হায়নার কান্না ছোটো গল্প – স্বস্তিক দাস
আফ্রিকার যে প্রান্তে এসে আমি উঠেছি। সে প্রান্তে পশুদের বড়ই উপদ্রব। হায়না,সিংহ, হাতি ইত্যাদি প্রাণী ছাড়াও আরও একটি প্রাণী নাকি এখানে পাওয়া যায়। এখানকার লোকেরা তাকে বলে ‘দেও’। বাংলা ভাষায় যাকে বলে-দানব। এই দেওয়ের কথা আমি আগে থেকেই জানতাম। তাইতো অ্যাডভেঞ্চারের টানে আমার এখানে আসা। আমি অবশ্য একা আসিনি। সঙ্গে এসেছে, আমার ছোটবেলাকার বন্ধু, কুন্তল। দুজনেই আমরা বেশ অ্যাডভেঞ্চারপ্রেমী। মাঝেমধ্যেই
অ্যাডভেঞ্চার করতে বেরিয়ে পড়ি। এইতো সেবারই, মারিয়ানা ট্রেঞ্চের রহস্য সলভ করতে বেরিয়ে পড়েছিলাম। অতদূর অবশ্য যেতে অবশ্য তার আগেই অন্য একটা অ্যাডভেঞ্চারের খোঁজ পেয়ে গেছিলাম। সে কথা পরে হবে। আজ বলবো, এই দুদিন আফ্রিকাতে আমরা কি করে বেরিয়েছি।
” কিরে?কেমন লাগছে?” আমার কাছে জানতে চাইলো কুন্তল। হাতির পিঠে চড়েছিলাম। বেরিয়েছি জাঙ্গল সাফারিতে। বললাম, দারুন। এরকম অনুভূতি এর আগে কখনোই হয়নি। কুন্তল হাসলো। আমার নিজেকে কেমন শংকর-শংকর মনে হচ্ছিল। আর কুন্তলকে আলভারেজ। মনে হচ্ছে, ওই দানব যেন সেই বুনিপ। হঠাৎ করে থেকে বেরিয়ে এসে আমাদের হাতিশুদ্ধ টেনে নেবে। থ্রিলিং ফিল হচ্ছিল। আচমকা আমাদের মাহুত দুটো আমাদের ধাক্কা মেরে হাতির পিঠ থেকে ফেলে দিল। এদের আবার হল কি? শয়তান দুটো কোমর থেকে দুটো মস্ত বড় ছোরা বার করে আমাদের দিকে এগিয়ে আসতে লাগল। কুন্তল বলল, এদের মতলব কিন্তু আমার সুবিধার ঠেকছে না। এদের কি ডাকাতি করার মতলব নাকি? আমরা আফ্রিকান ভাষা জানতাম। লোকদুটো আফ্রিকান ভাষাতেই বলল, ঠিক বোয়ানা, একদম ঠিক। এবার আমরা তোমাদের লুটে নেব। তারপর ও দুটো হাসতে লাগলো। এবার যা আছে সব বার কর। এবার আমার মাথায় রক্ত উঠে গেল। পকেট থেকে রিভলবারটা বার করলাম, মামদোবাজী নাকি? এই যন্তরটা দিয়ে তোমাদের বদন বেকিয়ে দিতে পারি জানো? লোকদুটো এবার ঘাবড়ে গেল। আর ছোরা ফেলে আমাদের পায়ে পড়ল, ক্ষমা করো দিন বোয়ানা। ভুল হয়ে গেছে মস্ত বড় ভুল হয়ে গেছে। এ ভুল আর জীবনে করব না। আমরা ডাকাতি ছেড়ে দিব। শুধু আপনারা আমাদের ছেড়ে দেন। আমি বললাম, দিতে পারি,কিন্তু তার আগে তোদের আমাদের নিয়ে আবার ওই বাংলোয় ছেড়ে দিয়ে আসতে হবে। লোকদুটো বলল, কেন নয় বাবু?অবশ্যই ছেড়ে দিয়ে বাবু? আমরা হাসলাম।
পরদিন ছিল জংলীদের একটা উৎসব। সেখানে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে আমাদেরও।কী এলাহি আয়োজন। বন মুরগির রোস্ট, কুমিরের মাংসের ঝোল, নানা ধরনের মিষ্টি, কত প্রকারের মাছ, আরো কত কি। পেট ভরে সেদিন খেয়েছিলাম আমরা। খাওয়া-দাওয়ার পর যখন ফের বাংলোয় ফিরলাম, সাথে সাথেই ঘুমিয়ে পড়লাম আমরা। কিন্তু মাঝরাতে কাদের কান্নার শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। ধড়মড় করে উঠে বসলাম। দেখলাম কুন্তল একটু আগেভাগেই উঠে বসে আছে। বলল, কিছু একটা হয়েছে ওই জংলিদের বস্তিতে। আমার যেতে ভয় লাগছে একা একা। তুই উঠে গেছিস,এবার চল দুজনে একসঙ্গে যাই। কথামত,আমরা খাট থেকে নেমে গায়ে একটা সোয়েটার চাপিয়ে ওদিকে যেতে লাগলাম। বস্তিতে গিয়ে তো আমরা হতভম্ব। একটা রক্তাক্ত ছিন্নভিন্ন লাশ পড়ে আছে এক জায়গায়। সেটাকে ঘিরে বসে আছে অনেকে। সবাই কাঁদছে। আমি কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম একজনকে, একে কে মারলো? লোকটা বলল,দেও এসেছিল বাবু,দেও এসেছিল। আমরা চমকে উঠলাম। ইস, এই বেচারীর দেওয়ের কোন ক্ষতি করেছিল? সেদিন রোখ চেপে বসেছিল আমার। ওই দেওকে শেষ না করে এই আফ্রিকা থেকে এক পা ও নড়ছিনা আমি। কুন্তল আমার ওই কথায় ভয় পেয়ে যায় আর পরদিনই দেশে ফিরে যায়। ওই কাপুরুষটার উপর খুব রাগ হচ্ছিল আমার। আমায় একা ফেলে ব্যাটা চলে গেল দেশে? যাকগে। আমিও আমার নতুন ডিয়েগো আলভারেজকে সেদিনই পেয়ে গেলাম। ওই লোকটাও আমার মত আ্যাডভেঞ্চারের টানেই এখানে এসেছে। ওর নাম,ব্রতীন হালদার। আমার সমবয়সী।তাই ভাব পাতাতে বেশি সময় লাগল না। প্ল্যান করে পরশুদিনই আমরা বেরিয়ে পড়লাম দেওয়ের সন্ধানে।
জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরে চলেছি আমরা, কিন্তু দেওয়ের দেখা নাই। জংলিরা অবশ্য বলেছিল, সে দেও দিনের বেলায় বেরোয় না বেরায় তখন,যখন সবাই ঘুমিয়ে পড়ে। সে নিঃশব্দে শিকার করে। ব্রতীনের অত ভয় ডর নাই। সে আমার মতই দুঃসাহসী। ভাববেন না আবার,নিজের ঢাক নিজেই পেটাচ্ছি। এমনি ই বললাম আর কি। ব্রতীন এবার বিরক্ত হয়ে উঠলো,আরে কোথায় সেই দেও?বললাম,মনে নেই?জংলীরা কি বলেছিল? দেওটা রাতে বেরোয়।আমাদের রাত অব্দি অপেক্ষা করতে হবে।এমন সময়,একটা কান্নার শব্দ শোনা গেল।এ কান্না কোন মানুষের নয়।কোনো জন্তুর।সে জন্তু কাছেপিঠেই কোথাও আছে।ব্রতীন বলল,ওটা আবার কোনো ভাবে আহত হয়নি তো? আমারও তাই মনে হচ্ছিল,পকেট থেকে গান বার করে ওদিকে এগোতে লাগলাম আমরা। হঠাৎ কেউ গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠলো, ওয়েট।ওদিকে যেওনা।ওটা ছল।ওটা ছল।আমরা পিছন ঘুরলাম।এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক।পরনে শিকারীদের ড্রেস।ভদ্রলোক বললেন,আমায় চিনলেনা তো?আমি কর্নেল কিসমত।নামটা বেশ পছন্দ হল আমার,কর্নেল কিসমত বোধহয় সেটা বুঝলেন,বললেন,নামটা সুন্দর না? আমি বলি,হ্যাঁ।কিন্তু ওই দেও-। কর্নেল বললেন,ধুর, ওসব দেও ফেও ঢপের চপ।ওটা একটা বড়ো আকারের হায়না।আমি নিজের চোখে দেখেছি ওটাকে।সেদিন মারাত্মক গরম পড়েছিল।তার ওপর লোডশেডিং।বাড়ির বারান্দাটায় এসে একটু বসলাম। চাঁদের অপরূপ শোভা দেখতে লাগলাম,এক সময় হারিয়ে গেলাম অন্য এক দুনিয়ায়।যেখানে আমি ছাড়া আর কোনো প্রাণী বা উদ্ভিদ নেই।হঠাৎ ঘোর ভাঙল,একটা চাপা কান্নার শব্দে। এত রাতে,গহীন বনে কে কাঁদে? ঘর থেকে বন্দুকটা নিয়ে নিচে নেমে এলাম।ঘড়ি দেখলাম।১ টা ১৫।দরজা খুলে বাইরে বেরোলাম।তারপর দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে জঙ্গলের দিকে এগোতে লাগলাম ধীরে ধীরে।সন্তর্পনে,অতি সন্তর্পনে। তাড়াহুড়োর তো কিছু নেই।দেখলাম,কার যেন বড়ো বড়ো আর আগুনের মত টুকটুকে লাল চোখ জ্বলছে একটা ঝোপের ভিতর।বন্দুকটা তাক করলাম সেদিকে।প্রাণীটা পালিয়ে গেলো।চাঁদের আলোয় যা দেখলাম,বিরাট এক চেহারা।না,সিংহ বা লেপার্ডের মত অত বড় না হলেও,বেশ বড়ো।
গায়ে কালো হলুদ ছোপ ছোপ দাগ।চামড়া অনেকটা ঘিয়ে রঙের মনে হল।বোধ হয় হায়না।ওটা আবার থেমে গেলো।আর ঘুরে তাকাল।আমি শূন্যে একটা গুলি চালাতেই পালিয়ে গেল।আমি ফের বাংলোয় ফিরে এলাম।এটা ওই হায়নাটাই।ব্যাটা দারুন ধুরূন্ধর।একে হারানো অত সোজা হবেনা।হতে পারে,ধারে কাছেই ওর বন্ধুরা আছে।
ও ডাকলেই এসে পড়বে।কান্না থামেনি।আমি বললাম,সেদিন জংলিদের বস্তিতে তার মানে এইই হানা দেয় আর লোকটাকে মেরে ফেলে। ব্রতীন বলে,তাই হবে।কর্নেল বললেন,ও একটু পরেই চলে যাবে।আবার আসবে মাঝরাতের দিকে।আজ পালা করে রাত জাগতে হবে।নইলে, সবাই মরবো। ওহ,একটা কথা তো জানতেই চাইনি, তোমরা কি এই অভিযানে আমায় নেবে? আমি বললাম,আপনাকে না বলি কিভাবে?আপনি অত্যন্ত সম্মানীয় ব্যক্তি।একজন কর্নেল। আপনি সাথে থাকলে বরং আমরা বেশ সাহস পাবো।কি বলো ব্রতীন? ব্রতীনও সায় দিল।আমরা বসলাম।বললাম,এখন বরং একটু আড্ডা দেওয়া যাক।ব্রতীন বলে,সবার আগে তুমি তোমার বিষয়ে কিছু বলো দেখি। আমি বললাম,আমার বিষয়ে আর কি বলার আছে।
কলকাতা শহরের এক মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে আমি।স্বপ্ন ছিল বড়ো পুলিশ অফিসার অথবা গোয়েন্দা হওয়ার।কিন্তু স্বপ্নটা ভেঙে চুরমার হয়ে গেল সেদিন,যেদিন আমার বাবার চাকরীটা চলে গেল।আমাদের বাড়ি থেকে উঠিয়ে দেওয়া হল।উঠলাম এক বন্ধুর বাড়িতে,কুন্তলের বাড়িতে। কুন্তল আমার ছোটবেলাকার বন্ধু। আমার বেস্ট ফ্রেণ্ড। বেশ আয়েশেই ওখানে ছিলাম আমরা। বহাল তবিয়তে যাকে বলে। মা বাবা এখন অবশ্য ওখানে নেই। আমরা নতুন একটা ফ্ল্যাট কিনেছি। সেবার মারিয়ানা ট্রেঞ্চ এর উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছিলাম। অদ্দুর অবশ্য যেতে পারিনি। তার আগে একটা আইল্যান্ডে থামতে হয়েছিল। আমাদের জাহাজ পড়েছিল একটা ঝড়ের মুখে। আমরা দুজন আর ক্যাপ্টেন ছাড়া কেউই বাঁচেনি। ভাগ্য কাকে বলে এবার শুনুন, যে দ্বীপে আমরা এসে পড়লাম। সে দ্বীপ ছিল ট্রেজার আইল্যান্ড। সে দ্বীপের কোনায় কোনায় লুকিয়ে ছিল গুপ্তধন।
যেগুলির অর্ধভাগ পেলাম আমি ও কুন্তল, আর বাকিটা পেল ক্যাপ্টেন। কুন্তলা অবশ্য কিছুই নিজের কাছে রাখেনি। সব আমায় দিয়ে দিয়েছে। ইন্ডিয়ায় এসে ওটা ভাঙিয়ে লাখ পঞ্চাশেক টাকা পেলুম। সেগুলো থেকে কিছু দিয়ে একটা ফ্ল্যাট কিনলাম। আর বাকিটা ব্যাংকে সঞ্চিত রাখলো বাবা। ব্রতীন বলল, তার মানে,এক লহমায় তোমাদের ভাগ্য ফিরে এলো।কি বল? বললাম, একেবারেই তাই। বিকেল হয়ে এসেছে। সুর্য ডুবুডুবু। কর্নেল উঠে দাঁড়ালেন। তোমরা কি ফিরবে?ফিরলে বলো।আবার না হয়,রাতে আসা যাবে। আমি বললাম,নাহ, আপনি ফিরলে ফিরুন, আবার রাতের দিকে আসবেন না হয়।কর্নেল বললেন, আমার জঙ্গলে রাত কাটানোর অভ্যাস আছে। তোমাদের জন্যই বললাম আর কি। তোমরা শহরের ছেলেপিলে, জঙ্গলে রাত কাটানোর অভ্যাস তোমাদের আছে কিনা ঠিক জানিনা তো,তাই বললাম আর কি।আর কিছুই না।আমরা সঙ্গে কিছু ড্রাই ফুড এনেছিলাম। সেগুলোই একসঙ্গে খেয়ে নিলাম ভাগ ভাগ করে।সন্ধ্যা নামার পরই বেশ একটা থ্রিলিং ফিল হতে লাগলো আমাদের।চারপাশ থেকে জন্তু জানোয়ারের চিৎকার ভেসে আসছে।দূরে কোথায় যেন জঙ্গলিরা নাচগান করছে।ব্রতীন বলল, আচ্ছা আমি কি তোমায় ‘তুই’ করে ডাকতে পারি? যেহেতু উই আর ফ্রেন্ডস। আমি বলি, অফকোর্স। হোয়াই নট? তাহলেই তোমার আমাকে আর আমার তোমাকে বেশ একটা বন্ধু বন্ধু মনে হবে। সেদিন থেকে ব্রতীন হয়ে গেল আমার সেকেন্ড রিয়েল ফ্রেন্ড।
সেদিন যখন ঘুম ভাঙলো। হাতঘড়িটায় দেখলাম,একটা দশ। কিন্তু ঘুমটা ভাঙলো কেন? হ্যাঁ,সেই হতভাগা দেও মানে ওই বিশাল হায়নার নাটুকে কান্নার শব্দে।দেখলাম,ব্রতীন আর কর্নেল ও উঠে বসেছে।বললাম,গুলি করবো?কর্নেল বললেন, না,একদম না।ওর সাঙ্গপাঙ্গ আশপাশেই আছে কিন্তু।ওটা এদিকে এলে তবেই গুলি করবে।
বললাম,যদি হঠাৎ ঝাঁপিয়ে পড়ে আমাদের কাউকে তুলে নেয়?কর্নেল বলেন,এত ভয় পেলে অ্যাডভেঞ্চার করতে এসেছ কেন কাপুরুষ।আমার ভিতরের আগুনটা দপ করে জ্বলে উঠলো।কিন্তু কিছু বলতে পারলাম না।হঠাৎ হায়েনাটা আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল।আমি চেঁচিয়ে উঠলাম,বাঁচাও।কর্নেল গুলি চালালেন,সেই মুহূর্তে একটা অবিশ্বাস্য ঘটনা ঘটে গেল,যেটা আমি নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাসই করতাম না।জানি আপনারাও করবেন না।তবুও বলি,গুলিটা হায়নাটাকে ভেদ করে চলে গেল আর গিয়ে লাগল সামনের গাছের গুঁড়িতে।কিভাবে সম্ভব এটা?তবে কি এটা সত্যিই দেও?দানব?আমি এক লাথি মেরে ওটাকে সরিয়ে দিতে গেলাম,পারলাম না।আমার পাটাও ওর শরীর ভেদ করে চলে গেল।আমি এবার খুব ভয় পেয়ে গেলাম।শুধু আমি না,এবার কর্নেলরাও ভয় পেয়ে গেলেন। আমার বলতে ইচ্ছে করছিল,এবার আপনি কেন ভয় পাচ্ছেন?কিন্তু বলার মত শক্তি তখন আমার ছিল না।আমার গালের উপর ওই দেওয়ের থাবা।তবে কি এবার আমার মৃত্যু নিশ্চিত?আচমকা, কোত্থেকে একটা সিংহ গর্জন করে উঠলো।দেও ভয় পেয়ে গেল,আর মিলিয়ে গেল কোথায় যেন।আমরা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম।ব্রতীন বলল, জীবনে আত্মায় বিশ্বাস ছিল না।কিন্তু আজ চোখের সামনে যা ঘটল,না মেনে থাকা যায়না।আমি বললাম,উঃ, কি যন্ত্রণা।ব্রতীন বলল,কোন মেডিসিন বা ওষুধও তো কাছে নেই।কি করা যায়?বরং ফিরে যাই চল। হঠাৎ ঝোপটা নড়ে উঠলো। আবার ওই দেওটা রিটার্ন এল নাকি?কিন্তু না, ঝোপ থেকে বেরিয়ে এল এক কিশোরী।না,সে জংলী না।বাঙালি কিশোরী।শুদ্ধ বাংলায় বলল, আ-আপনারা কি আমার দা-দাদাকে কোথাও দেখেছেন?
জানতে পারলাম,ওর নাম নিশা।গত পরশু,ওরা ঘুরতে আসে এই জঙ্গলে।সঙ্গে অবশ্য ওদের মা বাবা আর গাইড ছিল।কিন্তু তবুও কোনোভাবে ওরা ওদের ফ্যামিলি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।আর হারিয়ে যায় এই গহীন বনে।তারপর ওদের সাথেও ঠিক কাল রাত ১ টা ১০ এ একই ঘটনা ঘটে।ওর দাদাকে নিয়ে যায় দেও।তারপর থেকে এখনও অব্দি একটা লাঠিকে সঙ্গী করে ওর দাদাকে খুঁজে চলেছে ও। মেয়েটার সাহসের তারিফ না করে থাকতে পারলাম না।ওর বয়স কতই বা হবে?১৩-১৪ বছর? বড়োজোর ১৫।এই বয়সে এত সাহস থাকা মুখের কথা না।আমি কথা দিয়ে ফেললাম,আমরা তোমার দাদাকে খুঁজে বের করব।প্রমিজ।নিশার সরল মুখে হাসি ফুটলো।আমরা তিনজনেই সে হাসি দেখে খুশি হলাম।আর আমাদের অভিজ্ঞতাও ওর সাথে শেয়ার করলাম। বেচারী খুব ভয় পেয়ে গেল, এতক্ষণে যদি ওই শয়তানটা ওর দাদাকে মেরে ফেলে? আমরা ওকে সান্ত্বনা দিলাম। ভয় তো আমরাও পেয়েছি। তা স্বীকার করতে লজ্জা নেই। যা বীভৎস এক ঘটনা ঘটলো আমাদের সঙ্গে,সে ঘটনার সম্মুখীন হলে যে কেউ ভয় পেয়ে যাবে।আমরা ভোর পর্যন্ত জেগেই কাটালাম।সুর্য ওঠার পর,একটু ঘুমোলাম।
আমার যখন ঘুম ভাঙলো,তখন দেখি,১১টা বাজে।কর্নেল জেগে আছেন।নিজের বন্দুকটা মুছছেন।আমি,ব্রতীন আর নিশা,তিনজনই শুয়ে আছি। ব্রতীনরা এখনও ঘুমোচ্ছে। ঘুমোনোরই কথা,যে ঝড় বয়ে গেল কাল আমাদের উপর দিয়ে।আমি অবশ্য তুলে দিলাম ওদের। কিরে ব্রতীন,দেখ,কর্নেল স্যার কত সকালে উঠে পড়েছেন।আর আমরা?নিশার দাদাকে খুঁজতে যেতে হবে না?ব্রতীন তাড়াতাড়ি উঠে বসল। নিশাও উঠে পড়ল।তারপর আমরা চারজন তৈরি হলাম নতুন অভিযানের জন্য।আজ যেভাবেই হোক,নিশার দাদাকে আমাদের খুঁজতেই হবে। হ্যাঁ, যেভাবেই হোক।
”উফ,আফ্রিকার জঙ্গলে ঘুরছি তো ঘুরছি।মনে হচ্ছে, একই জায়গায় বারবার পাক খাচ্ছি।”বললেন কর্নেল। আমি বললাম,তাহলে বরং নিশানি রেখে যাই।একটা ইঁটের টুকরো তুলে নিয়ে পাশের গাছটায় একটা চিহ্ন রেখে দিলাম।তারপর আবার হাঁটতে লাগলাম। একটু পরে বুঝলাম। কর্নেলই ঠিক। আমরা সত্যিই গোল গোল ঘুরে চলেছি। আশ্চর্য ব্যাপার। কম্পাসগুলোও কাজ করছে না।দেখলাম, আকাশ মেঘ করে এসেছে। তাই হয়তো কাজ করছে না কম্পাসগুলো। একটা গাছের তলায় শেলটার নেব ভাবলাম। কিন্তু তারপরই ভাবলাম, জঙ্গলের মধ্যে বজ্রবিদ্যুৎ সহকারে বৃষ্টি হয়। বেশ বাজ পড়বে। গাছের নিচে শেল্টার নেওয়া মোটেই সঠিক হবে না,থামলাম। ভাবতে লাগলাম,কি করা যায়? হঠাৎ ব্রতীন বলল, এবার বৃষ্টি এলে কী করব? এবার এলো নতুন বিপদ। খুব কাছেই কোথাও একটা সিংহ ডেকে উঠলো। বুক কেঁপে উঠলো ওদের। নিশা বলে, তবে কি এবার আমারও মৃত্যু আছে?আমি বললাম, একদম বোকা বোকা কথা বোলোনা নিশা। কর্নেল বললেন, ব্রতীন,ঋষি। বন্দুক রেডি রাখো। যেকোনো সময় সিংহ ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে আমাদের রাখো। কর্নেলের কথামত আমরা বন্দুক রেডি করলাম। নিশা ভয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছে। সত্যিই সিংহ এসেছিল। আমাদের কিছুই করতে হয়নি, যা করার করেছিলেন কর্নেল। সাধে কি আর ওনার নাম কর্নেল কিসমত? সত্যি উনি আমাদের ভাগ্য। সিংহটা এসেছিল পিছন থেকে, আর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল ব্রতীনের উপর। তখনই কর্নেলের AK-47 গর্জন করে উঠল সিংহ’র আগে।
স্মরণীয় এই অ্যাডভেঞ্চারগুলি শুধু স্মৃতিতে রাখবার জন্য এখানে লিখে রাখছি না। আমার এই জমজমাট অ্যাডভেঞ্চার কাহিনী নিয়ে কুন্তল বলেছে, সিনেমা করবে। হ্যাঁ,ও আজ অনেক বড় একজন ফিল্ম ডিরেক্টর। এবার তবে বাকিটা বলি। কিন্তু তার আগে এখানে জানিয়ে রাখি আমার পরিচয়। গল্প অনেকটা এগিয়ে গেছে, এবার আমার পরিচয়টা না দিলে ভুলেই যাব দিতে। আমার নাম, ঋষিকেশ রায়। অনেকে বলে ঋষি। যেমন একটু আগে কর্নেল আর ব্রতীন বলল।
চাকরি কিছুই করিনা। কয়েকটা স্টুডেন্ট আছে, তাদেরকেই ব্যাচ করে পড়াই। থাকি কলকাতার মোঘলবাগানে ডাক্তার একটা 2BHK ফ্ল্যাটে, উইথ ফ্যামিলি। এবার আবার কাহিনীতে ফিরে আসা যাক।
“ও দেশে এই সিংহের ছালের দাম হবে প্রায় 50- 60 লক্ষ। এ আমি তোমায় দিলাম ,ঋষি।” আমি বললাম, দেখুন আমার ওটার কোনো প্রয়োজন নেই। ঈশ্বরের দয়ায়, আমাদের যা ইনকাম হয়, তাতে ভালোভাবেই চলে যায়। আর এমনিতেও এখন আমাদের মিশন নিশার দাদাকে উদ্ধার করা। এই কর্নেল লোকটাকে আমার ঠিক সুবিধার মনে হচ্ছে না। লোকটার কথাবার্তার ধরন, হাঁটাচলা,সবই কেমন সন্দেহজনক ঠেকছে। লোকটা আবার কোন ক্রিমিনাল নয় তো?বুকটা কেঁপে উঠল। কিন্তু পরমুহুর্তেই মনে হলো, লোকটা আবার আমাদের সঠিক সময়ে সব বিপদ থেকে রক্ষাও করে চলেছে। তবে কি লোকটার স্বভাবটাই এরকম? বোধহয় তাই হবে। আর উল্টোপাল্টা কিছু ভাবলাম না। কর্নেল বলল, বাবাহ, এ ছোড়ার দেখছি বড় ট্যারা ট্যারা কথা। আমি বললাম, দেখুন কর্নেল, আপনাকে আমরা আমাদের অ্যাডভেঞ্চারে অংশ নিতে দিয়েছি, কারন আপনার মত একজন শক্তসামর্থ লোক আমাদের সঙ্গে থাকলে আমরা সাহস পাব। তার মানে এই না যে আপনি আমাদের উপর জোর খাটাবেন, যা খুশি বলবেন। কর্নেল চোখ লাল হয়ে গিয়েছে, কী? কর্নেল কিসমত কে অপমান?এবার দেখ, তোকে আমি কেমন গুলি করে মারি। আমি বললাম, অত সোজা না কর্নেল কিসমত। রিভলবারটা তুলে নিয়ে সাথে সাথে গুলি চালিয়ে দিলাম ওই শয়তান লোকটার উপর। লোকটা সেখানেই শেষ। জীবনে এই প্রথম কোন একটা প্রাণকে হত্যা করলাম। লোকটাকে মেরে একটা অদ্ভুত শান্তি অনুভব করছিলাম।ব্রতীন আর নিশা থ হয়ে গেছে। এরকম পরিস্থিতিতে কি করা উচিত,মাথায় আসছিলনা।ব্রতীনের ঘোর ভাঙালাম।কিরে,অ্যাই।কি করি বলতো?ব্রতীন বলে, ত-তুই কর্নেলকে মেরে ফেললি কেন? আমি বললাম, লোকটা ভালো মানুষ নয় রে। এই দেখ। আমি পকেট থেকে একটা কার্ড বার করে ব্রতীন কে দেখালাম, কার্ডটা পেয়েছি এই জঙ্গলেরই এক জায়গায়। এটা একটা আধার কার্ড, যেটায় কর্নেল কিসমতের একটা ছবি লাগানো। কিন্তু সেখানে নাম লেখা অন্য, সেখানে লেখা- জয়ন্ত সেনগুপ্ত।
কি আশ্চর্য।হঠাৎ কর্নেলের পাশে পড়ে থাকা ফোনটা বেজে উঠলো। আমি রিসিভ করলাম।
বস, কর্নেল রবিনহুডের দল চলে এসেছে। ওরা আমাদের ফ্যাক্টরিটা ধ্বংস করে দিচ্ছে। আমরা কি করব বস?আমি চমকে উঠলাম,আর আসলে ব্যাপারটা কি সেটা জানতে কর্নেলের গলা নকল করে বললাম, ফ্যাক্টরিতে এখনো পর্যন্ত কি কি ধ্বংস করেছে?
-ওদের মেইন টার্গেট তো ওই-ওই হায়না প্রজেক্টর মেশিনটা। হুমকি দিচ্ছে ওটা যদি ওদের না দেওয়া হয়,ওরা সবাইকে সব বলে দেবে।
- কোন ফ্যাক্টরিতে আছো? আমি তো আরেকটা নতুন ফ্যাক্টরি খুলেছি।
- কঙ্গোরটায় আছি স্যার, কঙ্গোরটায়।
ফোনটা কেটে দিলাম আমি।ব্রতীন আর নিশাকে সবটা বললাম।ব্রতীন বলল,কি সাংঘাতিক। এই লোকটা এত ধুরন্ধর?কী করা যায় এখন? আমি বললাম, আপাতত আমাদের নিশার দাদাকে খুঁজতে হবে। আমরা আবারও নতুন করে যাত্রা শুরু করব। আমার মনে হয়,এই কর্নেল ইচ্ছাকৃত আমাদের ঘোরাচ্ছিল।
আমরা আবার নতুন করে যাত্রা শুরু করলাম। একটু পরেই বুঝলাম, আমার ধারনাই ঠিক। ওই কর্নেলই ইচ্ছাকৃত আমাদের ঘোরাচ্ছিল এই জঙ্গলে। নিশা হাঁপিয়ে গেছে। বৃষ্টি অবশ্য তখন হয়নি। ঠাকুর সহায় ছিলেন, হালকা ঝড় মত হয়েই কেটে গিয়েছিল। একটু পরে হঠাৎ কার যেন চাপা আর্তনাদ আমরা শুনতে পেলাম। না, অবশ্যই এ হায়না নয়। কারণ, তখন কর্নেল জয়ন্তর এক সাগরেদ বললো, হায়না প্রজেক্টর মেশিন। তার মানে হায়নাটিকে প্রজেক্ট করা হতো আমাদের ভয় দেখাবার জন্য। আর ওই জংলিটাকে টেনে নিয়ে গেছে অন্য কোন বন্য প্রাণী। হয়তো সিংহ বা নেকড়ে। এই আর্তনাদটা কোন মানুষ করছে। আবার নিশার দাদা নয় তো? আমরা তিনজন মিলে লোকটাকে খুঁজতে শুরু করলাম। নিশা বললো, দাদা,এটা কি তুই? উত্তর এলো, কেউ চাপা কণ্ঠস্বরে বলল,নিশা…।
”আমায় কোন হায়না টেনে নিয়ে যায়নি। আমায় নিয়ে গিয়েছিল কোন এক বিকটদর্শন প্রাণী। তার গলার স্বরটা শোনায় ঠিক কান্নার মতন। খুব বিচ্ছিরি দেখতে ওটাকে। চোখগুলো বড় বড় আর লাল লাল। যে কেউ দেখলে ভয় হার্টফেল করবে। আমারও হার্টফেল হওয়ার মতোই অবস্থা হয়েছিল।”থামল নিশার দাদা বিশান। আমি বললাম, তার মানে দুটো প্রাণী রয়েছে, একটা নকল আর একটা আসল। কালকের ওই হায়নাটা
যদি নকল হয়, তাহলে আমার গায়ে এই দাগ গুলো কিভাবে- আরে, কালকে যে ওই শয়তানটা
অতো জোরে আমার উপর হামলা করল, কতগুলো দাগ হয়ে গেল, সব ভ্যানিশ? আমি আর ব্রতীন চমকে উঠলাম।বললাম, তাই ভাবি, একটু ব্যথা নেই কেন গায়ে? তার মানে,ওটাও ওরা প্রজেক্ট করেছিল? আসলে দেও আছে? ফের সেই দেওয়ের আওয়াজ। যেটাকে আমরা এতক্ষণ হায়নার কান্না ভেবে ভুল করেছিলাম। দেওটা ধারে কাছেই আছে। আমরা আবার বন্দুক তৈরি করলাম। নিশা আর বিশানকে আড়াল করলাম আমি। কারণ ওদের কাছে বন্দুক নেই। ঘড়ি দেখলাম, রাত আটটা।দেওটা শেষমেশ এলো না অবশ্য। ব্রতীন বলল, এবার আমি ফেড আপ হয়ে যাচ্ছি। তোরা থাকলে থাক,আমি যাচ্ছি। এই বলে ব্রতীন সত্যি সত্যিই ব্যাগটা কাঁধে তুলে নিল। আমি বললাম, পাগল হলি নাকি? এত বড় রাস্তায় একা একা যাবি? যদি ওই দেও ধরে? ব্রতীন বলে, ধরলে ধরবে, মরলে মরবো। এখন আর আমার তাতে কিছু যায় আসে না। বললাম, তাহলে শেষ পর্যন্ত তুইও কাপুরুষই বেরোলি? আমার যেমন মনের ভিতর আগুন জ্বলে উঠেছিল, বোধ হয় ব্রতীনেরও তেমনই জ্বলে উঠলো। ব্যাগটা নামিয়ে দিল নীচে। ফালতু কথা কম বল। আমি মোটেই কাপুরুষ নই।ও আবার বসে পড়ল। বিশান বলল, চুপ করো। শান্ত হও, ও আছে।ও আশেপাশেই আছে। আমরা থমকে গেলাম। বিশান ওর সম্মুখীন হয়েছে। ওর অনুমান ভুল হতে পারে না। আমরা প্রস্তুত হয়ে গেলাম প্রথমবার দেওয়ের সম্মুখীন হওয়ার জন্য।
নিশা কাঁদছিল,অঝোরে কাঁদছিল। আমরা দু -দুজন পুরুষ থাকা সত্বেও, দেও বিষান কে টেনে নিয়ে গেল। আমরা ওকে বাঁচাতে পারলাম না। না, আমরা সত্যিই কাপুরুষ। বুঝতে পারছিলাম না, কি করে সান্ত্বনা দেব নিশাকে? কি বীভৎস দেখতে ওই জানোয়ার টাকে। অদ্ভুতরকমের মোটা। মুখটা অনেকটা কুকুরের মত। অনেকটা ফ্রেঞ্চ মাস্টিফ টাইপের। দেহটা জলহস্তীর মত। বইতে পড়েছি, এদের রোডেশিয়ান মনস্টার বলে। কিন্তু এ এখানে আছে কেন? এর মূল উদ্দেশ্য কি? আমার মনে পড়ে গেল, শঙ্করের কথা। তবে কি…।
গুহাটায় ভর্তি চামচিকে। সাহস করে ঢুকলাম আমি একাই। ব্রতীনকে বাইরে রাখলাম নিশার সুরক্ষার জন্য। আর তাছাড়াও আমি ওর জীবনকে বিপন্ন করতে চাইনা। অল রেডি আমরা একটা প্রাণকে খুইয়েছি। আমার মন বলছে,এটাই রোডেশিয়ান মনস্টারের গুহা। হায়নার কান্নার শব্দ শুনতে পেলাম আবার। অর্থাৎ, ওটা ধারেকাছেই আছে। কাঁধ থেকে রাইফেলটা নামিয়ে সামনের দিকে তাগ করে এগোতে লাগলাম।
হঠাৎ, কি যেন একটা পায়ে বাঁধলো। তুলে দেখলাম, একটা ডায়েরি। উপরে লেখা-
”দি ডাইরি অফ জিম করবেট”। জিম করবেট নামটা শুনেই ওটা পড়ার কৌতূহলটা দ্বিগুন বেড়ে গেল। কিন্তু গুহা থেকে বেরিয়ে আসতে পারলাম না। আরো বেশি কৌতুহল জাগলো, আবার ঐ শয়তানটার কণ্ঠস্বর শুনে। ডায়ারীটা ব্যাগে ঢুকিয়ে আবার এগোতে লাগলাম নিঃশব্দে। এই অ্যাডভেঞ্চারে আমার চারটি জিনিস ক্রমে বেড়েই চলেছে, বিপদ, রহস্য, ভয় এবং কৌতুহল। মনস্টারটা সমানে ডেকে চলেছে। আমার হাত কাঁপতে শুরু করেছে, খেয়াল করলাম। দেখলাম, দু আড়াই হাত দূরে দুটো বড় আর লাল টকটকে চোখ জ্বলজ্বল করছে। রোডেশিয়ান মনস্টার কি?
ওটা আরো কাছে আসতে লাগলো। দূরত্ব আর মোটে দু হাত,দেড় হাত, এক হাত। আমার বন্দুক থেকে গুলি ছুটল।বিকট আর্তনাদ করে পড়ে গেল প্রাণীটা।মরেনি,আহত হয়েছে।স্রেফ আহত।এখুনি আবার অ্যাটাক করবে।আর আমার কথা ফুরিয়ে যাবে।সেই ফাঁকে আরেকবার ডাইরিটা বার করে নিলাম।আর ওটা ঘোরাতেই চমকে উঠলাম। ওটার উল্টোপিঠেই লেখা রডেশিয়ান মনস্টারকে হারাবার পদ্ধতি।
“ছুরি?হ্যাঁ,তা অবশ্য একটা আছে।এই যে।”ব্রতীন ওর ব্যাগ থেকে একটা ছুরি বার করে আনল। রাজকীয় তলোয়ারের কায়দায় ওটা বানানো হয়েছে,এমনটাই মনে হল।ওটা নিয়েই ফের ঢুকলাম গুহায়।এবার আহত শয়তানের গল্প শেষ।
নির্মমের মত,ছুরিটা ঢুকিয়ে দিলাম ওর শরীরে।আবারো সেই অদ্ভুত শান্তিটা ফিরে এলো আমার মধ্যে। আরো এক শয়তানের বধ ঘটিল আমার হাতে।রক্তমাখা শরীর নিয়ে বেরিয়ে এলাম গুহা থেকে।বললাম,যুদ্ধ শেষ, রোডেসিয়ান মনস্টার শেষ,শেষ,শেষ।এবার ঘরে ফিরিবার পালা। ঝর্নার জলে স্নান সেরে আবার আফ্রিকার দিকে রওনা হলাম আমরা।নিশা বলল,বাড়ি ফিরে মা বাবাকে কি বলবো আমি?আমরা নির্বাক।
আমরা আফ্রিকায় ফিরতেই ওই বস্তির লোকেরা ছুটে এলো,বোয়ানা, বোয়ানা।আপনার বন্ধু এসেছিল।এখনও আছে,ওই বাংলাতেই আছে।আমি বললাম,কুন্তল এসেছিল?
– হ্যাঁ,উনি তো জঙ্গলেও গিয়েছিলেন,ওই দেওয়ের জঙ্গলে।কিন্তু,সিম্বার(সিংহ) আকস্মিক হামলায় ওকে আহত হয়ে ফিরে আসতে হয়।আমাদের কাঠুরিয়া’রা ওকে দেখতে পায় আর এই বাংলায় নিয়ে আসে।
আমি থমকে গেলাম।কুন্তল আমার জন্য সিংহর মুখোমুখি হয়েছে?আর সেই কুন্তলকে আমি দিনরাত কাপুরুষ বলে গেছি?ব্যাগ ফেলে তাড়াতাড়ি ওই বাংলোর দিকে ছুট লাগালাম।ব্রতীন আর নিশাও আমার পিছনেই এসেছিল বোধহয়। কুন্তলকে দেখে রীতিমত ঘাবড়ে গেছি আমি। ইস, সিংহটা কি পরিমান জখম করেছে বেচারীকে।আর পরমুহূর্তেই দেখলাম,নিশার বাবা মাকে।সঙ্গে নিশাও ছিল।কুন্তল বলল,এনারা বলেছিলেন,এনাদের ছেলে আর মেয়ে এনাদের থেকে আলাদা হয়ে গিয়েছে।কিন্তু ওনাদের ছেলে বিশান কোথায়?আমি সবটা খুলে বললাম ওনাদেরকে।ওনারা ভেঙে পড়লেন খুব।
নিশারা চলে গেছে।সন্ধ্যাবেলা,আমি,ব্রতীন আর কুন্তল ছাদে গিয়ে বসলাম।সঙ্গে নিলাম জিম করবেটের ডায়েরীটাও।এবার ওটা পড়বার পালা।খুলে ফেললাম প্রথম পাতা।৯ জুন থেকে শুরু হয়েছে লেখা।
৯ জুন-এর আগে আমার লেখা মোট ছটা ডায়েরী ছাপা হয়েছে।এটা তিন নম্বর। জানিনা,এটা ছাপবার সুযোগ মিলবে কিনা।কারণ,এক অদ্ভুত ধরনের বিপদে পড়েছি আমি।এবার কোন বাঘ, লেপার্ড বা হাতি না,একটা মনস্টার,রাক্ষস। যতদূর জানি,এর নাম রোডেসিয়ান মনস্টার। কাল হোটেল থেকে বেরিয়ে লেকের কাছে গেছিলাম, কোন প্রাণী জল খেতে এসেছে কিনা, তা দেখতে। তখনই রোডেশিয়ান মনস্টার এর সম্মুখীন হলাম। কোন প্রাণী না, ওই দানবটা এসেছিল জল খেতে।
তাকে দেখে আমার বুকের রক্ত হিম হয়ে গিয়েছিল। সঙ্গে একটা জেদও চেপে বসেছিল মনের ভিতর। পরদিন আমার এ কে ফরটি সেভেন টা নিয়ে একই সময় একই জায়গায় চলে গেলাম
রোডেশিয়ান মনস্টারকে ধরতে। শয়তানটাকে মেরে দিয়েছিলাম অবশ্য, কিন্তু আরও একটা ছিল, ওটা বোধহয় বড়টার বাচ্চা। বাচ্চাটার উপর মায়া হল, মারতে পারলাম না ওকে। তবে ওটাও তো কোন না কোনদিন বড় হবে আর আবার মানুষ মারা শুরু করবে। তাই দ্বিতীয় জিম করবেট এর জন্য ডাইরীর পিছনে লিখে দিলাম- রোডেশিয়ান মনস্টার কিলিং প্রসিডিউর।
এই তিন পেজ পড়াই ভাগ্যে জুটলো। বাকি পেজগুলো বেমালুম উধাও। আমরা নির্বাক। জিম করবেট এর মত ওরকম অসাধারণ শিকারিও এই দানবটার সম্মুখীন হয়েছিলেন? ব্রতীন বলল, তার মানে ঋষি, আজ তুই যেটাকে মেরে এলি, ওটা ওই বাচ্চাটা? আমি বললাম, বোধহয় তাই।
আমরা কলকাতায় ফিরে এলাম। এবারের অভিযানের বিস্তারিত সব এই খাতাতেই লেখা থাকল। আমার যদি কোনদিন এটা ছাপাবার সৌভাগ্য হয়, তবে অনেকেই লেখাটা পড়বে।
ব্রতীন ফিরলো না।আফ্রিকাতেই রয়ে গেল।ও বলেছিল,আমার জন্ম এই আফ্রিকাকে, আর এই আফ্রিকার সদস্যদের রক্ষা করবার জন্য। এরা সবসময় মৃত্যুভয়ে বাঁচে, কখন কোন বন্য প্রাণী হামলা করে ওদের বস্তিতে। কখন চোরাশিকারিদের ভয়ে দলছুট হয়ে কোন বুনো হাতি ঢুকে পড়ে ওদের বস্তিতে। তখন ওদের রক্ষা করবার জন্য তো কাউকে-না-কাউকে লাগবেই।
এ অভিযান চিরকাল আমার স্মরণে থাকবে। ও হ্যাঁ, ফেরার দিন তো আরো একটা কান্ড হয়েছিল,
আরও একটা শয়তানকে শাস্তি দিয়েছিলাম সেদিন আমরা। শুনবেন তো?
রাত তখন ১১টা। আমাদের প্লেন পৌনে বারোটায়। এয়ারপোর্টে অপেক্ষা করছি। আমরা ছাড়া এয়ারপোর্ট আর গুটিকয়েক লোক। আর আর্মিরা। হঠাৎই কে যেন চেঁচিয়ে উঠল, আমার পাসপোর্ট চুরি হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে আর্মিরা জড়ো হলো লোকটার কাছে। আর হাজারটা প্রশ্ন করতে লাগল। তারপর চলে গেল, আলটিমেটলি পাসপোর্টটা খোঁজাই হলো না। বরং মাইক অ্যানাউন্সমেন্ট করা হল, কেউ যদি কোন পাসপোর্ট খুঁজে পায়, তবে যেন এয়ারপোর্টে এসে জমা দেয়। লোকটা বলছে তার পাসপোর্ট চুরি গেছে, আর এরা ভাবছে, লোকটা পাসপোর্ট হারিয়ে ফেলেছে? আশ্চর্য ব্যাপার। এবার আমরা তিনজন লোকটার কাছে গেলাম, বললাম, কি হয়েছে? লোকটা বাঙালি,বলল, আমার পাসপোর্টটা চুরি হয়ে গেছে। ওটা না পেলে আমার প্লেনে ওঠাও হবে না। ওদিকে, আমার মা বড়ই অসুস্থ। এদের বলছি পাসপোর্ট চুরি হয়েছে, এরা বলছে,আমি নাকি হারিয়ে ফেলেছি। একটু আগে লাইনে দাঁড়িয়ে যখন আমার চেকআপ হচ্ছিল, তখন যে আমার পিছনে দাঁড়িয়েছিল, বোধহয় সেইই চুরিটা করেছে। আমরা আলাদা আলাদা হয়ে লোকটাকে খুঁজতে লাগলাম। একসময় পেয়েও গেলাম, কিন্তু লোকটা তার চেকিং করতে দিচ্ছিল না। বাধ্য হয়েই মিথ্যার আশ্রয় নিতে হলো, বললাম,আমরা সাদা পোশাকের আর্মি। শেষ পর্যন্ত তার পকেট থেকেই পাসপোর্ট উদ্ধার হল। জেলে ঢোকানো হলো লোকটাকে। ব্যাটা এদেশীয়। পরে তাকে জেরা করে জানা গিয়েছিল,তার কাজই এই,লোকের পকেট থেকে মোবাইল, পাসপোর্ট, মানিব্যাগ চুরি করা, এককথায় বলতে গেলে,ব্যাটা পকেটমার। এর আগে যারা ভুক্তভোগী, তাদের হয়ে দিলাম দু তিনটে কিল চড়।
(এ অভিযানটির অন্যগুলোর সাথে কোন সম্পর্ক নেই।)
কলকাতায় এসে কুন্তলকে আচ্ছা করে মারলাম, তারপর খুব কথা শুনালাম।
-ফিরেই যখন আসবি, তখন শুরুতে নাটকটা করার কোন প্রয়োজন ছিল কি?
– কেন? ভালই তো ভিড়েছিলি ব্রতীনের সাথে।
– দেখ কুন্তল- বাজে কথা কম বল।মাথা গরম হয়ে যায় এসব কথা শুনলে।ব্রতীনের জায়গা ব্রতীনের,তোর জায়গা তোর।
– থাক,আর জ্ঞান দিতে হবেনা।
– আজ বরং কফি হাউজে যাবো।কয়েকটা বইও
কেনার আছে।
ঝগড়ার ইতি হল ওখানেই।
সেদিন কলেজ স্ট্রিট থেকে একটা বই কিনলাম। বইটায় এই পৃথিবীর সব দানবদের কথা লেখা আছে।দেখলাম, রোডেসিয়ানের কথাও লেখা আছে।পড়তে লাগলাম-
-:রোডেসিয়ান মনস্টার:-
এই প্রাণীটি কাল্পনিক নয় মোটেই।এটি আছে।তবে অল্পসংখ্যক, সবকটাই আছে আফ্রিকায়। 2017 এর গণনা অনুযায়ী, অন্তত 8 টা।
আমি চমকে গেলাম, তার মানে, ওই দেওয়ের বংশ শেষ হয়নি। আরো আছে? আবার পড়তে লাগলাম।
– এরা দেখতে খুবই বীভৎস হয়। স্বয়ং শিকারি জিম করবেটও এর দেখা পেয়েছেন। সে কথা ওনার ডাইরি পড়ে জানতে পারেন আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট ওবামা। শুধু উনিই না। বেশিরভাগ আফ্রিকানরাই বইটা পড়েছে। হ্যাঁ, ডায়েরীটা ছাপা হয়েছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্য, ওটা ছাপা হয়েছিল আফ্রিকান ভাষায়।
আমি উৎসাহিত হয়ে উঠলাম। আমি তো আফ্রিকান ভাষা জানি। ডায়েরিটা কিনতেই হবে। কিন্তু, আমার ডায়েরীটা এখানেই শেষ করছি। মোট কথা,এবারের অভিযানে যে আমরা বেঁচে ফিরেছি, এটাই বড় কথা। আফ্রিকার মত গহীন অরণ্যে সিংহ, মনস্টার আরেকটা ক্রিমিনাল এর হাত থেকে নিজেদের বাঁচিয়ে আমরা ফিরে এসেছি। সাথে নিয়ে এসেছি জিম করবেটের নিজের লেখা একটা ডাইরী, আর ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা। এটা কম পাওনা নয়।
হায়নার কান্না ছোটো গল্প – সমাপ্তি
যে কেউ তাদের লেখা জমা দিতে চান। অনুগ্রহ করে আমাদের লেখা জমা দিন পৃষ্ঠায় জমা দিন| এবং যারা লেখা জমা দিচ্ছেন। পরবর্তী আপডেট পেতে আমাদের ফেসবুক পেজে অনুসরণ করুন।
অন্যান্য
ভালোবাসার দেবালোকে
বিজয়া দশমী
এক চিলতে রোদ্দুর