বেজি এখন অনেক তেজি সায়েন্স ফিকশন গল্প – রানা জামা
প্রফেসর মাসুদ হাওয়ায় উড়ছেন! কিভাবে উড়ছেন? পাখা গজিয়েছি কি পিঠে? প্রফেসর ঘাড় বাঁকিয়ে পেছনে তাকিয়ে কোনো পাখা দেখতে পেলেন না। তাহলে কিভাবে উড়ছেন তিনি? আসলে তিনি উড়ছেন না, পড়ছেন! বিমানের ইঞ্জিনে আগুন লাগায় প্রফেসর মাসুদ ভয় পেয়ে লাফ দিয়েছেন বিমান থেকে। লাফ দেবার সময় প্যারাসুট নিতে ভুলে গেছেন! প্রফেসর নিচে পড়ছেন। নিচে তাকিয়ে জঙ্গল দেখতে পেয়ে আঁতকে উঠলেন। গাছে পড়ে হাড়-গোড় ভাংবে এবার! পড়ছেন প্রফেসর, পড়ছেন! পড়ে গেলেন একটা গাছের উপর।
ঘুম ভেঙে গেলো প্রফেসর মাসুদ আলমের। পড়ে আছেন মাটিতে।
প্রফেসর মাসুদ প্রাতঃভ্রমণে এসেছিলেন পৌরপার্কে। হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্তি লাগায় আরসিসি বেঞ্চে শুয়েছিলেন বিশ্রাম নেবার জন্য। কখন আঁখি মুদে এসেছিলো বলতে পারবেন না। এতক্ষণ স্বপ্ন দেখছিলেন!
এরপরের দৃশ্য ভয়াবহ আতঙ্কের। যে বেঞ্চে উনি শুয়েছিলেন, সেটার উপর এখন একটা সাপ ওঁর দিকে ফণা তুলে লেজে ভর করে দাঁড়িয়ে আছে। অনবরত দ্বিখডিত জিভ বের করছে মুখের ভেতর থেকে। নড়াচড়া করলেই ছোবল মারতে পারে! শক্ত হয়ে শুয়ে থেকে অপলকনেত্রে তাকিয়ে আছেন সাপের দিকে। তখন ঘটলো আরেক কাণ্ড!
একটা বেজি লাফ দিয়ে পড়লো সাপের ঘাড়ে। ভয় পেয়ে প্রফেসর মাসুদ পিছেয়ে গেলেন কয়েক হাত। ওদিকে শুরু হলো সাপে নেউলে যুদ্ধ! ইতোপূর্বে সিনেমায় সাপ ও বেজির মারামরি দেখলেও বাস্তবে এটাই প্রথম। ভিডিও করতে পারলে কাজের মতো কাজ হতো একটা। কিন্তু পকেট হাতড়ে বুঝতে পারলেন আজ মোবাইল ফোনটা আনেন নি। তিনি উপভোগ করছেন সাপ-বেজির যুদ্ধ। বেজিটার সাহস দেখে প্রফেসর মাসুদ মুগ্ধ। সাপটা বার বার ছোবল মারছে বেজির গায়ে এবং লেজ দিয়ে বেজিকে পেঁচিয়ে চাপ দিচ্ছে।
বেজিটাও নাছোরবান্দা! লড়ে যাচ্ছে সাপের সাথে। বেজিটা চেষ্টা করছে সাপের ঘাড় কামড়ে ধরার জন্য। মাঝে মাঝে কামড়ে ধরছে; কিন্তু টিকে থাকতে পারছে না। এভাবেই চলছে যুদ্ধ। রক্ত বাড়ছে সাপ ও বেজির গায়ে। এ রক্ত কার, সাপ না বেজির; বুঝতে পারছেন না প্রফেসর মাসুদ আলম। রক্তাক্ত হয়ে গেলো দুটো প্রাণী-ই। ক্লান্ত হতে থাকায় উভয় প্রাণীর মারামারির গতি শ্লথ হয়ে আসছে। এক সময় থেমে গেলো লড়াই। দুটো প্রাণী পাশাপাশি পড়ে আছে নিথর হয়ে।
প্রফেসর মাসুদ আঁতকে উঠে মনে মনে বললেন: বেজিটা মারা গেলো নাকি! এ হতে পারে না! ওকে বাঁচানোর জন্যই বেজিটা সাপের সাথে যুদ্ধ করেছে। বেজিটাকে বাঁচাতে হবে। তার আগে সাপটার মৃত্যু নিশ্চিত করতে হবে। মাটি থেকে দ্রুত উঠলেন প্রফেসর। এদিক ওদিক তাকিয়ে একটা ইট দেখতে পেয়ে তুলে নিলেন দুই হাতে মাথার উপরে। সাপের মাথা লক্ষ্য করে ছুড়ে দিলেন। সাপের মাথায় লেগে থেতলে গেলো মাথা। আহত বেজিকে উঠিয়ে চলে এলেন ল্যাবে। সাপের বারংবার ছোবলে বেজির শরীর বিষে ভরে গেছে। আপন বৈজ্ঞানিক মেধা প্রয়োগ করে অত্যন্ত যত্নের সাথে বিষ বের করলেন বেজির শরীর থেকে। এবং সেসাথে বেজির শরীরে এণ্টিভেনোম জিন সংযোজন করে দিলেন। এতে সাপের দংশনে এই বেজির কিছুই হবে না।
প্রফেসর মাসুদ বেজিটার নাম দিলেন স্নেক হাণ্টার। স্নেক হাণ্টার সুস্থ হয়ে বাইরে যাবার জন্য বের হতে চাইলে প্রফেসর মাসুদ জিজ্ঞেস করলেন, কোথায় যাস রে, স্নেক হাণ্টার?
স্নেক হাণ্টার বললো, দেশটা ভরে যাচ্ছে সাপে। সাপ শিকার করে আসি।
প্রফেসর মাসুদ বেজিটাকে বাম হাতের তালুতে বসিয়ে বললেন,সাহস কী ফিরে এসেছে আমার স্নেক হাণ্টারের?
স্নেক হাণ্টার বললো, সাপের বিরুদ্ধে লড়াই-এর জন্য আমাদের সাহস সবসময় ছিলো। সেদিন ঐ সাপটা বেশি বেয়াড়া ছিলো! তাই আমি কাহিল হয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু তোমাকে ছোবল দিতে দেই নি।
জানি। আর সেকারণেই তোকে আমি আমার ল্যাবে এনে সুস্থ করে তোর শরীরে কিছুটা জেনেটিক্যাল চেঞ্জ করে এণ্টিভেনোম জিন লাগিয়ে দিয়েছি। এখন হাজার সাপ ছোবল দিলেও তোর কিছু হবে না।
সেজন্য তোমার প্রতি আমি কৃতজ্ঞ প্রফেসর। আমি মানুষের মতো কথা বলতে ও বুঝতে সক্ষম হলাম কিভাবে প্রফেসর?
অপারেশনের সময় তোর ভোকাল সিস্টেম আমি একটু চেঞ্জ করেছি। সেকারণে তুই শুধু আমার কথা বুঝতে পারবি এবং আমার সাথে কথাও বলতে পারছিস। তুই কি এখন সাপ শিকার করতে যেতে চাস?
জ্বি প্রফেসর। হাত দুটো বেশ নিশপিশ করছে! বহুদিন ধরে কোনো সাপ শিকার করছি না, তাই!
আজ শিকারে গিয়ে কাজ নেই। আজ আমরা নদীর ধারে বেড়াতে যাবো। আগামীকাল শিকারে যাস। কেমন?
এস ইউর উইস প্রফেসর!
প্রফেসর হাঁটছেন আস্তে ধীরে। হাতে লাঠি। প্রফেসরের বাসা থেকে নরসুন্দা নদীতীর কাছেই। কাঁধে স্নেক হাণ্টার। এলাকায় সবাই প্রফেসর মাসুদকে পাগল ধরনের বৈজ্ঞানিক বলেই জানেন। পশু-পাখি নিয়েই মেতে থাকেন। আজ কাঁধে বেজি দেখে সবাই ওর দিকে মৃদু হাসছেন।
একজন জিজ্ঞেস করলেন, নেউলকে কী করলেন এবার প্রফেসর? ওকে বাইক চালানোতে লাগিয়ে দিন প্রফেসর!
প্রফেসর হাসিমুখে বললেন, ডোণ্ট ওরি ম্যান! আমি অকাজের কিছু করি না!
নদীতীরে চলে এলেন প্রফেসর মাসুদ। অনেক ভ্রমণপিপাসু এসেছেন। এদের নব্বই ভাগই প্রেমিক-প্রেমিকা। যে ক’জন প্রফেসরের বয়সী ওঁরা খুব সংকোচিত হয়ে হাঁটছেন অথবা বসে আছেন। প্রফেসর মাসুদ স্নেক হাণ্টারের সাথে মৃদুস্বরে কথা বলতে বলতে আস্তে আস্তে হাঁটছেন। হঠাৎ স্নেক হাণ্টার নদীতে ঝাঁপ দিলো। সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে আছেন নদীর দিকে এবং মনে প্রশ্ন: বেজিটা পানিতে ঝাঁপ দিলো কেনো?
পানিতে আড়োলন হচ্ছে বেশ। সবাই তাকিয়ে আছে ওদিকে। কিছুক্ষণ পরে পানি থেকে অদ্ভূত কিছু একটা লাফ দিয়ে উঠে পাড়ে এসে আছড়ে পড়লো। সবাই ওদিকে ছুটতে গিয়ে ভয় পেয়ে আরো পিছিয়ে গেলো। একটা সাপ কিছু একটাকে প্যাঁচিয়ে ধরে আছে।
প্রফেসর মাসুদ এগিয়ে গেলেন ওদিকে। উনি বুঝতে পারলেন স্নেক হাণ্টারের কাণ্ড এটা। একটু ঝুকে বললেন, সাহায্য লাগবে স্নেক হাণ্টার?
স্নেক হাণ্টার এক ঝাঁকি দিয়ে সাপটাকে গা থেকে সরিয়ে ঘাড়ে কামড় দিয়ে ছেড়ে দিলো। সাপটা কয়েকবার মোচড় দিয়ে স্থির হয়ে গেলে প্রফেসর মুচকি হাসলেন। হাত বাড়ালে বেজিটা ওর বাম হাতের তালুতে লাফ দিয়ে উঠলো।
প্রফেসর মাসুদ জিজ্ঞেস করলেন স্নেক হাণ্টারকে, তুই হঠাৎ পানিতে গিয়ে সাপটাকে ধরে এনে মেরে ফেললি কেনো?
স্নেক হাণ্টার বললো, আমি না মারলে সাপটা একজন মানুষকে ছোবল দিতো।
চল্। তুই সিন ক্রিয়েট করে ফেলেছিস এখানে। এখানে আর থাকা যাবে না। আমরা অন্যদিকে যাই।
প্রফেসর মাসুদ চলে গেলেন অন্যদিকে। বিকেলটা হেঁটে কাটিয়ে ফিরে এলেন বাসায়।
রাতের রান্নাটা বরাবরের মতো স্নেক হাণ্টার করলো। কর্ণ স্যুপ এবং প্রফেসরের জন্য আলুর দম। রান্নাঘরের পাশেই ছোট্ট ডাইনিং স্পেস। দু’জন খেতে বসেছে। কাঁটাচামকে এক টুকরো আলু মুখে দিয়ে চিবুতে গিয়ে স্নেক হাণ্টারের দিকে তাকিয়ে চিবুনো বন্ধ করে দিলেন। স্নেক হাণ্টার স্যুপ না খেয়ে স্ট্র দিয়ে বাটিতে নড়াচড়া করছে।
প্রফেসর মাসুদ জিজ্ঞেস করলেন, বিষয় কী স্নেক হাণ্টার? খাচ্ছিস না কেনো? রুচি হচ্ছে না?
স্নেক হাণ্টার ভেউ ভেউ করে কেঁদে দিলো। প্রফেসর মাসুদ হতবাক বেজিটাকে কাঁদতে দেখে। প্রফেসর মাসুদ চেয়ার ছেড়ে বেজিটাকে হাতে নিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কী হয়েছে তোর? এভাবে কাঁদছিস কেনো? কোনো কারণে মন খারাপ?
বেজিটা বললো, পরিবারের জন্য মন কেমন যেনো করছে!
অবাক হবার সাথে হাসিও আসতে চাচ্ছিলো প্রফেসর মাসুদের। হাসি দমিয়ে রেখে প্রফেসর মাসুদ বললেন, তোর পরিবার মাসে স্ত্রী আছে? আগে বলিস নি তো? খুব সুন্দুরি বুঝি?
বেজিটা কান্না থামিয়ে রেগে বললো, স্ত্রী না!
তাহলে?
আমার মা আছে, বাবা আছে। ওদের কথা মনে পড়ছে।
কোথায় থাকে ওরা? আমি তোকে ওদের কাছে নিয়ে যাবো।
পৌরপার্কে।
তাহলে আর সমস্যা কী! আগামীকাল সকালে আমরা তোর মা-বাবার কাছে যাচ্ছি। এখন রাতের খাবার খেয়ে নে।
দু’জনে রাতের খাবার খেয়ে নিলো। ইদানিং ঘুম কম হওয়ায় প্রফেসর মাসুদ ঘুমের ঔষধ খেয়ে শোন। আজও তাই করলেন। পরদিন ভোরে ঘুম থেকে জেগে বিছানায় থেকেই হাক দিলেন, স্নেক হাণ্টার! চল এবার পৌরপার্কে যাবো।
স্নেক হাণ্টারের সাড়া না পেয়ে ফের হাক দিলেন প্রফেসর মাসুদ, স্নেক হাণ্টার! কোথায় তুই? নাকি এখনো ঘুমাচ্ছিস?
এবারও সাড়া না পাওয়ার বিছানা থেকে বেজিটার কক্ষে গেলেন। কক্ষে বেজি নেই। বিছানা দেখে মনে হচ্ছে রাতে ও শোয় নি বিছানায়। খুঁজতে থাকলেন বাসার প্রতিটি কক্ষে, প্রতিটি কোণায়। স্নেক হাণ্টারকে বাসায় না দেখে অবাক হলেন বেশ। ওঁকে না বলে বাইরে যাবার কথা না। সারাদিন বেজিটা ফিরে না আসায় বেশ উৎকণ্ঠার মধ্যে কাটালেন প্রফেসর মাসুদ। রাতেও ফিরে এলো না স্নেক হাণ্টার। আর বসে থাকা যায় না। তাই পরদিন স্থানীয় পত্রিকায় একটি হারানো বিজ্ঞপ্তি পাঠালেন। বিজ্ঞপ্তিটা ছিলো এরকম:
স্নেক হাণ্টার নামের একটা বেজি হারিয়ে গেছে। কোনো সহৃদয় ব্যক্তি পেয়ে থাকলে বাসায় পৌঁছে দিলে পুরস্কৃত করা হবে।
পত্রিকার সম্পাদকীয় দপ্তর সম্পাদনা করে বিজ্ঞপ্তিটা এভাবে প্রকাশ করলেন এই ভেবে যে বেজি সাপ মেরেই থাকে, এটা বিজ্ঞপ্তিতে লেখার কী দরকার!-
একটা বেজি হারিয়ে গেছে। কোনো সহৃদয় ব্যক্তি পেয়ে থাকলে বাসায় পৌঁছে দিলে পুরস্কৃত করা হবে।
পুরস্কার পাবার আশায় পরদিন ভোর হতে শ-এ শ-এ লোক একটি করে বেজি হাতে নিয়ে প্রফেসর মাসুদ আলমের বাসার সামনে সারি করে জমায়েত হতে থাকলো।
বেজি এখন অনেক তেজি সায়েন্স ফিকশন গল্প – সমাপ্ত
আপনাদের লেখা আমাদের ওয়েব সাইটে জমা দিতে গেলে, অনুগ্রহ করে আমাদের লেখা-জমা-দিন মেনু-তে ক্লিক করুন ও নিজেকে Author হিসেবে Register করুন এবং আমাদের পরবর্তী আপডেট পেতে আমাদের ফেসবুক পেজ অনুসরণ করুন।
অন্যান্য
স্বপ্নভঙ্গ
মহাকাশে একদিন
বাবুয়ার বন্ধু