মাথার হ্যাকার ছোটগল্প – বাসুদেব গুপ্ত
সকালে দাঁত মাজতে গিয়ে মাথাটা বোঁ করে ঘুরে গেল সুকান্ত সান্যালের। অভ্যেসমত চাপাচুপি করে টিউব থেকে দুগ্ধফেননিভ লবণের লাবণ্যে উজ্জ্বল পেস্ট ব্রাশে লাগিয়ে আয়নার দিকে মুখ ভ্যাংচালো। আয়নার ওপারে রোজ তিনি উদয় হন। প্রতিবিম্ববাবু। গোপালের গেন্জী আর পাজামা পরা একটা লোক, খোঁচামোচা দাড়ি, ধূসর চোখে ঘুম ঝরছে বালির মত। সেও কষে মুখ ভ্যাংচায়। নানা ভাবে। বাঁদিকে জিভ বার করে। ডান দিকে জিভ করে। সুকান্ত সান্যাল, ৩৯ পার। ৪০ এর গোড়ায় এসে বয়সটা বাঁদরের মত ঝুলছে। নেমে যাবার ইচ্ছে কিন্তু নিরুপায়।
আজ তিনি নেই। আয়নায় সোজা দেখা যাচ্ছে বেলডান্গার গামছা ঝুলছে। বাইরে হাওয়া উঠেছে ভাদ্রের সকালে। গামছাটা অল্প অল্প দুলছে। মাঝে কেউ নেই, কিচ্ছু নেই।
মাথাটা বিং করে উঠে, মাটিটা যেন দুলে উঁঠলো। সুকান্ত সান্যাল হাতে চিমটি কাটল। জিভ দিয়ে টুথপেস্ট চাটল। কল খুলে চোখে ঝাপটা দিল। সব ঠিকঠাক।
শুধু আমি নেই। মানে আমার ছবি নেই। ভাবতেও ব্যথায় ব্যথায় মন ভরে যেত গায়কের। সুকান্তের মাথা ঘুরতে থাকলো। ধীরে ধীরে বাথরুমের মেঝেতে বসে পড়ল। আমার রিফ্র্যাকটিভ ইল্ডেক্স হঠাৎ শূন্য হয়ে গেল? আমি কি শ্রোডিংগারের বেড়াল? এখানে আছি, ওখানে নেই? আছি, না নেই? বিজ্ঞানের শিক্ষক হওয়ার এই জ্বালা। না পরীক্ষা করে দেখতে হয়। আমি কি কোয়ান্টাম হয়ে গেলাম?
দেওয়ালে হাত ধরে ধরে সুকান্ত জানলার সামনে এসে দাঁড়ালো। উল্টোদিকের জানলায় খেয়া চক্রবর্তী সকালেই ঝাঁটা হাতে অবতীর্ণ। সুকান্ত ওদিকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। না। খেয়াদি আমাকে লক্ষ্য করেন নি। সাহস করে একবার জিভ ভেংচে দিলে। না কোন প্রতিক্রিয়া নেই। হাত ওপরে তুলে এলভিস প্রেসলের মত একটু নেচে দিল। তাতেও না। ভজ গৌরাংগ হল। তাতেও না। খেপে গিয়ে চেঁচিয়ে উঠল এই খেয়া। কি করছিস?
খেয়াদি হঠাৎ এমন অদ্ভুত ডাক শুনে ঘাড় বেঁকিয়ে এদিক ওদিক তাকালেন কিন্তু কাউকে দেখতে পেলেন না। আবার কান পেতে শোনার চেষ্টা করলেন। কিছুই আর শোনা গেল না।
ততক্ষণে সুকান্ত এসে শয্যাশায়ী। মাথার ওপর বালিশ কাঁথা সব চাপিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। পুরনো খাটটা ৪ রিখটারে কেঁপে কেঁপে উঠছে।
সুকান্ত শ্রোডিংগার নয় কোয়ান্টাম নয় স্রেফ ভূত হয়ে গেছে। না মরে। অর্থাৎ ভূতের সমাজেও তার স্থান হবে না। মানুষের সমাজ তো তাকে দেখতেই পাবে না। কি করে কেমন করে এটা হলো তা কিছুতেই মাথায় ঢুকছে না। শুধু কেঁদে গেল একটানা আধ ঘণ্টা। একটা টিকটিকি দেয়াল থেকে লক্ষ্য করে গেল, কিন্তু কেন খাটটা নড়ছে কিছুই তাঁর মাথায় ঢুকলো না।
অদৃশ্য হলেও খিদে পায়। বাজারে তো যাওয়া যাবে না। অগত্যা অনলাইন। একসংগে সাত দিনের মত রুটি দুধ ডিম মাখন। তারপর দু ডজন ম্যাগী। আপাতত এই। সাতদিন বেঁচে থাকা যাবে। ততদিনে একটা কিছু উপায় বার করতে হবেই।
একদিন দুদিন কেটে গেছে অবস্থার কোন পরিবর্তন হয় নি। সুকান্ত আর ঘরে লুকিয়ে বসে থাকতে পারে না। মানুষের মুখ দেখতে ইচ্ছে করে। মজার কথা এই দুদিনে কারও ইচ্ছেও হয় নি সুকান্তর মুখ দেখতে। আমি আছি কিনা নেই তাতে কারো মাথাব্যথাও নেই।
কিন্তু সুকান্ত ভালোবাসে মানুষের মুখ দেখতে। প্রাকমধ্য বয়সেও সুন্দর মেয়ে দেখলে তার বুক কেঁপে ওঠে। মনে হয় বিবর্তনের তো দায় ছিলো না সুন্দরের সৃষ্টি করার। পদার্থবিজ্ঞানে সুন্দরের কোন ব্যাখ্যা হয় না। এসব ভাবতে ভাবতে সুকান্ত সকালের উজ্জ্বল রৌদ্রে হাঁটছিল। তাকে কেউ দেখতে পাচ্ছে না। তাই নিজেই সাবধানে মানুষের স্পর্শ বাঁচিয়ে হাঁটতে হাঁটতে পিছন থেকে কার হাত পিঠে স্পর্শ করলো। বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মত ঘুরে দাঁড়িয়েই দেখা গেল ফ্যাক ফ্যাক করে হাসছে দিলীপ।
দিলীপকে অনেকদিন খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। ও আবার ফেসবুকটুকেও নেই। যাকেই জিজ্ঞাসা করা যায় সে বলে দিলীপ? ওর তো ২০১৯ থেকে কোন খোঁজ নেই। সময় কি চোরাবালি? একটা লোক চুপ করে হারাতে পারে?
সেই দিলীপ। উত্তমকুমারের মত চুলটি ঠিক আছে। শুধু ৫ ফুট ১ হাইটের জন্য ও পকেট হারকিউলিস হয়ে কাটিয়ে গেল। যেমন গান গাইতো তেমনি অভিনয়। টেবিলের ওপর শীর্ষাসন করে টানা ৫ মিনিট থাকতো। তবু এত সত্বেও সব বন্ধু একে একে প্রেম করে বৌ নিয়ে কোটরে ঢুকলো ওর আর কিছু হয় না। তারপর হঠাৎ নিখোঁজ।
দিলীপ কি করে দেখতে পেলো আমাকে? মাথায় গুরগুর করে উঠলো সুকান্তর। কিছু বলার আগেই দিলীপ ঠোঁটে হাত দিয়ে শশশ আওয়াজ করে ওর হাত ধরে টেনে ফুটপাথের কোণে পেয়ারাওলার বসার জায়গায় নিয়ে বসালো। তারপর ফিসফিস করে বলল
- ভয় পাসনি। তুইও যা আমিও তাই। অন্য কেউ আমাদের দেখতে পাচ্ছে না। বুঝলি তো? বল তোর খবর। কি করে তোর আপলোডটা হলো?
তারপর চোখ কুঁচকে ঘড়ঘড়ে গলায় বলল
- এসব শালা ঐ এ আইএর কাজ।
- কিসব বলছিস? আপলোড এআই কিচ্ছু বুঝছি না।
- সে অনেক সাংঘাতিক কথা। সহজে বোঝাতে পারবো না। মোদ্দা ব্যাপার হলো আমাদের বডিগুলো চুরি করা হয়েছে। তোরা বুঝতেও পারিস নি, একটা ভয়ংকর ক্রাইম সিন্ডিকেট চুপিচুপি গোটা পৃথিবীর দখল নিয়েছে।
- সে আবার কি? কন্স্পিরেসি থিওরির পাল্লায় পড়েছিস। আমার তো মনে হয় এটা একটা ইনফেকশন। করোনার কোন ভ্যারিয়ান্ট।
- করোনা মাথা থেকে আর যাচ্ছে না তোদের। শোন যা বলছি। আমাদের বডিগুলো থ্রিডি স্ক্যান করে এইভাবে আপলোড করে দেওয়া হচ্ছে আমাজনের এ ডব্লু এস সারভারে। আর ব্রেনটা স্ক্যান করে চলে যাচ্ছে নিউরাল ডাটা বেসে।
- বেশি টেকনিকাল হয়ে যাচ্ছে না?
- না, মন দিয়ে শোন যা বলি। এরপর এআইএর খেল শুরু। আমাদের প্রোজেক্ট করা হচ্ছে মেটাভার্স থেকে রিয়েল ভার্সে আলট্রা হাই ফ্রিকোয়েনসি দিয়ে বুস্ট আপ করে। এই যে তুই আমি কথা বলছি এটা মেটাভার্সে। কিন্তু নতুন এলগরিদমে আমাদের প্রোজেক্ট করছে রিয়েল ভার্সে।
- তো?
- তো তোর মনে হচ্ছে তুই যেখানে ছিলি সেখানেই আছিস। কিন্তু তুই আসলে তোর রিজেনারেটিভ বুস্টার দেওয়া হলোগ্রাম।
- মানে? তা হলে আসল আমিটা কোথায়?
- সার্ভারে। আসলে আমরা এখন আমরা এখন, লামডা ফাংশন হয়ে গেছি রে সুকান্ত। কেঁদেই ফেলে প্রায় দিলীপ।
- কি হাবিজাবি বকছিস? কোনো মাথা মুন্ডু বুঝি না। আমি সিওর এটা করোনার একটা ভেরিয়েন্ট।
অনেকদিন বিয়ে না করে ও একটাও প্রেম না করতে পেরে দিলীপ ধীরে ধীরে ভেঙে পড়েছিল। লোকমুখে শোনা যেত ওর মাথার চিকিৎসা শুরু হয়েছে। সুকান্ত শেষে এক পাগলের পাল্লায় পড়ল নাকি? তাও আবার অদৃশ্য পাগল!
- আচ্ছা সুকান্ত, এই যে তুই আমি ইনভিজিবল ম্যান হয়ে গেছি সেটা সত্যি না হাবিজাবি?
- সত্যি, কিন্তু করবোটা কি তাই তো বুঝতে পারছি না। মন খারাপ লাগছে। বাজে কথা না বলে একটু গান শোনা দেখি?
- তোর কি মাথা খারাপ হল নাকি। গান ধরি আর চারদিকের লোক ভূতেরা গান গাইছে শুনে ইঁটবর্ষণ না শুরু করে। কাজের কথা শোন। রেজিসট্যান্স পার্টি কাকে বলে জানিস? আমরা একটা রেজিসট্যান্স পার্টি তৈরী করেছি। সব হারিয়ে যাওয়া অদৃশ্য হয়ে যাওয়া মানুষের দল। তোকেও ওরা হাপিস করবে এটা ভাবিনি। তিন বছর অদৃশ্য হয়ে ঘুরে ঘুরে বেড়িয়েছি গ্রামে গন্জে। আজ তোকে দেখে কত ছোটবেলার কথা মনে পড়ে গেল। সেই শিখার ফোন নম্বরটা তোর মনে আছে?
- না। তুই যেটা বলছিলি সেটা বল। উঃ আবার একটা পার্টি। মারপিট খুনোখুনি ভোটের ব্যালট রাহাজানি এর মধ্যে আমি নেই।
- শোন সুকান্ত। তুই আবার স্বাভাবিক দৃশ্য মানুষ হতে চাস কিনা বল?
- চাইতো, পাগলের মত চাই।
- তুই একলা তোর সুরাহা করতে পারবি? কাজ করতে পারবি না, খাবার পয়সা পাবি কোথায়?
- কেন ওয়ার্ক ফ্রম হোম করব? আর আমাদের বডি যারা চুরি করেছে তারা তো কোন কিছু বুঝেই করেছে?
- করেছিল। কিন্তু কোডে বাগ থাকার জন্য প্রোগ্রাম ক্র্যাশ করে গেছে। এখন আমরা বেওয়ারিশ বডি। আছি কি নেই কারও মাথাব্যথা নেই। সার্ভার বন্ধ হয়ে গেলে আমরাও ফুস।
একটু একটু করে মাথায় ঢুকছে সুকান্তর। ফুস শুনে সারা শরীর ঘামে ভিজে গেল হুস করে। হাতপা কাঁপতে লাগল। তাড়াতাড়ি গেটোরেডের বোতল খুলে দিলীপ ওর সামনে ধরতে ঢকঢক করে অনেকটা খেয়ে ইলেকট্রিক্যাল সিগনালগুলো স্থির হলো।
- প্রোজেকশানের ঘাম হয়? ভয় করে?
- সবটাই ভার্চুয়াল। ঘামটাও। ভয়টাও। হ্যাঁ। গেটোরেডের বোতলটাও। বল আমাদের সংগে আসবি কি না?
- কিছুই তো জানিনা তোদের কথা। দুম করে জয়েন করব কি করে ?
- ঠিক আছে, আজ তোর বাড়িতে আমাদের ম্যানিফেস্টো পাঠিয়ে দেব। রিয়েল না। ভার্চুয়াল।
সুকান্ত হতভম্ব হয়ে মাথা নেড়ে রিপিট করলো
- রিয়েল না, ভার্চুয়াল।
এরপর ঘটনা ঘটতে শুরু করলো খুব দ্রুত গতিতে। যাকে বলে ঘটনা প্রবাহ।
প্রথম এজেন্ডা পার্টির ফেসবুক আর এক্স একাউন্ট খোলা। সেটা হয়ে গেছে। গ্রুপ খোলা। তার নাম ভূষুন্ডিপুর ভারচুয়াল। এখন সদস্য সংখ্যা ৮৭৫৬। এই সংখ্যাটা যখন দশলক্ষের নীচে দুটি প্রাইমের গুণফলের সমান হবে তখন সার্ভারের লগইন করার পাসওয়ার্ডটা নাল অর্থাৎ ফাঁকা হয়ে যাবে। তারপর শুরু হবে খেল।
- এত কথা তুই জানলি কি করে? সুকান্তের সন্দিগ্ধ প্রশ্ন।
- কারণ প্রথম লটে যাঁদের হাপিস করা হয়েছিল তাদের ভিতর ছিল এই প্রোজেক্টের চীফ প্রোগ্রামার ও তার টিম।
- সেটা বোকা বোকা হয়ে গেল না? চীফ প্রোগ্রামারকে কেউ হাপিস করে দেয়?
- তুই দেখিস নি টুইটারে কেমন টিমকে টিম বার করে দেওয়া হয়েছিল। আগের দিনে রাজারা প্রথমেই বিশ্বাসঘাতকদের মাথা কেটে ফেলতেন। তারই রকমফের। কিন্তু এই টিমের লীডার আগে থেকেই ব্যাকডোর করে রেখে ছিল যাতে কোনদিন গোলমাল হলে ঘুরপথে সার্ভারের কন্ট্রোল পাওয়া যায়।
- বাবা এতো শাহরুখ খাঁর সিনেমার গল্প।
- ঠিক। কিন্তু এই গল্পের তুই নিজে একটা চরিত্র। হাসি ঠাট্টার ব্যাপার নয়।
ভার্চুয়াল ভূতেরা একটা আইটি সেল বানিয়ে লেগে পড়লো কাজে। রোজ নতুন নতুন সাবস্ক্রাইবার। একটা ইউটিউব চ্যানেল খোলা হলো। সেখানে দিলীপ মেন এংকর। রোজ নতুন নতুন এপিসোড। কি ভাবে মানুষের বডি চুরি হচ্ছে বিটকয়েনে বিক্রি হচ্ছে মাফিয়াদের মধ্যে তার রোমহর্ষক তথ্য।
এ সব কিন্তু শুধু ভারচুয়াল ভূতেরাই দেখতে পাচ্ছে। যেসব মানুষের শরীর আছে এখনও দৃশ্যমান তারা জানতেও পারছে না কি হয়ে চলেছে।
মানুষের সংস্পর্শ বাঁচিয়ে চলাটা দরকার। তাই নতুন নতুন বসতি তৈরী হতে থাকলো ভার্চুদের জন্য। যেখানেই ফাঁকা জমি সেখানেই তৈরী হলো ভার্চুয়াল বড় বড় ফ্ল্যাট। তাদের নম্বর ভূষুন্ডি ০৮৭৯-৭৭ এরকম। মোবাইলের মত। এরিয়া কোড ফ্ল্যাট নাম্বার।
সুকান্ত আবিষ্কার করলেন কিছুদিন পর খিদে আর পাচ্ছে না। ওটা নেহাতই অভ্যাসের জন্য ঝামেলা করেছিল কিছুদিন। না খেলে শরীরে ইনসুলিন বাড়ে না ফুরফুরে লাগে। তারপর যে কারণেই হোক ওজন কমতে কমতে একদম শূন্য হয়ে গেল। অবাক কান্ড। শরীরটা দিব্যি ড্রোনের মত উড়তে লাগল। দুবার হাত পাখিদের মত ঝটপট করলেই। শরীরটা একদিকে হেলিয়ে পা নাড়ালেই দিব্যি পাখির মত এদিক ওদিক ঘোরা যাচ্ছে। দিলীপের মতে ভার্চুয়ালে একদিনেই সব পাওয়ার দিয়ে দিলে কোয়ান্টাম শক লাগবে। তাই ধীরে ধীরে ক্ষমতাগুলো প্রকাশ পায়। সবই প্রোগ্রাম করা। কিন্তু যতদিন না পাসওয়ার্ড পাওয়া যাচ্ছে প্রোগ্রাম পাল্টানো যাবে না।
সেদিন দিলীপ আর সুকান্ত ও নতুন আমদানী দিপ্তেন্দু ভেসে ভেসে চলেছে ঢাকুরিয়ার ওপর দিয়ে। হঠাৎ দিলীপের মাথায় আবার ফিরে এলো শিখা।
- আরে এখানেই তো শিখার বাড়ী…
- ছাড়তো। সে এখন দুই মেয়ের মা। মেয়ে সিবিএসই করে কলেজে পড়ছে দিপ্তেন্দু বলে ওঠে।
- তুমি জানলে কি করে! দিলীপ হঠাৎ রেগে যায়।
দুজনে একসময় প্রতিযোগী ছিল। এখনো সেটা যায় নি। সুকান্ত । তাড়াতাড়ি ওদের থামায়। কিন্তু দিলীপ গোল ধরে বসে ও একবার শিখাকে দেখবে। শুধু তো দেখা।
ভুগল ম্যাপে সব পাওয়া যায়। শিখার বাড়ী খুঁজে দিলো এ আই। শুধু বর্ণনা দিতে হলো শিখার। একে বলে প্রম্পট। শিখার বাড়ীর ব্যালকনি দিয়ে লিভিং রুমে পৌঁছে যা দেখে তার জন্য ওরা প্রস্তুত ছিলো না।
শিখা নাচছে। আর ওর স্বামী তার রীল বানাচ্ছে ইনস্টাগ্রামের। একটু পরে, স্বামীর মনে হল, জামা কাপড় অত পরলে ব্যাপারটা ঠিক জমছে না। রেকর্ডিং থামিয়ে দিয়ে আদেশ হলো আরো খোলা মেলা হবার।
শিখার তাতে জোর আপত্তি। দিলীপ সেটা দেখে ওদের দিকে একবার ঘুরে তাকায়। ভাবটা এই, দেখ শিখা কত ভালো মেয়ে। কিছুক্ষণ জোর জবরদস্তি চলে। শিখাও রাজী নয়, ওর স্বামীও ছাড়বে না। হঠাত স্বামীটি এক প্রচন্ড চড় লাগালো আর সেই আঘাতে মাথা ঘুরে পড়ে গেল শিখা। আলমারির কোণে কপাল লেগে সেখানে এক ইন্চি মত কেটে ঝরঝর করে রক্ত ঝরতে লাগলো।
দুই পুরাতন প্রেমিক আবার ভারচুয়াল। দুজনে মিলে বাঘের মত লাফিয়ে স্বামীকে দেদার মার। ধপাধপ মার পড়ছে, লোকটা কিছুই বুঝতে পারছে না কোনমতে দু হাত দিয়ে বাঁচার চেষ্টা করছে দেথে সুকান্তর খুব মজা লাগল। মার মার দে আরো দুটো।
শিখা কপালে একটা রুমাল চেপে দুচোখে আতংক নিয়ে এই অপ্রাকৃত দৃশ্য দেখতে থাকলো। ভূতে তাঁর স্বামীকে মারছে, তাকেও কি ছেড়ে দেবে?
পাঁচ মিনিট চলার পর দিলীপ বললো
- চল যাই এবারে।
- শিখার সংগে কথা বলবি না?
- নাঃ কি লাভ।
ঠিক সেই সময় হঠাৎ যাকে বলে ধুম মচে গেল। সাবস্ক্রাইবারের সংখ্যা বেড়ে বেড়ে যে প্রায় কাছাকাছি চলে এসেছে গত কাল এটা ওরা কেউ খেয়াল করে নি।
এক মুহূরতের মধ্যে সার্ভারের পাসওয়ার্ড পাবলিক হয়ে যেতেই চীফ প্রোগ্রামার মুত্তুস্বামী অরবিন্দন এলগরিদম রিভার্স করে দিতেই সব বডিগুলো ফটাফট ডাউনলোড শুরু হয়ে গেল। আর ভার্চুরা গ্রামে শহরে কলোনিতে দেখতে থাকলো তাদের বডি ডাউনলোড হতে হতে কেমন করে আয়নায় ফুটে উঠলো চোখ মুখ নাক হাতের আংগুল একের পর এক।
আর শিখা হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল সুকান্তদা আপনি? কখন ঢুকলেন আমাদের বাড়ী? আর দিলীপদা আপনাকে না আমার কাকা বলে দিয়েছিল কোনদিন আমার বাড়ীর ত্রিসীমানায় আসবেন না ? আপনারা ওকে মারলেন?
-বাঃ ওই বদমাশটা তোমার শরীর বিক্রি করছে নেটে, তোমাকে মারধোর করছে আমরা কিছু বলব না?
- না বলবেন না। আপনারা কি পুলিশ নাকি ? লজ্জা করে না আমার বাড়িতে দলবল নিয়ে হামলা করতে? আপনারা কি লালনীলসবুজদের দলে নাম লিখিয়েছেন না কি? বেশ তো ভালো মানুষ ছিলেন এককালে। বেরোন বাড়ী থেকে। এক্ষুনি।
সুকান্ত দিলীপ আর দিপ্তেন্দু তীরবেগে উদ্ভ্রান্তের মত ঊর্ধশ্বাস হয়। পিছনে এক জনতা তাদের পিছু নেয়। আর ঠিক সেই সময় ভাগ্যদেবী অথবা কোন হনুমান টুক করে একটি কলার খোসা ফেলে দেয় ওদের রাস্তায়। সদ্য ছাড়ানো কাঁঠালি কলার খোসা। তাতে পা দিয়ে সটান ধরণীতলে হন সুকান্ত। জ্ঞান হারান।
যখন জ্ঞান ফেরে তখন দেখেন হসপিটালের বেডের পাশে সাব ইন্সপেক্টর শর্মা হাতে লাঠি উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে। একদিকে নার্স ও আর একদিকে আর এম ও মনোযোগ গিয়ে ওর জ্ঞান ফেরা দেখে আর ঘাড় নেড়ে জানায়,
- সেন্স এসেছে। প্রশ্ন করুন।
সুকান্তর আবছা কুয়াশায় মনে পড়ে সন্ধের কথা। পাড়ার চোলাইএর দোকান। একটি মেয়ে, দিলীপ সিং। আসতে আসতে ফিকে হতে থাকে কুয়াশা।
অনেক আবেদন পিটিশান করে ঐ চোলাইএর দোকান তোলা যায় নি। সন্ধে হলেই আসর বসে। ১০ থেকে ৭০ কোন মেয়ে মানুষের সেখান দিয়ে যাবার উপায় নেই। খিস্তি গান ইঙ্গিত আহ্বান, কি নয়। কাল ব্যাপারটা একটু বাড়াবাড়ি হয়ে গিয়েছিল।
শিখা নামে পাশের বাড়ীর মেয়েটি গিয়েছিল বাবার ব্যথার ওষুধ আনতে। ওরাল ক্যানসারের রুগী। পান পরাগ আর বোল কেসরি বোল খেয়ে করাল অসুখের খপ্পরে।
শিখাকে পছন্দ হয়ে যায় দিলীপ সিং নামক নামজাদা নেতার। সোজা এসে হাত ধরে বলে চল। আমার বাড়ী। আমার এক্ষুনি গরম এসে গেছে, এক্ষুনি শোব চল। হ্যাঁ, আজকাল আরে বেশী ধানাই পানাই করেন না নেতাটাইপের ব্যক্তিরা।
সুকান্তর টিউশানী করে ফেরার সময় ওটা। কানে এলো শিখার আর্তনাদ। এক মুহূর্তে যেন মাথায় বিস্ফোরণ হয়ে গেল। অনেক দিনের অনেক হতাশা, রাগ যেন জমে জমে বিস্ফোরণের অপেক্ষায় ছিল।
সুকান্তর মাথায় সেই বিস্ফোরণটা হতেই, সব শক্তি জড়ো করে, এক ঘুষি লাগিয়ে দিল দিলীপ সিঙের মুখে। বেঁটে খাটো গুন্ডা, পরিচিত। একসময় একসাথে ফুটবলও খেলেছে। কিন্তু যেমন যেমন দেশ পিছিয়েছে ওরাও এগিয়ে গেছে নিজস্ব পাতালের দিকে। দিলীপ মাথাটা অবলীলায় সরিয়ে নিয়ে, খানিকক্ষণ ওর দিকে হাঁ করে তাকিয়ে রইল। তারপর খুব স্লো মোশানে পকেট থেকে বার করে মেসিন তাক করল ওর দিকে। তারপর আর কিছু মনে নেই।
- কি মস্তানের জ্ঞান ফিরেছে? তো সেদিন আপনি শিখা মেয়েটির ওপর চড়াও হলেন কেন হঠাৎ কি হলো? দিলীপ সিং মেয়েটিকে বাঁচাতে না এলে আপনি তো ওর শ্লীলতা আর রাখতেন না সেদিন।
- আমি? চড়াও? আমি তো স্যার টিউশানী করে ফিরছিলাম …
- শাট আপ। একদম মিথ্যে কথা বলবেন না। নিন এখানে সই করুন। আচ্ছা আন্গুল ভেঙ্গে গেছে তো টিপছাপ দিন।
সুকান্তর আন্গুল ধরে টেনে বেশ কয়েকটা কাগজে টিপ দেওয়ার পরে শর্মা ইংগিত করেন। একটা ইঞ্জেকশান দেওয়া হয়। গভীর ঘুমে আবার গড়িয়ে পড়ে ধীরে ধীরে কমা থেকে ফুলস্টপের দিকে ভেসে যায় সুকান্ত।
মাথার হ্যাকার ছোটগল্প – সমাপ্ত
আপনাদের লেখা আমাদের ওয়েব সাইটে জমা দিতে গেলে, অনুগ্রহ করে আমাদের লেখা-জমা-দিন মেনু-তে ক্লিক করুন ও নিজেকে Author হিসেবে Register করুন এবং আমাদের পরবর্তী আপডেট পেতে আমাদের ফেসবুক পেজ অনুসরণ করুন।
অন্যান্য
রজকিনী রাই
প্রচ্ছদ
কায়দায় জীয়ন কায়দায় মরণ