সাল একুশশো দশ, মাস ডিসেম্বর। তারকাখচিত রাত। নিকষ কালো আকাশ। দূর থেকে দূরে এক তারা থেকে আরেক তারায় বিন্দু বিন্দু আলোর কেমন যাওয়া-আসা। নৃপতিনারায়ণ ছাদে পায়চারি করছেন। এক হাতে কফির কাপ, অন্য হাতে ম্যাগনিফাইং গ্লাস। এই গ্লাস যে সে গ্লাস নয়, নৃপতিনারায়ণের নিজের তৈরি করা, আকাশের দিকে মেলে ধরলে তারাগুলোকে ইয়াব্বড় দেখায়, কোনটা নক্ষত্র, কোনটা গ্রহ, কোনটা উপগ্রহ, ঠিক ঠাউর হয়। মাঝে মাঝেই ম্যাগনিফাইং গ্লাসটা আকাশের দিকে তুলছেন, আর কী যেন দেখছেন নৃপতিনারায়ণ। মুখে বিড়বিড় করছেন, ব্যাটা যাবি কোথায়, ঠিক ধরব তোকে বেঁটে মস্তান। হঠাত্ দুদ্দাড়িয়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেলেন। স্টাডিতে ঢুকে কী যেন খুঁজলেন, তারপর সরু একটা পাইপ তুলে নিয়ে সোজা ছাদে। এটাও নৃপতিনারায়ণের নিজের হাতে তৈরি। এ টেলিস্কোপ যে সে টেলিস্কোপ নয়, এটা চোখে দিলে দূরের গ্রহের মাটি পর্যন্ত দেখা যায়। জল, পাহাড়, মরুভূমি, জঙ্গল, যদি থাকে, সব দেখা যাবে স্পষ্ট। টেলিস্কোপ চোখে লাগিয়ে অনেকক্ষণ কী যেন খুঁজলেন তিনি। ব্যাজার মুখ দেখেই মনে হল, যা খুঁজছিলেন, পাননি।
নৃপতিনারায়ণ বিশ্বের অন্যতম সেরা বিজ্ঞানীদের একজন। পৃথিবীর সেরা কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে গেস্ট লেকচারার হিসেবে তাঁর ডাক পড়ে। বিজ্ঞান বিষয়ক আন্তর্জাতিক সেমিনার নৃপতিনারায়ণকে ছাড়া ঠিক জমে না। সেই তিনিই কিনা ঘোল খেয়ে যাচ্ছেন কে এক বেঁটে মস্তানের কাছে!
-ব্যাটা, আমার ছাদে রাতেরবেলায় তোমার কাজটা কী, চাঁদু? বিড়বিড় করতে থাকেন নৃপতিনারায়ণ।
একদিন রাতে ছাদে উঠছেন, হঠাত্ ক্র্যাঁর ক্র্যাঁর, ঘ্যাঁচাং ঘট, কিড়কিড় কিড়কিড় আওয়াজ শুনে থমকে দাঁড়ান।
-কোথা থেকে আসছে শব্দটা? ছাদ থেকেই, ঠিক আন্দাজ করেন নৃপতিনারায়ণ। সিঁড়ির মাথায় ছাদে বেরোনোর আগে ছো্ট্ট একটা ঘর। আস্তে আস্তে সেই ঘরে ঢুকে ছোট্ট জানলাটা খুলে চোখ রাখেন তিনি। ছাদে যা দেখলেন, তাতে চক্ষু চড়কগাছ নৃপতিনারায়ণের। ছোট্ট বিদঘুটে একটা মেশিন, তার ভিতরটা আলোয় মোড়া। নানারকম যন্ত্র একসাথে চলছে। অদ্ভুত সব আওয়াজ। আর মেশিনের পাশে বসে আছে ছোট্ট একটা প্রাণী। অনেকটা মানুষের মতোই দেখতে, তবে খুব ছোট্ট, বেঁটে বামনের মতো, নীলচে গা, হাইট খুব বেশি হলে দুফুট। দুটো কান শরীরের চেয়ে অনেক বড়, চোখ দুটো কাচের গুলির মতো, খুব উজ্জ্বল আলো ঠিকরে আসছে চোখ দিয়ে। মুখে চুরুটের মতো কী যেন, টান দিচ্ছে আর ধোঁয়া বেরোচ্ছে। সেই ধোঁয়ায় সুগন্ধী ছড়াচ্ছে। মেশিনটা ধোঁয়ায় ঢেকে যাচ্ছে। ধোঁয়া পেয়ে মেশিনটা একটু একটু করে বড় হচ্ছে, একটা নীলচে আলো সরলরেখা তৈরি করে আকাশের দিকে ছুটে যাচ্ছে। নৃপতিনারায়ণ চোখের পাতা ফেলতে ভুলে গেছেন। চোখটা একবার রগড়ে নিলেন। তারপর যা দেখলেন, তা বিশ্বাস করা সত্যিই কঠিন। সেই নীলচে আলোর রেখা ধরে নেমে আসছে একের পর এক বেঁটে প্রাণী। অন্তত শ’খানেক বেঁটে প্রাণী তখন কিলবিল করছে নৃপতিনারায়ণের ছাদে। তিনি ভাবলেন, তাঁর স্ত্রী নির্ঝরিণীকে ডেকে এনে দেখাবেন। কিন্তু তাঁর পা আটে গেছে। সন্তর্পণে ঘর থেকে বেরিয়ে ছাদে পা রাখলেন নৃপতিনারয়ণ। মেশিনের দিকে এগিয়ে গেলেন। সঙ্গে সঙ্গে ঘটে গেল দুর্ঘটনা। বোমা ফাটার একটা শব্দ আর জ্ঞান হারালেন নৃপতিনারায়ণ। যখন জ্ঞান ফিরল, তখন তিনি বিছানায়। মাথার কাছে স্ত্রী। পাড়া প্রতিবেশী, যাঁরা ওই গগনবিদারী আওয়াজ শুনেছিলেন, তাঁরাও ছুটে এসেছেন। প্রত্যেকের চোখে বিস্ময়, মুখের ভাষা হারিয়ে ফেলেছেন। হাওড়ার আবাদার অনেকটা ভেতরে হলেও বেশ জনবহুল এলাকায় স্ত্রী নির্ঝরিণী আর পোষা লালমুখো বাঁদর ঘটোত্কচকে নিয়ে থাকেন নৃপতিনারায়ণ। অনেকেই শুনেছেন সেই আওয়াজ, কিন্তু কেউ কোথাও কিচ্ছু খুঁজে পায়নি। পাড়া-প্রতিবেশীদের কিছু বলেননি নৃপতিনারায়ণ। কিন্তু স্ত্রীকে সব খুলে বললেন,
-ওই সব বেঁটে বামুন নেপচুনে থাকে, আমার ছাদে নেমে এসেছিল, কারণ ওরা জানতে পেরেছিল, আমি নেপচুন নিয়ে গবেষণায় অনেকটাই সফল। মানুষ যদি নেপচুনে পা রাখে, তা হলে ওদের বাড়া ভাতে ছাই পড়বে, তাই আমাকে সরাবার প্ল্যান করছে।
-কী সাঙ্ঘাতিক! স্বামীর কথায় আঁতকে ওঠেন নির্ঝরিণী। নেপচুন থেকে তোমাকে মারবে বলে নেমে এসেছে?
-শুধু মারবে না, আমার ফর্মুলাগুলোও চুরি করার ধান্দা ওদের।
-তুমি রাতে আর ছাদে উঠো না বাপু।
-আরে ধুর, ওরা আমার কিচ্ছুটি করতে পারবে না। তুমি দেখতে থাকো, ওই বেঁটে মস্তান, পালের গোদাটাকে আমি ধরবই। ব্যাটা, পালাবে কোথায়? ওকে আবার আসতে হবে।
স্ত্রী বারণ করলেও নৃপতিনারায়ণের ছাদে ওঠা কমেনি, বরং বেড়েছে। নেপচুনের ওই বেঁটেটাকে ধরতেই হবে। আর ওকে যদি বোতলবন্দি করতে পারেন, তা হলে পৃথিবীর ইতিহাসে বিপ্লব ঘটিয়ে ফেলবেন নৃপতিনারায়ণ। নোবেল তখন হাতের মুঠোয়। দুনিয়ার তাবড় বিজ্ঞানীরা দর্শন পাওয়ার জন্য হাপিত্যেশ করবেন। সে সব এখন ভাবছেন না তিনি। এখন একটাই চিন্তা, নেপচুন থেকে নেমে আসা ওই বেঁটে মস্তানকে কব্জা করা।
দিনরাত এক করে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন নৃপতিনারায়ণ। চাঁদ, মঙ্গল, বৃহস্পতিতে মানুষের পা পড়েছে, কলোনি তৈরি হয়ে গেছে। মানুষ যাওয়া-আসা করছে। কিন্তু নেপচুন এখনও ধরাছোঁয়ার বাইরে। পৃথিবীতে নেপচুন নিয়ে গবেষণা কম হচ্ছে না। কিন্তু সবথেকে এগিয়ে আছেন নৃপতিনারায়ণ। হাওড়া জেলার অখ্যাত আবাদায় নিজের বাড়িতেই দিনের পর দিন অসাধ্য সাধন করে চলেছেন নৃপতিনারায়ণ।
সমুদ্রের রোমান দেবতা নেপচুন, টাইটান ক্রোনাসের ছেলে, জিউসের ভাই। আঠারোশো ছেচল্লিশ সালে আবিষ্কার। কঠিন নিউটোনিয়ান পদার্থবিজ্ঞানের প্রয়োগ। পুরোপুরি বৃত্তাকার কক্ষপথ। সৌরজগতের অন্য গ্রহগুলির মতো, নেপচুনের অভ্যন্তরেও চৌম্বক ক্ষেত্র রয়েছে। 1989 সালে ভয়েজার এটি শনাক্ত করে, তার পরেও এর রহস্য উন্মোচন করা যায়নি। নৃপতিনারায়ণের গবেষণা অন্য দিগন্ত খুলে দিচ্ছে। নেপচুনের চৌম্বক ক্ষেত্র পৃথিবীর ঠিক বিপরীত। ইউরেনাস ও নেপচুনের চৌম্বক ক্ষেত্রের অস্বাভাবিক কনফিগারেশনের জন্য তাবড় বিজ্ঞানী নেপচুনের রহস্যভেদ করতে পারেননি। কিন্তু নৃপতিনারায়ণ অন্য ধাতুতে গড়া, প্রফেসর ত্রিলোকেশ্বরের ভাবশিষ্য, অত সহজে হাল ছাড়ার পাত্র নন তিনি। একের পর এক বানিয়ে চলেছেন আশ্চর্য সব যন্ত্র, আর নেপচুনের কাছাকাছি পৌঁছতে চাইছেন। নেপচুনের চৌম্বক ক্ষেত্রটি প্রায় আপেল আকৃতির। সৌর বায়ু, বৈদ্যুতিক চার্জযুক্ত কণার একটি প্রবাহ নিয়মিত এই আকৃতিকে বিকৃত করে। চৌম্বক ক্ষেত্রের মধ্যে আটকে থাকে প্রধানত প্রোটন ও ইলেকট্রন। নেপচুনের গড় ঘনত্ব পৃথিবীর তিরিশ শতাংশের চেয়ে সামান্য কম। নৃপতিনারায়ণ দিনের পর দিন গবেষণা করে দুনিয়াকে দেখিয়েছেন, নেপচুন কার্যত গলিত বরফ ও গলিত পাথুরে পদার্থে গঠিত। অর্থাত্ নেপচুনে পা ফেলতেই হবে।
বেশ অনেকদিন ধরেই নৃপতিনারায়ণের তৈরি রিমোটার যন্ত্রে অনেক দূর থেকে আসা রেডিও সংকেত ধরা পড়ছিল। সেই থেকেই তাঁর চোখমুখ খুশিতে উজ্জ্বল। তার ওপর সেদিন তাঁর ছাদে ওই কাণ্ড। ভীষণ উত্তেজিত নৃপতিনারায়ণ। তবে স্ত্রী সেদিনের পর ভয় পেয়ে গেছেন। নৃপতিনারায়ণের ছাদে ওঠা বন্ধ করতে পারেনি তিনি।
-গিন্নি, ঘাবড়িও না। আমি এর শেষ দেখে ছাড়ব।
রাত নামলেই স্পেশাল ম্যাগনিফাইং গ্লাস আর টেলিস্কোপ নিয়ে তিনি অন্ধকার ছাদে পায়চারি করেন, কফিতে চুমুক দেন আর আকাশের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখেন। অনেক কিছুই তাঁর চোখে ধরা পড়ে। কিন্তু ওদের আর দেখতে পাচ্ছেন না। নৃপতিনারায়ণ জানতেও পারছেন না, ওরা আসছে, আরও রাতে, যখন নৃপতিনারায়ণ ঘুমিয়ে পড়ছেন। নীলচে খুদে শরীর, ইয়াব্বড় কান, মুখে চুরুট নিয়ে পালের গোদা প্রথম নামে ওই কিম্ভূত কিমাকার মেশিনে চেপে, তারপর নীলচে আলোর সরলরেখার ওপর পা ফেলে ফেলে ওরা আসে। প্রতিদিন আলাদা আলাদা, সেই বেঁটে মস্তান ছাড়া প্রতিদিন আলাদা আলাদা একশো জন। নৃপতিনারায়ণের গতিবিধির ওপর ওদের কড়া নজর। নেপচুনের মাটিতে যখন টেলিস্কোপ বেয়ে নৃপতিনারায়ণের দৃষ্টি পড়ে, তখন নেপচুনের বায়ুমণ্ডলে ওরা মিশে থাকে, সেই ক্ষমতা ওদের আছে, তাই ধুরন্ধর বিজ্ঞানীর নজরে পড়ে না। নৃপতিনারায়ণ নিশ্চিত, ওরা নেপচুন থেকেই আসে। কিন্তু নেপচুনে ওরা থাকে কোথায়? কীভাবে থাকে, ওদের জীবনযাত্রাই বা কেমন?
গ্যাস জায়ান্ট নেপচুন। উজ্জ্বল নীল রং। এই রঙের কারণ বাইরের বায়ুমণ্ডলে মিথেনের উপস্থিতি। নেপচুনের একটি বায়ুমণ্ডলে জল-সমৃদ্ধ আবরণ। নেপচুনের বিশাল ভরের সংমিশ্রণ, সূর্য থেকে বিরাট দূরত্ব এবং শক্ত পৃষ্ঠের মতো কিছু না থাকার কারণে জলের আকর্ষণ খুঁজে বের করতে তত্পর নৃপতিনারায়ণ। নেপচুনের গ্যাসীয় বায়ুমণ্ডল গ্রহের ব্যাসার্ধের বাইরের তৃতীয়াংশ দখল করে আছে। বায়ুমণ্ডলে জল, বাষ্প এবং মাইক্রোস্কোপিক ফোঁটা বা বরফ স্ফটিক আকারে রয়েছে। তাঁর গবেষণায় দুনিয়াকে এ সব দেখিয়ে দিয়েছেন নৃপতিনারায়ণ। বাইরের বায়ুমণ্ডল এবং কেন্দ্রের মধ্যে প্রায় এক-তৃতীয়াংশ দূরত্বে, গ্যাসীয় বায়ুমণ্ডলটি ম্যান্টলে পরিণত হয়। বায়ুমণ্ডলে বেশিরভাগ একই উপাদান, হাইড্রোজেন, মিথেন, অ্যামোনিয়া এবং জল। ম্যান্টেলের চাপ জলকে বাষ্পীভূত বা জমাট হতে বাধা দেয়, তাই অনেক জল তরল হিসাবেই আছে। ম্যান্টলের গভীরে অদ্ভুত কিছু ঘটে, জল একটি তাত্ত্বিক অবস্থায় সংকুচিত হয় যা সুপারিওনিক জল নামে পরিচিত। তা কিছুটা তরলের মতো, কিছুটা স্ফটিকের মতো এবং কিছুটা ধাতুর মতো কাজ করে। এতদিন কোনও বিজ্ঞানী সুপারিওনিক জল সরাসরি দেখেননি। তবে কণার রশ্মি ব্যবহার করে নৃপতিনারায়ণ তাঁর পরীক্ষাগারে ক্ষুদ্র নমুনা তৈরি করে ফেলেছেন। মঙ্গল বা শুক্রের তুলনায় নেপচুনে প্রচুর পরিমাণে জল রয়েছে, তবে এটি গ্রহের যান্ত্রিকতায় অনেক আলাদা স্থান দখল করে। নেপচুনের মেঘ জল দিয়ে তৈরি নয়, অ্যামোনিয়া এবং মিথেন দিয়ে তৈরি। নৃপতিনারায়ণ জানেন, নেপচুনের যে কোনও জলের ফর্ম ব্যবহার করতে প্রচুর অসুবিধে। তবে নেপচুনের সুপারিওনিক মহাসাগরে জীবনের সম্ভাবনা একটু একটু করে তুলে আনতে চাইছেন তিনি। তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস, তিনি সফল হবেনই। রাতে তাঁর ছাদে ওই বেঁটেদের নেমে আসার পর থেকে নৃপতিনারায়ণ আরও কনফিডেন্ট।নৃপতিনারয়ণ যখন ছাদ থেকে নেমে যান, রাত যখন আরও গভীর হয়, তখন দুঁদে বিজ্ঞানী জানতেও পারেন না, সে আসে, সেই মেশিনে চেপে, নৃপতিনারায়ণের ছাদের আশপাশে চক্কর কাটে সেই মেশিন, তারপর ছাদে নেমে আসে। কী সব করে, ফের উড়ে চলে যায়। মাঝে মাঝে নৃপতিনারায়ণের ওই বেঁটে মস্তান নেপচুনে ফেরে না, পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল ছাড়িয়ে আরেক বায়ুমণ্ডলে দিব্যি ভাসিয়ে রাখে সেই মেশিন।নৃপতিনারায়ণ ঘুণাক্ষরে জানতেও পারেন না, ওই বেঁটে মস্তানের মেশিন ছাড়াও আরও একাধিক বিদঘুটে দেখতে মেশিনে চড়ে কারা যেন আসে। আকাশে ঘুরপাক খায়, লেজার আলো ফেলে নৃপতিনারায়ণের ছাদে, কিন্তু ছাদে নামতে পারে না। সেই সব মেশিন কোনওটা আসে মঙ্গল থেকে, কোনওটা শুক্র, কোনওটা বৃহস্পতি, কোনওটা ইউরেনাস থেকে। সবাই নামতে চায়, কিন্তু অদৃশ্য এক বেড়াজাল। নৃপতিনারায়ণ কি তাঁর ছাদের ওপর রক্ষাকবচ তৈরি করে রেখেছেন? নাকি অন্য কোনও রহস্য? খুঁজে পায় না ওরা। কীসের টানে নৃপতিনারায়ণের বাড়িতে আসে ওরা? ঠিক কী নিয়ে গবেষণা দুনিয়াখ্যাত এই বিজ্ঞানীর? অন্য গ্রহ থেকে ঝাঁক বেঁধে এই বাড়িটাই কেন টার্গেট? নৃপতিনারায়ণের কথায় নেপচুনের বেঁটে মস্তানের মনেই বা কোন ভাবনা, যদি আদৌ মন থেকে থাকে? নিঃসন্তান নৃপতিনারায়ণ। সারাটাদিন নিজের ল্যাবরেটরিতে কী যেন করেন, বাড়ির চাকর পুঁটিরাম সময়ে সময়ে খাবার দিয়ে যায়। স্ত্রী খুব বেশি বিরক্ত করেন না, গান-বাজনা, বইপত্র, সেলাই-টেলাই নিয়েই থাকেন। নির্ঝরিণী জানেন, তিনি ভাগ্যবতী এমন একজন স্বামী পেয়েছেন। গোটা দুনিয়া তাঁকে সম্মান করে। নির্ঝরিণী এটাও বোঝেন, তাঁর স্বামী যে গবেষণায় রত, তাতে যদি তিনি সফল হল, তা হলে বিপ্লব ঘটবে, পৃথিবীর ইতিহাস নতুন করে লেখা হবে, সূর্য পূর্বদিকের বদলে পশ্চিমদিকেও উঠতে পারে।
একটু বেশি বয়সেই বিয়ে করেছেন নৃপতিনারায়ণ। বিয়ের পর থেকে নির্ঝরিণীকে কী যেন একটা পাচন খাওয়ান। কেমন যেন তেঁতো তেঁতো, মাঝে মাঝে বিরক্ত হন নির্ঝরিণী। স্বামীকে বলেনও নিজের বিরক্তির কথা। নৃপতিনারায়ণ বলেন, খাও, সুস্থ থাকবে, ভাল থাকবে। বলতে নেই, নির্ঝরিণী কিংবা নৃপতিনারায়ণ কখনও রোগভোগে বিছানায় শুয়ে থাকেন না। একটু আধটু সর্দি-কাশি, হাঁচি কিংবা জ্বর হলেও বড় কোনও অসুখ নেই ওঁদের শরীরে। নেপচুন নিয়ে গবেষণা সংক্রান্ত একাধিক তথ্য আন্তর্জাতিক সেমিনারে বহুবার দিয়েছেন নৃপতিনারায়ণ। দেশ-বিদেশের অনেকই জিজ্ঞেস করেছেন, নেপচুনে প্রাণ আছে কি না, সেখানে যাওয়া সম্ভব কি না, মানুষ কোনওদিন সেখানে বসবাস করতে পারবে কি না!নৃপতিনারায়ণ শুধু বলেছেন, সময় এলে সব বলব। আমায় কাজ করতে দাও তো বাপু।নৃপতিনারায়ণের ল্যাবরেটরি পুরু কাচ দিয়ে ঢাকা, বুলেটপ্রুফ, দরজার লক একমাত্র তিনিই জানেন। কাচের দরজার গায়ে একটা ছোট্ট রিমোটের মতো যন্ত্র বসানো। দরজা খুলতে তার গায়ে নৃপতিনারায়ণ হাত বোলান কখনও ঘড়ির কাঁটার দিকে, কখনও বিপরীতে। দরজা খুলে যায়। ল্যাবরেটরিতে নৃপতিনারায়ণের পোষা বাঁদর ঘটোত্কচ ছাড়া আর কারও প্রবেশ নিষেধ। তিনি যখন কাজ করেন, তখন পাশে চুপটি করে বসে থাকে ঘটোত্কচ। অসীম ধৈর্য তার। মাঝে মাঝে নৃপতিনারায়ণের সঙ্গে কথা বলে সে। কেউ অবশ্য তা জানতে পারে না। সবার অলক্ষ্যে তাকেও পাচন খাওয়ান দুনিয়াখ্যাত জ্যোতির্জীববিজ্ঞানী নৃপতিনারায়ণ, নিজেও খান।নেপচুন নিয়ে গবেষণার আগে বৃহস্পতি নিয়েও দীর্ঘ গবেষণা করেছেন নৃপতিনারায়ণ। বৃহস্পতির শীতল উপগ্রহগুলোতে প্রাণের সন্ধান দিয়েছেন এই নৃপতিনারায়ণই। বৃহস্পতির কক্ষপথে থাকা এসব শীতল উপগ্রহগুলি ঠিক কী দিয়ে তৈরি, তা জানতে বেশিদিন সময় লাগেনি তাঁর। নিজের তৈরি স্যাটেলাইটার যন্ত্র বিভিন্ন গ্রহের উপগ্রহের আদ্যোপান্ত জানতে সক্ষম। নৃপতিনারায়ণের এই যন্ত্রই সৌর জগতের বাইরের একটি গ্রহেও প্রাণের অস্তিত্বের আভাস দিয়েছে। অনেক আগে নাসা বানিয়েছিল জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ। নৃপতিনারায়ণের স্যাটেলাইটার অনেক উন্নত, অত্যাধুনিক প্রযুক্তির সংমিশ্রণে তৈরি। মহাবিশ্বে এ রকম আরও অনেক জগৎ ধরা পড়ছে স্যাটেলাইটারে। নৃপতিনারায়ণ জানেন, পৃথিবীর বাইরে যে প্রাণের সন্ধান তিনি দিয়েছেন, সেই সব প্রাণীর বুদ্ধি মানষের থেকে অনেক বেশি। অন্য গ্রহের আবহাওয়া, পরিবেশ নিয়ে নৃপতিনারায়ণের গবেষণা সবাইকে ছাপিয়ে গেছে। ইতিমধ্যেই একাধিক যুগান্তকারী আবিষ্কার করে ফেলেছেন নৃপতিনারায়ণ। এসব গ্রহের প্রতিবেশে এমন রাসায়নিক উপাদানের খোঁজ তিনি পেয়েছেন, যা উৎপন্ন হতে পারে একমাত্র জীবন্ত সত্তার মাধ্যমেই। পৃথিবীতে সামুদ্রিক প্রাণীদের উৎপন্ন একটি গ্যাসীয় পদার্থের মতোই একটি গ্যাসের অস্তিত্ব নৃপতিনারায়ণ খুঁজে পান পৃথিবী থেকে ১২০ আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত একটি গ্রহের প্রতিবেশ থেকে, যার নাম ‘কে২-১৮বি’। এই গ্রহগুলিকে গোল্ডিলকস জোন হিসেবে অভিহিত করেন নৃপতিনারায়ণ। গোল্ডিলকস জোন হল নক্ষত্র থেকে এমন একটি দূরত্বে তাকে কেন্দ্র করে ঘূর্ণায়মাণ কোনও গ্রহের অবস্থান, যেখানে তাপমাত্রা খুব বেশি ঠান্ডাও নয়, আবার খুব বেশি গরমও নয়। অর্থাৎ জল তরল অবস্থায় থাকার মতো উপযুক্ত তাপমাত্রা। শুধু ‘কে২-১৮বি’ গ্রহই নয়, এ রকম আরও অন্তত দশটি গোল্ডিলকস প্লানেটে ধারাবাহিক অনুসন্ধান চালান নৃপতিনারায়ণ। সৌরজগতের বাইরের গভীর মহাশূন্যেও অনুসন্ধান চালান নৃপতিনারায়ণ। নিজের প্রয়োজনে বিভিন্ন যন্ত্র তিনি নিজেই তৈরি করে নেন। নাসার জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ শক্তিশালী, তবে তার অনেক সীমাবদ্ধতা। নৃপতিনারায়ণের তৈরি টেলিস্কোপ অনেক বেশি শক্তিশালী, প্রযুক্তির দিক থেকে অনেক বেশি উন্নত। “কে২-১৮বি” পৃথিবী থেকে আটগুণ বড়। এর অন্যতম কারণ হল ওই সব সৌরজগতের নক্ষত্র থেকে বিচ্ছুরিত আলোকরশ্নির কারণে এসব নক্ষত্রের আশপাশে থাকা ছোট ছোট গ্রহগুলোকে পরিষ্কারভাবে পর্যবেক্ষণ করতে পারেনি নাসার টেলিস্কোপ। “হ্যাবিটেবল ওয়ার্ল্ডস অবসার্ভেটরি”র মতো শক্তিশালী টেলিস্কোপও খুব একটা সুবিধে করতে পারেনি। সৌররশ্নি-প্রতিরোধী ব্যবস্থা সংবলিত “সানশিল্ড” থাকলেও তা যথেষ্ট ছিল না। নৃপতিনারায়ণের টেলিস্কোপ এ সব নক্ষত্রের চারপাশে গোল্ডিলকস জোন-এ থাকা পৃথিবীর মতো ছোট ছোটগ্রহগুলোকে আরও সহজে পর্যবেক্ষণ করতে পেরেছে। ইউরোপিয়ান সাউদার্ন অবসার্ভেটরির এক্সট্রিমলি লার্জ টেলিস্কোপও নৃপতিনারায়ণের টেলিস্কোপের কাছে হার মেনেছে। তাঁর টেলিস্কোপে এত শক্তিশালী আয়না আছে, যা তাঁর বাড়ির ছাদ থেকেও আকাশকে আরও গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেছে। নৃপতিনারায়ণ তাঁর টেলিস্কোপ ও স্যাটেলেটরের মাধ্যমে ব্রহ্মাণ্ডের ওই দূরবর্তী স্থানে নির্গত হওয়া রশ্নি বিশ্লেষণ করে যে পদার্থ থেকে এই রশ্নি নির্গত হচ্ছে, তার ভেতরে থাকা রাসায়নিক বস্তু সম্পর্কে অনেক বেশি তথ্য পেয়েছেন। পৃথিবী থেকে শত শত আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত নক্ষত্রমণ্ডলীতে থাকা গ্রহের থেকে বিচ্ছুরিত আলোর একটি সামান্য কণাও নৃপতিনারায়ণের টেলিস্কোপে ধরা পড়েছে। ঠিক এভাবেই বৃহস্পতির শীতল উপগ্রহ ইউরোপাতে প্রাণের অস্তিত্ব খুঁজে পেয়েছেন তিনি। এর গায়ে রয়েছে বাঘের গায়ে থাকা ডোরাকাটা দাগের মতো রেখা। ইউরোপার বরফে মোড়া ভূপৃষ্ঠের নীচেই সমুদ্র। যেখান থেকে বাষ্প অবিরাম উড়ে মিশে যায় মহাবিশ্বে। ইউরোপায় নাসার ক্লিপার ও জুপিটার আইসি মুনস এক্সপ্লোরার বা ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সির জুস মহাকাশযান অবতরণ করলেও নৃপতিনারায়ণের কাছে তারা হেরে গেছে। যে কারণে আমেরিকা ও ইউরোপের একাধিক দেশ নৃপতিনারায়ণকে হিংসে করে, তাঁর ফর্মুলা বা যন্ত্র চুরির চেষ্টা করে। গভীর রাতে তাই তারা আসে। নৃপতিনারায়ণের বাড়ির ওপরে তারা ঘুরপাক খায়, কিন্তু ছাদে নামতে পারে না। শনি গ্রহের অন্যতম উপগ্রহ টাইটান নিয়েও বিস্তর গবেষণা করেছেন নৃপতিনারায়ণ। নাসার মহাকাশযান ড্রাগনফ্লাই সেখানে নেমেছিল। কিন্তু আসল আবিষ্কার নৃপতিনারায়ণেরই। জলাভূমিতে পূর্ণ উপগ্রহটিতে রয়েছে কার্বনসমৃদ্ধ রাসায়নিকে গঠিত মেঘমালা। এর ফলে উপগ্রহটি ঘিরে রেখেছে অদ্ভুত কমলা ধোঁয়া। জলের সঙ্গে এসব রাসায়নিক পদার্থের উপস্থিতির কারণে নৃপতিনারায়ণের গবেষণা দেখিয়ে দেয়, টাইটানেও জীবনের অস্তিত্বের জন্য প্রয়োজনীয় উপাদান আছে। তাঁর তৈরি একাধিক যন্ত্রে ধরা পড়ে বিভিন্ন গ্রহ, উপগ্রহ থেকে আসা রেডিও সিগন্যাল। আমেরিকার সার্চ ফর এক্সট্রা টেরেসট্রিয়াল ইনটেলিজেন্স বা সেটি ইনস্টিটিউট বহুবার নৃপতিনারায়ণের সঙ্গে যোগাযোগ করে, একাধিকবার আমন্ত্রণ জানায়। আমেরিকাও তাঁকে বহুবার নাগরিকত্ব দেওয়ার জন্য উঠেপড়ে লাগে। কিন্তু নৃপতিনারায়ণ একগুঁয়ে। কারও কোনও কথাতেই কান দেননি তিনি। সেটি ইনস্টিটিউটের কার্ল সেগান সেন্টার ফর দি স্টাডি অফ লাইফ ইন দি ইউনিভার্স- এর ডিরেক্টর ডেনিস কার্বালে তো অনেকবার ভারতে আসেন, নৃপতিনারায়ণের সঙ্গে দেখা করেন, কথা বলেন, কিন্তু তাঁর ল্যাবরেটরিতে ঢোকার পারমিশন পাননি।
নেপচুন নিয়ে গবেষণায় আরও খানিকটা এগিয়ে গেছেন নৃপতিনারায়ণ। সেই বেঁটে মস্তানকে ধরে ফেলবেন এবার, নিশ্চিত। সেই নীলচে আলোর রেখা, যা বেয়ে ওরা নেমে আসে, তারও উত্স খুঁজে বের করে ফেলবেন। নৃপতিনারায়ণ কনফিডেন্সের আগুনে টগবগ করে ফুটছেন। চাঁদ, মঙ্গল, বৃহস্পতি, শনিতে প্রাণের উত্স খুঁজে পেয়েছেন, এবার নেপচুন। ওরা যে নেপচুন থেকেই আসে, তা প্রমাণ করে দেবেন। সেদিন রাতে তাঁর ছাদে যা যা হয়েছে, তাঁর তৈরি ভিডিয়োসনিক যন্ত্রে সবটা রেকর্ড থাকার কথা। ছাদের ওই দৃশ্য দেখার পর তিনি নীচ থেকে চুপিসাড়ে ভিডিয়োসনিক যন্ত্রটি নিয়ে এসে ছাদের ঘরের জানলার ওপরে বসিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু পরে ভিডিয়ো রেকর্ডিং দেখার পর অবাক হয়ে যান নৃপতিনারায়ণ। সেই বোমা ফাটার আওয়াজ আর তাঁর অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার আগে পর্যন্ত ভিডিয়ো থাকলেও পরেরটা কিছু নেই। কোনও ছবি, কোনও অডিয়ো, কিচ্ছু না। ধরেও ধরতে পারছেন না নৃপতিনারায়ণ, কারা ঠিক কী উদ্দেশ্য নিয়ে আসছে। সেদিন রাতেও ছাদে পায়চারির পর ঘুমোতে চলে গেলেন তিনি। বিছানায় শুয়ে এপাশ ওপাশ করছেন, মনের মধ্যে অস্বস্তি। কিছুতেই ঘুম আসছে না। কী মনে হল, ছাদে উঠে এলেন। আবার সেই শব্দ। ছাদে না বেরিয়ে সেই ছোট্ট ঘরটাতে ঢুকলেন। জানলা খুললেন আস্তে করে। ফের সেই দৃশ্য। ছুটে নীচে গিয়ে ভিডিয়োসনিক যন্ত্র এনে জানলার ওপরে রেখে চালিয়ে দিলেন। সেই মেশিনের ভেতর সেই বেঁটে মস্তান, ঠোঁটে চুরুটের মতো মোটা কাঠি, সেই ধোঁয়া, সেই সুগন্ধী, তবে এদিন আরও বেশি কিছু চোখের সামনে মঞ্চস্থ হতে দেখছেন নৃপতিনারায়ণ। এদিন সেই আলোর রেখা ধরে একশো নয়, হাজারে হাজারে সেই ছোট্ট প্রাণীরা নেমে এসেছে। গোটা ছাদ জুড়ে যেন পার্টি চলছে। সেই মেশিনের ভেতর ঠাংয়ের ওপর ঠ্যাং তুলে বসে আছে সেই বেঁটে মস্তান। মেশিনটা ধোঁয়া পেয়ে একটু একটু করে বড় হচ্ছে। বাকিরা তো ছাদে রীতিমতো পার্টি করতে ব্যস্ত। হাতে নিয়ে কী সব চিবোচ্ছে, গায়ে রংবেরঙের আলো, খুব মিহি গলায় তারা কথা বলছে, কিছুই মাথায় ঢুকছে না নৃপতিনারায়ণের। ঠিক তার পরে যা ঘটল, তার জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিলেন না তিনি। অন্ধকার আকাশের বুক চিরে তিরবেগে নেমে এল আরও দুটো বিদঘুটে যান। রকেট, প্লেন এসব কিচ্ছু না, বরং বলা যেতে পারে আনআইডেন্টিফায়েড ফ্লাইং অবজেক্ট। গোঁ গোঁ আওয়াজ আর রকমারি আলোর ঝলকানি। নৃপতিনারায়ণের ছাদে নামার চেষ্টা করছে, কিন্তু পারছে না। সেই দুটি আকাশযান থেকে ছিটকে ছিটকে আসছে লেজার আলো। নৃপতিনারায়ণের ছাদে থাকা সেই সব ছোট্ট প্রাণীর গায়ে লাগছে সেই আলো আর মুহূর্তের মধ্যে ধরাশায়ী হচ্ছে তারা। ঠ্যাংয়ের ওপর ঠ্যাং তুলে দেখে যাচ্ছে বেঁটে মস্তান, কিচ্ছুটি বলছে না। আকাশে চক্কর কাটা দুটো যানের সঙ্গে যোগ দিয়েছে আরও পাঁচ-ছটা ইউএফও। নৃপতিনারায়ণ স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছেন, সেই সব যানে বসে রয়েছে কিম্ভূত কিমাকার সব আশ্চর্য দেখতে প্রাণী। হাতে নানা ধরনের যন্ত্র, সেগুলো যে এক একটা অস্ত্র, সেটা বুঝে নিতে ভূল হল না নৃপতিনারায়ণের। ততক্ষণে নেপচুন থেকে আসা সেই সব ছোট্ট প্রাণীর অনেককেই শুইয়ে দিয়েছে সেই সব অস্ত্র থেকে ছিটকে আসা লেজার আলো। এর পর শুরু হল বেঁটে মস্তানের খেল। যে মেশিনটায় সে শুয়েছিল, সেই মেশিনটা আরও বড় চেহারা নিল। মেশিনের গা থেকে বেরিয়ে এল অনেকগুলো বর্শার ফলার মতো কী যেন। মুখে চুরুটের মতো কাঠি থেকে দমকে দমকে বেরিয়ে আসতে লাগল সুগন্ধী ধোঁয়া। সেই ধোঁয়া বর্শার গায়ে লাগতেই তিরবেগে ছুটে গেল তারা আর নিমেষে ছাদের ওপর চক্কর কাটা যানগুলোকে আঘাত করল, সেগুলো ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে পড়ল ছাদে। আশ্চর্য সব দেখতে প্রাণী, তাদের প্রাণবায়ু বেরিয়ে গেছে। সেই বেঁটে মস্তান ফের মুখের সেই কাঠি থেকে ধোঁয়া ছাড়ল, সেই সুগন্ধী ধোঁয়ার স্পর্শ পেয়ে বেঁচে উঠল নেপচুন থেকে আসা ছোট্ট ছোট্ট প্রাণীগুলো। নৃপতিনারায়ণের অবাক হওয়ার আরও বাকি। সেই মেশিনের দরজা খুলে গেল। ভেতর থেকে বেরিয়ে এল বেঁটে মস্তান। নৃপতিনারায়ণ দেখলেন, মুহূর্তে প্রায় ছফুট লম্বা হয়ে গেল সে। তারপর স্পষ্ট ইংরেজি ভাষায় সে বলল, মিস্টার নৃপতিনারায়ণ পত্রনবিশ, প্লিজ কাম আউট, নো নিড টু হাইড এনি মোর।বাইরে বেরিয়ে এলেন নৃপতিনারায়ণ। হাত বাড়িয়ে দিল নেপচুনের সন্তান।আপনার পাচন আমি চুরি করতে পেরেছি। আপনি ঘুমিয়ে পড়ার পর ল্যাবরেটরিতে ঢুকেছি, আপনি টের পাননি। আপনার কাচের ঘরের দরজা খোলা আমার বাঁ-হাতের খেল। সেই পাচন নেপচুনে নিয়ে যেতে গ্যাসীয় পদার্থের রূপ নেয়। সেটা এই চুরুটে ভরা আছে। আপনি অমর হওয়ার ওষুধ আবিষ্কার করে ফেলেছেন, কিন্তু পৃথিবীর কাউকে জানাননি। আপনি শুধু বলে গেছেন, নেপচুনে প্রাণ খুঁজতে ব্যস্ত আপনি। সবাই সেটাই বিশ্বাস করেছে। আমিই আপনাকে দিনের পর দিন সিগন্যাল পাঠিয়েছি। আপনি বুদ্ধিমান মানুষ। সব বুঝতে পেরেছেন। আমরা সব নেপচুনের সন্তান। ওই পাচনের কল্যাণে আমরা সবাই এখন অমর। এই পৃথিবীতে আপনি, আপনার স্ত্রী আর আপনার পোষা বাঁদর ঘটোত্কচও অমর। পৃথিবীর আর কেউ না জানতে পারলেও ওই মঙ্গল, শনি, বৃহস্পতির প্রাণীরা জানতে পেরেছে। আপনার পাচন হাতানোর জন্য তারা আসতে শুরু করে, কিন্তু আমি বুঝতে পেরে আপনার ছাদের ওপর রক্ষাকবচ বলয় তৈরি করে দিই। ওরা সেটা ভেদ করে আর নামতে পারেনি। ওরা আপনাকে মেরে আপনার পাচনের ফর্মুলা নিয়ে পালিয়ে যেত। সেই পাচন খেয়ে ওরা অমর হয়ে যেত, তারপর একটু একটু করে এই পৃথিবীর সব মানুষকে ওরা খতম করে দিত। আমি তা হতে দিইনি মিস্টার পত্রনবিশ। আবার হাতে বাড়িয়ে নেপচুনের সন্তানকে বুকে টেনে নিলেন নৃপতিনারায়ণ।-আমার একটা অনুরোধ আপনাকে রাখতে হবে।-বলো।-এই পাচন আর তার ফর্মুলা আপনি নষ্ট করে ফেলবেন, কথা দিন। তবে তার আগে আপনাকে বিপরীত ফর্মুলা তৈরি করতে হবে, যাতে করে এই পাচনের প্রভাব শরীর থেকে নষ্ট হয়ে যায়। আমরা, নেপচুনের সন্তানরা কেউ অমর হতে চাই না। পৃথিবীতে এসে আমরা এই সহজ সত্যটা উপলব্ধি করতে পেরেছি। বছরের পর বছর বেঁচে থাকা অনেক কষ্টের। সেই কষ্টের ভাগীদার নেপচুনের সন্তানরা হতে চায় না। আমরা আর পৃথিবীতে ফিরে আসব না। আর আপনিও কথা দিন, নেপচুনে যে প্রাণ আছে, সেটা দুনিয়াকে জানাবেন না। আমরা একটু নিরিবিলি, শান্তিতে বাস করতে চাই। আমরা চাই না, পৃথিবীর মানুষ ওখানে গিয়েও তাদের আধিপত্য বিস্তার করুক, আমাদের বিরক্ত করুক। আমরা হিংসা চাই না, সংঘর্ষ চাই না, ধ্বংস চাই না। আপনাকে আমার খুব ভাল লেগেছিল, তাই আপনাকে রক্ষা করা কর্তব্য মনে করেছিলাম। তাই আমরা রাতে আসতাম আপনার ছাদে। কারণ আমি জানতাম, ওরা আসবে, আপনার ক্ষতি করতে চায় ওরা। তা আমি হতে দিতে চাইনি। কিন্তু আপনি প্রথম থেকে আমাকে শত্রু ভেবে নিয়েছিলেন।নেপচুনের সন্তানকে বুকে টেনে নিলেন নৃপতিনারায়ণ।একটু একটু করে অমরত্বের পাচনের প্রভাব নষ্ট করতে নতুন ফর্মুলা তৈরি করে ফেললেন তিনি। নিজে খেলেন, স্ত্রী আর ঘটোত্কচকেও খাওয়ালেন। রেডিও সিগন্যালের মাধ্যমে একদিন নেপচুনের সন্তানকেও ডেকে পাঠালেন। সেই পাচন তার হাতেও তুলে দিলেন নৃপতিনারায়ণ।ঠিক তার এক সপ্তাহ পর বিশ্বের সেরা বিজ্ঞান পত্রিকায় নৃপতিনারায়ণ পত্রনবিশের একটা প্রবন্ধ বেরোল। তিনি লিখেছেন, নেপচুন গবেষণা তিনি আর চালিয়ে যেতে চান না। নেপচুনে প্রাণের যে সম্ভাবনার কথা বলেছিলেন তিনি, তা কার্যত স্তব্ধ হয়ে গেল। দুনিয়ার তাবড় বিজ্ঞানীরা নানা জল্পনার কথা শোনালেও নৃপতিনারায়ণ চুপ।এর পর প্রায় ছমাস কেটে গেছে। পূর্ণিমার রাত। আকাশ ঝলমল করছে। সেই আকাশ ফুঁড়ে নৃপতিনারায়ণের ছাদে নেমে এল একটা আজব যান। ফের সেই তীব্র বোমা ফাটার আওয়াজ। রাতের চরাচর খান খান করে দিয়ে নৃপতিনারায়ণের বাড়ি ধুলোয় মিশে গেল।পরদিন দেশজুড়ে তোলপাড়। গোটা দুনিয়ার তাবড় মিডিয়া হাজির হাওড়ার আবাদায়। কিন্তু কেউ নৃপতিনারায়ণ, নির্ঝরিণী বা ঘটোত্কচকে আর কোনওদিন খুঁজে পায়নি। নৃপতিনারায়ণ অন্তর্ধান রহস্যের কিনারা কোনওদিন হয়নি।
নেপচুনের সন্তান সায়েন্স ফিকশন গল্প – সমাপ্ত
আপনাদের লেখা আমাদের ওয়েব সাইটে জমা দিতে গেলে, অনুগ্রহ করে আমাদের লেখা-জমা-দিন মেনু-তে ক্লিক করুন ও নিজেকে Author হিসেবে Register করুন এবং আমাদের পরবর্তী আপডেট পেতে আমাদের ফেসবুক পেজ অনুসরণ করুন।
অন্যান্য
স্বপ্নভঙ্গ
পালানরা পালায় না
নতুন পৃথিবী