নতুন পৃথিবী সায়েন্স ফিকশন গল্প – মৃণাল বন্দ্যোপাধ্যায়
অপ্রকাশ মঙ্গলের আজ মেয়ের বিয়ে। তাই সকাল থেকেই লাল গ্রহে তার বিপুল আয়োজন চলছে। কোনকিছুর যেন ঘাটতি না থাকে, অপ্রকাশের প্রকাশ্যে করা কড়া নির্দেশ, “তৃষ্ণা-র বিয়েতে কোনরকম যেন ত্রুটি না থাকে। ব্যবস্থাপনা হবে শতকরা একশত ভাগ নজরকাড়া। বিয়ের জাকজমক যেন মঙ্গলের সবাই আগামী শতাব্দীতেও মনে রাখে। ইতিহাস গড়তে হবে, ইতিহাস”। তবে বিয়ে বলতে সাধারণত আমরা বতর্মান পৃথিবীর মনুষ্য প্রজাতি যেরকমটা বুঝে থাকি, এই বিয়ে কিন্তু একদমই সেই ধরণের কোনো বিয়ে আদপেই নয়। এটা আসলে একটা পারস্পরিক বোঝাপড়া বা বিশেষভাবে দুটি বিপরীত মস্তিষ্কগত মন মানসিকতা সম্পন্ন দুটো রোবটের মধ্যে একটা চিরস্থায়ী বন্ধন স্থাপনের প্রচেষ্টা। এবং এই দুটি বিপরীত ধর্মী রোবট পরবর্তীতে নিজেদের গঠনগত এবং চিন্তা শক্তির উন্নতিগত পারদর্শিতাকে কাজে লাগিয়ে আগামীর প্রজন্মকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। এখানে শর্ত বা উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য একটাই, আর সেটি হলো নিজেদের তুলনায় আরও উন্নত মস্তিষ্ক বা চিন্তা শক্তি সম্পন্ন পরবর্তী রোবট প্রজন্ম তৈরি করা। কিন্তু সেটা একটা সামাজিক বন্ধনকে স্বীকৃতি দিয়ে। অর্থাৎ এলোমেলো বা বিশৃঙ্খল ভাবে নয়। একটা পারিবারিক প্রথার মধ্যে আবদ্ধ থেকে প্রযুক্তি বা উন্নতিকে তরাণ্বিত করা। কারণ, এদের শরীর যতই যান্ত্রিক হোক মস্তিষ্কটা তো মানুষের মতই রক্ত মাংসের। কিন্তু তথাকথিত ‘হৃদয়’ বলতে আমরা যেটা বতর্মানে বুঝি অর্থাৎ একটা মিনিটে বাহাত্তর বার স্পন্দিত হওয়া চার প্রকোষ্ঠের মনুষ্য হৃদয়, সেটা নয় বরং একটা অলিখিত পারস্পরিক বন্ধুত্বপূর্ণ একে অপরের প্রতি টান বা অনুভব, যেটা দুজন ভালো বন্ধুর মধ্যেই একমাত্র দেখা যায়। যেটার মধ্যে কোনও ব্যক্তিগত স্বার্থ প্রাধান্য পাবেনা, প্রাধান্য পাবে একে অপরের বিপদে ঝাপিয়ে পড়ার তীব্র প্রচেষ্টা। অর্থাৎ স্বামী-স্ত্রী’র মতো একে অপরকে ভালোবাসা, আবার প্রয়োজনে একে অপরের ত্রুটিবিচ্যুতি খুঁজে বার করে তার সমালোচনা করা এবং তার ফল স্বরূপ প্রয়োজনে তাকে চিরকালের জন্য ত্যাগ করে আরেকজনের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করা- সেইরকমটা নয়। বরং উল্টে এমন বন্ধুত্ব যেটা চট করে নষ্ট হয়ে যাওয়ার নয়।কারণ উদ্দেশ্য একটাই, আর সেটা হলো নিজেদের থেকেও ক্রম উন্নততর বিচার বুদ্ধি সম্পন্ন প্রজন্মের জন্মলাভের মধ্য দিয়ে আগামীর কোনো এক উজ্জ্বল প্রভাতে ঈশ্বর তুল্য প্রজাতির জন্ম দেওয়া। কোনও অঙ্গ প্রত্যঙ্গের প্রয়োজন নেই। শুধুই একটা অকল্পনীয় স্থিতধী মনন সমৃদ্ধ মস্তিষ্ক। যে বা যারা শুধুমাত্র চিন্তা শক্তির মাধ্যমে এক জায়গায় স্থির অবস্থায় অবস্থান করে এই সমগ্র বিশ্বের সমস্ত ক্রিয়াকলাপকে সুচারু ভাবে পরিচালনা করবে। অর্থাৎ মানুষের সেই উচ্চাকাঙ্ক্ষা যা তাকে ঈশ্বর তুল্য হতে প্রতি মুহূর্তে অনুপ্রাণিত করে, উদ্বুদ্ধ করে। প্রয়োজনে নিজের গঠনগত এবং জিনগত পরিবর্তন ঘটিয়ে বুদ্ধি বিন্দুতে পরিণত হতে হবে। যা হবে চির অমর। যার মধ্যে না থাকবে কোনও শারীরিক প্রবৃত্তি, কামনা, বাসনা বা কোনওধরনের জাগতিক আকাঙ্ক্ষা। থাকবে শুধুই নিজেকেই আরও শ্রেষ্ঠ করার বৌদ্ধিক ক্ষিধে। এক বুদ্ধি বিন্দু থেকে দূরবর্তী আরেক বুদ্ধি বিন্দুতে তরঙ্গাকারে ছড়িয়ে পড়বে নতুন নতুন উন্নততর ভাবনার বহিঃপ্রকাশ। আর সেই সমবেত দীপ্যমান প্রকাশের ছটা থেকে গড়ে উঠবে অপরূপ স্বর্গীয় কল্প ভূমি। এক সর্ব সুখ সমৃদ্ধ নতুন বিশ্ব, যেখানে সবাই ঈশ্বর। সম্ভাব্য সমস্ত ধরনের চাওয়া পাওয়ার ঊর্ধ্বে সর্ব গুণান্বিত সত্ত্বা।
মঙ্গলের উত্তর গোলার্ধে স্তিমিত সূর্য তখনও আকাশগঙ্গায় আবির্ভূত হয়নি। স্পিডোক্রফ্ট মহাকাশ যানে চেপে কন্যাপক্ষের তরফে মোট পাঁচজন টার্মিনাল এক্স-এর তত্ত্বাবধানে রাত তেত্রিশটা সাতান্ন মিনিটে মঙ্গলের এক্সোস্ফেয়ার ছেড়ে বৃহস্পতির মাধ্যাকর্ষনের বিস্তারে প্রবেশ করে গেছে। তাদের গন্তব্য পিট্রুনেফ এইট। অ্যান্ড্রোমেডা গ্যালাক্সির দক্ষিণ দিকের তিন নম্বর স্পাইরাল আর্মে অবস্থিত প্রায় সূর্যেরই সম ভরের নক্ষত্র পিট্রুনেফ-এর আট নম্বর গ্রহ। বিগত তেরো লক্ষ বছর ধরে মিল্কিওয়ে এবং অ্যান্ড্রোমেডা গ্যালাক্সির মধ্যে ক্রম সংযুক্তি শুরু হয়। প্রথম দিকে যে ভয়টা সবাই পেয়েছিল সেটা হচ্ছে, হয়তো বা একটা ভয়ঙ্কর মহাজাগতিক বিসৃঙ্খলা ঘটতে চলেছে মহাকাশের এই অঞ্চলে। কিন্তু না। মহাকাশ এতটাই বিশাল এবং এখানে বস্তুর আধিক্য শূন্যতার সাপেক্ষে এতটাই কম যে আরও তিন চারটে গ্যালাক্সির একত্রিকরণ ঘটলেও পারস্পরিক সহাবস্থান বা স্থান সঙ্কুলানের ক্ষেত্রে কোনরকম অসুবিধাই হতো না। ব্যাপারটা অনেকটা এইরকম যে আগে আশেপাশে প্রচুর ফাঁকা জমি ছিল এখন সেখানে বেশ কিছু নতুন নতুন বাড়ি-ঘর তৈরি হয়েছে। আর যারা এলাকায় ধরো জমি কিনে নতুন বাড়ি বানালো তারা অন্য রাজ্যের বাসিন্দা। অর্থাৎ একটা নির্দিষ্ট এলাকায় আগের থেকে বসতি বা লোকসংখ্যা বৃদ্ধি পেলো। বুঝে নেওয়ার জন্য ভেরি সিম্পল ।
স্পিডোক্রফ্ট মহাকাশ যানটি বৃহস্পতির বিপুল মাধ্যাকর্ষণ শক্তিকে কাজে লাগিয়ে রিপাল্সিভ এক্সিলেটর সিস্টেম নামক নয়া অত্যাধুনিক বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তির সাহায্য নিয়ে মহাকাশযানের গতিবেগকে আলোর গতিবেগের প্রায় তিন গুন করে নিতে সক্ষম হবে এবং মঙ্গলের সাপেক্ষে ঠিক ছয় ঘন্টা চুয়াল্লিশ মিনিট তেরো নেনো সেকেন্ড বাদে পিট্রুনেফ এইটের নিরক্ষিয় রেখার তেত্রিশ ডিগ্রি পশ্চিমে স্ফটিক রিফ্লেক্স’দের ডোমের অডিটোরিয়ামে পৌঁছে যাবে। তারপরে পাত্র কে নিয়ে উল্টো অভিমুখে পুনরায় একইভাবে যাত্রাপথের পুনরাবৃত্তি। মনুষ্য সভ্যতায়, বিশেষ করে সুদুর অতীতে একদা পালনীয় বাঙালি রীতির মতনই এখানেও আজ এতো লক্ষ বছর বাদেও বিয়ের ক্ষেত্রে পাত্রপক্ষকেই প্রথমে কন্যার পিতার গৃহে এসে পাত্রীর সাথে শিষ্টাচার মেনে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে হয়। হতেই পারে, যে বায়ো রোবটের অতীত বংশধর প্রায় বারো লক্ষ বছর আগে এখানে বসতি স্থাপন করেছিল তার মাথাটা কোনো বাঙালির।
স্ফটিক খুব স্বচ্ছ মনের ভালো পুরুষ বায়ো রোবট। বয়সও বেশি নয়। মাত্র তিন মাস বাহান্ন দিন। শুনে অবাক হচ্ছেন, তাইনা? হওয়াটাই স্বাভাবিক। কারণ আপনার কাছে সময়ের হিসাবটা গুলিয়ে যাচ্ছে। আপনি পৃথিবীর ক্যালেন্ডার অনুযায়ী হিসেব কষছেন। আরে, এটা আপনার পৃথিবী নয়, এটা মঙ্গল। আর এখানে পৃথিবীর সাপেক্ষে প্রায় ছয়শো সাতাশি দিনে বছর। ফলে এক মাস মানে পৃথিবীর হিসেবে প্রায় সাতান্ন দিন। এবার নিশ্চই বুঝতে আর অসুবিধা হচ্ছেনা?
কি হলো, আবার কি এতো শাত-পাঁচ ভাবছেন? বুঝেছি, তৃষ্ণার বয়স নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েছেন তো? হ্যা, ঠিক তাই। জানিতো, আরে আপনিতো মানুষ। ভাবনাটাই তো আপনার বেঁচে থাকার একমাত্র রসদ। ভাবতে পারছেন বলেই তো বেঁচে আছেন। যেই মাত্র মরে যাবেন, অমনি ভাবনারও ইতি। তাহলে মন দিয়ে শুনুন। মেয়ের বয়স তিন মাস পনেরো দিন। কি ভাবছেন, বাল্য বিবাহ? দূর, এরা কি আপনার মতো মানুষ নাকি? এরা সব যন্ত্রমানব। মানে ইংরেজিতে রোবট। তবে পৃথিবীর রোবট বৈজ্ঞানিকরা যেসব রোবট আজ পযর্ন্ত বানাতে সক্ষম হয়েছেন, এই রোবট সেই রোবট নয় যে আমাদের বলে দেওয়া বা পোগ্রামিং করা নির্দেশ মেনেই শুধু কাজ করবে। এরা অত্যাধুনিক প্রযুক্তির বায়ো রোবট। অর্থাৎ শরীরটা যন্ত্রাংশ দিয়ে তৈরি কিন্তু মাথাটা মানুষের মতোই রক্ত মাংসের। অর্থাৎ সবকিছুই আমাদের থেকেও আরও আরও উন্নত। এরা যেকোনো সমস্যার সমাধান কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে করে দিতে সক্ষম। এদের কোনো শারীরিক সমস্যা, মানে রোগ-ভোগ, জ্বর-জ্বালা, ক্ষিধা-তৃষ্ণা কিচ্ছু নেই। শরীরের যান্ত্রিক অংশের মেরামতি নিজেরাই করে নিতে সক্ষম। এবং সেটাও রোবটিক আর্মকে কাজে না লাগিয়ে শুধুমাত্র চিন্তা শক্তির মাধ্যমে। প্রথমে অসুবিধাগুলোকে সনাক্ত করে আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলীজেন্সকে কাজে লাগিয়ে সেই ক্ষতিগ্রস্ত অংশের সমাধান সূত্র খুঁজে বার করে সেই জায়গাটিকে সেল্ফ রেক্টিফিকেশনে প্রি পোগ্রামিং-এর মাধ্যমে পুনরায় পূর্বের অবস্থানে সেল্ফ রিপ্লেসমেন্ট ঘটায়। তাই বলে কি মৃত্যু নেই? আছে, এবং সেটা হচ্ছে মস্তিষ্কের মৃত্যু। তবে শুধুমাত্র মস্তিস্কজনিত মৃত্যুর কারণেই এদের গড় আয়ু বতর্মান পৃথিবীবাসীর সাপেক্ষে প্রায় পাঁচ থেকে ছ’শো বছর। এবং প্রায় প্রতি এক শতাব্দী অন্তর এদের গড় আয়ু প্রায় চারদিন করে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হচ্ছে নিজেদের মধ্যকার ভুল ত্রুটি গুলোকে ক্রমাগত সংশোধন বা পরিমার্জিত করণের মধ্য দিয়ে।
তো এরকম একটা অত্যাধুনিক প্রযুক্তি সম্পন্ন জগতের জীবেদের পারস্পরিক সম্পর্ক, জীবন যাত্রা বা প্রযুক্তিগত দৌড়ে তারা আমাদের তুলনায় কতদূর অগ্রগতি লাভ করেছে সেটাকে আমাদের এই মুহূর্তের কল্পনা শক্তিকে কাজে লাগিয়ে বুঝতে গেলেও মনে হয় নিজেদের বিদ্যা-বুদ্ধির দৌড়ে ঘাটতি পরে যাবে। যাকগে, এই মহাকাশেরই কোনো একটি জগত বিজ্ঞান সম্মত ভাবে আগামী বেশ কয়েক লক্ষ বছর বাদে সভ্যতার উন্মেষে এতদূর এগিয়ে যাবে, এটা জেনেও নিজেকেই তো বেশ গর্বিত মনে হচ্ছে। হচ্ছে কিনা বলুন?
না, আমাদের সেই সাধের ঘন সবুজে মোড়া নীল গ্রহ, যেখানে আকাশে বর্ষা বা শরতের কালো বা পেজা তুলোর মতো সাদা মেঘ ভেসে বেড়াতো বা গাছে গাছে রঙবেরঙের পাখি বা প্রজাপতিরা উড়ে বেড়াতো বা অপূর্ব সব রঙিন ফুলের মন ভোলানো সুগন্ধ বাতাসে ভেসে আমাদের ঘ্রাণ শক্তিকে আরও প্রাণবন্ত করে তুলতো, আজ সেইসব কিছুই অতীতের সুখ স্মৃতি মাত্র। নেই বারো মাসের তেরো পার্বণ বা উৎসব। তবে এরজন্য একদা নিজেদেরকে মহান জ্ঞানী, মহান পরাক্রমশালী মনে করা মানুষই কিন্তু আসলে খাতায় কলমে দায়ী। তাদেরই নির্বুদ্ধিতায় প্রাকৃতিক সম্পদের স্বেচ্ছাচারী অতিরিক্ত অপব্যবহার গত ক্ষয়ের দরুন প্রাকৃতিক ভারসাম্যহীণতার কারণে প্রায় দশ লক্ষ বাহাত্তর হাজার বছর আগেই পৃথিবী থেকে প্রাণ চিরতরে অবলুপ্ত হয়ে গেছে। তবুও রক্ষা যে, সেই সময়কার কিছু অতি উৎসাহি, মানুষের হাতেই উৎপন্ন বায়ো রোবট মঙ্গলে গিয়ে বসবাস শুরু করেছিল নিজেদের অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখার জন্য। নাহলে ভাবুন তো, মানুষ বলে পরিচয় দেওয়ার মতো কিছুই আর অবশিষ্ট থাকতো না। আরে বাবা শরীর না থাক শরীরের কার্যনির্বাহী পরিচালনাকারী প্রধান অঙ্গ, অর্থাৎ মস্তিষ্কটা তো সেই আগের মতই রয়েছে। মস্তিষ্কটাই তো সমগ্র শরীরকে পরিচালনা করে। আর শরীরের বাকি অঙ্গ গুলো তো শুধুমাত্র মস্তিষ্কের বিভিন্ন নির্দেশ পালন করে মাত্র, বিভিন্ন কাজকর্ম করার জন্য। এবার যদি এমন একটা প্রযুক্তি আবিষ্কার করা যায় যেখানে শুধুমাত্র চিন্তা শক্তিকে কাজে লাগিয়েই সব কাজ করে নেওয়া সম্ভব হয় তাহলে শুধু শুধু হাত-পা, পেট, বুক এসবের দরকার কি। অতিরিক্ত অঙ্গ থাকলেই তো বরং সমস্যা বেশি। আজকে এটা ভাঙবে তো কাল ওটা অকেজ হবে। আর তার ফলে মস্তিষ্ক গুরুত্বপূর্ণ জিনিস নিয়ে ভাববার যতনা অবকাশ পাবে তার থেকে বেশি ভাবতে হবে আনুসঙ্গিক শারীরিক অঙ্গপ্রত্যঙ্গের মেরামতি নিয়ে। ফলে সময় এবং খরচা দুটোই অত্যধিক হারে বিনষ্ট হবে। যাকগে, যেটা বলছিলাম। যখন পৃথিবীর বায়ুমন্ডল প্রচন্ডরকম ভাবেই সূর্যের ক্ষতিকারক অতিবেগুনি রশ্মির আওতায় এসে পড়ে সূর্যেরই মধ্যকার গ্যাসীয় হাইড্রোজেন মৌলের পারমাণবিক সংযুক্তিকরণের মাধ্যমে ভারি মৌল হিলিয়ামের উৎপত্তির মধ্য দিয়ে রাসায়নিক ভাবে স্ফীতি লাভের দরুণ, তখন পৃথিবী থেকে প্রাণের চির বিলুপ্তি ঘটে। আবার পাশাপাশি সেই সময়কার উন্নত চিন্তাশীল মানুষদের মাধ্যমেই আগাম চিন্তা শক্তি প্রয়োগের ফলস্বরূপ কিছুটা হলেও মনুষ্য উপস্থিতির ধারাবাহিকতা আজও বহন করে চলেছে মঙ্গলের এই নতুন পৃথিবী। যেহেতু এদের মস্তিষ্কটা এখনো পুরোটাই মানুষের।এবং এই বৈচিত্রের মধ্য দিয়েই এখনো তারা এই মহাবিশ্বে আধিপত্য বজায় রাখতে কিছুটা হলেও সক্ষম হয়েছে, বলাই বাহুল্য।
ঐ যে, প্রচন্ড রকমের একটা যান্ত্রিক কোলাহল শোনা যাচ্ছে। মনে হয় এন্ড্রোমিডা নক্ষত্রমন্ডলের সোনার টুকরো ছেলে- বায়ো রোবট, ‘স্ফটিক’ আমাদের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির কন্যা তৃষ্ণাকে বিয়ে করার জন্য স্বশরীরে উপস্থিত হয়েছে। সমস্ত সামাজিক রোবটেরা ভিড় করেছে এন্ড্রোমিডার পাত্রকে একঝলক দেখবার জন্যে। এই প্রথম আমাদের জানা সভ্যতার ইতিহাসে দুটি আলাদা গ্যালাক্সির মধ্যে আন্ত-গ্যালাক্টিক্যাল পবিত্র বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপিত হতে চলেছে। ফলে উপস্থিত সকলের মধ্যে একটা বাঁধভাঙা ঔৎসুক্য প্রকাশ পাওয়াটা খুবই স্বাভাবিক।
এখনকার বিয়েতেও পাত্র এবং পাত্রির একে অপরকে হাতের আঙ্গুলে আংটি পরিয়ে দেবার রীতি বজায় আছে। তবে এটা কোনরকম ধাতব আংটি নয়। এটা একটা উজ্জ্বল আলোর রিং। পাত্রের আঙ্গুলে শোভা পাচ্ছে উজ্জ্বল নীল রঙের আর পাত্রির হাতে উজ্জ্বল লাল বর্ণের আলোর সরু বলয়। এবং এই দুটি আলো সর্বস্ব আংটির গুরুত্ব অনরিসীম। প্রথমত এই দুটো নক্ষত্রপুঞ্জের যেকোনো প্রান্তে বসে একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করা সম্ভব এই আংটির মাধ্যমে রিফ্রাকটিভ ইনডেক্সের বিচ্যুতির সামান্য পরিবর্তন ঘটিয়ে। অনেকটা সেই আদিম যুগের ব্যবহৃত রেডিওতে নব ঘুরিয়ে সূক্ষ্ম টিউনিং-এর মাধ্যমে বিভিন্ন দেশের সম্প্রচারিত বেতার তরঙ্গকে খুঁজে বের করার মতো।
এছাড়াও দ্বিতীয় যে কারণে এই আংটির অপরিহার্যতা, সেটা হলো এই দুই আংটির থেকে বিচ্ছুরিত আলোক রশ্মির একত্রিকরণের মধ্য দিয়ে পরবর্তী রোবট প্রজন্মের প্রভুত উন্নতিসাধন ঘটানো। বিবাহের পরবর্তী সময়ে এই মুহূর্তে সকলের যান্ত্রিক বুদ্ধি প্রকোষ্ঠে একটাই জিজ্ঞাসা, যার উদ্দেশ্যে এত কাঠ খড় পুড়িয়ে দুটো গ্যালাক্সির অতি উন্নত প্রজাতির দুটো বায়ো রোবটের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করা হলো, সেটি হচ্ছে পরবর্তী রোবটিক প্রজন্ম যেন তার উৎপাদনকারী রোবট মস্তিষ্কদ্বয়ের থেকে আরো অধিক উন্নত মানের হয়।
মানুষই বলো বা তার পরবর্তীতে বায়ো রোবট, মূল প্রত্যাশা বা প্রচেষ্টা কিন্তু সেই একটাই। আর সেটা হচ্ছে ঈশ্বর থাকুক বা না থাকুক, বিজ্ঞানের অগ্রগতিকে কাজে লাগিয়ে নিজেদেরকেই ঈশ্বর তুল্য করে প্রতিষ্ঠিত করে এই সমগ্র বিশ্বের সমস্ত মহাজাগতিক বস্তুর ওপরে, সে হোক সজীব বা নির্জীব, প্রভুত্ব কায়েম করা। পারলে এই বিশ্বের সমস্ত নিয়ম বা শৃঙ্খলাকে নিজের অনুশাসনে বেঁধে নিজের ইচ্ছা, অনিচ্ছাকে তার উপরে চাপিয়ে দিয়ে, সেই চির আকাঙ্ক্ষিত অমরত্ব লাভ করা।
দেখা যাক আগামীর মঙ্গলে আজকের সদ্য বৈবাহিক বন্ধনে আবদ্ধ দুটি বিপরীত শারীরিক বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন বায়ো রোবট তৃষ্ণা ও স্ফটিক আরও আধুনিক, আরো ঈশ্বর তুল্য রোবট সন্তানের জন্ম দিতে সক্ষম হতে পারে কিনা। এ যেন অনেকটা সেই চার্লস ডারউইনের “টিকে থাকার আমৃত্যু লড়াই এবং যোগ্যতমের উদবর্তন” তত্ত্বেরই নতুন সংস্করণ। তবে এখন থেকে আর শুধু টিকে থাকা নয়, বরং যেন স্রষ্টার দিকেই চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেওয়া। এটা কোনও লড়াই নয়। এটা একটা সৎ প্রচেষ্টা। এবং এই প্রচেষ্টায় সত্যি সত্যিই যদি কোনদিন সফলতা আসে, অর্থাৎ মানুষ তার মস্তিষ্কে লালিত বুদ্ধি বিন্দুর ক্রম রূপান্তর বা বিকাশ ঘটিয়ে নিজেই ঈশ্বর তুল্য হয়ে উঠতে সক্ষম হয় তবে সেইদিন হয়তো বা সমান্তরাল বিশ্বের কল্পনা বাস্তবায়িত হবে। এখন শুধু তারই অপেক্ষা।
নতুন পৃথিবী সায়েন্স ফিকশন গল্প – সমাপ্ত
আপনাদের লেখা আমাদের ওয়েব সাইটে জমা দিতে গেলে, অনুগ্রহ করে আমাদের লেখা-জমা-দিন মেনু-তে ক্লিক করুন ও নিজেকে Author হিসেবে Register করুন এবং আমাদের পরবর্তী আপডেট পেতে আমাদের ফেসবুক পেজ অনুসরণ করুন।
অন্যান্য
স্বপ্নভঙ্গ
পালানরা পালায় না
নক্ষত্রকন্যা