ভূত বাংলো ভৌতিক গল্প – সমর আচার্য্য
ইন্টারভিউ দিয়ে চাকরিটা হয়ে গেল প্রবালের। প্রথম জয়েনিং নবাবগঞ্জে। নাম শুনেছে কিন্তু কোনদিন যায়নি। শুনল, বাড়ি থেকে পঞ্চাশ কিলোমিটার মতো রাস্তা।
ছোটখাটো একটা বেডিং আর কিছু টুকিটাকি জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়ে, বাবা মা এবং বাড়ির সবাইকে টা টা করে রওনা হল নবাবগঞ্জের উদ্দেশ্যে।
বেশ ভিড় বাসে চড়ে অনেক কষ্টে নবাবগঞ্জে পৌঁছাল। বাস থেকে নামতেই অদ্ভুত চেহারার একজন প্রবালের দিকে এগিয়ে এসে অদ্ভুত এক হাসি হেসে বলে, কোথায় যাবেন বাবু? একটু ইতস্তত করে প্রবাল বলে, নবাবগঞ্জ ইরিগেশন অফিসে। লোকটি একটু এগিয়ে এসে প্রবালের বেডিংটা নিতে চায়, বলে চলুন বাবু, আমি ওখানকার কর্মী। আপনি আসবেন জেনেই গোপালবাবু আমাকে পাঠিয়েছেন। প্রবাল জিজ্ঞাসা করে, কে গোপালবাবু? লোকটা যেন আশ্চর্য হয়ে যায়, বলে –সে কি, গোপালবাবুকে চেনেন না? আমাদের এছো বাবু। এছো বাবু? সে আবার কে। পরক্ষণেই বুঝতে পারে যে সে এস, ও বাবু মানে সেকশনাল অফিসারের কথা বলছে। চাকরিটা প্রথম হলেও প্রবাল ইঞ্জিনিয়ারিং দপ্তরের বিভিন্ন পোস্টের নামগুলো জানে। বুঝতে পারে প্রবাল, তার এপয়েন্টমেন্ট এর কপি তো এসেই গিয়েছে, তাই হয়তো উনি ওকে পাঠিয়েছেন। এবার বেডিংটা ওর হাতে দিয়ে বলে, তাই, ঠিক আছে চলো। তা কতদূর এখান থেকে? লোকটা নিস্পৃহ ভাবে বলে, এইতো একটু খানি।
সত্যিই তাই, একটু হাঁটার পরেই গঙ্গার ধারে তারকাঁটা ঘেরা লাল রঙের একটা বাড়িতে নিয়ে আসে। বাড়ির বারান্দায় বেডিংটা নামিয়ে বলে, এই হল এছো বাবুর অফিস এবং ঘর। আপনি ডাকুন, আমি একটু আসছি। বলে চলে গেল। প্রবাল কলিং বেলটা বাজাতেই ভিতর থেকে আওয়াজ এল, কে —? প্রবাল বলে, আমি –প্রবাল, প্রবাল ব্যানার্জী। এই অফিসে জয়েন করতে এসেছি।
একটু পরে খুট করে দরজা খুলে একজন সৌম্য দর্শন লোক বেরিয়ে আসেন। জিজ্ঞাসা করেন, আপনি ই প্রবাল ব্যানার্জী। আমাদের নতুন গেজ রিডার? প্রবালের সন্মতি সূচক ঘাড় ঝাকানি দেখে বলেন, আসেন। বলে ঘরের মধ্যে ডাকেন। পুরাতন দিনের, সেই ব্রিটিশ আমলের বাড়ি। মোটা মোটা কাঠের কড়ি বরগা দেওয়া ছাদ। পুরু দেওয়াল। বেশ ঠান্ডা ঠান্ডা। জানালা দরজা সব চওড়া এবং উঁচু উঁচু।
বিশাল কাঠের টেবিলের একপাশে একটা কাঠের চেয়ার, তাতে লাল গদি লাগানো। তার সামনের চেয়ারটাও কাঠের, গদি ছাড়া।
গদিওয়ালা চেয়ারটায় বসে উল্টোদিকের চেয়ারে বসতে বলেন প্রবালকে। বলেন, আমি গোপাল ব্যানার্জী, সেকশলাল অফিসার,দেখি আপনার কাগজ পত্র। স্বরটা কেমন ভাঙা ভাঙা।
সব কিছু দেখে জয়েনিং রিপোর্ট নিয়ে, প্রবালকে জিজ্ঞাসা করলেন, কাজ কি করতে হবে সে আমি কাল সকালে আপনাকে বুঝিয়ে দেব। এখন আপনি থাকবেন কোথায়? প্রবাল বলে, সে আমি কি করে বলবো স্যার, আপনাকেই একটা ব্যবস্থা করে দিতে হবে। আমি তো এখানকার কিছুই চিনিনা। মুহূর্ত গোপালবাবু একটু ভেবে নেন, তারপরে বলেন, জায়গা বলতে আমাদের এই বাংলোতে একটা ঘর আছে। সেখানে আপনাকে কিছুদিনের জন্য এলাও করতে পারি। দেখুন ওখানে থাকতে পারেন কি না।
এতক্ষণ পরে পলাশের মনে পড়ল, আরে গোপাল বাবু যাকে পাঠিয়েছিলে আমাকে আনতে তার কথা তো শোনা হয়নি। জিজ্ঞাসা করল, আমাকে বাস পয়েন্ট থেকে আনতে যাকে পাঠিয়েছিলেন, সে কে? গোপালবাবু আশ্চর্য হয়ে বলেন, কৈ, আমিতো কাউকে পাঠায়নি। তারপর বলেন, এখানে অনেকেই আসে, হয়তো তেমন কেউ আপনাকে পৌঁছে দিয়ে গিয়েছে। কিন্তু –লোকটার কথা বলতে যাচ্ছিল প্রবাল। গোপালবাবু সে কথাই কান না দিয়ে ঘর থেকে একটা চাবি নিয়ে এসে পলাশকে বলে, চলুন।
একটু সামনেই বিশাল একটি বাড়ি। রাজপ্রাসাদের মতো। রঙ ঐ লাল। সামনে অনেকটা প্রশস্ত জায়গা নিয়ে একটা ফুলের বাগান। পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে গঙ্গার উপনদী জলঙ্গি। তার নীলচে স্বচ্ছ জল কুলকুল করে বয়ে চলেছে অদূরের গঙ্গার দিকে।
বাংলোর ঘরের তালা খুলে দিয়ে একটা ঘর দেখিয়ে বললেন, এই ঘরটা —। ঘরের দরজা খুলতেই একটা ভ্যাপসা গন্ধ ভেসে এল, ঘুলঘুলি থেকে কয়েকটা পায়রা পাখা ঝাপ্টে উড়ে গেল। ঘরে আলো নেই। গোপাল বাবুই বললেন, লাইন টাইন সব কাটা আছে, আজকের রাতটা থাকুন, কাল ব্যবস্থা করে দেওয়া যাবে। তারপর বললেন, সামনে একটা ছোট মুদির দোকান আছে, ওখানে মোমবাতি,ম্যাচ বক্স টুকটাক সব পাওয়া যায়। আসলে বাংলোটা অনেকদিন পড়ে আছে। কেউ থাকে না, বা আসেও না। তাই এই অবস্থা।
গোপালবাবু চলে গেলেন। প্রবাল যেন অথৈ জলে পড়ল। তবু উপায় নেই। আপাতত থাকতে হবে। পরে ধীরে ধীরে থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করে নিতে হবে। পুরো চত্বরটা ভীষণ ফাঁকা ফাঁকা। আশপাশে বেশি লোকজন ও নেই মনে হচ্ছে। আপাতত এখনো চোখে পড়েনি প্রবালের। তখন বেলা অনেক হয়ে গিয়েছে। খুব খিদে পায় প্রবালের , সঙ্গে যা একটু চিড়ে ছিল তাই চিবিয়ে দিন কাটে। আজকের রাতটা গোপালবাবুর ঘর থেকে খাবারের ব্যবস্থা হবে বলে গিয়েছেন তিনি। কিছুটা নিশ্চিন্ত হওয়া। উঠে গিয়ে মুদিখানা থেকে মোমবাতি আর ম্যাচ বক্স কেনে। দোকানিটা যেন কেমন অদ্ভুত। মুখে কোন কথা নেই, ভালো করে মুখখানা দেখা ও যাচ্ছে না।
ধীরে ধীরে সূর্য ঢলে পড়ল পশ্চিম আকাশে। ঘনিয়ে এল আঁধার। মোমবাতিটা জ্বালিয়ে নিল প্রবাল। কিন্তু কেন যেন বারবার সেটা নিভে যাচ্ছে। না –বাইরে তো হাওয়া বইছে না, ঘরের মধ্যে তো নয়ই। বুঝতে পারেনা প্রবাল। চুপচাপ বসে থাকে ঘরের মধ্যে। চারিদিক নিঝুম, নিঃশব্দ। শুধু সামনের বাগানে কিছু ঝিঁ ঝিঁ পোকা অবিরাম ডেকে চলেছে। রাত যে কত হল তা- ও বুঝতে পারছে না। প্রবালের ঘড়ি নেই।
কতক্ষণ চুপচাপ বসে থাকার পর, হঠাৎ দেখে সকালের সেই লোকটা খাবারের থালা হাতে উপস্থিত। অন্ধকারে তাকে দেখতে ভীষণ ভয়ঙ্কর লাগছিল। মুখে বলে, গোপালবাবু আপনার খাবার পাঠিয়ে দিলেন। বলেই থালাটা ঘরের ভাঙা নোংরা টেবিলে রাখে। প্রবাল জিজ্ঞাসা করে, এই তুমি? সারাদিন কোথায় ছিলে? গোপালবাবু যে বললেন , তোমায় চেনে না। কিন্তু ততক্ষণে সে হাওয়া। চিরকাল ই প্রবাল খুব সাহসী। কিন্তু এবার যেন কেমন তার ভয় ভয় লাগে। বুঝে উঠতে পারে না, কি করবে। গোপালবাবুকে ডাকবে কিনা ভাবছিল। দেখে গোপালবাবু নিজেই আসছেন তার কাছে। প্রবালকে বলে, কি ব্যাপার আপনি আলো জ্বালেননি কেন? তারপরেই বলেন, বুঝতে, পেরেছি, আলো থাকছে না তো? এই নিন আমি হ্যারিকেন টা রেখে যাচ্ছি। আর এই আপনার খাবার। প্রবাল আশ্চর্য হয়ে বলে, এইমাত্র সকালের সেই লোকটা এসে আপনার পাঠানো খাবার দিয়ে গেল তো। বলেই তাকিয়ে দেখে, কোন খাবার নেই। আরও ভয় পেয়ে যায় প্রবাল। গোপাল বাবুই বলেন, ও আপনার মনের ভুল। এই নিন, এইগুলো খেয়ে নিয়ে চুপচাপ শুয়ে পড়ুন। রাতে কেউ ডাকাডাকি করলে দরজা খোলার দরকার নেই, এমন কি আমি ডাকলেও। প্রবাল এবার খুবই ভয় পেয়ে যায়। গোপালবাবুকে জিজ্ঞাসা করে, কি ব্যাপার আমি কিছুই বুঝতে পারছি না স্যার। প্লিজ বলুন, কোন ভয়ের কিছু নেই তো? গোপালবাবু প্রবালের মুখের দিকে তাকিয়ে বলে, আপনি শুয়ে পড়ুন, যা বলার বা শোনার, কাল হবে। শুধু যেটা বললাম, কেউ ডাকলে সাড়া দেবেন না, বা দরজা খুলে বের হবেন না। বলেই তিনি অন্ধকারের মধ্যে মিলিয়ে গেলেন।
ঘরের দরজা বন্ধ করতে গিয়ে দেখে, দরজার খিল বা হুড়কো কিছুই নেই। খুব ভয় ধরে গেল প্রবালের। খাবার খেতে গিয়ে দেখে, ঠান্ডা বরফ হয়ে গিয়েছে। খিদের জ্বালায় তা-ই মুখে দিল। কিন্তু কি দূর্গন্ধ খাবারে। মনে হলো কত দিনের পঁচা বাসি খাবার। বমি উঠে যাওয়ার জোগাড়। না খেয়ে থালাটা দূরে সরিয়ে রাখে।
গোপালবাবু চলে যাওয়ার পর পাশের ঘর গুলোতে অনেক লোকের চলাচল, কথাবার্তার আওয়াজ শুরু হল। মাঝে মাঝে কান্নার শব্দ ও ভেসে আসে। হঠাৎ দুড়ুম দড়াম শব্দ, কখনো মনে হচ্ছে কেউ কাউকে মারছে। সে চিৎকার করে কান্না করছে।একটি মহিলা কন্ঠ। তক্তাপোষটা দরজায় ঠেসে রেখে তার উপর বসে রইল প্রবাল। ভয়ে হাত পা হিম হয়ে যাওয়ার জোগাড় । একটু চুপ। চতুর্দিকে আবার নিস্তব্ধ। কৌতূহল বশে দরজা একটু ফাঁক করে দেখে, সেই লোকটা আর গোপালবাবু কি যেন বলাবলি করছে, আর ঠিক থাকতে পারে না। হাত পা কাঁপতে শুরু করে। কিন্তু কৌতূহল বড় পাজি। আবার দেখতে যায় বাইরে ওরা কি করছে। আবার দরজা ফাঁক করে দেখে, গোপালবাবু চিত হয়ে ঘাসের উপর শুয়ে আছেন, আর ঐ লোকটা তার মাথায় জল ঢালছে। লোকটার চোখদুটো জ্বল জ্বল করে জ্বলছে। কখনো জল ঢালা বন্ধ করে গলা টিপে ধরছে। এবার আর নিজেকে সামাল দিতে পারে না প্রবাল। ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে ঘর থেকে বের হয়ে সেই মুদিখানার দিকে দৌড়ে যায়। তারপর কি হয়েছে আর মনে নেই তার।
সকালে কোন লোক ঐ রাস্তা দিয়ে যেতে প্রবালকে পড়ে থাকতে দেখে, এবং আশপাশের লোক ডাকে। সবাই উৎসুক হয়ে তাকে জিজ্ঞাসা করে চলেছে, কি হয়েছে আপনার। কিন্তু প্রবাল তখন ও কোন কথা বলতে পারে না। শুধু মুখে গোঁ গোঁ শব্দ করে অদূরে ঐ বাংলোর দিকে আঙ্গুল নির্দেশ করে । আশপাশের লোকের আর বুঝতে অসুবিধা হয় না। তারা জানে এখানে কি হয়।
কতক্ষণ পর প্রবাল ধাতস্থ হলে, একজন বয়স্ক লোক এগিয়ে এসে প্রবালের কাছে সব জানতে চায়। প্রবালের কাছে সব শুনে তিনি মাথায় হাত দিয়ে বলে ওঠেন, রাম –রাম –রাম। আপনি বড় বাঁচা বেঁচে গিয়েছেন। তারপর বলে, আপনি যে অফিসে জয়েন করতে এসেছেন, সেটা এখন আর এখানে নেই। আরও কিলোমিটার খানেক দূরে নতুন বাড়িতে চলে গিয়েছে। প্রবাল বলে, তাহলে কাল আমাকে যে ব্যক্তি নিয়ে এল, গোপালবাবু এরা কারা? ভদ্রলোক বলেন, সে অনেকদিন আগের কথা। এইখানেই এই বাংলোতেই গোপালবাবু এসেছিলেন পোস্টিং হয়ে। এই বাংলোয় থাকতেন। বাংলোর কেয়ার টেকার খগেন থাকতো এই ছোট ঘরে। খগেন দেখতে খুব ভয়ঙ্কর ছিল। কিন্তু তার বৌটি ছিল খুব সুন্দরী। গোপালবাবু তখন ব্যাচেলর। যা হওয়ার তাই হয়েছিল। একদিন সকালে সবাই আমরা দেখলাম খগেনের বউ গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলছে, আর পাশে গোপালবাবু আর খগেন রক্তাক্ত অবস্থায় প্রাণহীন দেহে পড়ে আছে। তারপর থেকে এই এলাকায় আর কেউ বেশি আসে না। কিছুদিন পর অফিস উঠিয়ে তাদের নতুন বিল্ডিং এ নিয়ে যায়। প্রবাল জিজ্ঞাসা করে, তাহলে কাল যে মুদিখানা দেখলাম, সেটা ? ভদ্রলোক বলেন, সব তিনাদের কারসাজি। কৈ দেখুনতো, এখন আছে কিনা। প্রবাল দেখে, সত্যিই তো কোন মুদিখানা নেই, না আছে গোপালবাবুর ঘর। শুধু দাঁড়িয়ে আছে ভূতের মতো ঐ লাল রঙের বাংলোটা। ভদ্রলোক এবং আশপাশের লোকের কথায় যেটা এখন ভূত বাংলো বলে পরিচিত।
ভূত বাংলো ভৌতিক গল্প – সমাপ্ত
আপনাদের লেখা আমাদের ওয়েব সাইটে জমা দিতে গেলে, অনুগ্রহ করে আমাদের লেখা-জমা-দিন মেনু-তে ক্লিক করুন ও নিজেকে Author হিসেবে Register করুন এবং আমাদের পরবর্তী আপডেট পেতে আমাদের ফেসবুক পেজ অনুসরণ করুন।
অন্যান্য
রাজবাড়ী রহস্য
ব্রহ্ম দৈত্য
প্রত্যাবর্তন