কলম পাতুরি

ভাবনা আপনার প্রকাশ করবো আমরা

সিঁদুর টোকা

সিঁদুর টোকা গল্প – তাপস ঘোষ

একটু আগেই পান্থ স্টেশানে এসে গেছে। ট্রেন মানে আপ ট্রেন আসবে সেই সন্ধে সাড়ে ছ’টায়। নিজেকে আর ধরে রাখতে পারছে না, তাই তাড়াতাড়িই এসে হাজির হয়েছে। শীতের বেলা, কেমন ঝুপ করে অন্ধকার নামে। বেশি ঠাণ্ডা না পড়লেও গায়ে গরম কাপড় উঠেছে। কী জানি যে খবরটা পান্থ’র কানে এসেছে তার সত্যতা কতটা আছে? গত রবিবার টাউন হলে সুদীপা ফোনে তার অন্য এক বন্ধুকে বলছিল যে রাধা আসছে। রাধা, সুদীপার ছোটবেলার বন্ধু! বহুদিন পর একসাথে হবে। সুদীপাদেরই অতিথি হয়ে কিছুটা সময় কাটবে।

     স্টেশানে এসে সুদীপাকে দেখতে না পেয়ে পান্থ’র একপ্রকার মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল। তারপর নিজেকে বোঝায়, সে একটু বেশি তাড়াতাড়িই এসে গেছে। তবু দ্বিধা-দ্বন্দ্ব রয়ে যায় পান্থ’র মনে। আবার সেটা কেটেও যায় সুদীপার আগমনে। তবে তার রাধা অবশ্যই আসছে।

     হ্যাঁ তার রাধা! মনে মনে যে কবে থেকে একসাথে বাস করে, আর তা মনে নেই। তবে বেশ ছিল সেই পাঁচ ছয়টা বছর। তখন এই অজ পাড়াগাঁয়ে ট্রান্সফার হয়ে আসেন রাধার বাবা। প্রথম দিন বাবার হাত ধরে এসেছিল রাধা। বসেছিল ক্লাস থ্রি’র ঘরে। ভালো স্কুল ছিল না বলেই সবাইকে এই সাধারন প্রাইমারী স্কুলে পড়তে হত। পান্থ’র তখন ক্লাস টু। একটি ক্লাস রুমকেই দু টুকরো করা চাঁচের বেড়ার সাহায্যে। ক্লাসে ঘটনাচক্রে প্রথম দিনই রাধা একদম পিছনের সারিতে দেয়ালের গায়ে এসে বসে। সেখানে বেড়ার শেষ অংশ এসে পৌঁছায়নি। তার আগেই তা শেষ হয়ে যায়। ঠিক তার অপর প্রান্তে বসেছিল পান্থ। কেমন অবাক করা দৃষ্টি ছিল ঐ দুই শিশুর চোখে। দু জন দু জনকে দেখছিল অবাক হয়ে।

     পুতুল পুতুল রাধা তার প্রথম বন্ধু পায়। রাধাই প্রথম বলে- তুমি আমার বন্ধু হবে! হতবাক পান্থও তার বন্ধুত্বের হাত নির্দ্বিধায় বাড়িয়ে দেয়। তারপর রাধাকে স্কুল ঘুরিয়ে দেখায়। আশেপাশের গ্রাম ঘুরিয়ে দেখাত স্কুলের টিফিনে। রাধা মুগ্ধ হয়ে দেখতো গ্রাম বাংলাকে। তার জন্ম এবং বড়ো হয়ে ওঠা শহরে। গাড়ি ঘোড়ার শব্দে, মানুষের কোলাহলে, কলকারখানার ধোঁয়ায়। ভালো স্কুলে তার পড়াশুনা শুরু। কিন্তু এই গ্রামের স্কুল যেন তার বেশি ভালো লাগল!

     পান্থ’র অভিনয় ক্ষমতা ছিল খুব সুন্দর। তার ঠাকুমার কাছ থেকে রামায়ণ মহাভারতের গল্প শুনতো। আর তাদের গ্রামের বিভিন্ন প্রান্তে রামযাত্রা হতো, তার নিয়মিত দর্শক ছিল পান্থ, তারই বিভিন্ন অংশগুলি হুবহু অভিনয় করে দেখাত। এদিকে রাধারও একটা ভালো গুণ ছিল। তার গান মুগ্ধ হয়ে শুনতে হতো সবাইকে। তার কণ্ঠে রবীন্দ্র সংগীতের তো তুলনা হয় না।

     স্কুলে দুজনকে এক সঙ্গে দেখা যেত টিফিনের সময় আর স্কুল ছুটির পর। আর ওদের দুজনের প্রতিভার কথা জানাজানি হবার পর, স্কুলের বাৎসরিক ফাংশানে ওদের দুজনকে নেয়া হয় নাটকের জন্য। পান্থ সুযোগ পায় ডাকঘর নাটকের অমলের ভুমিকায়। আর রাধা চণ্ডালিকার মুখ্য ভূমিকায়। অনুষ্ঠান শেষে ওদের দুজনার প্রশংসায় পঞ্চমুখ গ্রামের মানুষ থেকে শুরু করে টিচার ও গ্রামের বিশিষ্ঠ ব্যক্তিত্বরাও।

     আজ এই এতোগুলো বছর পর স্টেশানে বসে স্মৃতির পথ ধরে পান্থ ঘুরে বেরাচ্ছিল সেই প্রাইমারির দিন গুলোতে। যেখানে স্কুলের টিফিনে তাদের খুব ভালোলাগার খেলা ছিল সিঁদুর টোকা। ছোট বেলায় অনেকেই এই খেলা খেলে থাকে। এটা দুটো দলে ভাগ হতে হয়। আর এক একটি দলের সকল সদস্যকে এক একটি নাম দেয়া হতো। তবে সেই নাম গুলো দিত তাদের দলের ক্যাপ্টেন। একটি দল যদি ফুলের নাম নিত তো অপর দল পাখির নাম। আর এক দলের একজন এসে অপর দলের একজনের চোখ পিছন থেকে চেপে ধরে রেখে মুখে বলবে- আয়তো আমার চন্দনা! তখন যাকে চন্দনা নাম দেয়া হয়েছে সে এসে যার চোখ হাতে চাপা আছে তার কপালে আঙুলের টোকা দেয়, আর না দেখেই কে টোকাটা দিল তা বলতে হয়। এইটাই পয়েন্ট দেয় বা নেয়। এই হল সিঁদুর টোকা।

     এই খেলায় পান্থ মোটেই ভালো ছিল না। কিন্তু যদি টোকাটা রাধা দিত, পান্থ অবলিলায় বলে দিত রাধার নামটা। কারণ একটা ছিল, রাধা টোকা দিত না। শুধু কপালে আঙুল ছোঁয়াত। ঐ ছোট বেলাতেও পান্থ বুঝতে পারত কেন রাধা টোকা দিত না। তার মনের মধ্যে কেমন একটা হত। পান্থ যদি দেখত রাধা স্কুলে আসেনি, তবে তার আর কিছু ভালো লাগত না। বন্ধুরা টিফিন বেলায় খেলতে ডাকলেও সে খেলত না। নানা বাহানায় সে এড়িয়ে যেত। একটা সময় রাধা প্রাইমারি স্কুল ছাড়ল। সেই বছরটা পান্থ’র খুব খারাপ গিয়েছিল। সেই সিঁদুর টোকা তাকে টানতো না। টিফিন বেলা সে মন মরা হয়ে বসে থাকত ক্লাসরুমে। পড়াতে কিছুতেই মন বসাতে পারত না। এক বছর পর সেও হাইস্কুলে গেল। গার্লস আর বয়েজ হাইস্কুল পাশাপাশি ছিল। কিন্তু টিফিন বেলা তাদের দেখা হত না। ছুটির পর দেখা হত। বিশেষ কোন কথা হত না। শুধু একে অপরের দিকে চেয়ে থাকত কিছুক্ষণ। তারপর যে যার চলে যেত তাদের বাড়ি।

     স্কুলের বাৎসরিক অনুষ্ঠান হত একসাথে। সেই সময় রাধা আর পান্থ কিছুদিন এক সাথে থাকার সুযোগ পেত। কারণ সেই নাটক। দুজনই নাটকে সুযোগ পেত তাদের যোগ্যতায়। তারা দুজনই প্রধান চরিত্রে অভিনয় করত। নাটকের রিহার্শালের ছলে দুজনের দেখা হত। কিছু কথা হত। শুধু কেমন আছ? কাল রাতে ঘুম হয়েছিল!

     নিঃশব্দে মাথা নাড়তো রাধা। বলতো- না।

     কেন?

     জানি না!

     আমারো ঘুম যেন অন্য কোন রাজ্যে পাড়ি দিয়েছে।

     কেন?

     কিছুতেই চোখের উপর তাদের আনতে পারছি না। তার কারণ আমার জানা নেই।

     এমনই কিছু কথা হত তাদের। এদিকে রাধার বাবার ট্রান্সফার অর্ডার চলে আসে। রাধা সেই খবর পান্থকে জানাতে পান্থ’র চেহারায় পরিবর্তন আসে। মন ভার হয়ে যায়। চারিদিকে যেন জমাট বাঁধা অন্ধকার। পান্থ’র দম বন্ধ হয়ে আসছিল।সমস্ত কষ্ট দুঃখ যেন গুটলি পাকিয়ে গলার কাছে বিদ্রোহ করছিল। রাধা সেটা বুঝতে পেরে বলে আমরা একটা পিকনিকের আয়োজন করেছি। তুমি আসবে তো!

     সম্বিত ফের পান্থ’র, বলে হ্যাঁ, পিকনিক! কোথায়?

     খুব কাছে নদীর ধারে। তুমি আসবে তো!

     কেমন যন্ত্রণা কাতর গলায় পান্থ সম্মতি জানায়। পিকনিকের দিন আসে। রাধা আর পান্থ কেমন নিজেদের আলাদা করে নেয়। নদীর ধারে গিয়ে পাশাপাশি বসে। নির্বাক হয়ে থাকে বেশ কিছুক্ষণ। পান্থ নুড়ি পাথর ছুড়তে থাকে নদীর বুকে। আর শাড়ির আঁচলের ডগা নিয়ে রাধা প্যাঁচ খেলতে থাকে। কারো মুখে কোন কথা নেই। শুধু ডুকরে ওঠা ব্যথাকে বহু কষ্টে চেপে রাখা দীর্ঘশ্বাসের মাঝে। সেই দীর্ঘ নিস্তব্ধতা ভেঙে পান্থই বলে- চলে যাবে রাধা!

যেতে তো সবাইকে হয়। আমিও যাব। ইচ্ছা কিম্বা অনিচ্ছা এক ব্যাকরণে বাঁধা, যা আমার যাওয়াতে প্রভাব ফেলে না। তাই মন খারাপ করো না। এই ক’বছরের স্মৃতি নিয়ে আমরা দুজনেই বেঁচে থাকবো। এগিয়ে চলবো। স্মৃতি সতত সুখের হয়। পড়াশুনায় অমনোযোগী হও না। আর অভিনয় চালিয়ে যেও। এই বলে উঠে পড়ে রাধা। আর বলে চলো সবার মধ্যে যাই। ওরা সব আমাদের এতক্ষণে খুঁজতে বেরিয়েছে। তোমার গান যে আর শুনতে পাব না! শুনতে পাব না “মনে রবে কি না রবে আমারে”! থাকবে রাধা, মনে থাকবে। কোন দিনই এই কটা বছর ভোলার নয়। তবে চলে না গেলেই ভালো হতো!

     কাপড়ের আঁচলে চোখের কোণাটা মুছে রাধা পান্থ’র হাত ধরে টেনে বলে ওঠো, ওরা এখান এসে পড়লে লজ্জার শেষ থাকবে না।

     উঠে পড়ে দুজনেই। সবার মধ্যে গিয়েও নিজেদের সবার একজন ভাবতে পারছে না। পিকনিকের হইচই, হাসিঠাট্টা, কোন কিছুই তাদের কানে পৌঁছাচ্ছে না! এমন সময় সুদীপা এসে বলে চল অনেক দিন সিঁদুর টোকা খেলিনি। আজ একটু খেলি। সবাই রাজি হয়। আর খেলে। রাধাদের পাখির নামে নাম। আর পান্থদের নাম হয় দেশের নামে।

     এবার যখন পান্থ’র চোখ ধরে ডাকা হয়- আয়তো আমার মৌপিয়া। মৌপিয়া আসে আর টোকা দিয়ে চলে যায়। সেদিন পান্থ ঠিক বলে ছিল। কারণ একটা আলতো আঙুলের ছোঁয়া পড়েছিল কপালে। ঐ শেষ আর দেখা হয়নি তাদের। যাবার সময় পান্থ চোখের জল ধরে রাখতে পারেনি। তারপর এই পনের বছর। স্মৃতির অলিগলি বেয়ে বহুদূর চলা। স্মৃতির উপর নানান পর্দা পড়ে থাকা জীবনে হঠাৎ পেয়ে যাওয়া ভালোলাগাকে দেখার ইচ্ছা। কিছুক্ষণ নিজের করে পাবার ইচ্ছা। আর একরাশ অভিমান ঢেলে দেয়া অনুযোগের সুরে- এতদিন চিঠি দাওনি কেন? আমার ঠিকানা তো একই আছে!

     গাড়ির ঘোষনা হল। নড়েচড়ে বসলো পান্থ। এবার তা’হলে সেই সময় আসছে। সঙ্গে করে কি নিয়ে আসবে জানা নেই। কেমন দেখতে হয়েছে রাধাকে। ওকি বিয়ে করেছে? সে কি তার ভালোলাগাকে সত্যি সত্যি ভুলে গেল! এতো বছরে একবারও মনে পড়েনি। নাকি অন্য কোন কারণ! হাজার জিজ্ঞাসা তার অবচেতন মনে। এমন সময় গাড়ি প্লাটফর্মে ঢুকল। সবাই নামছে গাড়ি থেকে। সেই সময় প্লাটফর্মের আলো গেলে নিভে। চারিদিক কালো আর কালো। কিছু দেখার উপায় নেই। চোখ সইয়ে নিতে গেলে কিছু সময় অবশ্যই লাগে। কিন্তু তার আগেই সে অনুভব করলো সেই আঙুলের ছোঁয়া তার কপালে। নড়ে উঠল পান্থ। চোখটা সইয়ে নিয়ে চারিদিক সে খুঁজল। পাগলের মতো সে তার ভালোলাগাকে খুঁজে চলল। কিন্তু নিমেষে সুদীপাও কেমন হাওয়া হয়ে গেল। কিছুতেই রাধার দেখা পেল না। প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে থাকল পান্থ, নিশ্চল নিরব হয়ে। ভেজা চোখ যখন খেয়াল করল আলো এসে গেছে তখন প্লাটফর্ম ফাঁকা। ঠিক যেমন পনের বছর আগে ছিল…। আনমনে পান্থের হাতটা কপালের সেই জায়গায় চলে গেল যেখানে সে কিছুক্ষণ আগে একটা আঙুলের ছোঁয়া অনুভব করেছে!

সিঁদুর টোকা গল্প – সমাপ্তি

আপনাদের লেখা আমাদের ওয়েব সাইটে জমা দিতে গেলে, অনুগ্রহ করে আমাদের লেখা-জমা-দিন মেনু-তে ক্লিক করুন ও নিজেকে Author হিসেবে Register করুন এবং আমাদের পরবর্তী আপডেট পেতে আমাদের ফেসবুক পেজ অনুসরণ করুন।

error: Content is protected !!