কলম পাতুরি

ভাবনা আপনার প্রকাশ করবো আমরা

বুধুয়া

বুধুয়া ছোটগল্প- সন্দীপ কুমার বিশ্বাস

ঐ যে লালমাটির শীর্ণ পথরেখাটা যেখানে শেষ হয়েছে সেখান থেকেই আমাদের গ্রামটি শুরু।পঞ্চাশ-একশো ঘর পরিবার নিয়েই আমাদের ‘আদিবাসী’গ্রাম। আমি এই গ্রামের ছেলে আছিক বটে। নাম আমার বুধুয়া আছেক বটে। এই গ্রামের প্রত্যেকটা পরিবার আমার পরিবার। উহাদের সুখ-দুখের সাথী আমি। গ্রামের শেষ বাড়িটা আমাদের বাড়ি। খড়ের চাল দেওয়া হাড় জিরজিরে বাড়িটাই আমার কাছে স্বপ্নের বাড়ি। এই বাড়িতে মায়ে-পোয়ে দু-জনে মিলে থাকি। কোন ছোটবেলায় বাপ-টাকে হারায়ছি বটে।দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়তে লড়তে ‘মা’ আমার জীর্ণ-শীর্ণ হয়ে গেছে। আর হবে নাই বা কেন। পরের বাড়ি র ফাইফরমাশ খাটতে খাটতে বহু বছর কেটে গেল। মাঝে-মাঝে যখন সংসার আর চলতো না ‘মা’ আমার পা’য়ে হেঁটে দূরের জঙ্গল থেকে কেন্দুপাতা সংগ্ৰহ করতো তাঁর সঙ্গী-সাথীদের সাথে। তখন আমি খুব ছোট্ট-টি ছিলাম। অকারনে কান্নাকাটি করে জেদ ধরতাম মা’য়ের সাথে যা’ব বলে। মা আমায় ভুলিয়ে গল্প বলে ঘুম পাড়িয়ে রেখে চলে যেত। তখন কিছু বুঝতাম না। আজ আমি লায়েক হয়ছি বটে এখন বুঝতে পারি। ক্লান্ত দেহে কেন্দুর বোঝা নামিয়ে একটু হেসে বলত কী রে সোনা তোর বুঝি ডর করছিল। এইতো আমি এসে গেছি। আর তোর ডর করবে না। তখন কি করব ভেবে না পেয়ে মায়ের আঁচল-টা টেনে নিয়ে চুপচাপ কেঁদে চলতাম। এরকম যে কতদিন হয়েছে মান-অভিমানের খেলা। গ্রামের প্রাথমিক স্কুলের পাঠ শেষ করে যখন দূরের স্কুলের নবম ক্লাসে উঠলাম লম্পের আলো জ্বালিয়ে ‘মা’ আমায় পাশে বসে আমার পড়াগুলো খুব মন -দিয়ে শুনতো আর নানা প্রশ্নবানে আমাকে ব্যতিব্যস্ত করে তুলতো। কারণ, ‘মা’ যে আমার নিরক্ষর। পড়তে পড়তে হঠাৎ যখন ঢুলুনি আসত চোখে ক্লান্ত কন্ঠে মা আমায় বলতো ও বুধুয়া,বুধুয়া রে তোর নিজেকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য একটু পড়-না রে। তখন কিছু বুঝতাম কিছু বুঝতাম না। এভাবেই রাত গড়িয়ে দিন, দিন গড়িয়ে রাত আসতো। সময়ের হাত ধরে মাস বছর পার হয়ে যেত। একটু একটু করে সময়ের সাথে জীবন যুদ্ধের নানান অভিজ্ঞতা এসে ধরা দিতে থাকলো। মাধ্যমিক পাশ করে উচ্চ মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে এক্বেবারেই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্ৰি নিয়ে জীবন যুদ্ধের মাঠে নেমে পড়লাম। আমি বুধুয়া দরিদ্র আদিবাসী ঘরের ডাকাবুকো ছেলে বুধুয়া।আমাকে এক ডাকে চেনে এই গাঁয়ের লোক।আমাকে সম্মান করেও বটে।কারণ আমি উহাদের বিপদে-আপদে যেমন পাশে থাকি তেমনি এ গাঁয়ের প্রথম ডিগ্ৰিধারী ছেলে।গাঁয়ের লোক আমাকে নিয়ে গরব করে।এই যে আমি এত সুন্দর সুন্দর কথা কইছি এ তো পড়াশুনো জেনেছি বলেই তো কইছি। শহুরে হাওয়া আমার কথার মধ্যেও এসে গিয়েছে। ঐযে দূরে নীল আকাশের গায়ে পাহাড়ের ধারে যে জঙ্গল শুরু হয়েছে ওই জঙ্গলকে ছোট থেকেই হাতের তালুর মতো চিনি। উখানকার হরিণ, বুনো শুয়োর, হাতির পাল ও সুন্দর সুন্দর পাখিদের আওয়াজ শুনলে ছোটবেলা থেকেই মন ভালো হয়ে যেত। উখানকার বনের শুকনো পাতার মর্মর ধ্বনি আজও আমাকে ডেকে ডেকে নিয়ে যায় উহার ধারে। আনন্দে ছুটে চলি বনের এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত। খুব গরমের সময় শুকনো গাছের ডালে ডালে যখন আওয়াজ উঠত তখন উহাদের ঘর্ষনে মাইলের পর মাইল জ্বলে-পুড়ে সব খাক্ হয়ে যেত। বনের পশু, পাখ-পাখালী গুলো কেমন যেন অস্থির হয়ে উঠতো পালানোর জন্য। তা দেখে মনটা কেমন যেন ভারী হয়ে আসতো। আমি বুধুয়া আজ লায়েক হইছি বটে। সরকারি চাকরির পরীক্ষা দিতে দিতে আজ আমার ভাগ্যে বনরক্ষীর চাকরি-টা এসে জুটেছে। তাই যেতে হবে দূরে কোন এক জঙ্গল পাহারাতে। যদিও আমি একা না দু-একজন সঙ্গী -সাথীও আছে, তারাও যে এই একই কাজ পেয়েছে। মনের মত কাজ পাওয়াতে মনের আনন্দ ধরে রাখতে পারছি না। কাল এ গ্রামের বন্ধু-বান্ধব ও মা-কে ছেড়ে অনেক দূরের জঙ্গলে যেতে হবে। শেষ মুহূর্তের গোছগাছ চলছে। আমার সাথে আমার বাল্যবন্ধু আমাকে পৌঁছাতে নিয়ে যাবে। আমি কোথায় থা’কবো তা দেখতে যাবে। ও’কে শেষ মুহূর্তের নির্দেশ দিয়ে বললাম বন্ধু তুই তো গ্রামে যখন থাকবি আমার মা’কে একটু দেখিস। তার যেন কষ্ট না হয় আর মাঝে-মাঝে আমার খবর তা’কে দিস। ‘মা’ আমার তাতে ভালো থাকবে। গোছগাছের মধ্যে আমি আমার বাপের দেওয়া একমাত্র শেষ সম্বল’ লগুড়’-টা যত্ন করে বেঁধে নিলাম। ওটা দিয়ে এতদিন এ জঙ্গলে ঘুড়ে বেড়াতাম। ভোর হতে না হতেই বাল্যবন্ধু কে নিয়ে গ্রামের পথে বেরিয়ে পড়লেম ট্রেন ধরার উদ্দেশ্যে। ইস্টিশান গ্রাম থেকে কিছুটা দূরে। ইস্টিশানে এসে ট্রেনের টিকিট কেটে গন্তব্যে যখন পৌঁছলাম তখন শেষ বিকেলের আলো এসে পড়ছিল আমাদের গায়ে। আমি ও আমার বাল্যবন্ধু সরকারের দেওয়া নির্ধারিত ঘরে উঠলাম। গিয়ে দেখি আরও একজন শহুরে বাবু গোছের একটা ছেলে ঐ ঘরে আগেই এসেছে। ওর সঙ্গে পরিচয় সেরে গল্প -গুজবে কিছু সময় তিনজনের কেটে গেল। নাম ওর অমিত। আজ থেকে আমরা দুজন এক ঘরে থা’কবো । অমিত আমাকে সঙ্গী পেয়ে খুব খুশি। আমার বাল্যবন্ধু ফাগান এর সাথে অমিতের আলাপ জমে গেল। সূর্য ওঠার সাথে সাথে আমাদের বিদায় জানিয়ে ফাগান বেরিয়ে গেল গাঁয়ের বাড়ির উদ্দেশ্যে। আমি আর অমিত কাজের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লাম। এ-ভাবে দিন যায়, মাস যায়, অবশেষে আমরা কিছুদিনের জন্য হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। কিছুদিনের জন্য বাড়ি এসে মায়ে -পোয়ে একসাথে কাটালাম। সময় চলে গেল বন্ধু-বান্ধব ও অন্যান্য পরিবারের সাথে। আমার মাইনের কিছু টাকা দিয়ে মায়ের জন্য একটা মোবাইল ফোন কিনে দিয়ে এলাম বন্ধুর কাছে যাতে ও আমার সাথে যোগাযোগ রাখে আমার খবর মা’কে দিতে পারে। আনন্দের রেশ কাটতে না কাটতেই আবারো কাজের ভিড়ে হারিয়ে গেলাম আমি আর অমিত। আজ সকাল থেকেই আকাশের সাথে মেঘের খুনসুটি চলছে। কেউ কাউকে সমঝে চলছে না। আমরা দুজনে কাজ সেরে ঘরে ঢোকার আগেই এমন হুড়মুড়িয়ে ঝাঁপিয়ে বৃষ্টি এসে হাজির হল তা’তে আমরা অর্ধেক ভিজে গেলাম। জামা কাপড় ছেড়ে সান্ধ্য আড্ডায় সবেমাত্র যেই বসেছি তার কিছুক্ষণ পরেই বড় সাহেবের ফোন এল অমিতের ফোনে। জরুরী ভিত্তিতে আমাদের দু-জনকে আজ রাতে বন টহলে যেতে হবে। অন্যান্য যারা আছে তারাও যাবে। কিন্তু তাদের সংখ্যা কম থাকাতে আমাদের উপর দায়িত্ব এসে পড়ল। যাহোক, কি আর করা যাবে? তড়িঘড়ি করে আমরা দু-জনা বেরিয়ে পড়লাম অবশেষে। আমরা বনের উত্তর দিকে টহলে যাব সে-দিকটার দায়িত্ব পড়েছে আমার আর অমিতের। অন্যান্য যারা আছে তাদের বনের অন্যদিকে দায়িত্ব পড়েছে। রাত বাড়ার সাথে সাথে বৃষ্টির জোর বাড়তে থাকল। আমরা দু-জন সেই বৃষ্টির ভিতর টহল দিতে থাকলাম। বৃষ্টির আওয়াজের ভিতর বিভিন্ন ধরনের ভৌতিক-আদি ভৌতিক সব শব্দ ভেসে আসতে থাকলো। অমিত এই আওয়াজ শুনে ঘাবড়ে গেল। আমি ওকে বললাম তোর কি ডর করছে। সে মুখে কিছু বলল না। কিন্তু আমি ঠিক বুঝতে পারলাম ও ভীষণ ভয় পেয়েছে। যেহেতু ও শহরের ছেলে। আমি বললাম আমি বু ধুয়া আছি ।
বন আমাকে ডরায় আমি উহাকে ডরাই না।উহাকে আমি হাতের তালুর মতো কোন ছোটবেলা থেকেই চিনি। তু ইধার-টা দেখ। আমি বনের ভিতর দিকটা যেখান থেকে আওয়াজ হচ্ছে একটু দেখে আসি। এই যে দেখছিস আমার বাপের দেওয়া ‘লগুড়’-টা এইটা যতক্ষণ বুধুয়ার কাছে থাকবে ততক্ষণ ভূত-প্রেত ,হিংস্র প্রাণী কাছে ঘেঁষতে পারবে না। এছাড়া তো সরকারের দেওয়া অস্ত্র তো আছে-ই। তুই চিন্তা করিস না রে শহুরে বাবু। অমিত কয়েকবার বুধুয়াকে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করল। কিন্তু তার বলার আগেই বুধুয়া অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। অমিত বনের এধারে একা টহল দিতে থাকল। নীরবতা ভেঙে ঝিঁ ঝিঁ পোকাও ব্যাঙের ডাক আওয়াজ দিচ্ছে। এভাবে কিছুক্ষণ কাটানোর পর অমিতের সম্বিৎ ফিরতেই দেখল সে অনেকটা জায়গা টহল দিয়ে ফেলেছে। অথচ এখনও বুধুয়া ফিরে আসেনি। অমিত রীতিমত ভয় পেয়ে খুব জোরে ‘বুধুয়া’ ‘বুধুয়া’ বলে বারকয়েক ডেকে উঠল।ঐ যে দূরে কি একটা ক্ষীণ আওয়াজ শোনা যাচ্ছে না। অমিত পায়ে পায়ে কয়েক পা এগোতেই ক্ষীণ আওয়াজ-টা আরও স্পষ্ট হয়ে উঠতে থাকল। এক ভারী স্পষ্ট গোঙানির আওয়াজ। অমিত তখন পকেট থেকে ফোন-টা বের করে ওর উপরওয়ালার কাছে ফোন করল। আর্জি জানালো অন্য যারা বনরক্ষী আছে তাঁদেরকে এক্ষুনি পাঠানোর জন্য। এক এক করে যখন অনেকে হাজির হল সবাই মিলে ভারী গোঙানির আওয়াজ শুনে সেদিকে যেতে আরম্ভ করল। গোঙানির আওয়াজ-টা কেমন ক্ষীণ হতে আরও ক্ষীণ হয়ে আসছে। অমিত ও অন্যান্য বনরক্ষীরা মিলে অনেক খোঁজাখুঁজির পর একটা জায়গায় দেখতে পেল সরু নালা দিয়ে যে বৃষ্টির জল গড়িয়ে যাচ্ছে তার রঙ লাল। কিছুটা দূরে ঝোপের ধারে ডাকাবুকো ‘বুধুয়ার’ দেহটা পড়ে আছে। চারিদিকে চাপ চাপ রক্ত। পিঠে বুকে মাথায় শতশত হিংস্রতার কালশিটে দাগ । সেই অন্ধকারের ভিতর শত সহস্র হিংস্রতার দানবিক রূপ ফুটে উঠেছে ‘বুধুয়ার’ সারা শরীর জুড়ে। এই হিংস্রতার পাশবিক রূপ রাতের অন্ধকারে এঁকে দিয়েছে একদল স্বার্থান্বেষী চোরাশিকারি ও গাছ কাটার দল। আবারও ভোর আসবে পৃথিবী হবে আলোকিত। আবার ও বনের প্রান্তে জোৎস্না নামবে, আবারও ঘন অন্ধকার রাতে কোন এক মায়ের কোল খালি হবে।আমরা শুধু নির্বাক হয়ে দেখবো হয়তো শুধু-ই দেখবো। মাথায় হাত দিয়ে অস্ফুটে বলে চলে অমিত।

বুধুয়া ছোটগল্প- সমাপ্ত

আপনাদের লেখা আমাদের ওয়েব সাইটে জমা দিতে গেলে, অনুগ্রহ করে আমাদের লেখা-জমা-দিন মেনু-তে ক্লিক করুন ও নিজেকে Author হিসেবে Register করুন এবং আমাদের পরবর্তী আপডেট পেতে আমাদের ফেসবুক পেজ অনুসরণ করুন।

error: Content is protected !!