অচল পয়সা ছোটো গল্প – চন্দ্রাণী গুপ্তা ব্যানার্জী
আর আমার গলার ব্যথাটা নেই।কি কষ্টই না পেয়েছি এতদিন। কি যে কষ্ট হত খেতে , বলে বোঝাতে পারবো না। সে এক অসহ্য যন্ত্রণা। মৃত্যু যন্ত্রণার সামিল। খাবার সামনে থাকা সত্ত্বেও খেতে পারতাম না। পেটে খিদের আগুন জ্বলতো। কিন্তু খেতে যে তার থেকেও কষ্ট। সেই জালা থেকে আজ আমি মুক্ত। ঈশ্বর কে অশেষ ধন্যবাদ। তাই আজ আমার বড় খোকার বাড়িতে এক বিশাল অনুষ্ঠান। অনেক লোকজন এসেছে। খুব খাওয়া দাওয়া হবে। বড় খোকা খরচ করতে কোন কার্পণ্য করেনি। পোলাও , লুচি, পনির, বেশ কয়েক রকমের মাছ— পাবদা, ইলিশ, চিংড়ি, ভেটকি, মন্ডা মিঠাই। আরো কত কি। তাদের আমি নামও জানিনে।
ঠাকুর ঘরে ফলাহারের সমাহার। আমার সুন্দরী বড় বৌমাও সব কিছু যত্ন করে গুছিয়ে রাখছে। ঝুড়ি ঝুড়ি সব ফল। আপেল, কলা, নাশপাতি, আঙুর।সব অতিথিদের প্রদান করা হবে। আমার বড় খোকাকে আর তার বউকে সবাই ধন্য ধন্য করছে।এত বড় অনুষ্ঠান এ তল্লাটে তারা নাকি হালে আর দেখেনি। সত্যিই তো। অতিথিদের মুখে মুখে আমার বড় খোকা আর তার বউ এর সুখ্যাতি। কয়েকজন তো বলেই ফেলল আমি নাকি ‘রত্নগর্ভা’। চারিদিকে শুধু ব্যস্ততা। সক্কাল সক্কাল রান্নার ঠাকুর এসে হাজির। সে তো ঘেমে নেয়ে একসার। একটার পর একটা রান্নার পদ কড়া থেকে নামাচ্ছে। সকাল গড়িয়ে দুপুর হলো। বড় খোকা বোধকরি পুরো গ্রাম টা কে নেমন্তন্ন করে এসেছে। পুরো গা ঝেঁটিয়ে লোক খেতে এসেছে।আমারো বেশ মজা লাগছিল এত লোক দেখতে। বহুদিন তো এত লোক দেখিনি। আমার ধারেকাছে তো নাই-ই। শুধু তিনটে লোক ছাড়া। তাই এত লোকের সমাগম বেশ লাগছিল।
বড় খোকার তিনতলা প্রাসাদোপম বাড়ী। আমি তিনতলার ছাদ থেকে সব কান্ডকারখানা দেখছিলাম। শরীরটা এখন বেশ হাল্কা লাগছে। কোনো শারীরিক অসুবিধা নেই। বাড়ির কোথা থেকে যেন একটা মন্ত্রোচ্চারণ শুনতে পেলাম।একটু উদাসীন হয়ে গেলাম। ছোট খোকার জন্য মনটা বড্ড ব্যাকুল হয়ে উঠল।চোখ দিয়ে দু’ ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল আমার। আমি যদি তার কাছে এখন যাই , সে কি আমায় চিনতে পারবে? জড়িয়ে ধরবে ‘মা’ বলে? ‘ওরে খোকা , আমি যে তোর মা। আমায় চিনতে পারবি নে? ‘মনটা ছটফট করে উঠল । তার কাছে কি এখন যাবো? যাওয়ার জন্য তৈরী হতেই একটা অট্টহাসে্্য চিন্তার তরঙ্গে বাঁধা পড়ল। পাশের বাড়ির পাল বাবু এসেছেন। সপরিবারে। বড় বৌমা বেশ আপ্যায়ন করে তাদের সবাইকে খেতে বসাল। পাশে আমার বড় খোকা । মুখে বেশ চওড়া হাসি। বিজয়ীর হাসি। — ‘ সবাই পেটপুরে খাবেন। লজ্জা করবেন না।’— ‘ না, না লজ্জা কিসের। অনেক আয়োজন করেছো দেখছি। মায়ের যোগ্য সন্তান তুমি। ‘ ‘ আর লজ্জা দেবেন না পাল বাবু। — ‘না সে , সঠিক বলছি।’পাল বাবুর কথায় বাকি অতিথিরাও মাথা নেড়ে সমর্থন করল।বেলা অনেকটা পড়ে এসেছে। আমার খিদে পাচ্ছে যে। ছোট বউটা কি এখনো রান্না শেষ করে নি? কে জানে। না এখনি যেতে হবে। নয়তো এরা তিনজন আমার পথ চেয়ে বসে থাকবে।
আমার ছোট খোকা, ছোট বউ আর তিন বছরের ছোট্ট নাতিটা। এখান থেকে ছোট খোকার বাড়ি পৌঁছূতে আমার বেশি সময় লাগবে না।উড়তে উড়তে চলে যাব। ওপর থেকেই দেখতে পেলাম… বড় খোকা হাতে একখানা পেল্লাই থালায় নানা রকমের দামী দামী সুস্বাদু খাবার সাজিয়ে বাড়ির বাইরের গাছটার দিকে একা এগিয়ে চলেছে। আমি ও পেছন পেছন গেলাম। কেউ আমায় দেখতে পেল না। বড় খোকা ও না। গাছতলায় একপাশ থেকে খাবারগুলো দেখলাম।আগে যখন খেতে চাইতাম বড় খোকা খেতে দিত না। আজ আর খেতে প্রবৃত্তি হলো না। বেশ কয়েক মাস আগে আমার গলায় ক্যান্সার ধরা পড়ে। আমার ছোট খোকা প্রায় সর্বসান্ত হয়ে গেছিল তার বিধবা মায়ের চিকিৎসা করাতে। কোনরকমে দুমুঠো অন্ন জোগাড় করতে হিমশিম হয়ে যেত ছোট খোকা আর তার বউ। ওষুধের বিপুল খরচের জন্য দাদার কাছে গিয়েছিল সে। কিন্তু শূণ্য হাতে তাকে ফিরতে হয়েছিল। খোকা আমায় বলতো, ‘মা, আমি তো তোমার অচল পয়সা। তোমার জন্য কিছুই করতে পারছি না।’আমি বলতাম, ‘ নারে, ছোট খোকা, তুই যে আমার সচল পয়সা। সত্যিই আমি রত্নগর্ভা। তোকে আমার গর্ভে ধারণ করেছি।’———————————
আমার সমস্ত দায়িত্ব থেকে আজ আমি তোকে মুক্ত করলাম, ছোট খোকা।ডানা দুটো ঝাঁপটাতে ঝাঁপটাতে ছোট খোকার ছোট বাড়িটাতে এলাম। ঘরে বউটা আর নাতিটা। আর দু’ একজন অতি নিকট আত্মীয় ।সন্ধে নামবে নামবে। দেখলাম ছোট খোকা বাড়ির বাইরের পুকুর পাড়ে আমার জন্য খাবারের থালাটা রাখল। ভক্তি ভরে জ্বালালো ধূপ-দীপ। সামনে দাঁড়িয়ে দেখলাম আমার পছন্দের বেশ কয়েকটি রান্না করা পদ। ছোট বউটা নিশ্চয়ই সব একা হাতে রান্না করেছে। আমি খাবো। নিশ্চয়ই খাবো। ছোট খোকা চারিপাশটা দেখল।আমায় বোধকরি খুঁজছে। হঠাৎ ‘মা’ বলে ডুকরে কেঁদে উঠলো। তারপর উঠে দাঁড়ালো। আর পেছনে দেখলো না।
আমি আমার ছোট বউ এর হাতের রান্না পরম তৃপ্তি করে খেতে লাগলাম।
অচল পয়সা ছোটো গল্প – সমাপ্তি
যে কেউ তাদের লেখা জমা দিতে চান। অনুগ্রহ করে আমাদের লেখা জমা দিন পৃষ্ঠায় জমা দিন এবং যারা লেখা জমা দিচ্ছেন। পরবর্তী আপডেট পেতে আমাদের ফেসবুক পেজে অনুসরণ করুন।
অন্যান্য
বাংলার রূপের সাত সতেরো
সাগর দেখার স্বপ্ন
বসন্ত ফেরে