কলম পাতুরি

ভাবনা আপনার প্রকাশ করবো আমরা

বেদ কথা 

বেদ কথা সায়েন্স ফিকশন গল্প – মিঠুন মুখার্জী

নাম প্রফেসর বিনায়ক দাশগুপ্ত।বাড়ি দিল্লির পাহারগঞ্জ। জন্ম সূত্রে বাঙালি হলেও কর্মসূত্রে তিনি তার পরিবার নিয়ে ২০১০ সালে এখানে চলে আসেন। তিনি দিল্লির একটি নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক।তার গবেষণার বিষয় মানবমন ও মানব চরিত্র। বিষয়টি যদিও খুব জটিল, তবুও তার দীর্ঘ অভিজ্ঞতা তাকে অনেক দূর পৌঁছে দিয়েছে। তিনি মানুষের চোখ-মুখ দেখে তার চরিত্র ও ভবিষ্যৎ সম্পর্কে বলে দিতে পারেন। মনের মধ্যে লুকিয়ে থাকা বিভিন্ন জটিলতা নিমেষে তিনি ধরে ফেলেন। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দেশের বড় বড় কলেজে ও বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি তাঁর বক্তব্য রাখার জন্য গেছেন।

           প্রফেসর বিনায়ক দাশগুপ্তের বাবা একজন বিজ্ঞানী ছিলেন। ভিনগ্রহের প্রাণীদের নিয়ে তিনি গবেষণা করতেন। বাবার কাছ থেকে তিনি অনেক সময় বুদ্ধি নিতেন। কথায় বলে, জিনিয়াস জিনিয়াস চেনেন। আমেরিকা-লন্ডন-আফ্রিকা-কানাডা- সুইজারল্যান্ড এমন কোন জায়গা নেই যেখানে প্রফেসর বিনায়ক দাশগুপ্তের বাবা গবেষণার কাজে যান নি। সকলে তাঁকে বিজ্ঞানী বঙ্কু নামে চিনতেন। তার একটাই দোষ ছিল, তিনি খুব সহজ কথা সহজ ভাবে গ্রহণ করতেন না। বাঁকা ভাবে গ্রহণ করে উত্তর দিতেন। প্রফেসর বিনায়ক দাশগুপ্ত বাবার কাছ থেকে কিছু স্বভাব বৈশিষ্ট্য পেয়েছিলেন। সারা জীবনটাই গবেষণার কাজে নিয়োজিত করতে চেয়েছেন তিনি। তাই বিবাহ করেননি। করবেন না বলে মনে মনে ঠিকও করেছিলেন।

         প্রফেসর বিনায়ক দাশগুপ্ত তিনকাল গিয়ে এককালে পড়েছেন। জীবনে অভিজ্ঞতা প্রচুর। আজ সেই অভিজ্ঞতার কথা আলোচনা করব। প্রফেসরের বয়স যখন চল্লিশের কাছাকাছি ছিল, তখন একবার তিনি জার্মানির এক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডাক পেয়েছিলেন বক্তৃতা রাখার জন্য। দুই সপ্তাহের জন্য তিনি জার্মানিতে গিয়েছিলেন। সে এক বিচিত্র অভিজ্ঞতা। না আলোচনা করলে অজানা থেকে যাবে। প্রফেসর তাঁর কলেজের আরো তিনজনকে নিয়ে জার্মানিতে গিয়েছিলেন। সেখানে পৌঁছানোর পর রাজকীয় অভ্যর্থনা  জানানো হয় তাঁদের। প্রফেসর বিনায়ক দাশগুপ্ত ছাড়াও ছিলেন ডক্টর ঋতব্রত চট্টোপাধ্যায়, ডক্টর পরমব্রত মুখোপাধ্যায় ও ডক্টর রফিকুল ইসলাম। তাদের একটি পাঁচতারা হোটেলে রাখা হয়েছিল। এরকম আড়ম্ভর তাঁরা কখনো অনুভব করেননি। জার্মানির যে বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁরা গিয়েছিলেন, সেখানে চার দিন যাবত আন্তর্জাতিক সেমিনারের আয়োজন করা হয়েছিল। কেবল ভারতবর্ষ থেকেই নয়, আমেরিকা, আফ্রিকা ও ইউরোপ মহাদেশের বিভিন্ন বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক-অধ্যাপিকারা এসেছিলেন বক্তৃতা দিতে। অধ্যাপক বিনায়ক দাশগুপ্ত ছাড়া ভারতের অন্য তিনজন অধ্যাপক ছিলেন যথাক্রমে অর্থনীতি, রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও ইতিহাসের অধ্যাপক। অধ্যাপক বিনায়ক দাশগুপ্তের একটি কোকিল পাখি ছিল। সেই পাখিটাকে সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। এই কোকিল পাখিটির বিশেষত্ব হলো, অহংকারী ও সুবিধাবাদী মানুষদের চোখ দেখলেই চিনে ফেলত এবং অধ্যাপক বিনায়ক দাশগুপ্তকে তাদেরকে সামলে চলতে সাবধান করে দিত। তাছাড়া কোন বিপদের সম্ভাবনা থাকলে এই  পাখিটি আগেভাগেই বুঝে যেত। তার পূর্বাভাস অধ্যাপকদের জানিয়ে দিত। পা দিয়ে পেন ধরে দুটি শব্দ সে লিখতো। “সামনে বিপদ” আর “আনন্দের দিন”। অধ্যাপক  দাশগুপ্ত তাকে এই লেখা শিখিয়েছিলেন। 

         এই কোকিল পাখিটিকে অধ্যাপক নিজেই ট্রেনিং দিয়েছিলেন। মানুষের চোখ-মুখের ভঙ্গি দেখে মনের ভিতরে কি ঘটছে তা সে ধীরে ধীরে আয়ত্ত করেছিল‌। ভালো-মন্দ জ্ঞানও তাকে বিভিন্নভাবে বুঝতে শিখিয়েছিলেন তিনি। পাখিটির নাম দিয়েছিলেন বেদ। ‘বেদ’ যেমন হিন্দু ধর্মের পূর্ণাঙ্গ প্রকাশ, কোকিল পাখিটিও তেমনি মানব মনের সবকিছুর পরোখকারী। জার্মানিতে তাকে নিয়ে আসার আগে বিভিন্ন সম্মেলনে অধ্যাপক বিনায়ক নিয়ে গিয়েছেন। সেসব জায়গায় গিয়ে এমন কাণ্ড করেছে পাখিটি, যা দেখে মানুষেরা অবাক হয়ে গেছেন।

     জার্মানির যে বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাকে অধ্যাপক ও গবেষক বিনায়ক দাশগুপ্তরা বক্তৃতা দিতে গিয়েছিলেন, সেখানকার কর্তৃপক্ষ তাদের চারজনকে দেখাশোনার জন্য দুজন লোককে নিয়োজিত করেছিলেন। তাদের একজনের নাম স্টিফেন ফ্লেমিং ও অপরজন স্টিভ স্মিথ। তারা দুজনেই ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ছিলেন। একজন দর্শন ও অন্যজন মানববিদ্যার। হোটেল থেকে শুরু করে সেমিনার হল পর্যন্ত যত কার্যকলাপ অধ্যাপক বিনায়ক দাশগুপ্তদের ছিল সবকিছুরই দেখভালের দায়িত্ব দিয়েছিলেন তাদের। এই কয়দিনে তাদের সঙ্গে বিনায়ক দাশগুপ্তদের সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে। কোকিল পাখিটিকে  দেখে তাদের দুজনের মধ্যে কৌতূহল দেখা যায়। তারা পাখিটি আনার কারণ জিজ্ঞাসা করলে, অধ্যাপক বিনায়ক দাশগুপ্ত তাদের বলেন—“এটির নাম বেদ। এ মানবমন ও মানব চরিত্র সম্পর্কে সব বলতে পারে। ব্যক্তির চোখ দেখে তাকে পড়ে ফেলার মত ক্ষমতা আছে ওর।” স্টিভ স্মিথ ও স্টিফেন ফ্লেমিং অধ্যাপকের কথা শুনে হেসে দেন। তারা বলেন—“একটা পাখির পক্ষে এটা অসম্ভব। তাছাড়া সে প্রথম অচেনা- অজানা ব্যক্তি সম্পর্কে কি করে বলতে পারে! সৃষ্টির সবচেয়ে উন্নত জীব মানুষের পক্ষে মানবচরিত্র ও মানবমন বোঝা যেখানে খুব কঠিন ব্যাপার, সেখানে একটা পাখি!! কুড়ি-ত্রিশ বছর একসঙ্গে থেকে বা সংসার করে মানুষ তার কাছের মানুষদেরই ঠিকঠাক চিনে উঠতে পারেন না, একটা পাখির পক্ষে তা কয়েক মিনিটে করা সম্ভব?” অধ্যাপক দাশগুপ্তের কথা বিশ্বাস হচ্ছে না দেখে ডক্টর ঋতব্রত চট্টোপাধ্যায়   স্টিভ স্মিথ ও স্টিফেন ফ্লেমিংকে বলেন— “উনি যা যা বলছেন সবটাই সত্য। এটা অন্য পাখিদের মতো একটা সাধারন পাখি নয়। এর আগে অসংখ্য মানুষের চোখ দেখে ও তাদের সম্পর্কে সব বলে দিয়েছে। তাদের মধ্যে কয়েকজন অবাক হয়ে পাখিটিকে চুরি করার চেষ্টা করেছে, কিন্তু পারেনি। ও বিশেষ বিশেষ মুহূর্তে আকারও পাল্টাতে পারে। তবে এর জন্য ওর ক্রোধ রিপুর জাগরণ ঘটাতে হয়।” ডক্টর ঋতব্রতের কথাও তাদের বিশ্বাস হয়না। তখন তারা বলেন— “ঠিক আছে আমাদের চোখ দেখে পাখিটি আমাদের সম্পর্কে কি বলে দেখি। যদি সবটাই মিলে যায়, তবে মনে আর কোন সন্দেহ থাকবে না।”

         প্রথমে বেদ স্টিভ স্মিথের চোখ দুটোর দিকে মিনিট খানিক অপলক নয়নে তাকিয়ে থাকে। তারপর কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। সামনে থাকা পেনটি দিয়ে একটি সাদা খাতার উপর পাখিটি লেখে—“আপনি খুব চঞ্চল। কোনো কাজই স্থির ভাবে করতে পারেন না। তাড়াহুড়ো করার কারণে এ যাবত অনেক কিছুই হারিয়েছেন। আপনি আপনার এই স্বভাবের জন্য প্রায় মানুষের কাছেই  কথা শোনেন। মাত্র কয়েক দিনের পরিচয়ে আপনি মানুষকে বিশ্বাস করেন। তার কারণে অনেকবার ঠকেছেন। নিজের জীবনে আপনার সততার সুযোগ নেয় সকলে। আপনার বাবা-মাও।” লেখাটি অধ্যাপক বিনায়ক সকলের সামনে পড়ে শোনান। কথাগুলো শুনে অধ্যাপক স্মিথ অবাক হয়ে যান। বেদ যা যা বলেছে কোনটাই ভুল নয়। অধ্যাপক স্মিথ আনন্দে অধ্যাপক বিনায়ককে জড়িয়ে ধরেন। বলেন— “বা প্রফেসর বা! আশ্চর্য পাখি। এ তো নিজের সাথে সাথে আপনার নামও জগতের মানুষের কাছে পৌঁছে দেবে। আপনার ট্রেনিং দেখে অভিভূত।”

        এরপর অধ্যাপক স্টিফেন ফ্লেমিংয়ের চোখের দিকে একইভাবে তাকিয়ে থেকে কিছুটা সময় চোখ বোঝে বেদ। তারপর পেনটি ঠোঁটে নিয়ে লেখে — “আপনি খুব ধীর-স্থির এবং বুদ্ধিমান। আজ পর্যন্ত কোন কাজ তাড়াহুড়ো করে করেননি। আপনার উপস্থিত বুদ্ধি ও জ্ঞান আপনাকে অনেক দূর পৌঁছে দিয়েছে। ভবিষ্যতেও দেবে। নিজের প্রতি আপনার বিশ্বাস প্রবল। আপনার কাছে অসম্ভব বলে কিছুই নেই। না পারলেও চেষ্টা করে দেখেন আপনি। আপনাকে অনেকেই ঈর্ষা করেন। সব সময় তারা চেষ্টা করেন কিভাবে আপনার ক্ষতি হয়। প্রতিটি মুহূর্তে আপনি সাবধানে চলার চেষ্টা করেন।” অধ্যাপক বিনায়ক দাশগুপ্ত বেদের লেখা পৃষ্ঠাটি আবার পড়ে শোনান। বেদের বলা কথাগুলি শুনে অধ্যাপক স্টিফেন ফ্লেমিংয়ের চোখ দুটো বিস্ময়ে বড় বড় হয়ে যায়। তিনি প্রফেসর বিনায়ক ও তার তিনজন অধ্যাপককে উদ্দেশ্য করে বলেন—“অবিশ্বাস্য! সত্যিই অবিশ্বাস্য! আমার সম্পর্কে বলা একটা কথাও ফেলনা নয় একেবারে। আমি যা তাই বলে দিয়েছে‌। এ তো অত্যাশ্চর্য পাখি। একে সাবধানে রাখবেন। এর এই বিরল প্রতিভার খবর জানলে কেউ চুরি করে নিতে পারে। সকলেই তো আর সমান মনের মানুষ নন।”

          স্টিফেন ফ্লেমিংয়ের কথা শুনে অধ্যাপক বিনায়ক দাশগুপ্ত বলেন— “আমার বেদকে চুরি করা অতো সহজ ব্যাপার নয়। তাছাড়া ও আত্মরক্ষা করতে পারে।ওর ধারালো নখ আর ঠোঁটের ভয়ে ওর সামনে কেউ যেতে চাইবে না। তাছাড়া আমার বাবার আবিষ্কার করা একটা ছোট্ট পিস্তল ওর আত্মরক্ষার জন্য সবসময় গলায় ঝুলানো থাকে। পিস্তল চালানোর ট্রেনিংও ওকে দেওয়া। এই পিস্তলের গুলি যার গায়ে লাগবে সে এক ঘন্টার মতো পাথর হয়ে যাবে। একঘন্টা পর আবার পুনরায় আগের অবস্থায় ফিরে আসবে। বাবা এই পিস্তলটির নাম দিয়েছিলেন ‘সেল্ফসেভ গান’ বা ‘আত্মরক্ষা পিস্তল’। আমার বাবার এই আবিষ্কারের জোরে আমরা অনেক সমস্যা থেকে খুব সহজেই পরিত্রাণ পাই। বাবা আবিষ্কার করেছেন ‘ভ্যানিস পিল’।এই পিল একটি খেলে আধা ঘন্টার মতো ভ্যানিস হওয়া যায়। যে খাবেন সে সকলকে দেখতে পাবেন, কিন্তু তাকে কেউ দেখতে পাবেন না। অনেকবার এই বড়ি আমাদের প্রয়োজনে এসেছে। অনেক অসম্ভব কাজ আমরা সম্ভব করেছি। আমরা মানবমন ও মানবচরিত্র নিয়ে কাজ করি। তাই অপ্রিয় সত্য কথা বলায় শত্রুর শেষ নেই। বেকায়দায় পড়লে এই পিলটির জুড়ি মেলা ভার। তাছাড়া ‘ট্রু পিল’ বা ‘সত্য পিল’ নামক একটা ট্যাবলেট আমার পিতা তৈরি করেছেন। যে ট্যাবলেট যেকোনো ব্যক্তি সেবন করলে দশ মিনিটের মধ্যে নিজের মনের ভিতরে লুকিয়ে থাকা সমস্ত সত্য কথা ফর ফর করে বলে দেবেন। ঠিক মদ সেবন করলে মানুষ যেমন সাংসারিক সব সত্য কথা বলে দেন। এছাড়া বেদের জন্য বাবা বট গাছের ফল দিয়ে তৈরি করেছেন ‘বটিকা’ নামের একটি ট্যাবলেট‌। এর একটা খেলে বেদের বারো ঘন্টা আর খিদে পাবে না। এছাড়া পূর্ব জন্মের সমস্ত বিষয় মনে করতে আবিষ্কার করেছেন ‘জাতিস্মর’ টেবলেট। এই টেবলেট  খেলে মিনিট পাঁচেকের মধ্যে আগের জন্মে সে ফিরে যাবেন। মিনিট পনেরো পর আবার এই জন্মে তিনি ফিরে আসবেন। এর দামটা বেশি। এখনও পর্যন্ত দশ জন এই টেবলেট খেয়ে পূর্বের জন্মে ফিরে গিয়েছেন। তবে এর একটাই সমস্যা, এই জন্মে ফিরে আসলে আধাঘন্টার মতো সেই ব্যক্তির মধ্যে আগের জন্মের সকল বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা যায়। এমনকি আগের জন্মের নামটিই তার মাথার মধ্যে ঘোরে।”

           স্টিভ স্মিথ ও স্টিফেন ফ্লেমিং-এর বুঝতে ভুল হয় না যে, অধ্যাপক বিনায়ক দাশগুপ্ত ও তাঁর পিতা অসাধারণ প্রতিভাবান মানুষ। তাঁরা দুজনেই মনে মনে সংকল্প করেন— ‘যে করেই হোক এই ‘জাতিস্মর’ টেবলেট খেয়ে তাদের আগের জন্মের কথা জানতেই হবে। আর সুযোগ বুঝে এটাকে নিজেদের প্রডাক্ট বলে চালাতে হবে জার্মানিতে। যদি তার জন্য অধ্যাপক বিনায়কের সঙ্গে কোনো চুক্তিতে আবদ্ধ হতে হয় তাও করবেন তারা।’

         এরপর দুদিন বাদে সেমিনারের দিনটি উপস্থিত হয়। সকালবেলা থেকে সেমিনার হল সুন্দরভাবে ফুল দিয়ে সাজানো হয়। বিভিন্ন নামিদামি অতিথিদের বসার জায়গা করা হয়। ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে অধ্যাপক বিনায়ক সেমিনারে কি বলবেন, কেমন ভাবে সবকিছু উপস্থাপন করবেন তার একটা অনুশীলন সেরে নেন। সঙ্গে তার তিনজন অধ্যাপক বন্ধুরাও ছিলেন। যদিও সেমিনারটি তিন দিনের ছিল। প্রথম দিন অবশ্য অধ্যাপক বিনায়কের অন্য তিনজন বন্ধুদের বলার দিন ছিল না। বেদকে ভালো করে পরখ করে নিচ্ছিলেন তিনি, যাতে সেমিনারের সময় কোন রকম ভাবে সমস্যা না হয়। মানব মনের অলিগলি কূটনীতি সমস্ত কিছুর পাঠ দিয়েছিলেন তিনি। কোকিল পাখিটিকে দেখে সবচেয়ে বড় আশ্চর্য লাগত পা দিয়ে পেন ধরে লেখার শিক্ষা।

        সকাল দশটা থেকে সেমিনার শুরু হয়েছিল। সেমিনারে উপস্থিত ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, জার্মানির বিশিষ্ট কয়েকজন মানব তত্ত্ববিদ, বিজ্ঞানী ও বড় বড় দার্শনিকরা। এই সেমিনারে বত্রিশটি দেশের অধ্যাপক ও গবেষক উপস্থিত ছিলেন। সেমিনারের বিষয় ছিল “মানব মন ও মানব চরিত্রের সেকাল-একাল।” একে একে মঞ্চে সকল বক্তাকে ডাকা হলো। এক এক জন করে অসাধারণ বক্তব্য রাখলেন। মানব মন ও মানব চরিত্র নিয়ে কি অধ্যাবসায়, কি অসাধারণ গবেষণা— না শুনলে বলে ঠিক বোঝানো যাবে না। অধ্যাপক বিনায়ক দাশগুপ্তের পাশের চেয়ারে কোকিল পাখিটিকে দেখে সকলে অবাক হচ্ছিলেন। ভেবে উঠতে পারছিলেন না পাখিটি কেন আনা হয়েছে। দুপুর একটার সময় অধ্যাপক বিনায়ক দাশগুপ্তের বক্তব্য রাখার সময় এলো। তিনি মাইক্রোফোনের সামনে গেলেন বেদকে নিয়ে। বেদ তার পাশে রাখা একটা লম্বা টুলের উপর উড়ে গিয়ে বসলো। অধ্যাপক ‘মানব মন ও মানব চরিত্রের জটিলতা’ নিয়ে তার বক্তব্য শুরু করলেন। অসাধারণ সব কথা সকলে মনোমুগ্ধ হয়ে শুনছিলেন। হাততালিতে হল ফেটে পড়ছিল। বিখ্যাত মনস্তত্ত্ববিদ ডক্টর ফ্রয়েডের মানব মনের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গও তিনি নিয়ে আসেন। চেতন মন, অচেতন মন ও অবচেতন মন নিয়ে আলোচনা করেন। বেদকে দেখিয়ে বলেন— “এই আশ্চর্য পাখিটির সঙ্গে আপনাদের পরিচয় করিয়ে দিই। এর নাম বেদ। মানব চরিত্র ও মানব মনের জটিলতা নিয়ে ওকেও আমি আজ কয়েক বছর ধরে ট্রেনিং দিচ্ছি। এই পৃথিবীর সমস্ত মানুষের চোখের দিকে কয়েক মুহূর্ত দেখে ও তার চরিত্র ও মনের মধ্যে কি চলছে তা বলে দিতে পারে। অধ্যাপকের কথা শুনে অনেকেই অবাক হন, আবার কেউ কেউ অবিশ্বাসবশত হেসে ওঠেন। অধ্যাপক বুঝতে পারেন তাঁর কথা বেশিরভাগ মানুষেরই বিশ্বাস হয়নি। তাই শ্রোতাদের মধ্যে থেকে দুজন মহিলাকে ডেকে সকলকে প্রমান দিয়েছিলেন তিনি। একজন মহিলা  অ্যানাফ্রাঙ্ক আর অন্যজন মিস ডায়ানা। বেদের সামনে প্রথমে অ্যানাফ্রাঙ্ককে তিনি দাঁড় করান। বেদ তার চোখের দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে চোখ বোঝে। তারপর পেন নিয়ে একটা সাদা কাগজে লেখে। লেখাটি অধ্যাপক বিনায়ক সকলের সামনে পড়ে শোনান। অ্যানাফ্রাঙ্ক কথাগুলো শুনে লাফিয়ে ওঠেন আর বলেন— “বাও, মিরাক্কেল বার্ড। all are absolutely right। একদম সব মিলে গেছে।” সকলে হাততালি দেন। সমগ্র হল গমগম করতে থাকে। এরপর মিস ডায়ানার সম্পর্কেও হুবহু বলে দেয় পাখিটি। শ্রোতাদের মধ্যে থেকে একজন বলেন— “ওয়ান্ডারফুল, অসাধারণ ট্রেনিং। ভাবা যায় না। সত্যি এ তো আশ্চর্য পাখি। এটি দেশের ও দশের কাজে লাগবে। এরদিকে নজর দেবেন। লোভী মানুষদের চোখ এড়িয়ে চলার চেষ্টা করবেন।”

         এরপর অধ্যাপক বিনায়ক দাশগুপ্ত তাঁর বাবার আবিষ্কৃত ‘জাতিস্মর’ ট্যাবলেটের কথা সকলের সামনে উপস্থাপন করেন। এবারও অনেকেই অবিশ্বাস বশত হেসে ফেলেন। দর্শকদের বিশ্বাস করানোর জন্য তিনি দুজনকে মঞ্চে আসার জন্য অনুরোধ করেন। কিন্তু কেউই মঞ্চে আসার সাহস করেন না। অবশেষে তাঁর সঙ্গে আসা দুজন অধ্যাপক ডক্টর পরমব্রত মুখোপাধ্যায় ও ড: ঋতব্রত চট্টোপাধ্যায়কে তিনি মঞ্চে ডাকেন। তাদের মনের মধ্যেও ভয় হচ্ছিল। কিন্তু প্রফেসর বিনায়ক দাশগুপ্তের সম্মান রক্ষার্থে তারা মঞ্চে যান। ‘জাতিস্মর’ ট্যাবলেট খাওয়ানোর নিয়ম ও খেলে কি হতে পারে তার বিষয় সকলের সামনে তিনি খোলসা করে বলেন। এরপর ডক্টর পরমব্রত মুখোপাধ্যায়কে ও ডক্টর ঋতব্রত চট্টোপাধ্যায়কে অধ্যাপক বিনায়ক দাশগুপ্ত একটি করে ‘জাতিস্মর’ ট্যাবলেট সেবন করান। তারপর তাদের একটি করে চেয়ারে বসিয়ে দেওয়া হয়। পাঁচ মিনিটের মধ্যে দুজনেরই চোখ বুজে যায়‌। প্রথমে অধ্যাপক ডক্টর পরমব্রত মুখোপাধ্যায়কে জিজ্ঞাসা করেন— “কে আপনি?” কয়েক সেকেন্ড পরেই তিনি উত্তর দেন— “আমি ফারুক শেখ।” এরপর প্রশ্ন করেন— “কোথায় থাকেন?” ডক্টর পরমব্রত উত্তর দেন— “বাংলাদেশের ঢাকায়।” এরপর প্রশ্ন করেন— “কি করেন সেখানে?” ডক্টর পরমব্রত উত্তর দেন— “আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা। আমার মাতৃভূমিকে স্বাধীন করার জন্য বুকে গুলি খেয়ে মৃত্যুবরণ করেছি। তবে পশ্চিম পাকিস্তানের পাঁচটি শয়তানের প্রানও আমি নিয়েছি।” কয়েক সেকেন্ড পর অধ্যাপক বিনায়ক দাশগুপ্ত ডক্টর ঋতব্রত চট্টোপাধ্যায়কে জিজ্ঞাসা করেন— “আপনার নাম?” তিনি উত্তর দেন— “মেরা নাম আমজাদ আলী।” এরপর প্রশ্ন করেন—“কোথায় থাকেন আপনি?” বলেন—“উত্তরপ্রদেশ কা ছোটাসা গাও সরাইমির মে।” তিনি ওখানে কি করেন জিজ্ঞাসা করলে উত্তর পান— “ম্যায় উহা কা এক কৃষাণ হুঁ। ইংরেজকা গোলি সে মেরা মউথ হুয়া। জমিন দেনেমে রাজি নেহি থা ইসলিয়ে।”  তাদের এই সকল উত্তর দিতে দেখে শ্রোতারা সকলে অবাক হয়ে যান। হলের  সকলেই হাততালি দেন। পনেরো মিনিট পর তারা দুজন পুনরায় এই জন্মে ফিরে আসেন। কিন্তু তখনও তাদের চোখ বন্ধ। অধ্যাপক বিনায়ক দাশগুপ্ত পরীক্ষা করার জন্য তাদের দুজনকে জিজ্ঞাসা করেন—“কারা আপনারা?” একজন বলেন– “আমি ফারুক শেখ” আর অন্যজন বলেন—“আমি আমজাদ আলী।” সকলে বুঝতে পারেন অধ্যাপক বিনায়ক দাশগুপ্ত ‘জাতিস্মর’ ট্যাবলেট সম্পর্কে যা যা বলছেন সবটাই সত্য। এরপর প্রফেসর দুজনকে ধরে এনে মঞ্চের পাশে বসিয়ে দেওয়া হয়। আধা ঘন্টা পর তাদের আগের জীবনের সমস্ত বিষয়টি মাথা থেকে চলে যায়। তাঁরা ‘জাতিস্মর’ ট্যাবলেট খাওয়ার আগে যেমন ছিলেন, তেমন অবস্থায় ফিরে আসেন। তাঁদের মনেও থাকেনা এতক্ষণ তাঁরা কোথায় ছিলেন, কি কি করছিলেন। প্রফেসর তাঁদেরকে মঞ্চের মধ্যে ডেকে এবার জিজ্ঞাসা করেন— “আপনারা কারা?” কিছুটা হেসে একজন বললেন—“আমি ডক্টর পরমব্রত মুখোপাধ্যায়।” আর অন্যজন বললেন— “আমি ডক্টর ঋতব্রত চট্টোপাধ্যায়।” এরপর বিনায়ক দাসগুপ্ত তাদের প্রশ্ন করেন— ‘ঘন্টা খানেকের মধ্যে আপনাদের জীবনে কী কী ঘটেছে বলতে পারেন?’ অনেক চেষ্টা করেও দুজনের মধ্যে কেউই কিছু বলতে পারলেন না। শুধু বলছেন— “আপনি আমাদের দুজনকে মঞ্চে ডেকে দুটি জাতিস্মর ট্যাবলেট খাইয়েছিলেন—এইটুকুই মনে আছে, আর কিছুই মনে পড়ছে না। তাদের এই উত্তরে হলটি হাততালিতে ভড়ে যায়।

        এরপর অধ্যাপক বিনায়ক দাশগুপ্ত তাঁর বাবার আবিষ্কৃত ‘ট্রু পিল’ নিয়ে সকলের সামনে আলোচনা করেন। প্রমাণ দেওয়ার সাপেক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে ডাকেন। তিনি ভয়তে আসতে চাইছিলেন না। কিন্তু সকলে অনুরোধ করায় তিনি মঞ্চে যান। তাঁকে একটি ‘ট্রু পিল’ ট্যাবলেট খাওয়ানোর কিছুক্ষণের মধ্যেই বিগত এক সপ্তাহের মধ্যে তাঁর জীবনে ঘটা বিশেষ বিশেষ ঘটনা তিনি নিজেই সকলের সামনে বলে যেতে থাকেন। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষরা তাঁর বলা ও করা কর্মের মধ্যে অনেক অসংগতি খুঁজে পান। তারা বুঝতে পারেন, উপাচার্য কেমন মানুষ, আর কিভাবে তারা তাঁর দ্বারা প্রবঞ্চিত হচ্ছেন। ওষুধের ক্ষমতা হ্রাস পেলে উপাচার্য পুনরায় স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসেন। তিনি দেখেন, তার বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক-অধ্যাপিকারা তাকে সন্দেহের চোখে দেখছেন। আসলে তাঁর সমস্ত গোপন রহস্য সে নিজের মুখেই সকলের সামনে উন্মোচন করেছেন। সে লজ্জিত হয়ে নিজের চেয়ারে গিয়ে বসে পড়েন। নিজের অন্যায় কাজগুলো নিজের মুখে এভাবে বলায় দর্শকেরা সকলেই হো হো করে হেসে ওঠে। সকলে বুঝতে পারেন—“এই ট্যাবলেটটি শত্রুকে আঘাত না করে জব্দ করার মোক্ষম জিনিস।” এবারও অধ্যাপকের বাবার এই আবিষ্কারের জন্য জার্মানির বিখ্যাত সেমিনারের হলটি দর্শকদের হাততালিতে ফেটে পড়ে।

           বিকেল চারটের সময় সেই দিনটির অনুষ্ঠান সমাপ্তি ঘোষিত হয়। বিশেষ বিশেষ মানুষেরা অধ্যাপক বিনায়ক দাশগুপ্তের সঙ্গে করমর্দন ও আলাপ করে প্রশংসা করেন তাঁর। এদের মধ্যে দু-একজন সুযোগ সন্ধানী মানুষও ছিলেন। তারা চেয়েছিলেন প্রফেসরের পাখিটি ও আবিষ্কারগুলি ছিনিয়ে নিয়ে নিজেদের নামে পুরো জার্মানিতে ছড়িয়ে দিতে এবং অনেক সম্পত্তির মালিক হতে। হোটেলে অধ্যাপক বিনায়ক দাশগুপ্তদের চারজনকে দুটি ঘর দেওয়া হয়েছিল। একটিতে ছিলেন অধ্যাপক বিনায়ক দাশগুপ্ত ও ডক্টর ঋতব্রত চট্টোপাধ্যায় আর অন্যটিতে ডক্টর পরমব্রত মুখোপাধ্যায় ও ডক্টর রফিকুল ইসলাম। সেইদিন সন্ধ্যেবেলা ডঃ পরমব্রত ও ডঃ ঋতব্রত পরের দিনের সেমিনারের বিষয়গুলো বারবার ঝালিয়ে নিচ্ছিলেন। তাঁরা ছিলেন ডঃ ঋতব্রতদের ঘরে। অধ্যাপক বিনায়ক দাশগুপ্ত ডক্টর রফিকুল ইসলামকে নিয়ে পাশের একটি পার্কে গিয়েছিলেন। ঘন্টা দুয়েক পর ফিরে এসে অধ্যাপক দাশগুপ্ত তাদের ঘরে ঢুকতে গিয়ে দেখেন ঘরের দরজা খোলা। তিনি খুবই ভয় পেয়ে যান। তাড়াতাড়ি ঘরের মধ্যে ঢুকে দেখেন তাঁর সুটকেস এলোমেলো এবং কোকিল পাখিটিও নেই। তিনি চিৎকার করে ওঠেন। তাঁর  চিৎকার শুনে তিনজন অধ্যাপক ছুটে আসেন তাঁর ঘরে। অধ্যাপক বিনায়ক দাশগুপ্ত  ডঃ পরমব্রত ও ডঃ ঋতব্রতকে বলেন—“আপনারা থাকাকালীন কাউকে এই ঘরের সামনে আসতে দেখেছেন?” অধ্যাপকের প্রশ্নের উত্তরে তাঁরা বলেন— “না তো। এখানে তো কেউ আসেনি। কেন, কি হয়েছে? ” এরপর অধ্যাপক বিনায়ক দাশগুপ্ত তাঁদেরকে বলেন— “তাঁর বেদ ও আবিষ্কৃত ঔষধগুলো কিছুই তিনি পাচ্ছেন না।”

        এরপর বিনায়ক দাশগুপ্ত হোটেল ম্যানেজারের কাছে গিয়ে সমস্ত বিষয়টি জানান। তিনি রুমবয়দের জিজ্ঞাসা করে কোনো সদুত্তর পান না। তারপর হোটেলের সিসি টিভি ফ্রুটেজ চেক করেন। দেখেন একজন পাঞ্জাবী লোক তাঁর ঘরে ঢুকছেন। কেউই তাকে চিনতে পারেন না। খুব কাছ থেকে তার মুখটা দেখার চেষ্টা করেন তাঁরা। কিন্তু অসফল হন। এরপর বিনায়ক দাশগুপ্ত পুলিশের দ্বারস্থ হন। পুলিশ ঐ সিসি টিভি ফ্রুটেজ ভালো ভাবে চেক করে ও কম্পিউটারের মাধ্যমে ছবি এডিট করে বুঝতে পারেন এই ব্যক্তি তাদেরই দায়িত্বে থাকা অধ্যাপক স্টিভ স্মিথ । বিনায়ক দাশগুপ্ত মনে মনে তাদের সন্দেহ করছিলেন। এবার পুলিশ রহস্য উন্মোচন করলে সেই সন্দেহটি বাস্তবে রূপ পায়। এদিকে এই দিন অধ্যাপক বিনায়ক দাশগুপ্তদের দেখাশোনার জন্য অন্য দুজন লোক এসেছিলেন। সেখানেই তাঁর সন্দেহ দানা বেঁধেছিল। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে আসে পাশের কোথাও পুলিশ তাদের খুঁজে পান না। তাদের কোয়ার্টারে গিয়ে দেখেছিলেন তালা বন্ধ।

        পরদিন সেমিনার হলে স্টিভ স্মিথ ও স্টিফেন ফ্লেমিংকে দেখা যায়। বিনায়ক দাশগুপ্ত সেমিনারে বিঘ্ন ঘটবে বলে তখন কিছুই বলেন না। দ্বিতীয় দিনের সেমিনার সকাল দশটা থেকে শুরু হয়। দ্বিতীয় দিন ডক্টর ঋতব্রত চট্টোপাধ্যায় ও ডক্টর পরমব্রত মুখোপাধ্যায় তাদের বিষয় নিয়ে খুব সুন্দর বলেন। সকলেই খুব খুশি হয়ে হাততালি দেন। ডক্টর পরমব্রত মুখোপাধ্যায়ের বিষয় ছিল”রাষ্ট্র ও মানবজীবন সম্পর্ক” এবং ঋতব্রত চট্টোপাধ্যায়ের আলোচনার বিষয় ছিল ” মানবজীবন নির্ভর ভারতীয় অর্থনীতি”। বিকেল চারটার সময় দ্বিতীয় দিনের সেমিনার শেষ হয়। সেমিনারের শেষে অধ্যাপক বিনায়ক দাশগুপ্ত স্টিভ স্মিথ ও স্টিফেন ফ্লেমিংকে পাশের একটি ঘরে নিয়ে গিয়ে জেরা করেন। কয়েক জন পুলিশের লোকও বিনায়ক দাশগুপ্তদের সঙ্গে ছিলেন। পুলিশের সমস্ত প্রশ্নের উত্তরে তারা দুজন জানান — ” তারা এই বিষয় সম্পর্কে কিছুই জানেন না। তারা গতকাল সেমিনারের পর কলেজের একটি কাজে বার্লিন শহর থেকে পঞ্চাশ কিলোমিটার দূরে ছিলেন। ফিরতে ফিরতে রাত এগারোটা বেজে যায়।”পুলিশ তখনও তাদের জানায় নি যে তাদের কাছে প্রমান আছে। তারা দেখতে চান আর কে কে এই ঘটনার সঙ্গে যুক্ত আছে। স্টিভ ও স্টিফেন প্রমানস্বরূপ উপাচার্যকে ডাকেন। তিনি ঘটনাটি ভালো করে শুনে বলেন— “না না আপনাদের কোনো ভুল হচ্ছে। গতকাল বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজে ওনারা দুজন আমাদের সঙ্গেই ছিলেন। এই ব্যাপারে ওনারা দুজনে কিছুই জানেন না। ওনাদের এভাবে আপনারা হ্যারেজ করবেন না।” এই কথা শুনে বিনায়ক দাশগুপ্তরা ও তাদের সঙ্গে থাকা পুলিশেরা আবাক হয়ে যান। এরপর কোনো উপায় না পেয়ে পুলিশের লোক সকলকে পাশেই অবস্থিত বিনায়ক দাশগুপ্তদের হোটেলে নিয়ে গিয়ে সিসি‌‌ টিভির ফ্রুটেজ দেখান এবং ভাল করে সকলে দেখেও কেউ চিন্তে পারেন না। তখন পুলিশ অফিসার একজন প্রফেশনাল আর্টিস্টকে ডেকে প্রথমে চোরের ছবি আঁকান । তারপর দাঁড়ি ও মাথার পাগড়ি উধাও করে আবার আঁকতে বলেন। এবার সবাই দেখেন সত্যিই তো হুবহু অধ্যাপক স্টিভ স্মিথ। উপাচার্যসহ সকলে অবাক হয়ে যান, এটা কীভাবে সম্ভব! একই সময় একজন ব্যক্তি দুই জায়গায়। প্রমান পেয়েও কিছু বলতে পারেন না অধ্যাপক বিনায়ক দাশগুপ্তরা। মনটা একেবারে ভাড়াক্রান্ত হয়ে ওঠে তাঁর। যে যার মতো চলে যায়। কিছুতেই তিনি বুঝতে পারেন না, কিভাবে এটা সম্ভব। অনেক ভেবে চিন্তে তিনি পুলিশ অফিসারকে বলেন—“দেখুন আমার মনে হচ্ছে  অধ্যাপক স্টিভ স্মিথের নিশ্চয় যমজ কোনো ভাই আছে। আমাদের ও কলেজের সবাইকে বোকা বানানোর জন্যে ও এই কাজ তাকে দিয়েই করিয়েছেন। তার উপর আপনারা ভালো ভাবে নজর রাখুন ।” স্টিভ স্মিথের আসল বাড়ি বার্লিন থেকে দশ কিলোমিটার দূরে। পুলিশ তদন্ত করে দেখেন সত্যিই তাঁর কোনো যমজ ভাই নেই। খুবই অবাক করা কান্ড । তাহলে কে এই কাজ করেছেন! 

         অধ্যাপক বিনায়ক দাশগুপ্ত অনেক ভেবে চিন্তে পুলিশ অফিসারকে বলেন—“স্যার আপনি যদি সেমিনারের দিনগুলির সি সি টিভি ফ্রুটেজ চেক করেন তাহলে আসল আসামিকে ধরা সম্ভব হবে। হঠাৎ করে তো কেউ একাজ করবে না। তাছাড়া এখনো এক সপ্তাহ হয় নি আমরা এদেশে এসেছি। আমার বেদকে সকলে সেমিনারেই দেখেছে। এর আগে ওকে কেউ চিনত না।” অধ্যাপকের কথায় যুক্তি থাকায় পুলিশ সেমিনারের দুই দিনের সি সি টিভি ফ্রুটেজ ভালোভাবে চেক করেন। কয়েক বার ভালোকরে দেখার পর হঠাৎ পুলিশ অফিসার লক্ষ করেন, স্টিভ স্মিথের মতো দেখতে একজন ব্যক্তি মঞ্চের সামনে থেকে সেমিনারের আলোচনা শুনছেন। তখন মঞ্চে ছিলেন অধ্যাপক বিনায়ক দাশগুপ্ত ও তাঁর পাখি বেদ। সি সি টিভি ফ্রুটেজে পরিষ্কার ধরা পড়েছে কোকিল পাখিটির দিকে সে লোভী দৃষ্টি দিয়ে তাকিয়ে আছে। দেখে মনে হয়েছে ওই পাখিটি পাওয়ার বাসনা তার মধ্যে প্রবল। সেই সময় স্টিভ স্মিথও মঞ্চের বাঁদিকে একটি আসনে বসে ছিলেন। অর্থাৎ এ থেকে পরিষ্কার স্টিভ স্মিথের মত দেখতে ওই ব্যক্তিই অধ্যাপক দাশগুপ্তের বেদকে চুরি করেছে। এরপর পুলিশ ওই দিনগুলির রেজিস্টার খাতা চেক করেও ওই ব্যক্তির সঙ্গে যোগাযোগ করার মত কোন তথ্য খুঁজে পাননি। অধ্যাপক বিনায়ক দাশগুপ্ত খুবই হতাশ হয়ে পড়েন। তিনি বুঝে উঠতে পারেন না কি করবেন। 

       পরদিন সকাল পাঁচটার সময় অধ্যাপক বিনায়ক দাশগুপ্তের মোবাইল হঠাৎ বেজে ওঠে। তিনি মোবাইল ধরলে একটি অদ্ভুত গলা ভেসে আসে। একজন ব্যক্তি তাকে বলেন— “আপনি খুব হতাশ না? আপনার একটি প্রিয় পাখি মিশিং। আমার কথাটা ভাল করে শুনবেন। আপনার পাখিটি আমার কাছেই আছে। আপনি যদি কোন রকম চালাকি না করে দুই লক্ষ ইউরো নিয়ে কাল দুপুর একটার সময় দেখা করেন, তবে আপনার পাখি আপনি অক্ষত পেয়ে যাবেন। আর যদি চালাকি করেন তাহলে ওর মাথা কাটা দেহ একটা সুটকেস করে আপনার হোটেলে পাঠিয়ে দেব।” এরপর কিছুটা ভয় পেয়ে অধ্যাপক বলেন— “ইউরোগুলি কোথায় নিয়ে আসবো?” তখন ওই ব্যক্তি বলে–“যখন আপনি বাড়ি থেকে বেরোবেন, তখন দিক নির্ণয় আমি ফোনে ফোনেই আপনাকে করে দেব। পুলিশকে জানানোর চেষ্টা একদম করবেন না।”

অধ্যাপক বিনায়ক দাশগুপ্ত ভেবে পারেন না কি করবেন। তারপর তিনি বিষয়টি ফোনে পুলিশ অফিসার সাইমন দুলকে জানান। পুলিশ অফিসার দুল তাকে তার কোয়ার্টারে আসতে বলেন। সেখানে কীভাবে অপরাধীকে ধরবেন তার ছক কষে ফেলেন। পরদিন অধ্যাপক বিনায়ক সকাল দশটা নাগাদ বাড়ি থেকে বেরোন। বাড়ির বাইরে একটা কালো রঙের ক্যাডিলাক গাড়ি দাঁড় করানো ছিল। গাড়ির সামনে গিয়ে তিনি দাঁড়াতেই তার ফোন বেজে ওঠে। অধ্যাপক ফোন ধরলে একজন বলেন– “আপনার সামনের গাড়িটা চালিয়ে সোজা দুই কিলোমিটার চলে আসুন। তারপর পরের পথ বলে দেব।” অধ্যাপক ফোনে বলে দেওয়া দিক নির্দেশ মতো এগিয়ে যান। দুই কিলোমিটার যাওয়ার পর আবার ফোন আসে। সেখান থেকে ডান দিকে কিছুটা গিয়ে একটা তিন রাস্তার মোড় ঘুড়ে সোজা আসার কথা বলেন ফোনে দিক নির্দেশ করা লোকটি। তার কথা মতো অধ্যাপক এগিয়ে যান। এরপর পুনরায় ফোন। ফোনের ওপার থেকে বলেন–“সোজা গিয়ে ডান দিকে একটা মাঠ পড়বে, মাঠের মধ্যে একটা বিশাল গাছ আছে— সেই গাছের কাছেই একটা লাল রঙের গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে, ওখানে আসুন।” অধ্যাপক  কিছুক্ষণের মধ্যে সেই গাছতলার নিকটে এসে হাজির হয়। এবার লাল গাড়ির ভেতর থেকে দরাজ গলায় একজনের কথা শুনতে পান অধ্যাপক। তিনি বলেন — “দুলক্ষ ইউরোর সুটকেসটি লালগাড়ির সামনে রেখে কালো ক্যাডিলাকে গিয়ে বসুন। ওখানেই ডিকির মধ্যে আপনার বেদ ও ঔষধগুলো পাবেন।” ঐ ব্যক্তির কথা মতো সুটকেসটি লালগাড়ির সামনে রেখে কালো গাড়িতে গিয়ে অধ্যাপক বসেন। দুই মিনিট পর ডিকির সামনে গিয়ে ডিকি খুলে দেখেন বেদ ও ঔষধগুলো সেখানে রয়েছে। অধ্যাপক লক্ষ করছিলেন সুটকেসটি নিতে লাল গাড়ি থেকে কে নামছে। তিনি দেখেন, একজন একটা মুখোশ পরে লাল গাড়ির সামনে থেকে সুটকেসটি তোলেন। সঙ্গে সঙ্গে পূর্ব পরিকল্পনা মতো চারটি পুলিশের গাড়ি ওই লাল গাড়িটিকে চার পাশ থেকে ঘিরে ধরে। পালানোর চেষ্টা করেও ওই অপরাধী ব্যক্তি পালাতে পারেন না। পুলিশ অফিসার তাকে ধরে ফেলেন। পুলিশ অফিসার মুখোশ খুললে দেখা যায় জার্মানির বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। সকলে অবাক হয়ে যান। তাঁকে পুলিশ থানায় নিয়ে এসে জেরা করলে জানা যায়, এই কাজে তিনি ছাড়া স্টিফেন ফ্লেমিং,স্টিভ স্মিথ ও স্টিফেন ফ্লেমিংয়ের যমজ ভাই স্টুয়াট ফ্লেমিং যুক্ত। তিনি বলেন — “সেমিনারের প্রথম দিন ঐ আশ্চর্য পাখির খবর স্টিফেন ফ্লেমিং আমাকে দিয়েছিলেন। ঐ পাখি দিয়ে আমরা অনেক অর্থ ও যশ অর্জন করতে পারব বলে ওরা আমাকে লোভ দেখিয়েছিলেন। আমি খনেকের জন্য সব ভুলে গিয়ে ওদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলাম। আপনাদের ভুল পথে চালিতও আমিই করেছিলাম ওদের কথায়। আমায় আপনারা ক্ষমা করে দিন।” ক্ষমাতো দূরে থাক এরপর উপাচার্যের সহযোগিতায় পুলিশ বাকি তিনজনকে গ্ৰেপ্তার করেন। বার্লিন আদালতে তাদের চারজনের জরিমানাসহ একবছর কারাদণ্ড হয়। অধ্যাপক বিনায়ক দাশগুপ্ত পুলিশ অফিসার সাইমন দুলকে অসংখ্য ধন্যবাদ জানান। বলেন– “আপনাদের প্রশাসন এতোটা তৎপর না হলে আমি আমার বেদকে খুঁজে পেতাম না। ও আমার প্রাণস্বরূপ। আপনাদের কাছে আমি চিরকাল কৃতজ্ঞ থাকব।” পরদিন তারা দেশে ফেরার টিকিট কেটে সকলে মিলে ফিরে আসেন। একটা সুখকর অনুভূতির সঙ্গে সঙ্গে একটা শিহরণ জাগানো অনুভূতি নিয়েও তাঁরা দেশে ফিরেছিলেন। এই অনুভূতি তাঁরা কখনোই ভোলেন নি।

বেদ কথা সায়েন্স ফিকশন গল্প – সমাপ্ত

আপনাদের লেখা আমাদের ওয়েব সাইটে জমা দিতে গেলে, অনুগ্রহ করে আমাদের লেখা-জমা-দিন মেনু-তে ক্লিক করুন ও নিজেকে Author হিসেবে Register করুন এবং আমাদের পরবর্তী আপডেট পেতে আমাদের ফেসবুক পেজ অনুসরণ করুন।

error: Content is protected !!