কলম পাতুরি

ভাবনা আপনার প্রকাশ করবো আমরা

Home » পুজো সংখ্যা ১৪৩১ » ভূতুড়ে ঝড়

ভূতুড়ে ঝড়

ভূতুড়ে ঝড় ভৌতিক গল্প – মৃণাল বন্দ‍্যোপাধ‍্যায়

লাল কুটুস আর নীল পুটুস দুই যমজ বোন। দুই বোনের চেহারায় অদ্ভুত মিল। অবশ‍্য সেটাই তো হওয়ার কথা। যমজ বোন তো। দুজনেরই শরীর বলতে শুধু  গুনে গুনে দুশ ছ’টা করে হাড়। তাহলে তো ভারি মুশকিল। আলাদা করে চিনবো কি করে? কোনও চিন্তা নেই, এরও সমাধান আছে। উপেন্দ্র কিশোর রায়ের গুপি গাইন আর বাঘা বাইনের গল্পের সেই ভূতের রাজার কথা মনে আছে তো? তো সেই রাজা ওদেরকে এক জোড়া করে লাল আর নীল চোখ উপহার দিয়ে ছিলেন, কারণ উনিও ওদের দুজনকে আলাদা করে চিনতে ভুল করেছিলেন। ফলে নিজের সমস‍্যা দূর করতে গিয়ে বাকিদের সমস‍্যারও সমাধান হয়ে গেল। কি হলো তোমরা কি ভয় পেলে নাকি? আরে ওরা নামেই ভূত কিন্তু তোমাদের মধ‍্যে থাকা অনেক দুষ্টু বাচ্চার থেকে হাজার গুন ভালো। কারোর কোনও ক্ষতি করেনা। কোনও বাচ্চা বেশি দুষ্টুমি করলে একটু চোখ গুলো বড় বড় করে ভয় দেখায় আর ক্কচিৎ কদাচিৎ কান দুটো একটু ধরে আলতো করে মুলে দেয়। ওরা গ্রামের পূর্ব দিকে জহর দাদুদের বড় সান বাঁধানো দিঘির পশ্চিম পাড়ের কোণায় যে সমান মাপের দুটো পাশাপাশি তাল গাছ আছে, ঐখানেই সারাদিন লম্বা পা দুটো ঝুলিয়ে বসে থাকে শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা সব ঋতুতেই। অনেকক্ষণ ধরে পা ঝুলিয়ে রাখতে রাখতে যখন আর ওদের ভালো লাগেনা তখন ওরা পরস্পরের হাড় গুলো নিয়ে ডাং-গুটি খেলে। তবে সবার ভালো করতে গিয়ে একটা অপকর্মও করে ফেলে না বুঝে। বিশেষ করে ভরা ভাদ্র মাসে। যখন গাছের তাল গুলো গ্রীষ্মের প্রখর তাপে পেকে একেবারে কালো কুচকুচে আর নরম টুসটুসে হয়ে ওঠে তখন ওরা গাছের তলায় কেউ পাকা তাল পরে আছে কিনা খুঁজে দেখতে এলে উপর থেকে তাল পেরে নীচে ফেলে দেয়। ভালোর কথা ভেবেই করে কিন্তু আচমকা অজান্তেই পাকা তাল মাথায় পড়ে অনেকেই অল্প বিস্তর আহত হয়।

কি হলো, ঋকু বাবু তুমি কি ভয় পাচ্ছো? 

“নাগো গল্প দাদু, আমি মোটেও ভয় পাচ্ছিনা”।

তাহলে চোখ বন্ধ করে ঠোঁট নাড়িয়ে কি বিড়বিড় করছো?

“না, মা বলেছিল, যখনি ভয় পাবি তখনই –

‘ভূত আমার পূত পেত্নি আমার ঝি,

রাম লক্ষণ সাথে আছে ভয়টা আমার কি’-

এই ছড়াটা মনে মনে বলবি। দেখবি ভূত তোর কিচ্ছু করতে পারবে না”। 

মিনু বাদে বাকি সবাই ঋকুর কথা শুনে সমবেতভাবে হেসে উঠলো।

গল্প দাদু চার বছরের মিনুকে কাছে ডেকে নিয়ে কোল ঘেঁসে বসিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,

কি, এখন আর ভয় পাচ্ছো নাতো? 

মিনু গল্প দাদুর গায়ে আরও একটু ঠেসে বসে, আদো আদো গলায় জবাব দিলো, “একটু, একটু”।

ঠিক আছে একটু একটু ভয় গল্প শুনতে শুনতে একটু একটু করেই কেটে যাবে।

এই কুটুস আর পুটুস মাত্র তেরো বছর আগেও এই গ্রামেই বাস করতো ওর মা বাবার সাথে। ওর একটা দাদুও ছিল, অনেকটা আমারই মতো। চুল দাড়ি সব সাদা ধবধবে। শরীরের পৈতেটাও ধবধবে সাদা। উপাধি মুখুজ্জে তো, তাই।

আরে আমার দিকে সবাই ঐভাবে ড‍্যাবড‍্যাব করে তাকিয়ে ওদের দাদুর সাথে আমারও মিল খুঁজে বের করার চেষ্টা করছো নাকি?

“আরে, ছাড়ো তো দাদু। তুমি গল্প বলো। এখানে তো আমরা সবাই জড়ো হয়েছি তোমার কাছ থেকে ভূতের গল্প শুনবো বলেই। আর প্রতি শনিবারই বিকেলে আমরা সেটা করি। তাহলে ভয় পেলে চলবে কেন? আর ভূত বলে কিছু হয়না, বুঝেছিস ঋকু আর মিনু। ওটা আমাদের মনের ভুল। তাই নাগো গল্প দাদু?” সদ‍্য বারো বছর পার করা চাপাডালি গ্রামের ‘ব্রজগোপাল স্মৃতি’ উচ্চ মাধ্যমিক বিদ‍্যালয়ে অষ্টম শ্রেণিতে পাঠরত সবুজ বললো।

সবুজ দাদুভাই যেটা বলেছে সেটা কিছুটা হলেও সত‍্যি তো বটেই। তবে তেনারা একেবারেই নেই এই কথাটা মনে হয় জোর গলায় বলার মতো পরিস্থিতি এখনো আসেনি। যাকগে, ঐসব আপাতত ভুলে গিয়ে কুটুস আর পুটসদের গল্প শোনো সবাই।

তো যেটা বলছিলাম। ওদের দাদুর একদম সাদা ধবধবে পৈতে। আসলে খুব সাত্ত্বিক মানুষ ছিলেন এই ব্রজকিশোর বাবু। ওনারই বাবা হচ্ছেন ব্রজগোপাল বাবু যার নামে গ্রামের উচ্চ মাধ্যমিক বিদ‍্যালয়টি। এদের পরিবারটি আগাগোড়াই খুব শিক্ষিত। গত তিন প্রজন্ম ধরে এই মুখুজ্জে বাড়ির বড় ছেলেরাই বিদ‍্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের পদ অলঙ্করণ করে আসছেন নিজেদের কৃতিত্ত্ব এবং যোগ‍্যতার নিরিখে। বর্তমানে ব্রজসুন্দর, মানে কুটুস আর পুটুসের বাবা এই বিদ‍্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। 

“কিন্তু তাহলে তো গল্প দাদু কুটুস আর পুটুস ভূত না হয়ে শাকচুন্নী হবে। কারণ বামুনের মেয়েরা অপঘাতে মরে গেলে শাকচুন্নী হয়ে যায়। মায়ের মুখ থেকে তাইতো শুনেছি”। বেশ বিজ্ঞের মতো বলে ওঠে বছর চোদ্দোর প্রভাত ঘোষ। আমাদের গ্রামেরই ভরত মুদির তিন মেয়ের পরে জন্মানো একমাত্র ছেলে। লেখাপড়ায় খুব ভালো। ছোট থেকে প্রতিবছর ক্লাসে ফাস্ট হয়। স্কুলের শিক্ষকদের সবারই খুব প্রিয় নবম শ্রেণির এই প্রভাত।

হ‍্যা তোমার মা যেটা বলেছেন সেটা খুবই সত‍্যি। কিন্তু সেটা বামুন বাড়ির বিবাহিত মহিলারা যদি কম বয়সে সধবা অবস্থায় কোনও দৈবী দুর্ঘটনায় মারা যান তাহলে তাদের ক্ষেত্রে ওরকমটা সাধারণত হয়ে থাকে বলেই শুনেছি। ভূত নিয়ে যারা অনেক পড়াশুনা বা গবেষণা করেন তারা এরকমটাই বলেন। কিন্তু এরা তো একেবারেই ছোট অবস্থায় একসাথে ঐ জহর দাদুদের পুকুরে সবার অজান্তে স্নান করতে গিয়েই ছয় বছর আগে ভরদুপুরে জলে ডুবে মারা গেলো। সাত বছরের দুটো ফুলের মতো ফুটফুটে জলজ‍্যান্ত মেয়ে। বেঁচে থাকলে ওরা এখন তেরো বছরের হতো। প্রথমে তো কেউ খুঁজেই পাচ্ছিলো না তন্ন তন্ন করে গ্রামের সব জায়গায় সবাই মিলে গোটা বিকেল ধরে খুঁজে দেখার পরেও। মেয়ে দুটো কি হাওয়ার উবে গেলো নাকি? সবার মুখে একটাই প্রশ্ন। খোঁজ মিলল দুদিন পর যখন ওদের শরীর দুটো ফুলে গিয়ে ধবধবে ফ‍্যাকাশে অবস্থায় ভেসে উঠলো পশ্চিমের ঐ জোড়া তালগাছ দুটোর ঠিক নীচে দিঘির ঘন কালচে নীল জলে।

“ওরাই যে ঐ তালগাছ দুটোয় মরে গিয়ে আস্তানা গেড়েছে সেটা কি করে প্রমাণিত হলো? কেউ কি দেখেছে ওদের?” জানতে চাইলো এগারো বছরের প্রতিমা, সবুজের খুড়তুতো বোন।

হ‍্যা। আসলে তারপর থেকেই সন্ধ‍্যার পরে রাত বিরেতে ঐ তালগাছ দুটোর তলা দিয়ে যারাই যাতায়াত করেছে তারাই কিছু না কিছু অলৌকিক ঘটনার সাক্ষী থেকেছে। যেমন ধরো কোথাও একফোটা হাওয়া নেই অথচ ঐ দুটো তালগাছের পতায় যেন ঝড় বইছে, এতো হাওয়া !! আবার কেউ কেউ জোড়া হাসি বা জোড়া কান্নার সমবেত আওয়াজও নাকি শুনতে পেয়েছে তলা দিয়ে যাতায়াতের সময়। তবে যা কিছু ঘটেছে সবটাই গভীর রাতে। দিনের বেলায় আজ পযর্ন্ত কোনকিছু ঘটতে দেখেনি বা শোনেনি কেউ। তোমরা আবার ভূতের হাসি শুনবে বলে ওপাশে কখনও একলা চলে যেওনা কিন্তু। ভূতেদের মতি গতি বলে কথা। এমনিতে তো খুব একটা খারাপ নয় বলেই শুনেছি। কিন্তু বলা তো যায়না, হয়তো একা পেয়ে গাছ থেকে নেমে এলো একসাথে ডাং গুলি খেলবে বলে। ওদের হাড় গুলো নাহয় ইচ্ছে মতো যখন তখন খুলে নেওয়া যায় কিন্তু তোমাদের বেলায় তো সেটা কোনভাবেই সম্ভব নয়। এবার ওরা তো আর সেটা বুঝবে না। ভাববে তোমরা ওদের সাথে খেলতে চাইছো না। অর্থাৎ ওদেরকে অবহেলা করছো। সুতরাং রাগ হওয়াটাই তো স্বাভাবিক। এবার অনেক করে আব্দার করার পরও যদি না খেলো তাহলে রেগে গিয়ে বেশি কিছু না হোক, হতেই পারে কান দুটো একটু বেশিই জোড়ে মুলে দিল। এবার তুমি যদি কাঁদতে কাঁদতে বাড়িতে ফিরে এসে বলো যে কুটুস বা পুটুস তোমার দু-কান মুলে দিয়েছে তাহলে বাড়ির বড়রা বিশ্বাস করবে ? উল্টে একা একা কেন বনে বাদারে ঘুরে বেড়াচ্ছো তার জন‍্যে আরও একবার কানমলা খেতে হবে। আর মায়েদের হাতের কানমলা আমার মনে হয় কচি ভূতেদের কানমলার থেকেও অনেক বেশি যন্ত্রণাদায়ক। কি ঋকু বাবু মায়ের কানমলা প্রতিদিন গড়ে এক দুবার করে পরে তো? 

“আমি আর কখনও তাল খুঁজতে ঐ গাছ দুটোর আশেপাশে যাবোনা গো গল্প দাদু”।

সেকি, তুমি কি এরমধ্যে একা একা ওখানে গিয়েছিলে নাকি? 

“সবাই বলো, মা’কে বলে দেবে নাতো? আসলে গত পরশু স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার সময় ঘুর পথে একটু গিয়েছিলাম গো”।

খুব বাঁচা বেঁচে গিয়েছো ঋকু দাদুভাই। এইসময় গাছে তাল থাকেনা তাই। নাহলে নির্ঘাৎ মাথায় একটা পাকা তাল পড়তোই পড়তো।

উপস্থিত সবাই আবারও একসাথে হো হো করে হেসে উঠলো।

“তোর তো খুব সাহস রে ঋকু দাদা। এখনো নিজের চুলটাই ঠিকমতো আঁচড়াতে শিখিসনি, জ‍্যাঠিকে আঁচড়ে দিতে হয়, আর তুই গেছিস তাল কুড়োতে? তাও একলা!! পুকুরে পড়ে গেলে কি হতো। সাতারও তো জানিসনা। জলে পড়ে গেলে ঐ ভূত দুটোর মতো তুইও ভূত হয়ে যেতিস। আমি জ‍্যাঠিকে ঠিক বলে দেবো, দাড়া বাড়ি যাই আজকে সন্ধ‍্যাবেলা”। আদো আদো গলায় পাকা গিন্নির মতো দুই বছরের বড় জ‍্যাঠতুতো দাদাকে রীতিমতো শাসনের সুরে বলে গল্প শুনতে আসা দলের সবথেকে ছোট সদস‍্যা মিনু।

সবাই মিলে মিনুকে বারণ করলো, সে যেন বাড়ি ফিরে গিয়ে তার জ‍্যাঠির কাছে ঋকু দাদার নামে নালিশ না করে। অবশ‍্য ঋকু দাদাকেও বোনের কাছে কথা দিতে হলো যে, সেও ভবিষ্যতে আর কখনও এই ধরনের ভুল করবেনা।

“ওঃ এই ঋকু আর মিনুর জন‍্য না আজকের গল্পটাই ঠিক জমছে না। গল্প দাদুর কথা শুনবো না এদের দুজনের কথা শুনবো। এই তোরা না আর পরের দিন থেকে আমাদের সাথে আসবি না, বুঝেছিস? তোদের এখনও ভূতের গল্প শোনার মতো বয়সই হয়নি। মাঝখান থেকে ক্রমাগত বকবক করে গল্পের আসরটাই নষ্ট করে দিচ্ছিস”। রীতিমতো রাগত স্বরে একটু কড়া করেই বলতে বাধ‍্য হলো তেরো বছরের একটু সিরিয়াস, মাধব কাকার ছেলে রাহুল। মাধব কাকা গ্রামের হাটে রেডিমেড জামাকাপড় বিক্রি করেন। হাটে নিজস্ব একটা ছোট দোকানও আছে। পাশের শহরেও বিভিন্ন বাঁধা দোকানে জামাকাপড় যোগান দেন। অবস্থা মোটামুটি সচ্ছল।

গল্প দাদু রাহুলকে সমর্থন করেই আপাতত সবাইকেই চুপ থাকতে বললেন। কারণ ওদিকে বিকেলও অনেকটাই গড়িয়ে এসেছে। সন্ধ‍্যের আগে যে করেই হোক গল্পটা শেষ করতে হবে। সুতরাং আর কথা নয়। একদম মুখে আঙ্গুল দিয়ে বসে মন দিয়ে সবাই শুধু গল্পের বাকি অংশটা শুনবে।

গল্প দাদু পুনরায় তার গল্প বলা শুরু করলেন। 

দিঘির পাশেই বিশাল চারকোনা ফুটবল মাঠের পূব ধারে মা চন্ডির থান আছে। তোমরা বড়রা নিশ্চয়ই দেখেছো।

“আমিও দেখেছি গো গল্প দাদু। ওটার চারপাশে রঘুদের খুশি ছাগলের বাচ্চা তিনটে ঘাস খাচ্ছিলো”। স্বাভাবিকভাবেই ঋকু চোখ বড় বড় করে বলে নিজেকেও বড় প্রমাণ করার চেষ্টা করলো।

রঘুই বা চুপ থাকবে কেনো? সেওও মুখ বেঁকিয়ে জবাব দিল, “কেন রে, শুধু আমাদের খুশির বাচ্চা গুলোই ওখানকার ঘাস খায়? এই গ্রামে আর কারও ছাগল নেই বুঝি”।

মিনুও ছাড়নেবালা নয়। “এই রঘু দাদা, তুই ঐভাবে কেন বলছিস রে? আমার ঋকু দাদা কখনও মিথ‍্যে কথা বলেনা তোর মতো”।

“কি, আমি মিথ‍্যে কথা বলি?” রঘু রাগে ফেটে পড়লো।

এই রে, আবার শুরু হয়ে গেল? ছোটরা, সবাই ঠোঁটে আঙ্গুল দিয়ে বসো। যে ঠোঁট থেকে একবারের জন‍্যও আঙ্গুল সরাবে সে সোজা উঠে নিজের বাড়ি চলে যাবে। এবং পরের দুই সপ্তাহ গল্প শোনার জন‍্য এখানে আসতে পারবে না। মনে থাকে যেন।

উপস্থিত ছোট থেকে বড় সবাই ঠোঁট থেকে আঙ্গুল না সরিয়ে ঘাড় নেড়ে নীরবে সম্মতি দিলো।

তো, ঐ চন্ডির থানের ঠিক পাশেই “দশঘরা ব‍্যায়াম সমিতি” ক্লাবঘর। দুটোই বহু পুরোনো। আমাদের বাপ কাকাদের নিজেদের হাতে তৈরি। আসলে শুরুর দিকে সেইসময় মনে হয় গ্রামে মোট দশ ঘরের বাস ছিল। আর ব্রিটিশ আমলে দেহ ও মন শক্ত এবং পেশিবহুল করার জন‍্য সমগ্র ভারতবর্ষ জুড়েই বিভিন্ন গ্রামে গঞ্জে প্রত‍্যন্ত এলাকায় প্রচুর শারীরিক কসরতের জন‍্য বিশেষ করে কুস্তির আখড়া ছিল। আমাদের গ্রামের নামটা তখন মনে হয় চাপাডালি ছিলনা। এই নামটা স্বাধীনতা পাওয়ার পরবর্তী কালে নেওয়া। তখন হয়তো এই গ্রামের নাম দশঘরা’ই ছিল। আর গত এগারো বছর হলো ঐ চন্ডির থানেই ক্লাবের সদস‍্যরা দুর্গাপূজা করে আসছে। আমি আবার যেহেতু ক্লাবের সভাপতি তাই সেই সুবাদে পুজো কমিটির সভাপতিও বটে। প্রচুর দায়িত্বও তার জন‍্য সামলাতে হয়। বারংবার বারণ করা সত্বেও বাকিরা কিছুতেই আমাকে এই দায়িত্ব থেকে নিষ্কৃতি দিচ্ছেনা। তবে গত পাঁচ বছর আগে পুজো চলাকালীন যা যা কান্ড ঘটলো, অবশ‍্য শুধু কান্ডই বা বলছি কেন বলা উচিত একেবারে লন্ডভন্ড কান্ড, সে আর ভাষায় প্রকাশ করার যোগ‍্য নয়। এখানে যারা বড়রা আছো তারা নিশ্চয়ই কিছুটা হলেও মনে করতে পারছো।

“হ‍্যা গল্প দাদু আবছা আবছা মনে আছে”। চটজলদি উত্তর দেয় প্রভাত।

সেইদিন আমরা বড়রাই পালানোর পথ খুঁজে পাচ্ছিলাম না তো ছোটরা। সত‍্যি ঐ দৃশ্য জীবনে ভুলবার নয়। পরিস্কার আবহাওয়ায় বলা নেই কওয়া নেই হঠাৎ করে কোথা থেকে যে ঐরকম অসময়ের কালবৈশাখী ঝড় উদয় হলো সেটা ভাবলেই অবাক হতে হয়। দিঘির চারপাশে যে কটা গাছগাছালি ছিল সবগুলোই কমবেশি ক্ষতিগ্রস্ত হলেও ঐ জোড়া তালগাছ দুটো এক ফোটা হেলেনি। নবমীর সন্ধী পুজো চলছিল। আমরা গ্রামের ছেলেমেয়ে, কচি বুড়ো প্রায় সবাই পরম ভক্তি সহকারে পুজো দেখছিলাম। ঠাকুর মশাই সবাইকে তৈরি থাকতে বলেছিলেন যে পুজো শেষ হলেই অঞ্জলি শুরু হবে। তার জন‍্য সবাই যেন মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকে। আর প্রস্তুতি !! কোথা থেকে বিনা মেঘে ভূতুড়ে ঝড় শুরু হয়ে গেল। আর সেকি একটু আধটু ঝড়। সবকিছু প্রায় উড়িয়ে নিয়ে গিয়ে ফেলে দেওয়ার যোগাড়। ভয়ে দিকবিদিক জ্ঞান শূন‍্য অবস্থায় পালাতে গিয়ে কতজন যে নিজের অজান্তেই ঐ দিঘির জলে পড়ে হাবুডুবু খেয়েছিল তার সঠিক কোনও হিসেব নেই। পল্টু পুরোহিতের তো প্রায় বস্ত্রহীন অবস্থা। সে বেচারা আশেপাশে কোনো অবলম্বন না পেয়ে অসুরের পা আকড়ে পড়েছিল। পরে তার মুখ থেকে ঐ মুহুর্তের যে বর্ণনা শুনেছিলাম সে তো রীতিমতো গায়ে কাঁটা দেওয়ার মতো। ঐ প্রবল লন্ডভন্ড করা ঝোড়ো তান্ডবের মধ‍্যে মা দুর্গা আর অসুরের মধ‍্যে নাকি রীতিমতো যুদ্ধ বেঁধে গিয়েছিল। ভয়ঙ্কর হুঙ্কার করে নাকি মা দুর্গা এবং অসুর পরস্পরের দিকে তেড়ে তেড়ে যাচ্ছিলেন আর রাগে ফুঁসছিলেন। তাহলে সিংহটা কি করছিল সেইসময়? সেই বর্ণনা তো আরও ভয়ঙ্কর। সেই জঙ্গলের রাজা মা দুর্গার বাহন পশু শ্রেষ্ঠ সিংহ নাকি আধমরা পেট ফাটা মহিষটাকে কামড়ে ছিড়ে ছিড়ে আয়েস করে খাচ্ছিল। একবার নাকি ভুল করে পল্টুর কালো রোগা পায়েও একটা কামড় বসিয়েছিল মহিষের পা ভেবে। অবশ‍্য পরক্ষণেই নাকি হাত জোড় করে ভুল হয়ে গেছে এমন ভঙ্গিতে ক্ষমা চেয়ে নিয়ে আবার মহিষটার সামনের পায়ের অর্ধেক মাংস খুবলে নিয়ে পরম তৃপ্তিতে খেতে শুরু করে দেয়। পল্টুর মিথ‍্যে কথা বলার অভ‍্যাস আছে জানতাম। কিন্তু তাই বলে মা দুর্গা বা অসুর এবং সিংহকে নিয়ে এইরকম একটা আজগুবি গল্প বানাবে সেটা মেনে নিতে মন চাইছিল না। শত হলেও ওরা গত চার পুরুষ ধরে এই পুরোহিতগিরি করেই সংসার চালায়। সংস্কৃত মন্ত্র উচ্চারণ গুলোও মোটামুটি পরিস্কার এবং সঠিক। তারমানে পেটে বিদ‍্যা এবং তার চর্চা দুটোই আছে। তাই গ্রামের সবাই যেখানে একসাথে উপস্থিত সেখানে সকলের সামনে গড়গড় করে মুখস্ত বলার মতো এই ধরণের একটা অলৌকিক বর্ণনা দেবার সৎ সাহস দেখাবে, সেটাও মেনে নিতে একটু অসুবিধা হচ্ছিলো বৈকি। আর পুজো মন্ডপের ভেতরকার যা লন্ডভন্ড ছত্রখ‍্যান পরিস্থিতি ছিল তাতে করে অবিশ্বাস্য হলেও বিশ্বাস না করে উপায়ও ছিলনা। মা দুর্গার হাতের সমস্ত অস্ত্রগুলোই অসুরের শরীরের চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছিল। অসুরের একটা চোখ কে যেন উপরে নিয়েছে। অসুরের কাঁধের কাছেও বেশ খানিকটা খুবলে তুলে নেওয়া হয়েছে । আর মহিষটার দৈহিক বর্ণনা যত কম দেওয়া যায় ততই ভালো। তার শরীরের অর্ধেক অংশই আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। পল্টুকে যখন সবাই মিলে উদ্ধার করা হয় তখন সে ছিল অজ্ঞান অবস্থায়। অনেক কষ্টে যখন তার জ্ঞান ফেরানো হলো তখন তো সে প্রথমে কাউকে চিনতেই পারছিল না। বড়দেরকে ‘তুই’ বলে সম্মোধন করছিল আর অকারণে “আমাকে মেরো ফেলনা মা, আমি কোনও অন‍্যায় করিনি দিব‍্যি দিয়ে বলছি”- এইসব অসংলগ্ন কথা নিজের মনেই বলে যাচ্ছিল। বেচারা !! বিশাল একটা মানসিক দুর্যোগ যে ওর উপর দিয়ে বয়ে গেছে গত প্রায় ঘন্টা খানেক ধরে সেটা ওর চোখেমুখেই স্পষ্ট। এই ঘটনা, সে অবিশ্বাস্য বা বিশ্বাস্য যাই হোক না কেন, ওর যে ভুলতে বেশ খানিকটা সময় লেগেছিল তা বলাই বাহুল‍্য।

গল্প দাদুর অদ্ভুতুড়ে গল্প শুনে উপস্থিত কারোর মুখেই আর টু শব্দটি নেই। চোখগুলো সব ছানাবড়ার মতো গোল গোল আর পলকহীন। মিনুকে এই মুহূর্তে গল্প দাদুর কোলে বসে থাকতে দেখা যাচ্ছে।

ঐদিকে গল্প দাদু বলেই চলেছেন। সেদিন কপাল ভালো যে গ্রামের কেউ প্রাণে মরেনি। তবে একটা অজানা ভয় যে সবাইকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছিল সেটা প্রত‍্যেকের আচার আচরণেই স্পষ্ট। এর দু-চার দিনের মধ‍্যেই সবকিছু মোটামুটি সামলে ওঠার পর এর কার্যকারণ নিয়ে আমরা কয়েকজন গ্রামের বিচক্ষণ বয়স্ক মানুষেরা ক্লাবঘরে সন্ধ‍্যার আগ দিয়ে ঠিক এই সময়েই একত্রিত হলাম। কারণটা যে কি, বা কারা এর সাথে সরাসরি জড়িত সেটা বুঝতে কাররই আর বাকি ছিলনা। কারণ সেইদিনের ঐ আসুরিক ঝড় শুধুমাত্র ঐ জহরদের দিঘির আশেপাশের অঞ্চলেই ঘটেছিল। পরবর্তীতে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে যে ঐরকম একটা অকাল ঝড়ের তান্ডব আর কোথাও ঘটেনি। তার মানে কারণটা লুকিয়ে আছে ঐ অক্ষত দুটো তালগাছের মধ‍্যেই। আর সেখান থেকেই স্বাভাবিকভাবেই উঠে আসে লাল কুটুস আর নীল পুটুসের আলোচনা। সভায় সেইসময় ব্রজসুন্দরও উপস্থিত ছিল। তারই অকালে মরে যাওয়া যমজ দুই ফুলের মতো নিষ্পাপ মেয়ে এই গোটা ঘটনাটার জন‍্য মূলত দায়ী এটা ব্রজসুন্দরের কাছে কতটা দুঃখজনক সেটা তার দুছোখের দিকে তাকালেই স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল। সে একজন শিক্ষিত মানুষ। ফলে তার কাছে ভূত প্রেতের অস্তিত্বও যে কতটা মান‍্যতা পায় সেটা নিশ্চয়ই আলাদা করে বলার প্রয়োজন পরেনা। কিন্তু পুরো ঘটনাটার কার্যকারণ ব‍্যাখ‍্যা করলে দ্বিতীয় আর কোনও প্রাকৃতিক দুর্যোগকেও তো প্রাধান্য দেওয়া যাচ্ছনা। প্রথমত ঐ জোড়া তালগাছ দুটোর অক্ষত অবস্থায় থেকে যাওয়া এবং প্রচুর ভীত সন্ত্রস্ত মানুষের দিঘির জলেই সম্পূর্ণ অজান্তেই পড়ে যাওয়া। কোনওধরনের প্রাণ হানি ঘটেনি এটাই রক্ষে। এবার যাতে করে ভবিষ্যতে এইধরনের ভয়াবহ ঘটনার আর পুনরাবৃত্তি নাহয় তার জন‍্য কি করণীয় সেটাই ছিল ঐ বিশেষ সভার মূল আলোচ‍্য বিষয়। এখন ভূতেদের সাথে কথা বলে তাদের কাছ থেকে কারণ জিজ্ঞাসা করে তাদের দুজনকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে শান্ত করা, সে তো আমাদের মতো সাধারণ মানুষের কম্ম নয়। আবার প্রশাসনকে জানালে তারা গাছ দুটো কেটে দিয়ে আপদ বিদায় করে দেওয়ার পরামর্শই দেবেন এবং সেটাতে সন্তান হীন ব্রজসুন্দরের আপত্তি আছে। আর যাই হোক মেয়ে দুটো যে রূপেই হোক আছে তো এই গ্রামেই। অগত‍্যা চার ক্রোশ দূরের বেলডিহি গ্রামের রামস্মরণ ওঝার ডাক পড়লো। ভূত তাড়ানোর ক্ষেত্রে তার যথেষ্ট নাম ডাক আছে এলাকায়। কিন্তু এখানে শর্ত কিছুটা আলাদা। আর সেটা হলো, ভূত তাড়ানো নয়, উল্টে ঐ দুই ভূতকে শান্ত করে গ্রামের আর কোনও অমঙ্গল যাতে ভবিষ্যতে আর না হয় তার জন‍্য বুঝিয়ে রাজি করানো।

রামস্মরণ এসে ওর যা কিছু করণীয় করে দিয়ে চলে গেল। কিন্তু যাবার আগে যা বলে গেলো, তাতে করে কুটুস এবং পুটুস সেদিন নিজেদের বাড়ির সামনেই উঠোনে খেলছিল। হঠাৎ করেই একজন বয়স্ক করে কেউ এসে ওদেরকে কোলে করে নিয়ে যায় দিঘির ধারে গল্প শোনাবে বলে। এবং একটা ঝোড়ো হাওয়া হঠাৎ করেই ওদেরকে জলে ঠেলে ফেলে দেয়। ওরা আর উঠে আসতে পারেনি। 

তাহলে কি আরও একজন কেউ আছে এই গ্রামে ??

আজকে সন্ধ‍্যায় মিনুকে কোলে করে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে যান স্বয়ং গল্প দাদু।

ভূতুড়ে ঝড় ভৌতিক গল্প – সমাপ্ত

আপনাদের লেখা আমাদের ওয়েব সাইটে জমা দিতে গেলে, অনুগ্রহ করে আমাদের লেখা-জমা-দিন মেনু-তে ক্লিক করুন ও নিজেকে Author হিসেবে Register করুন এবং আমাদের পরবর্তী আপডেট পেতে আমাদের ফেসবুক পেজ অনুসরণ করুন।

error: Content is protected !!