কলম পাতুরি

ভাবনা আপনার প্রকাশ করবো আমরা

রক্ষাকবচ

রক্ষাকবচ ছোট গল্প – তমালিকা ঘোষাল ব্যানার্জী

“মিসেস বাসু, আপনি শান্ত হন। টেনশন করবেন না। আপনাকে ডিপ ব্রিদিং করতে বলেছিলাম মনে আছে? শান্ত না হলে আমায় সমস্যাটা খুলে বলবেন কীভাবে?”

মনের ডাক্তারের দিকে মুখ তুলে চায় তৃণা। কথা বলতে গিয়ে স্বর কেঁপে যায়।

“ওরা আমাকে পাগলাগারদে দেওয়ার ফন্দি আঁটছে ডাক্তারবাবু। আশীষের অত্যাচারে অতিষ্ট হয়ে আত্মরক্ষা করতে গিয়ে ওর ওই অ্যাক্সিডেন্টটা ঘটেছিল। আচ্ছা আপনিই বলুন, দুর্ঘটনার উপর কারুর হাত থাকে! আর এই রাগ মেটানোর জন্য ওরা আমাকে পাগলাগারদে রেখে দিতে চাইছে।”

ডাক্তারবাবু চোখ থেকে চশমাটা খুলে কিছুক্ষণ চিন্তা করেন। তারপর পুনরায় সেটা পরে নিয়ে বলেন, “একটা কথা বলুন, আপনাদের দাম্পত্যজীবনে আপনি কতখানি খুশি ছিলেন?”

অসহায়তা ফুটে ওঠে তৃণার কথায়।

“এমনি তো সব ঠিকঠাকই ছিল। কিন্তু ওইযে, আশীষের সন্দেহবাতিক মন! সবসময় আমাকে সন্দেহ করতো।” ফুঁপিয়ে ওঠে তৃণা। “এমনকি আপনাকে নিয়েও। আপনার সঙ্গে কী আমার আজকের পরিচয়! আপনি আমার কাছে কতখানি ভরসার জায়গা! কখনও কোনো সমস্যায় পড়লে আপনার কাছেই তো আগে আসবো! আর এতেই ছিল আশীষের আপত্তি, আপনার সঙ্গে আমাকে কিছুতেই কথা বলতে দেবে না। খালি বাধা দিত, আমার উপর জোর খাটাতো। সহ্য করতে করতে একসময় আর পারলাম না।” তৃণা কান্নায় ভেঙে পড়ে।

চশমাটা খুলে শশব্যস্ত হয়ে ডাক্তারবাবু বলেন, “আরে মিসেস বাসু, এভাবে কাঁদবেন না প্লিজ। আশীষবাবু আপনাকে সেভাবে বুঝে উঠতে পারেনি। এতে আপনার কোনো দোষ নেই।”

চোখের জল মোছে তৃণা, “সেটাই তো কেউ বুঝতে চাইছে না। আমাকে পাগল অপবাদ দিতে চায়।”

………………..

“দেখছেন ডক্টর! এই সমস্যার জন্যই বিশেষ করে রাত্রিবেলায় আপনাকে একবার চেকআপ করার জন্য রিকোয়েস্ট করেছিলাম।” কাঁচের ঘরটার সামনে দাঁড়িয়ে আকুলস্বরে বলে নন্দিনী।

ডক্টর পূর্ণেন্দুপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় আশ্বস্ত করেন, “ঘাবড়াবেন না। এরকম ‘শয়ে ‘শয়ে পেসেন্ট আমরা রোজ দেখছি। আপনার দিদিকে আমরা ঠিক সামলে নিতে পারবো। ওইযে উনি বারবার চশমা খোলাপরা করছেন, নিজের অন্য সত্ত্বার সঙ্গে কথা বলছেন এখন। ডুয়াল পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডারের পেসেন্টরা এমনই করেন। এই ঘরটা এজন্যই বানানো হয়েছে যাতে আমরা পেসেন্টকে এখানে কিছুক্ষণের জন্য রেখে অবজার্ভ করতে পারি।”

হতাশকণ্ঠে নন্দিনী বলে, “কীভাবে যে কী হয়ে গেলো! আমার জামাইবাবুর মতো ভালোমানুষ আর হয় না। দিদির যে এমন একটা সমস্যা ছিল আমরা কেউ ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারিনি। বিয়ের আগে বাড়িতে দিদির নিজের জন্য আলাদা রুম ছিল। সেখানে এমন কিছু করতো কিনা জানতামও না। আর এমনিতেও সারাটা দিন তো ঠিকঠাকই থাকতো। বিয়ের পর জামাইবাবুই এটা প্রথম লক্ষ্য করে। দিদির সমস্যাটা ক্রমে বাড়তে থাকে। রাতের বেলায় ঘন্টার পর ঘন্টা দিদি আয়নার সামনে কথা বলে যেতো, আশীষদা বাধা দিত যাতে অবস্থাটা আরো বিগড়ে না যায়। তাও আশীষদা দিদিকে ছেড়ে যায়নি, ট্রিটমেন্ট করাতে চেয়েছিল। আর দিদি কিনা কাঁচি দিয়ে আশীষদাকেই..!!”

কান্নায় কণ্ঠরোধ হয়ে আসে নন্দিনীর। তারপর সামলে নিয়ে বলে, “সবাই বলেছিল রাত হলেই দিদির উপর ভূতপেত্নী ভর করে। আত্মীয়স্বজনরা একরকম জোর ফলিয়েই দিদির উপর ওঝা, ঝাড়ফুঁক সবকিছু করিয়েছে। কিছুতেই কিছু হয়নি। শেষ ভরসা আপনারা।”

“আপনি কিছু ভাববেন না। আমরা আপনার দিদিকে বেস্ট ট্রিটমেন্ট দেবো।” আশ্বাস দেন ডক্টর চট্টোপাধ্যায়।

………………

“আপনাকে কী করতে হবে মনে আছে তো? ভেঙে পড়লে চলবে না।”

মনের ডাক্তারের কথায় শাড়ির ভাঁজে লুকিয়ে রাখা কাঁচিটা শক্ত করে ধরে তৃণা। মুচকি হেসে বলে, “আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন ডাক্তারবাবু। ওরা কেউ একবার আমার কাছে আসুক!!” অবিকল একইরকম মুচকি হেসে আয়নার ভেতর থেকে তৃণার দিকে তাকিয়ে তার অন্য সত্ত্বা তার বহুকালের পরিচিত সেই ডাক্তার বলে, “ভয় কি! আমি তো আছি, আপনার রক্ষাকবচ। আশীষবাবুর ডেথ-এ আপনার যেমন কোনো জেল হয়নি, এবারেও হবে না। সারাটা জীবন আমি আপনাকে গার্ড দিয়ে চলবো।”

রক্ষাকবচ ছোট গল্প – সমাপ্তি

আপনাদের লেখা আমাদের ওয়েব সাইটে জমা দিতে গেলে, অনুগ্রহ করে আমাদের লেখা-জমা-দিন মেনু-তে ক্লিক করুন ও নিজেকে Author হিসেবে Register করুন এবং আমাদের পরবর্তী আপডেট পেতে আমাদের ফেসবুক পেজ অনুসরণ করুন।

error: Content is protected !!