চিত্রশিল্পী শ্রী শুভ সরকার সঙ্গে সৌরভ ও কলমে উৎপল চক্রবর্তী (কলম-পাতুরি)।
আজ আমরা এমন একজন বাঙালি শিল্পীর সঙ্গে কথা বলব যিনি রংতুলির যাদুতে মুগ্ধ করেছেন দেশ বিদেশের অগনিত মানুষকে। আর যাঁর ঝুলিতে রয়েছে বহু কালজয়ী ব্যক্তিত্বের কথা ও কাহিনী, যা শুনলে পরে রোমাঞ্চিত না হয়ে পারা যায় না। এক লহমায় হারিয়ে যেতে হয় কয়েক যুগ আগে। সেই বর্ষীয়ান চিত্রশিল্পী হলেন মাননীয় শ্রী শুভ সরকার তাঁর সঙ্গে একান্তে আলাপচারিতায় আমি সৌরভ মিত্র ও কলমে উৎপল চক্রবর্তী (কলম-পাতুরি)।
প্রশ্নঃ— নমস্কার। কলম পাতুরির পক্ষ থেকে বিনম্র শ্রদ্ধা ও শুভেচ্ছা। কেমন আছেন বলুন?
উত্তরঃ— নমস্কার। আমার তরফ থেকেও কলম পাতুরির জন্য আন্তরিক ভালবাসা ও শুভেচ্ছা। প্যান্ডেমিক, লক ডাউন ইত্যাদি নিয়ে চলার প্রায় দু’বছর পর এই প্রথম আমরা যেন একটু বুক ভরে শ্বাস নিতে পারছি। অজয় নদীর তীরে কাশফুলের ভরা যৌবন আর আসন্ন শারদীয়ার আবহ আমাদের মনেও এবার যেন বেশ ভালই দাগ ফেলেছে। তাই ভাল আছি বলতে কোনও দ্বিধা নেই।
প্রশ্নঃ— ধন্যবাদ দাদা। আচ্ছা, প্রথমেই যদি জিজ্ঞেস করি আপনি ঠিক কবে থেকে আঁকা শুরু করলেন বা আঁকার প্রেরণা লাভ করলেন?
উত্তরঃ— তাহলে বলব,” আজ থেকে প্রায় ৫৮ বছর আগে ১৯৬৪ সালে। মনে আছে সেই সময়ে আমার ঠাকুমা শ্রীমতি
সরোজিনী সরকার শান্তিনিকতনে গুরুদেবের এক বিশেষ দায়িত্ব পালন করতেন। আমরা থাকতাম বার্ণপুরে। তিনি এসে আমার বাবাকে বললেন, “তোর ছোট ছেলেকে নিয়ে চললাম।”
বাবা বললেন, ‘কোথায়?’
‘শান্তিনিকেতনে।’ তারপর থেকে আর আমাকে পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। সেখানে থাকার সময় যে সব শিক্ষক শিক্ষিকাকে পেয়েছি, সেখান থেকেই এই আঁকার ইচ্ছাটা যেন আমার মজ্জায় প্রবাহিত হতে থাকল।
প্রশ্নঃ—এখনকার কংক্রিটের জঙ্গলে আমাদের ছোটবেলা একরকম। আর আপনাদের সময়টা ছিল একদম অন্যরকম। যদি বলেন আপনার ছোটবেলাটা ঠিক কেমন কেটেছে?
উত্তরঃ—আমার ছোটবেলা তো খুবই সুন্দর কেটেছে। এককথায় দুর্দান্ত। আমি গাছে উঠতে পারতাম। আম, জাম, পেয়ারা সহ কত গাছে যে উঠেছি তা বলে শেষ করা যায় না! এছাড়া আমলকি, বয়ড়া হরিতকী কোড়াতাম। ফল চুরি করতাম। তাড়াও খেতাম। মনে আছে আম গাছে উঠে কাঠবিড়ালির বাচ্চা নিয়ে বাড়িতে আনার শখ ছিল আমার। বাড়িতে পুষতাম। কোনওটা তাড়াতাড়ি মারা যেত। কোনওটা আবার অনেক দিন আমাদের সঙ্গ দিত।
প্রশ্নঃ— আচ্ছা। এই যে খেলতে খেলতে প্রকৃতি দেখা। এটা কী আপনাকে শিল্পের কোনও রসদ যুগিয়েছে?
উত্তরঃ— নিশ্চয়ই। প্রকৃতিকে কাছ থেকে দেখেছি বলেই তো আমি আঁকতে পেরেছি। যেকোনও শিল্পের প্রথম শর্ত আমার মনে হয় প্রকৃতিকে ভালভাবে দেখা।
প্রশ্নঃ— আচ্ছা। শান্তিনিকতনে আপনি কাকে কাকে দেখেছেন?
উত্তরঃ— কাকে দেখিনি তাই বলুন। ডঃ অমিয় সেন, বিনোদ বিহারী মুখোপাধ্যায়, চিত্তরজ্ঞন দাসের ভাই সুধী রজ্ঞন দাস, শান্তিদেব ঘোষ, নিমাই চাঁদ বড়াল, নন্দলাল বোস, মোহর দি, রামকিঙ্কর বেইজ। ক’জনের নাম বলব!
শ্রদ্ধেয় অন্নদা শংকর রায় , ডক্টর সৌমেন বন্দোপাধ্যায়, আচার্য্য সত্যেন বোস , শ্রদ্ধেয় সত্যজিৎ রায়, শ্রদ্ধেয়া প্রতীমা ঠাকুর ( বৌঠান )
শ্রদ্ধেয় সুধীর চন্দ্র কর ( কবি গুরুর প্রধান সচিব ছিলেন ) শ্রদ্ধেয়া লীলা মজুমদার, শ্রদ্ধেয় সেলিম মুন্সী প্রখ্যাত শিল্পী র কাছে ক্লাস করেছি ( বর্তমানে শান্তিনিকেতনের গুরু পল্লী তে থাকেন )।
প্রশ্নঃ— রামকিংকর বেইজকে দেখেছেন? এতো বিরাট প্রাপ্তি। তাঁকে নিয়ে লেখা ” দেখি নাই ফিরে” সমরেশ বসুর অমর সৃষ্টি।আমার গাঁ কাঁটা দিয়ে উঠছে।
উত্তরঃ—দেখেছি কী! ঘুরেছি ফিরেছি। গল্প করেছি। তখন কী আর জানতাম উনি এত বড় মানুষ!অটোগ্রাফ চাইলে বলতেন, ওসব কেন? এই তো প্রায় আমাদের দেখা হচ্ছে। কথা হচ্ছে। এটাই তো ভাল।রামকিঙ্কর দা তো বহু কাজ করেছেন, ওঁনার সৃষ্টির অন্যতম একটি ভাস্কর্য্য , ঠিক উপাসনা গৃহ ও শান্তিনিকেতন বাড়ির সামনে , ওঁনার ঐ অপূর্ব একটি সৃষ্টি দেখেই। গুরুদেব বলেছিলেন ~ আশ্রম ভরিয়ে দাও তোমার সৃস্টি দিয়ে।
প্রশ্নঃ—উনি কেমন মানুষ ছিলেন?
উত্তরঃ—খুবই সাধারণ। আত্মভোলা। হাঁটতেন মাথায় তাল পাতার একটা টুপি পরে বিড়ি খেতে খেতে।
প্রশ্নঃ—তখন আপনার বয়স কত হবে?
উত্তরঃ—-তখন আমি ফাইভ-সিক্সে পড়ি। সালটা হবে ৬৪/৬৫। একদিন দেখলাম আমার সামনেই তালপাতায় একটা সূর্যমুখী ফুল এঁকে ফেললেন। কী সুন্দর তার রং! যেন সূর্য স্বয়ং তার সব উজ্জ্বলতা নিয়ে তাঁর হাতে এসে ধরা দিয়েছে। উনি বললেন, “দ্যাখ, এই সূর্যের মতো উজ্জ্বল হতে হবে।”
প্রশ্নঃ—শুনেছি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর উনাকে খুব স্নেহ করতেন। আপনি কি কিছু বলতে পারবেন এ সম্পর্কে?
উত্তরঃ— হ্যাঁ। একটা ঘটনা জানতাম। উনি একবার একটা মন্দিরের সামনে একটা ছবি এঁকে ছিলেন। দূর থেকে দেখে মনে হবে যেন একটা কাপল একে ওকে কিস করছে। কিন্তু আসলে তা নয়। সেই ছবি দেখে মুগ্ধ হয়ে গুরুদেব বলেছিলেন, ” এবার আয় তো। তোর সব সৃষ্টি দিয়ে ভরিয়ে দে তো আশ্রমে আশ্রমে। জেনে রাখুন উনার হাত ধরেই ভারতে আধুনিক বিমূর্ত শিল্পের জন্ম হয়েছে কিন্তু।”
প্রশ্নঃ—আচ্ছা মোহর দি সম্বন্ধে কি কিছু মনে পড়ে?
উত্তরঃ— উনি তো এক কিংবদন্তী শিল্পী। উনাকে দেখলেই আমরা প্রণাম করতাম। আর উনি তখনই ব্যাগ থেকে লজেন্স বের করে হাতে দিতেন। শ্রদ্ধা তো করতামই। কিন্তু তখন তো বেশ ছোট ছিলাম। তাই লজেন্স পাওয়ার লোভেও উনাকে দিনে একবারের বেশিও প্রণাম করে বসতাম। বুঝতাম উনি হয়তো ব্যাপারটা বুঝে যেতেন। তারপর নন্দলাল দাদুর সান্নিধ্যে পাওয়া।
প্রশ্নঃ—-নন্দলাল বোস? বিশ্বখ্যাত চিত্রশিল্পী?
উত্তরঃ—হ্যাঁ। উনার কথাই তো বলছি। নন্দলাল দাদুর সান্নিধ্য পেয়েছি মাত্র তিন বছর , এ এক বিশাল প্রাপ্তি বলে মনে করি। তখন উনি বয়স ভারে নুব্জ প্রায়। নন্দদুলাল দাদু বলতেন শুনেছি ” যেখানে তুমি আঁকবে সেখানে তুমি রোজ আসবে। না হলে আঁকা তোমাকে ভালবাসবে না।’
প্রশ্নঃ—আচ্ছা, এবার একটা কথা বলি। গিনিস বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে আপনার অংশগ্রহণের ছবি দেখলাম। এটা ঠিক কীসের জন্য যদি একটু বলেন।
উত্তরঃ— হ্যাঁ। আসলে প্রতিযোগিতাটা ছিল খুব টাফ। ১ ঘন্টার মধ্যে একটা ছবি সেট করে আপলোড করতে হবে। পেন বা ব্রাশ দিয়ে। যেমন বলা হবে। এবছর ৮৩২ জন সিলেক্টেড হয়েছেন। আমি তাদের মধ্যে একজন।
—বাহ। সত্যি এটা একটা দারুণ ব্যাপার।
প্রশ্নঃ— দাদা, আপনার ছবিতে শান্তিনিকেতনের একটা ছাপ দেখতে পাওয়া যায়। রবিঠাকুরের ছবিতে যেমন একটা কার্ভ বা একটা চোখের ডাইমেনশন দেখতে পাওয়া যায়। সেরকমই একটা কার্ভ কিন্তু আপনার ছবিতেও দেখেছি।
উত্তরঃ— বাহ। সৌরভ। খুব ভাল করে ছবি দেখার জন্য অনেক ধন্যবাদ। হ্যাঁ, এই কথাটা আরও অনেকে আমাকে বলেছে।
প্রশ্নঃ— আমি তো ছবিই আঁকতে পারি না। ছবি সম্বন্ধে জ্ঞানও আমার সীমিত। তবু জিজ্ঞেস করি এই সুন্দর শিল্প বোধ কী ভাবে গড়ে ওঠে?
উত্তরঃ— দ্যাখো শিল্পবোধ সবার মধ্যেই থাকে। আমার এক নাতনির বয়সী ছোট্ট একরত্তি মেয়েকে একবার বললাম, “এই জামাটা পরবি?”
সে মেয়েটা বলল, “না, দাদু। আমি ম্যাচিং জামা পরি।” ছোট্ট মেয়েটার মধ্যেও শিল্পবোধ কাজ করছে, তাই সে ওই কথা বলল। আর তা না হলে কোনও কিছু দেখে তোমার সুন্দর লাগে আবার মন্দও লাগে।”
প্রশ্নঃ—ঠিক। ঠিক। আচ্ছা, আপনার ছবি আঁকা সম্বন্ধে যদি কিছু বলেন।
উত্তরঃ— যা কিছু দেখি তাকেই আমি আঁকতে চেষ্টা করি। প্রতিদিন আমি ছবি আঁকি। খাটের দুইপাশে খাতা-পেনসিল-রঙ ছড়ানো থাকে। অমলা শঙ্কর আঙুল দিয়ে কাজ করতেন।
অয়েল দিয়ে কাজ করতেন।
আঙুল দিয়ে আমিও কত ছবি এঁকেছি!
প্রশ্নঃ—পাকাপাকি ভাবে কবে থেকে আপনি চিত্র শিল্পী হিসাবে নিজেকে পরিচয় দিতে চাইলেন?
উত্তরঃ—দ্যাখো আমি বম্বেতে কমার্শিয়াল আর্টিস্ট হিসাবে কাজ করেছি আবার হোটেলেও কাজ করেছি। দুবাইতে গিয়েও আমি হোটেলে কাজ করেছি। দীর্ঘ তেরো বছর আমি হোটেলে কাজ করেছি। কিন্তু ছবি আঁকা ছাড়িনি। ৬৩ বছর বয়সে এসে আমার ছোটবেলায় শেখা শিল্প চর্চার প্রকৃত বহিপ্রকাশ শুরু হয়। ২০১৮ সালে প্রথম আমি গ্যালারি গোল্ডে এগজিবিশান করি। তারপর থেকে দেশ ও বিদেশে বহু একজিবিশন করেছি।
প্রশ্নঃ—এটা একটা শিক্ষনীয় বিষয়। এতদিন বাদেও যে প্রকৃত প্রতিভার প্রকাশ ঘটে ও স্বীকৃতিও মেলে এটা জেনে খুব আনন্দ পেলাম। তবে জানতে চাইব শান্তিনিকেতনে থাকতেই কী আপনি আর্টিস্ট হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন?
উত্তরঃ— না। তেমনটা ঠিক না। আসলে আমি ডাক্তার হতে চেয়েছিলাম। কিন্তু খেলাধুলায় বিশেষ করে হকিতে এতই আমার আগ্রহ ছিল যে পড়াশুনাটা ঠিক সেভাবে করতে পারিনি। কিন্তু শেষমেশ আমি ডাক্তারও হতে পারলাম না আবার খেলোয়াড়ও হতে পারলাম না।
প্রশ্নঃ— কিন্তু শেষপর্যন্ত তো শিল্পী হলেনই। তাহলে আর খেদ কেন!
আচ্ছা, রবি ঠাকুরের কোনও সমসাময়িক বা আত্মীয়ের সঙ্গে আপনার পরিচয় হয়েছিল?
উত্তরঃ— সাহিত্যিক প্রভাত মুখোপাধ্যায় ছিলেন গুরুদেবের হুবহু অবিকল। উনি থাকতেন ভুবন ডাঙায়। উনাকেই আমরা প্রথমে গুরুদেব বলে মানতাম। উনার নাতি সুমন্ত্র মুখোপাধ্যায় আমার এক ক্লাস সিনিয়র ছিলেন এবং প্রতিমা বউঠানের নাতি ডঃ সুনন্দন লালা আমার সহপাঠী ছিলেন। বর্তমানে এখন বাঙ্গালর-এ থাকে।
প্রশ্নঃ—আচ্ছা, আমরা কথা বলতে বলতে অনেকটা সময় কাটিয়ে ফেললাম। একেবারে শেষ লগ্নে এসে একটা প্রশ্ন করতে খুব ইচ্ছা হচ্ছে।
উত্তরঃ— নিশ্চয়ই বলুন।
প্রশ্নঃ—অনুজ শিল্পীদের জন্য বা আগামী প্রজন্মের কাছে আপনি কী বার্তা রেখে যেতে চান?
উত্তরঃ—আমি একটাই কথা বলব। কারোর সাথে কারও তুলনা কোরো না। যা কিছু করবে, যে শিল্পই হোক, মন থেকে কোরো। গুগল থেকে বা অন্য কারও থেকে কপি কোরো না। চর্চা চালিয়ে যেতে হবে। কর্ম করে যেতে হবে। ফলের প্রত্যাশা করবে না। একদিন দেখবে লোকেই তোমাকে টেনে নিয়ে যাবে।’
— বাহ। আপনার কথা শুনে অনেক অনেক ঋদ্ধ হলাম। খুব ভাল লাগল আপনার সঙ্গে এই আন্তরিক আলাপে। এবারে কলম-পাতুরির উদ্দেশে দু’এক কথা যদি বলেন।
—এটা বলতে পারি, “কলম পাতুরি” নামটা আমার ভাল লেগেছে। নতুন ধরণের নাম। কলম পাতুরির শ্রীবৃদ্ধি কামনা করি। সাহিত্য-সংস্কৃতি নিয়ে এগিয়ে চলুক এই পত্রিকা, দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ুক তোমাদের প্রয়াস। আর একটা কথা বলব- রেষারেষি, হানা-হানি নয়। এটাই থাকবে, যা তোমরা করে চলেছ। ধন্যবাদ জানাই সৌরভ তোমাকে ও তোমার পত্রিকা কে। আমার তরফ থেকে শারদীয়ার শুভেচ্ছা রইল।
আপনাদের লেখা আমাদের ওয়েব সাইটে জমা দিতে গেলে, অনুগ্রহ করে আমাদের লেখা-জমা-দিন মেনু-তে ক্লিক করুন ও নিজেকে Author হিসেবে Register করুন এবং আমাদের পরবর্তী আপডেট পেতে আমাদের ফেসবুক পেজ অনুসরণ করুন।
অন্যান্য
ভরুয়া
উদ্বর্তিনী
নীলবাস্প