় নিস্তব্ধতা ভেঙে বলল, “মায়ের কথা খুব মনে পড়ে। খুলনায় বাড়ি ছিল আমাদের, সুন্দর সুফলা গ্রাম। এই জমিদারের এলাকা, কিন্তু তিনি কলকাতার এই বসত বাটিতেই বেশির ভাগ সময় কাটাতেন। কেবল খাজনা আদায় করতে যেতেন। সেবার বন্যা হল, আমি বাপ মা বোন সবাই বাড়ির ছাদে উঠে ছিলাম পুরো এক হপ্তা! জল নেমে গেল কিন্তু ধান পচে গেছে। জমিদারবাবু কোন কথাই শুনল না, খাজনার বদলে আমারে নিয়ে এলো এ বাড়িতে। বলেছিল চাকর করে রাখবে, যতদিন না খাজনার টাকা ওঠে। জ্যান্ত পুঁতে দিল বাড়ির নিচে। মায়ের জন্যে কাদতে কাদতে, একসময় ক্ষিদা তৃষ্ণার্ত হয়ে মরে গেলাম!”
সৌগতের বড় মায়া হল ছেলেটার জন্যে। গরীব ঘরের মানুষের জীবনের কতটুকুই বা মূল্য, সে একালেই হোক বা সেকালে। সাহস পেয়ে জিজ্ঞেস বলল, “আপনার তো আজ মুক্তি হয়ে যাবে।”
ধপ! ধপ! ধপ!
সিঁড়ি দিয়ে উঠে আসছে ভারী পদধ্বনি। এগিয়ে আসছে ঘরের বন্ধ দরজার দিকে। খসখস শব্দে মনে হয় দরজার বন্ধ তালায় কেউ চাবি ঢোকানোর চেষ্টা করছে, অন্ধকারের ভিতর হাতড়ে হাতড়ে।
খটাং! দরজার পাল্লাটা খুলে গেল। কিন্তু মালিক বোধহয় ঘরের ভিতর নিকষ অন্ধকার দেখে থমকে গেছে, ভিতরে ঢুকছে না।
“কিরে! কই তুই! অন্ধকার কেন?” আওয়াজ করল বাইরে থেকে।
“ঢুকে আসুন। আলোটা কেটে গেছে।” সৌগত বলল। ওর মন বলছে এই ঘরের চৌহদ্দির ভিতর ঢুকলেই কিছু একটা ঘটবে।
কর কর করাত!
একটা যেন বাজ পড়ল কোথায়। সেই সঙ্গেই আলোটা একবার দপ করে জ্বলে উঠল। তাতে সৌগত দেখতে পেল দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মালিকের চেহারাটা। তারপরেই কোণে অপেক্ষায় বসে থাকা বিশাল তিনমাথা কুকুরটি দন্তবিকশিত করে ঝাঁপিয়ে পড়ল তার উপরে, টুঁটি চেপে ধরেছে তার। সৌগত তার কাতর আর্তনাদ শুনতে পেল, কিন্তু সে সেইদিকে কর্ণপাত করল না। ঘড়া দুটি তুলতে গিয়ে বুঝল, সেগুলো বেজায় ভারী। একার পক্ষে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। কেবল একটি ঘড়ার ভিতর হাত ঢুকিয়ে খাবলা মেরে তুলে নিল যেটুকুনি পারল। তারপর দিকবিদিক শূন্য হয়ে সে দৌড়াল মুক্তির পথে, আলোর পথে।
সৌগত দৌড়ে বড় রাস্তার মোড়ে পৌঁছে হাঁপাতে লাগল। একদিকের পকেটটা স্বর্ণমুদ্রার ভারে নুয়ে পড়েছে। ঘাড়ের ক্ষতটা থেকে রক্ত ঝরা বন্ধ হয়েছে আপাতত। সে আর অন্য কিছু না পেয়ে ঘরময় ছড়িয়ে থাকা কাগজের কয়েকটি সেখানে চেপে ধরেছিল। এখন ফেলতে গিয়ে দেখল সেটি বইটির শেষ পৃষ্ঠা।
“আমি জানি এই বই কখনই পৃথিবীর মুখ দেখবে না। আমি নিঃসন্তান। এই বইটিই আমার সন্তান, আমার সারা জীবনের পরিশ্রম। পুঁথিটা আমি পেয়েছিলাম এই বইটির মূল্যেই। পুঁথিটি যে পাতালের চাবি, সেটিকে পাহারা দিচ্ছিল স্বয়ং যমরাজের কুকুর সেরিব্রাস। আমি পুঁথিটা পেয়েছিলাম এই শর্তেই, যদি কেউ এই বই থেকে যে কোন একটি বিদ্যা ব্যবহার করতে চেষ্টা করবে, তার তৎক্ষণাৎ মৃত্যু ঘটবে। বা কারুর জীবনের মূল্যে সে নিজের মুক্তি কিনতে পারবে।”
সৌগত বুঝতে পারল যে তিন মুখের কুকুরটি সেরিব্রাস। সে ভুল বশত ওই যক্ষটিকে মন্ত্র পড়ে আহবান করে ফেলেছিল, তাই সেরিব্রাস তাকে হত্যা করতে আসে। কিন্তু পরাজিত হয় যক্ষের কাছে। সৌগত যখন নিজের প্রিয় মানুষ বলে তার মালিককে তুলে দেয় যক্ষের হাতে, যক্ষ সেরিব্রাসকে লেলিয়ে দেয়ে তাকে হত্যা করতে। এক ঢিলে তিন পাখি! সেরিব্রাস তার প্রাপ্য পেয়েছে, যক্ষের পেয়েছে কেবল মুক্তি নয় তার সাথে প্রতিহিংসার রক্তপিপাসু মেটানোর সুযোগ, আর সৌগত? সে পেরেছে তার প্রাণ বাঁচাতে!
কলেজ স্ট্রিটের মুখে ভারী বর্ষণে জল জমে গেছে। সৌগত সেই জলে ভাসিয়ে দিল কাগজটাকে। নেমে আসা বৃষ্টি ধারা তার জীবন থেকে যেন মুছিয়ে দিচ্ছে এই ভয়ানক অধ্যায়, তাকে নবজীবন দিচ্ছে।
একবার হাত দিল সে পকেটে। বেশি না, তবে যেটুকু সে পেয়েছে তাতেই চলে যাবে তার, তার পরিবারের। বিশেষ সমৃদ্ধি হয়ত আসবে না, কিন্তু জীবনে অভাব হয়ত কিছুটা লাঘব হবে। মেয়ের পড়াশোনাটা হয়ে যাবে, বোনের বিয়েটা, মায়ের চিকিৎসা। সংসারে সুখ আসবে, শান্তি আসবে। এর থেকে বড় যক্ষের ধন আর কি আছে!
যক্ষী ভৌতিক গল্প – সমাপ্ত
আপনাদের লেখা আমাদের ওয়েব সাইটে জমা দিতে গেলে, অনুগ্রহ করে আমাদের লেখা-জমা-দিন মেনু-তে ক্লিক করুন ও নিজেকে Author হিসেবে Register করুন এবং আমাদের পরবর্তী আপডেট পেতে আমাদের ফেসবুক পেজ অনুসরণ করুন।
অন্যান্য
শ্রাবণ সন্ধ্যা
শাস্তি
তিতির কান্না