পিশাচসিদ্ধ গল্প- শাশ্বত বোস
ছেষট্টির বিগত আশ্বিনের এক সন্ধ্যেবেলায় বারীনবাবু ট্রেন থেকে নেমে চারপাশটা দেখে একটু বিরক্তি প্রকাশ করলেন। এমনিতেই উত্তাল সময়ে জঙ্গি রাজনৈতিক আন্দোলনের নামে চারপাশে আগুন জ্বলছে| ট্রেন ক্যানসেল থেকে শুরু করে ট্রেনে অগ্নিসংযোগ লেগেই আছে। সেই শ্রীরামপুর থেকে এই গন্ডগ্রামে সব ব্যবস্থা করে কি ভাবে আসা যাবে সেটাই বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছিল। স্টেশনটা অন্ধকার মতন, জনমনিষ্যি নেই বললেই চলে| দূরে দুটো একটা লোক জমায়েত করেছে ছায়ার মতন। স্টেশনের গ্যাসবাতিটা নিভু নিভু। সঙ্গে তাঁর পরিবার আছেন, আছেন দুই সদ্যবিধবা যুবতী, সম্পর্কে এরা বারীনবাবুর বৌদি হন। চলতি বছরে তাঁর ওপরে ও পরে পর পর চারজন ভাই গত হয়েছেন। হাঁটুর বয়সী ছোট ভাইটাও চলে গেলো শেষ চৈত্রে। সবে বাড়িতে তাঁর বিয়ের কথা উঠছিলো। প্রতিটিই আপাত স্বাভাবিক মৃত্যু, কিন্ত বড় আকস্মিক। “করোনারি থ্রম্বোসিস”, প্রায় ঘুমের মধ্যেই সকলের মৃত্যু হয়েছে। তার ওপর ছোট ভাইটি তো আবার শুয়ে ছিল মায়ের পাশে। বড় জমাটি যৌথ পরিবার ছিল বারীনবাবুদের। এলাকার লোকজন মজা করে বলতো “বোসেদের সাজানো বাগান”। সারা দিনে বাড়ির লোক, অতিথি অভ্যাগত, ঠাকুর চাকর, ঝি নিয়ে প্রায় ৩৪ টা পাত পড়তো তাঁদের বাড়িতে| কিন্তু নিয়তির অমোঘ লীলাখেলায় সে বাড়ি আজ প্রায় শ্মশান। এই মৃত্যুপর্ব শুরুর আগে বেশ কিছুদিন ধরেই বারীনবাবুদের বাড়িতে বেশ কিছু অতিলৌকিক ঘটনা ঘটছিলো| স্বর্গীয় শ্রী পাঁচুগোপাল ভাদুড়ীর ভাবশিষ্য, প্রেসিডেন্সির ফিজিক্সের ছাত্র, ঈষৎ বাম ঘেঁষা বারীনবাবুর এসবে বিশ্বাস ছিল না কোন কালেই। কিন্তু বাড়ির ঠাকুর, চাকর, ঝি-বৌ, বাজারের মুটে, সর্বোপরি পাড়ার কিছু মানুষের কাছে ঘটনাগুলো ছিল অতিপ্রাকৃত| এই যেমন শীতের রাতে বারীনবাবুদের বাড়ির উঠোন লাগোয়া প্রকান্ড নিমগাছটার একটা বেশ ভারী ডাল হঠাৎ ভেঙে পড়ল ভীষণ আওয়াজে| মাঝ রাতে সকলের ঘুম ভেঙে যায় আর কি! সকালে উঠে দেখা গেল, সেটা বাড়ির উঠোনে আড়াআড়িভাবে পরে আছে| যেন একটা মস্ত ভারী কিছু নির্দয়ভাবে ডালটাকে ভেঙে ফেলে দিয়ে গিয়েছে| এর কিছুদিন পরের ঘটনা চৈত্রের এক সকালে বারীনবাবুর বড়দা বিনয়কৃষ্ণ বাড়ি লাগোয়া নিজের গোলায় যাবার সময় দেখেন, সদরের ঠিক সামনেটায় একটা মাগুর মাছ ঠিক মাঝখান থেকে দুআধখানা করে কেটে কেউ ফেলে রেখে গেছে| মাছটার কপালে তখনও তাজা সিঁদুর মাখানো| বিনয়কৃষ্ণর কয়লার রেশনিং ছিল পুরো চত্ত্বরে| সেই কারণে নিমগাছওয়ালা কয়লাগোলা “বোসেদের বাড়ি” বললে এক ডাকে সবাই চিনত| বেশ কাটতি ছিল ব্যবসাটার| ব্যবসার প্রয়োজনে দুটো বিহারী মুটে ছিল বিনয়কৃষ্ণের| একজন রঘু, অন্যজন পিয়ারী| এরমধ্যে রঘুর বউটাকে বাড়ির বাচ্ছারাও বউ বলে ডাকত| বিনয়বাবুর ছোট ছেলে তার বুকের দুধও খেয়েছে, এরকমই ছিল সম্পর্কের বাঁধন| পিয়ারী ছিল বিপত্নীক, তার ছেলে মুরারী ছিল বোসেদের রাখাল| এরকমই কোন এক বিকেলে রেলের সাইডিং এর ধারে দীর্ঘদিনের পোষা গরু মুংলিকে চড়তে দিয়ে এসেছিল| সন্ধ্যার সময় গিয়ে দেখে গরুটা মালগাড়িতে কাটা পড়েছে| অবলা জীবের সাথেও একটা আত্মিক যোগে জড়িয়ে গেছিল এই পরিবার| গরুটার এই অপমৃত্যু তাই গোটা পরিবারকে ভেঙে দিয়েছিল এক অজানা আশঙ্কায়| বারীনবাবুর বিধবা মা উর্মিবালা দেবী গোটা একটা দিন কিছু খাননি, কারও সাথে কথাও বলেননি| এই বিচ্ছিন্ন ঘটনাগুলোই পুরো পরিবারটিকে এক প্রচন্ড মানসিক দোটানায় ফেলে দিয়েছিল| উর্মিবালা সন্তানসহ পরিবারের কল্যাণ কামনায়, তদোপরি এই অদৃশ্য অশনির হাত থেকে মুক্তি পাবার জন্য বাড়িতে সত্যনারায়ণ পূজা দেন| শহরের নামী দামী পন্ডিত ব্রাহ্মণ যারা এই বাড়িতে আসতেন তাঁরা তাঁকে এই পরামর্শই দিয়েছিলেন| নিজ কুলগুরুকে আকুলি বিকুলি করে পান্ডুয়া থেকে আনিয়েছিলেন তিনি| বোসবাড়ির কোনো অনুষ্ঠানে কোনোদিন আয়োজনে কোনো ত্রুটি থাকে না| তাই এই সত্যনারায়ণ পূজাতেও প্রয়োজনের তুলনায় বেশীই আয়োজন করা হয়েছিল| কিন্তু তাতেও মনের মধ্যে চাপা অস্বস্তিটা গেল না, মুখে কেউ কিছু বলতেন না, ভেতরে ভেতরে একটা চাপা মনখারাপ কাজ করত সবার| বারীনবাবুরা এককালে দেশ গাঁয়ে জমিদার ছিলেন| হুগলি জেলার খন্যানের ছোট সর্ষা গ্রামটাই প্রায় গড়ে উঠেছে বোসেদের কল্যাণে| প্রায় পুরো হুগলি জেলা জুড়ে শোনা যায় তাঁদের দান ধ্যান এর কাহিনী| তেভাগা আন্দোলনেরও অনেক আগে আদিবাসী প্রজাদের জমির পাট্টা বিলি করে জমির প্রকৃত অধিকারীদের দাবি সুপ্রতিষ্ঠিত করেছিলেন তাঁরা| সেখানে প্রায় গোটা দুটো আদিবাসী পাড়া সাথে পুরো মুসলমান পাড়া বোসেদেরই দান করা| বারীনবাবুর বাবা ঈশ্বর দীনদয়াল বোস একটি ব্রিটিশ সওদাগরী আপিসে চাকরী করতেন, তাঁর মৃত্যুর পর বড়দার মহানুভবতায় সে চাকরী বারীনবাবু এখন নিজে করেন| সেই চাকরীর সুবাদেই দীনদয়াল পরিবার নিয়ে শ্রীরামপুরে এই বাসাটি ভাড়া নেন| দীর্ঘ্য চল্লিশ বছর ধরে বোসেদের বাস এই বাড়িতে| সম্প্রতি বাড়িটির মালিকানায় হাতবদল হয়েছে, নতুন মালিক উঠতি বড়লোক, কিছুতেই তার সাথে মতে মিলছিল না বারীনবাবুদের| তাই বেশ কদিন ধরেই নতুন বাড়িওয়ালা উঠে যেতে চাপ দিচ্ছিল তাঁদের| বাড়িটা তাঁরা কিনে নিতে চেয়েছিলেন কিন্তু দামাদামীতে নতুন মালিকের সাথে এঁটে উঠতে পারেননি| ব্যাপারটা কোর্ট কাছারি অবধি গড়ায়| লোয়ার কোর্টের পর ডিস্ট্রিক্ট কোর্টে ডিক্রিও পেয়ে গেছিলেন তাঁরা| হাই কোর্টের সিঙ্গেল বেঞ্চ এর রায় বোসেদের পক্ষে গেলে নতুন বাড়িওয়ালা ডিভিশন বেঞ্চে আপিল করে| এতদিনের বসত ভিটে এতো সহজে ছাড়তে রাজি ছিলেন না তাঁরা| হাজার হোক এই বাড়িতেই বারীনবাবুদের সব ভাই বোনেদের জন্ম ও বেড়ে ওঠা| তাদের সংসারধর্মও সব এ বাড়িতেই| দীর্ঘ্য চল্লিশ বছর থাকতে থাকতে বাড়িটার প্রতি নাড়ির বাঁধনে জড়িয়ে আছেন বোসেরা| সেই টান এমনি যে বাড়িটার জন্য তাঁরা সুপ্রিম কোর্ট অবধি যেতে রাজি হয়েছিলেন| সারা এলাকায় তখন জোর গুঞ্জন| বাড়ির এডভার্স পসেশন এর জন্য একটি মধ্যবিত্ত পরিবারের এহেন সুদীর্ঘ্য আইনের লড়াইয়ের পথ বেছে নেওয়ার নিদর্শন সে সময় প্রায় বিরল ছিল| কিন্তু দেওয়ানি মামলার আইনি জটিলতা ও রায়দানের দীর্ঘ্যসূত্রিতা অর্থনৈতিক ভাবে ভঙ্গুর করে দিচ্ছিলো বোসেদের| সাথে ছিল দেশের ক্ষয়িষ্ণু জমিদারি সম্পত্তির অংশীদারি মামলা| সংসারের অগ্রজ ও দীননাথের অবর্তমানে বিধবা মা এর প্রধান সম্বল হিসেবে এর প্রায় পুরো খরচ-খরচাই বহন করতে হতো বিনয়কৃষ্ণকে| এমনকি মাঝে কিছুদিন অসুস্থ হয়ে পড়লে শ্রীরামপুর কোর্টের জজ, মুহুরী, আবদালি সহ পুরো আইন ব্যবস্থাকে নিজের বাড়িতে তুলে নিয়ে আসেন তিনি| অবশ্যই সমস্ত খরচ তাঁকেই বহন করতে হয়| তার ওপর এইসব মন খারাপ করে দেওয়া ঘটনাগুলো বোধহয় দিলদরিয়া বোসেদের মানসিক ভাবে ভঙ্গুর করে দিয়েছিলো| হাজার হোক তাঁরা ভদ্রলোক, জমিদারি রক্ত আছে শরীরে| সেই তাঁরাও ভেতরে ভেতরে শহরের অন্যত্র জমি দেখতে শুরু করেন| তখনই ঘটে আরও এক আশ্চর্য্য ঘটনা| বোস বাড়ির সবচেয়ে দাপুটে ছেলে পান্নালাল, বারীনবাবুর ঠিক উপরের ভাই, লম্বা চওড়া চেহারা, ফর্সা, খাদ্যাভ্যাসে তীব্র মাংসাশী| এ বাড়ির সকলেই প্রায় খেতে ও খাওয়াতে ভালবাসেন| কিন্তু খাওয়া নিয়ে সবথেকে বায়নাক্কা বেশী এই সেজো ভাইয়ের| পাড়ায় সবথেকে হেক্কারি বেশী তাঁর| বাড়ির পাশে তাঁদের নিজেদের হাতে করে তৈরী করা ক্লাব, সেখানে কোন পূজা বা অনুষ্ঠানে সবথেকে বেশী উদ্যোগ তাঁর| দান ধ্যানও তাঁর বেশী| নিজে “এ জি সেন্ট্রাল” এ চাকরী করতেন, কিন্তু আপিস যাওয়ার প্রতি তাঁর ছিল তীব্র অনীহা| বাড়িতে বসে ভাইপো ভাইঝিদের নিয়ে সময় কাটাতে আর রকমারি খাবার খেতে ও খাওয়াতে তাঁর ছিল জুড়ি মেলা ভার| দোষের মধ্যে তাঁর ছিল অসম্ভব মাথাগরম, অন্যায় দেখলে চুপ থাকতে পারতেন না, এমনকি হাতও উঠে যেত তাঁর| সেদিন সন্ধ্যায় এক জমির দালালের আসার কথা ছিল| আপিস না গিয়ে সারাদিন বাড়িতেই ছিলেন পান্নালাল| সন্ধ্যে তখন সাতটা, বাড়ির পিছনের দরজায় টোকা পড়ল| বাড়ির চাকর এসে খবর দিল একটা বেঁটে মতো লোক তাঁকে খুঁজছে| সবে সন্ধ্যের চা জলখাবারটা নিয়ে বসেছিলেন পান্নালাল| বেশ বিরক্ত হলেন, এটা কি একটা আসার সময় হল, তাও আবার বাড়ির পেছন দিক দিয়ে? তাড়াহুড়ো করে চা টা শেষ করে অর্ধেক জলখাবার খেয়ে হাফশার্টটা গায়ে গলিয়ে নিলেন তিনি| মুখে একরাশ বিরক্তি নিয়ে বাড়ির পেছনের দরজার সামনে এসে দাঁড়ালেন| পিছনের গলিটা অন্ধকার মতন, রাস্তার গ্যাসবাতিগুলো জ্বলেনি| এদিক ওদিক চেয়ে খুঁজতে গিয়ে দেখলেন দূরে আপাদমস্তক চাদরে ঢেকে একটি খর্বকায় লোক দাঁড়িয়ে আছে| সময়টা তখন শীতের শেষ| পায়ে জুতোটা গলিয়েই এসেছিলেন পান্নালাল, দরজাটা লাগিয়ে রাস্তায় নেমে পড়লেন| লোকটার কাছে গিয়ে এক জোরে ধমক পারলেন “এখন এসেছো কেন হে? তোমার জমি কতদূর?” লোকটা কোনো উত্তর দিল না, শুধু পিছন ফিরে হাঁটতে শুরু করল| বেশ অবাক হলেন পান্নালাল, কিছুটা হতচকিত হয়ে তিনিও হাঁটতে শুরু করলেন লোকটির পিছু পিছু| যেন এক অদৃশ্য আকর্ষণ তাঁকে টেনে নিয়ে চলেছে| বেশ কিছুটা এগিয়ে অশোক গাছের তলাটায় এসে রাস্তার মোড়ে ল্যাম্পপোস্টের আলোটা পরতেই সেই বেঁটে মতন লোকটা বেমালুম উবে গেল| চারদিকে খুঁজেও তাকে আর দেখতে পেলেন না পান্নালাল| মোড়ের মাথার রোয়াকে বসা কিছু পরিচিত মুখ শুধু তাঁকে দেখে বলে উঠল “কিরে বুড়ো, এই ভর সন্ধ্যেবেলায় কোথায় বেরিয়েছিস? বাড়ি যা”| এই ঘটনার কিছুদিন পর এক রোববার সকালে বাজার করে ফেরার পথে কিছুটা অসুস্থ বোধ করেন পান্নালাল| বাড়ি ফিরতে দেরী হচ্ছে দেখে বড়ভাই বিনয়কৃষ্ণ রঘুকে নিয়ে রাস্তায় সেজোভাইকে খুঁজতে গিয়ে দেখেন কিছুদূরে ফুটপাথের উপর লম্বা হয়ে শুয়ে আছেন পান্নালাল| পাশে বাজারের ব্যাগটা পরে রয়েছে, আনাজগুলো ছড়ানো ছেটানো| তাঁকে ঘিরে ছোট্ট একটা জটলা| পাড়ার লোক বাড়িতে খবর দিতে যাচ্ছিলো, ইতিমধ্যে বিনয়কৃষ্ণ সেখানে হাজির হয়েছেন| বাড়ি থেকে পেয়ারীকে ডেকে নিয়ে এসে ধরাধরি করে তাঁকে বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হল| পাড়ার ডাক্তার নলিনীবাবুকে খবর দেওয়া হল| ডাক্তার নিজের হাতের তালুতে পান্নালালের হাত নিয়ে পালস পরীক্ষা করছেন এমন সময়ে জ্ঞান ফেরে তাঁর| চোখ খুলেই ডাক্তার দেখে প্রচন্ড রেগে যান পান্নালাল| এমনিতেই ডাক্তার বদ্যিতে ভীষণ রকম অ্যালার্জি ছিল তাঁর| তাঁর কাছে ডাক্তার আর উকিল গৃহস্থের টাকা হাতিয়ে তাদের সর্বস্বান্ত করার ফিকির ব্যাতিত কিছু নয়| নিমেষে সজোরে নিজের হাতটা সরিয়ে সটান বিছানায় উঠে বসে ডাক্তারবাবুকে উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন “আপনি এখানে কেন? কে আপনাকে খবর দিয়েছে? আমি ভালো আছি আপনি যান এখন এখান থেকে”| ডাক্তার শুধু গম্ভীর মুখে মাথা নাড়তে নাড়তে বিনয়কৃষ্ণকে আড়ালে ডেকে বলে যান “শিরায় শিরায় করোনারি, আপনার ভাইকে সাবধানে রাখবেন|”
এর কিছুদিন পর হঠাৎ এ বাড়ির বড়কর্তা “বিনয়কৃষ্ণ বোস” অসুস্থ হয়ে পরেন| একটি বিশেষ অস্ত্রোপ্রচারের দরকার হয়ে পরে তাঁর শরীরে| বিনয়বাবুর বড় ভগ্নীপতি তৎকালীন কংগ্রেস সরকারের উচ্চ পদমর্যাদা সম্পন্ন ব্যক্তি ছিলেন| তাই সেই জ্বলন্ত সময়েও কলকাতার নামজাদা নার্সিংহোমে ভর্তি হতে কোন অসুবিধা হয় না তাঁর| স্বল্প খরচে অস্ত্রোপ্রচারটি সম্পন্ন হলেও তা তাঁর শরীরে কিছু স্থায়ী কু উপসর্গ রেখে যায়| শরীর দিন দিন খারাপ হয় তাঁর| দীর্ঘদিন নার্সিংহোমেই বন্দীদশায় কাটাতে হয় তাঁকে| এরই মাঝে এক সরস্বতী পূজার আগের রাতে পান্নালাল ঘুমের মধ্যেই মারা যান| শেষ রাতেও খাওয়া নিয়ে বায়না শেষ হয়নি তাঁর| নিভে যাওয়া উনুনে বামুন মা কে দিয়ে নতুন করে আঁচ দিয়ে লুচি আর আলুভাজা করিয়ে খেয়েছিলেন সকলের প্রিয় “সেজ খোকা”| চল্লিশ বছরের এক সদা হাস্যময়, প্রাণবন্ত, উদার ও পরোপকারী যুবকের মৃত্যুতে পুরো পাড়াতে নেমে আসে শোকের ছায়া| সকলের মনে তখন একটাই বিস্ময়, একটাই জিজ্ঞাসা “বুড়োকে দেখে তো বোঝা যেত না!” জিজ্ঞাসাটা একেবারেই অমূলক নয়| দেহ দাহ করার সময় বেশ কিছু হাড় পোড়েনি, অস্থির সাথে সেগুলিও ভাসাতে হয়েছে, এতটাই বলিষ্ঠ ছিল পান্নালালের শরীর| ঘরে তার সদ্যবিধবা স্ত্রী দুই পুত্র ও এক কন্যাকে নিয়ে অথৈ জলে পড়তে বসেন| দীর্ঘ্যদিন অফিস কামাইয়ের ফলে তার স্বর্গত স্বামীর সার্ভিস রেকর্ড খারাপ হয়ে যাওয়ায় প্রাপ্য পেনশনটুকুও বোধ করি হবে না| তখন পরের জন্য ভাবার মানুষের অভাব ছিল না, তাই পাড়ারই এক সহৃদয় কেন্দ্রীয় সরকারী চাকুরে, পান্নালালের বন্ধুস্থানীয় “শ্রী অশোকতরু মিত্র” এর মহানুভবতায় ও তদ্বিরের জোরে সেই পেনশন ফাইল শেষ অবধি ক্লিয়ার হয়| পান্নালালের পরলৌকিক ক্রিয়া মিটে যাবার পর নার্সিংহোম থেকে বিনয়বাবু ফিরে আসেন| এসে থেকেই তার আদরের বুড়োর খোঁজ! বুড়ো ঠিকমতো আপিস যাচ্ছে কিনা, খাওয়া দাওয়া করছে কিনা ঠিক মতো, শরীর কেমন আছে তার, মাথাগরম করছে কি না প্রশ্নবাণে সকলকে জর্জরিত করে তুলেছিলেন বিনয়বাবু| পান্না লালের ছেলে দুটো বড় জ্যাঠামশাইয়ের বিছানায় গা ঘেঁষে দাঁড়াত শুকনো মুখে| সকলকে শিখিয়ে দেওয়া হয়েছিল বিনয়বাবুকে কিছু না জানাতে| ভাই অন্ত প্রাণ তিনি, শোকটা নিতে পারবেন না| শেষ যেদিন পান্নালাল দেখেছিলেন নিজের বড়দা কে, সেদিন বিনয়বাবুকে নার্সিংহোমে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল| দোতলায় জানালা ধরে দাঁড়িয়ে হাউ হাউ করে কেঁদেছিলেন তিনি| হঠাৎই একদিন আচম্বিতে পান্নালালের সদ্য বিধবা স্ত্রী ননীবালাকে সাদা থানে দেখে ফেলেন বিনয়কৃষ্ণ| শোকে চুপ করে যান তারপর থেকে| ঠিকমতো খেতে অবধি চাইতেন না| আর নিজের সন্তানদের মুখের দিকে তাকিয়েও তার আর বাঁচার ইচ্ছে হত না| সে বছরই দূর্গা পুজোর পঞ্চমীতে বাড়ির পাশের ক্লাবের প্যান্ডেলে ঢাক বাজছে, বাড়ির বাকি ছেলেরা যে যার মতো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এদিক ওদিক| বিনয়বাবুর বড় ছেলে সূর্য্য পাড়ার বন্ধুদের সাথে ঠাকুর নামাচ্ছিল লরি থেকে, হঠাৎ কে এসে তার কানে কানে বলল “শিগগিরি বাড়ি যা, তোর বাবা কেমন করছে”| ছুটে বাড়ির ভেতর এসে সে দেখল খাটে তার বাবা শুয়ে ঘুমাচ্ছেন| তাকে ঘিরে চারপাশে মা কাকিমাদের কান্নার রোল উঠেছে| সে রাতে পুজোর ঢাকের বাজনা থেমে গিয়েছিল| পুরো পাড়া জুড়ে নেমে এসেছিল এক অপার নিস্তব্ধতা। হিমেল রাতের বুক চিরে এক তীব্র সাইরেনের মতো বেজে উঠেছিল রাস্তার কুকুরের কান্নার শব্দ। বিসর্জনের সুর বিষাদবিধুর হয়ে বাতাসে মিশতে না মিশতেই ডিসেম্বরে চলে গেলেন এ বাড়ির মেজো ছেলে “গুরুদাস বসু”| পেশায় রেলের উচ্চপদস্থ কেরানী ছিলেন তিনি| ঠিক একইভাবে রাতে ঘুমের মধ্যে মৃত্যু| পরিবারের এক একজন পুরুষ সদস্যের মৃত্যুর কালাশৌচ কাটতে না কাটতেই ঘটে চলে আরেক মৃত্যুলীলা| মৃত্যুর দেবতা যেন বিলাপ করে চলেছেন পরিবারটির প্রতি| সেই বছরই হোলিতে চলে গেলেন বাড়ির ছোট খোকা “মোহনলাল বসু”| ফর্সা টুকটুকে, মাথায় কোঁকড়ানো চুল, সদা স্মিত হাস্যের মানুষটি ছিলেন সেকালের ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার| নিজস্ব লেদ কারখানা ছিল তাঁর, এমনকি ছিল নিজের ফিয়াট গাড়িও| উর্মিবালা দেবী তার আদরের ছোট ছেলেকে কাছ ছাড়া করতেন না শেষের দিকে| কিন্তু মায়ের আকুল আকুতিও মৃত্যুর কালান্তর দূত কে ঠেকাতে পারল কই? অবিবাহিত ছেলেকে তক্তপোষে নিজের মাথার কাছে কোল ঘেঁষে শুইয়ে ঘুমিয়েছিলেন উর্মিবালা| সকালে উঠে দেখলেন সেই ছেলে আর নেই, কান দিয়ে বেরিয়ে এসেছে ক্ষীণ শোণিতধারা| গোটা পাড়া তখন রাত জেগে বোসবাড়ি পাহারা দিত, ওই বুঝি আবার! আবার শোনা গেল কান্নার রোল| নিমগাছে একটি কালপেঁচা শুধু ডেকে যেত বসু পরিবারের দুর্জয় কাঠামোয় অমোঘ পতনের নিকষ ভীমকেতুর রূপ ধরে| বড় করুণ সে স্বর! ভয় ধরানো, জিঘাংসা মেশানো হিম কণ্ঠে বোধহয় সে বলতে চাইত “চলে যাও! সবাই চলে যাও! শিগগিরি এখান থেকে পালিয়ে যাও সব|”
“এই তোরা মা-কাকিমাদের সাথে সাথে আয়” হাঁক পেরে বললেন বারীনবাবু শিশু ও বালকগুলির উদ্দেশ্যে। তাঁর ভাইপোদের মধ্যে সূর্য সদ্য কৈশোরে পা দিয়েছে। তার প্রজন্মের বংশের পুরুষ সন্তানদের ভেতর সেই বয়সে সব থেকে বড়| সদ্য স্কুল ফাইনাল দিয়েছে সে| বছরখানেক আগে পিতৃহারা হয়ে ছোট ভাই মানিক, বিবাহযোগ্যা বড় দিদি “ইতু” আর তাদের বিধবা মা কে নিয়ে পরিবারে একমাত্র জীবিত রোজগেরে ন কাকার ছাতার তলায় এসে দাঁড়িয়েছে। বাকি তুতো ভাইরাও বেশ ছোট। সবাই স্কুলে পড়ে। সূর্য্য র মেজো কাকা গুরুদাস এর ছেলে বিমান, সূর্য্যের ঠিক পরের ভাই, একটু রুগ্ন চেহারা, ক্লাস এইট এ পড়ে, মাথা ভর্তি কোকড়ানো চুল, চোখদুটো কোটরে ঢোকা| কদিন ধরেই ভীষণ ভুগছে ছেলেটা| ঘুসঘুসে জ্বর টা ছাড়তেই চাইছে না, সাথে মাঝে মাঝে প্রচন্ড মাথার যন্ত্রনা| ব্যাথায় ঐটুকু ছেলে বেঁকে যায় আর কি! ডাক্তার রাও সঠিক রোগ ধরতে পারছেন না| বারীনবাবুর সেজদার দুই ছেলে সুজন ও বিজনের বয়স যথাক্রমে আট ও সাড়ে ছয়| লাল বাবার নির্দেশে এই নেহাৎ অপরিণতবয়স্ক কিশোর ও বালকের দলও এসেছে নিজেদের মা কাকিমাদের হাত ধরে। লাল বাবা বাড়ির সব জীবিত পুরুষকে সামনে রেখে ভৈরব নামাতে চান বেলতলার শ্মশানে। বারীনবাবুর নিজের সন্তানেরা নেহাৎই দুধের শিশু, তাই তাদের বাড়িতে রেখে এসেছেন তাঁর অনূঢ়া ছোট বোনের কাছে। চোখের সামনে নিজের ছেলেদের পরপর মৃত্যু দেখে উর্মিবালা শোকে বিছানা নিয়েছেন বিগত কয়েক মাস ধরে| অকস্মাৎ বাড়িতে পর পর এতগুলো সমর্থ পুরুষের মৃত্যুর পর তাঁর সেজবৌদির বাবা “শ্রী বঙ্কিম ঘোষ” মহাশয় নিজের সদ্য বিধবা কন্যা “উমা” কে নিয়ে লাল বাবার কাছে এসেছিলেন। বঙ্কিম বাবু নিজে পেশায় উকিল, ব্যারাকপুর কোর্টে প্র্যাক্টিস করেন| মামলার সাত সতেরো ঝামেলার ব্যাপারে লাল বাবার কাছে আগে থেকেই তাঁর যাতায়াত ছিল| সেরকম ত্যাড়া কেস লড়লে তন্ত্রের সাহায্যের প্রয়োজন হয় বৈকি| লাল বাবার নিৰ্দেশে বারীনবাবুদের বাড়ির মাটি তাঁর কাছে নিয়ে যাওয়া হলে বাবা নিজের করতলে সেই মাটি নিয়ে হাতটি নিজের চোখের সমান্তরালে রেখে ও তাঁর গন্ধ বিচার করে ছুঁড়ে সেই মাটি হাত থেকে ফেলে মাটিতে ছড়িয়ে হুঙ্কার ছেড়ে বলেছিলেন “এ বাড়ির মাটি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে, শিগগিরি এ বাড়ি ছেড়ে দিগে যা”। সেদিনের লাল বাবার সেই হুঙ্কার বারীনবাবুরও বুক কাঁপিয়েছিল। কাজেই অন্তর থেকে না মানতে পারলেও এই ভৈরব নামানোর অনুষ্ঠান নিয়ে আপত্তি করার জোর তাঁর ছিল না। লাল বাবা বলেছেন সামনে বড় বিপদ, বংশের অস্তিত্বই সংকটের মূলে। কে বা কারা ভিটেতে তান্ত্রিক উপায়ে অপকর্ম করে দিয়েছে, তারই প্রতিকারে এতদূর আসা।
স্টেশন থেকে পুরোটা রাস্তা ছই গাড়িতে প্রায় কেউ কোনো কথাই বলেননি| দিগন্ত বেয়ে গোধূলির আলোর রেখা সবে উঠেছে। অজানা আশংকার সাথে চাপা উত্তেজনা মিশে শুধু বারীনবাবুর মুখে এঁকে দিচ্ছিলো কালের কলিরেখা| প্রায় চার ক্রোশ পথ পেরিয়ে লাল বাবার মন্দিরে ঢুকতে ঢুকতে রাত বেশ গাঢ় হলো।
মুখ চাপা দেওয়া ছয়টি সরা, তার মধ্যে তিনটি সূর্য, বিমান আর মানিকের নামে| আরও দুটি সুজন আর বিজনের নামে| আর শেষ সরাটি আকারে বড় সেটি বারীনবাবুর নাম করে উৎসর্গ করা। প্রতিটি সরায় লুচি, মাছ ভাজা সাথে একটি করে ডিম সেদ্ধ ও কিছুটা মাখা সন্দেশের মন্ড । প্রতিটি সরার ভেতর যার যার নাম এবং গোত্র একটি করে কাগজে লাল কালিতে লিখে মুড়ে রাখা। সরাগুলি পুজোর সরঞ্জাম থেকে নির্দিষ্ট দূরত্বে সার দিয়ে রাখা। সাথে রাখা হুইস্কির বোতল “কারণবারি”| নিধিরাম সব জোগাড় করেছে। শ্মশানের পূর্বদিক থেকে হালকা হিমেল হওয়া বইছে। অনেক ক্ষেত্রেই গ্রামের দিকে নির্দিষ্ট করে শ্মশ্মান বলে কিছু থাকে না, খোলা ধান ক্ষেতের ভেতরেই তাঁরা দাহকার্য্য সম্পন্ন করে থাকেন| এক্ষেত্রেও শ্মশ্মান কতকটা তেমনি| আধো আবছায়ায় লণ্ঠনের আলোয় দেখা যাচ্ছে ক্ষেতের আলের গায়ের গর্ত থেকে সাপ বেরিয়ে মেঠো ইঁদুর ধাওয়া করছে| দিপাবলী এবারে কিছুটা পিছিয়ে কার্তিকের মাঝামাঝি পরেছে। আগত অমাবস্যার নিকষ অন্ধকারকে ছিঁড়ে ফেলতে চাইছে দূরের কটি জ্বলন্ত চিতা। ধোঁয়ার কুন্ডলি আর শবদেহের চামড়া-মাংস পোড়ার তীব্র এক জান্তব গন্ধ বাতাসে মিশে চারপাশে এক অপার্থিব পরিবেশ তৈরী করেছে| শ্মশানের একদিকে আবার ধানক্ষেত| ছোট আলের গায়ে খাল কেটে ক্যানেল থেকে জল নেওয়া হয়েছে| অমাবস্যার জমাট অন্ধকারেও সেই জলের কুলকুল শব্দ দিব্য কানে আসছে| ক্ষেতের ফসল এখনো কাটা হয়নি| আলো আঁধারিতে ভরা যৌবনা ধানের শিষ হাওয়ার তালে তালে দুলছে| ক্ষেতের ধারে এক বিশাল বটগাছ তলায় একটা মন্দির| সেখানে পাশাপাশি বগলামুখী ও দক্ষিণাকালী মূর্তি, এটি লালবাবার সাধনা স্থল| জাগ্রত পঞ্চমুন্ডির আসন তাঁরই প্রতিষ্ঠা করা| সামনের হাড়িকাঠে তখনও বলির রক্ত লেগে আছে| বারীনবাবুরা অশ্বত্থ গাছের তলায় বসেছেন| বিধবাদের মাথায় ঘোমটা, গায়ে চাদর| শিশুগুলি যে যার মায়ের গা ঘেঁষে বসেছে।
“হল রে শালা! কত দেরী লাগে রে তোর? নিজের গুষ্টির জোগাড়ও করছিস নাকি রে শালা!” হুঙ্কার ছেড়ে অন্ধকার চিরে বেরিয়ে এলেন দীর্ঘদেহী, রক্তবসনা, এক তন্ত্রসাধক| গাত্রবর্ণ তাঁর ঈষৎ তাম্রাভ, কপালে তাঁর রক্ততিলক| সন্ধের পূজার বলির রক্ত পাঁচ আঙ্গুলে মেখে কপালে টিপ দিয়েছেন নিজেই। ইনিই “লাল বাবা”, সাধক পরমানন্দ ব্রহ্মচারী, “পিশাচসিদ্ধ”| পরনের রক্তবস্ত্র ও দীর্ঘ তন্ত্র সাধনার ফলে তাঁর ঈষৎ উগ্র স্বভাবের জন্য গায়েঁর লোক তাঁকে এই নামে ডাকে। বারীনবাবুদের দিকে একবার দেখে নিয়ে পূজার আসনে গিয়ে বসলেন লাল বাবা। হাতের কোষে করে কমন্ডলু থেকে সরাগুলোর উপর জল ছিটিয়ে বিড়বিড় করে মন্ত্র পড়তে লাগলেন “হ্রীং স্রিং চামুন্ডাঐ তর্পামৈঃ স্বাহা; ওং শুভ কর্ণঙ্গ আমা নৈবেদ্যং ভাগ্যং ফলতাম্বুলম ধূপদ্বীপ্যং নমঃ।” পিছনের দিকে না তাকিয়ে হুঙ্কার ছাড়লেন “কেউ ভয় পাবে না, যে যার মন্তর জপ করো।” পুষ্পপত্র থেকে একটি সুবিকশিত নীল পদ্ম হাতে তুলে নিয়ে মন্ত্র পড়তে পড়তে ঠিক নিজের ব্রম্ভতালুতে রাখলেন তিনি| লালবাবা এবার সমাধিস্থ হলেন| পরনের রক্তাম্বর নিকষ আঁধারে অসিত বর্ণ ধারণ করেছে| গন্ডদেশের পরিচর্য্যারহিত শ্মশ্রূ রাশিতে ঈষৎ পক্ক কেশের আভা রচনা করছে এক নিগূঢ় রহস্য কথা| গলার রুদ্রাক্ষের মালার রাশি যেন দুর্জয় শৃঙ্খলের মতো শতকোটি প্রেতযোনিকে তার বশীভূত করে রেখেছে কয়েক সহস্র বছর ধরে| বিগত কেশ মস্তকের নিচে বিস্তীর্ণ ললাট দেশে ভ্রূ যুগলের মাঝখান থেকে টানা রক্তবর্ণ সিঁদুর তিলক যেন তান্ত্রিকের সাধন ত্রিশূলের ফলা বিশেষ| বেশ কিছুক্ষন পর তার ধ্যান ভাঙলো| সামনে রাখা তামার পুস্প পত্র থেকে মুঠো করে ফুল আর চাল নিয়ে সামনে ছেটাতে ছেটাতে বিড়বিড় করে মন্ত্র পড়তে লাগলেন “ক্র্যাং ক্রিং কিং কোয়িং কঃ কৃষ্ণসাপ বিমুর্চিতাঐ সুধা দেব্যৈ নমঃ; স্র্রাং স্রিং সিং সৈং সঃ শ্বেতসর্প বিমুর্চিতাঐ সুধা দেব্যৈ নমঃ”| আঙুলে মোটা লাল সিঁদুর নিয়ে অর্ধচন্দ্রাকারে হুইস্কির বোতলে র গায়ে লেপে দিয়ে বোতলটিকে হাতে করে একটু হেলিয়ে ধরে মুখের সামনে নিয়ে বিড়বিড় করে মন্ত্র পড়তে লাগলেন “ওঁ কারণং তর্পামৈঃ স্বাহা”, তারপর বোতলের ছিপিটা খুলে কোষায় ঢাললেন সেই মন্ত্রপুত কারণতোয়| সেই জল কুশি করে ছিটিয়ে দিলেন সড়াগুলোর দিকে| লালবাবার সামনে কয়েকটা মড়ার খুলি সাজানো| আপাদমস্তক সিঁদুরের মাঝে কিছুটা তাদের করোটির প্রকৃত অস্থিসার দৃশ্যমান| ইতিমধ্যে নিধিরাম আসনের সামনের বেল কাঠের স্তূপে অগ্নিসংযোগ করেছে| বাবার ঘৃতাহুতিতে আগুনের তীব্রতা ক্রমশ বাড়ছে| বাবা এবার হাতে মদের বোতলটা থেকে ঢকঢক করে মদ ঢালতে লাগলেন মড়ার খুলিগুলোর মাথায়| “ওঁ আনন্দ ভৈরবায় তর্পামৈঃ স্বাহা; ওঁ আনন্দ ভৈরবীভ্য তর্পামৈঃ স্বাহা”..বিড়বিড় করে মন্ত্র পড়ছেন লালবাবা| যজ্ঞের আগুনে তাঁর বিস্তৃত ললাটের রেখাগুলো স্পষ্ট হয়ে উঠেছে| কারণবারিধারা গড়িয়ে পড়তে পড়তে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে করোটিগুলির উপর থেকে, যেন তীব্র পিপাসায় তারা আকণ্ঠ অমৃতসুধা পান করছে| “ওঁ হসকমলবর জুং আনন্দ ভৈরবায় হৌঙ্; আনন্দ ভৈর বীভ্য ভৌষঠ্”..পিতলের বাটির উপর রাখা ছোট্ট করোটির খণ্ডটি হাতে তুলে নিলেন বাবা, তাতে মদ ঢেলে খেতে লাগলেন ধীরে ধীরে| ওই টিই হলো তন্ত্র সাধকদের “মহাপাত্র”| কথায় আছে উপযুক্ত মন্ত্রসিদ্ধ মহাপাত্রে কারণ ঢাললে কারণ সুধা গঙ্গা বারি তে পরিণত হয়| ক্রমশ মন্ত্রের তীব্রতা বাড়ল..”ওঁ কালীকে বিগতদংষ্ট্রে স্ফেৎকারিনী ওঁম কালী কালী কিচি কিচি মম শত্রু খাদয় খাদয় মারয় মারয়”| হোমশিখা ক্রমশ তার লেলিহান জিহবা দিয়ে গ্রাস করতে চাইছে চারপাশের জমাট আঁধার| সহস্রমস্তা সাপের মতো বিশাল কদাকার রূপ ধারণ করেছে সে| সেই আগুনে করোটিগুলি যেন জ্বলজ্বল করতে লাগলো| তাদের নিস্প্রাণ অক্ষি কোটরে তখন দেখা দিয়েছে ভয়ানক প্রাণের স্পন্দন| তাদের দন্তবিহীন পাংশু মুখগহ্বর যেন বিস্ফারিত বিভীষিকার অট্টহাসি হেসে শূন্যে নৃত্য করতে চাইছে| সেই অগ্নিশিখায় দিব্য অনুভব করা যায় সামনের দুই কালীমূর্তিতেও সঞ্চারিত হয়েছে প্রাণবিন্দু| সহসা সেই স্থানের বাতাস যেন থেমে গেলো| ঠিক যেন বর্ষার আগের গুমোট ভাব, দূরে কোথাও শঙ্খচিল ডেকে উঠলো| শ্মশানের দক্ষিণ দিকে একটা বিশাল বাজ পড়ল। হিমশীতল একটা হাওয়া ছুটে আসতে লাগল সে দিক থেকে।
লালবাবা হুঙ্কার ছাড়লেন “কিরে এসেছিস?”
হাওয়ার ভেতর থেকে একটা গোঙানির আওয়াজ ভেসে এল|
লাল বাবা আবার হুঙ্কার ছাড়লেন “উত্তর দে, এদের কি হবে? বল শালা|”
হাওয়ায় ভেসে উত্তর এল “নিব্বংশ নিব্বংশ নিব্বংশ”| মাটির হাঁড়িতে মুখ চেপে আওয়াজ করলে যেমন প্রতিধ্বনি হয় উত্তরটাও ঠিক তেমন আকাশে বাতাসে অনুরণিত হতে লাগল।
লালবাবার চেহারা এবার উগ্র হয়ে উঠল, “কি করতে হবে উপায় বল”।
হাওয়ার সেই অদৃশ্য আগন্তক এবার অসন্তষ্ট| তীব্র রাগে কাঁপতে কাঁপতে সে বলল “বলব না, আমার খিদে পেয়েছে”। লালবাবা হাতের কোষে মদ ঢেলে সরার দিকে ছুড়ে বললেন “বল শালা তোকে বলতেই হবে”|
এবার গোঙানির শব্দ ভেসে এল “সদ্যকালি – বগলামুখী, জোড়া পুজো, জোড়া পাঁঠা চাই।” আসন ছেড়ে উঠে পড়লেন লালবাবা| ভৈরবের থেকে বসু পরিবারের শাপমুক্তির উপায় তার জানা হয়ে গেছে।
অশরীরী এবার দানবচিত হুংকারে আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে তুললো| বোঝাই যাচ্ছে সে একই সাথে প্রচন্ড ক্ষুদার্থ ও কল্পনাতীত হিংস্র| বারীনবাবু স্তব্ধ চিত্তে হতবাক হয়ে বসে আছেন, নিজের চক্ষু কর্ণের বিবাদভাজনের অনুভূতির অনেক ঊর্ধ্বে এখন তিনি, বাচ্চারা ভয়ে সিঁটিয়ে গেছে|
বারীনবাবুদের দিকে উদ্দেশ্য করে বাবা বললেন “এই সব সরে আয়, ওকে খেতে দে”। দূরে ছায়ার মতো একটি বিশালাকায় শৃগালের ন্যায় বৃহৎ কুকুরকে ঘোরাফেরা করতে দেখা যাচ্ছে তখন|
গল্পটা এর আগে অনেকবার বাবার থেকে শুনেছি। তবু আজ সদ্য আগত বর্ষার দিনে এই গল্প আবার শুনে গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। কৌতূহলমাখা চোখে বাবাকে প্রশ্ন করলাম “সরাগুলো পরে দেখেছিলে?” চোখের চশমাটা একবার মুছে বাবা উত্তর দিলেন “নিধিরাম পরে সরাগুলো এনে দেখিয়েছিল| সবকটা সরাই ফাঁকা ছিল শুধু বিমান আর ন কাকারটা যেমন ছিল তেমন। সরার মুখের ঢাকনাটা অবধি সরায়নি। মদের বোতলটা পুরো ফাঁকা। রাতারাতি বাবার নির্দেশ মতো শহরের অপর প্রান্তে সম্পূর্ণ অচেনা, জনাকীর্ণ পরিবেশে আমরা জমি কিনে কোনোরকমে মাথা গোঁজার মতো একতলা একটা বাড়ি বানিয়ে ন কাকা, মা, কাকিমা আর ভাই বোনেদের নিয়ে চলে আসি। সেই ঘটনার পর থেকে পরপর তিন বছর লাল বাবা নতুন বাড়িতে জোড়া কালীপূজা করেছিলেন জোড়া পাঁঠা দিয়ে। যদিও ঠাকমা সে বছর ডিসেম্বরে পুরোনো বাড়িতেই মারা গেছিলেন| লাল বাবা তন্ত্র উপায়ে আমাদের কাল অশৌচ কাটিয়ে দিয়েছিলেন। পরের বছর জ্যৈষ্ঠ মাসে প্রথম পুজো হয়, সেই পুজোকে ঘিরেও একটা ঘটনা আছে। পুজোর সংকল্প হয়েছিল নকাকার নামে।” এত অবধি বলে বাবা একটা ছোট দীর্গশ্বাস ফেললেন।
পৌঢ়ত্বে পা দেওয়া আমার বাবা শ্রী মানিক কুমার বসুর সারা মুখ জুড়ে তখন ফুটে উঠেছে এক অসীম বেদনাক্লিষ্ট হতাশা| বয়সজনিত বলিরেখার ভাঁজে ভাঁজে তীব্র বাঙময়তা এঁকে দিচ্ছে অপার জিজ্ঞাসার ল্যান্ডস্কেপ| জীর্ণ পুরাতন ঘরের ছাদে যেমন ফুটে ওঠে অজস্র কল্পনার মায়াজাল কতকটা সেরকম, কথক দুটি চোখের দৃষ্টিও তখন ঝাপসা|
“লোকে বলে মহা পুজো, আর দুর্গা পুজো আমাদের কাছে কালপুজো| দেবীপক্ষে একবছর পঞ্চমীতে বাবাকে হারিয়েছি তখন আমি ক্লাস সিক্সে পড়ি আর কিছু বছর পর ষ ষ্টিতে মাকে হারালাম তখন সদ্য স্কুল ফাইনাল দিয়েছি| পুজোর সময় সবাই আনন্দ করছে আর আমরা দুই ভাই গলায় কাছা দিয়ে বসে আছি|”
ছোট থেকেই শুনে আসছি দুর্গাপুজোর সাথে জড়িয়ে থাকা আমাদের পরিবারের এই বিয়োগ গ্লানি ও মলিনতার কথা| যত বড় হয়েছি বাবাকে দেখে বুঝেছি এক শিশুর সামাজিক আনন্দের দিনে পিতৃ-মাতৃ বিয়োগের তীব্র বেদনা ব্যাথা| তখন জানতাম না সেই অলিখিত অভিশাপ পরবর্তীতে সত্যি হয়ে যাবে যখন দেখব আমার বড় জ্যাঠামশাই শ্রী সূর্য্য কুমার বসুও চলে যাবেন এমনই কোন এক ভবিষ্যৎ মহালয়ার ভোরে, পিতৃপক্ষের অবসান ও দেবীপক্ষের সূচনার সঙ্গমকালে পুণ্যতিথির পুন্য তর্পন লগ্নে| আজ এই কাহিনী লিখতে বসে কেবলই মনে হচ্ছে এই বংশের উত্তরপুরুষ হিসেবে প্রতি পুরুষই কি বহন করে চলেছে সেই অমোঘ অদৃষ্টের পারম্পর্য্য? এ অভিশাপ কি শেষ হবার নয়?
“বিমান তো সেই কবেই চলে গেছে। ন কাকা গেলেন শেষ জ্যৈষ্ঠে| কিন্ত আশ্চর্যের কথা হল হিসাব করলে দেখা যাবে দুজনেরই আয়ু লাল বাবা মেপে ত্রিশ বছর বাড়িয়ে দিয়েছিলেন”| বাবার চোখে মুখে তখন এক অদ্ভুত শূন্যতা| চোখের দৃষ্টিতে একই সাথে পিতৃসম কাকা ও তুতো ভাইয়ের মৃত্যুর বেদনা বিধুরতা ও অবাক বিস্ময় মেশানো। ঠিক যে বিস্ময়ে ছোট্ট মানিক সেদিন লাল বাবাকে দেখেছিলো।
পিশাচসিদ্ধ গল্প- সমাপ্ত
আপনাদের লেখা আমাদের ওয়েব সাইটে জমা দিতে গেলে, অনুগ্রহ করে আমাদের লেখা-জমা-দিন মেনু-তে ক্লিক করুন ও নিজেকে Author হিসেবে Register করুন এবং আমাদের পরবর্তী আপডেট পেতে আমাদের ফেসবুক পেজ অনুসরণ করুন।
অন্যান্য
ভরুয়া
উদ্বর্তিনী
নীলবাস্প